#নিখোঁজ_প্রেমের_শহরে
# পর্বঃ ৮
#আতিয়া_আদিবা
লণ্ঠন হাতে নিয়াজ করিম দাঁড়িয়ে আছে। এই ফার্ম হাউজে কোনো ইলেক্ট্রিসিটির ব্যবস্থা নেই। ইচ্ছে করে রাখা হয়নি। সন্ধ্যে হলে চার পাঁচটে গাছ পর পর ঝুলে থাকা লণ্ঠন জ্বলে ওঠে। সেগুলোও রাত নয়টার পর নিভিয়ে রাখা হয়। কারণ, রাত নয়টা হলো জোনাকিদের আগমনের সময়। রাত নয়টা থেকে দশটা এই এক ঘণ্টা জোনাকিরা এদিক সেদিক উড়ে বেড়ায়। টিমটিম করে জ্বলে। কেমন রহস্যময় পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
ঠিক দশটার সময় জোনকিগুলো ছুটে যায় প্রস্থানের পথে। আশেপাশে কোনো জংলা নেই। তবুও জোনাকিগুলো কোথা থেকে আসে আবার কোথায় হারিয়ে যায় কেউ জানে না!
নিয়াজ করিম লণ্ঠন হাতে বাড়ির সামনে পায়চারি করছেন। আজ তার নাতনী বর্ষার আসার কথা। হিসেব মতো এতক্ষণে বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছে গেছে। গাড়ি পাঠানো হয়েছে। ড্রাইভার হাসিবের সাথে ফারুককেও পাঠানো হয়েছে। ফারুক বিশ্বস্ত লোক। দীর্ঘদিন ধরে নাজিমের সাথে আছে। এ যুগে বিশ্বস্ত লোক পাওয়া দুরূহ।
এই ফার্ম হাউজের বাড়িটি অতি সাধারণ। পাকা বাড়ি তবে বাড়ির ছাদ চালের। আকাশী রঙের চাল। বারান্দায় লাল রঙের গ্রীল। বাড়ির পেছোনে ছোট একটি পুকুর। এই পুকুরে মাছ চাষ করা হয়। বাড়ির সামনে সাড়ে আটশ ডেসিমলের মতো জায়গা। একপাশে সবজি চাষ করা হয়। আরেক পাশ খোলামেলা। ফুলগাছ আছে। বসার জায়গা আছে। তবে বেশ কয়েকমাস ধরে একটি সীম কোম্পানি জায়গাটায় টাওয়ার বসাতে চাচ্ছে। নিয়াজ সাহেব নিমরাজি। পুরোপুরি রাজি হতে পারছেন না। তবুও আগামীকাল কোম্পানি থেকে লোক পাঠানো হবে। এবিষয়ে আলাপ আলোচনা করা হবে। তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। দেখা যাক! কি হয়।
বারান্দায় রাখা ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে চুরুট ধরালেন নিয়াজ। রান্নাঘর থেকে শুটকি মাছের বিশ্রি গন্ধ আসছে। শুটকি মাছ বর্ষার পচ্ছন্দ। তার জন্যই এই আয়োজন করা হচ্ছে। ছোট আলু আর টমেটো দিয়ে শুটকির ঝোল। বেশ মাখা মাখা করে। রন্ধনশিল্পী মালা। মেয়েটা অল্পবয়স্ক কিন্তু নিদারুণ রান্নার হাত! যাই রাঁধে স্বাদে মনে হয় অমৃত। জানালার কাছে রেডিও রাখা। নিয়াজ সাহেব রেডিও ছাড়লেন। ফ্রিকোয়েন্সি ধরা কষ্টসাধ্য। অনেক চেষ্টার পর দু একটি চ্যানেল যাও ধরা যায়, তবে ঝিরঝির শব্দ সমেত।
রেডিওতে একটি মেয়ে খবর পড়ছে। সন্ধ্যে সাতটার খবর। খবর শুনতে শুনতে নিয়াজ সাহেবের ঝিমুনি চলে এলো।
ক্ষণিককাল বাদে তার ঝিমুনি কেটে গেলো গাড়ির হর্ণ শুনে। তিনি পুনরায় লন্ঠন হাতে বাড়ির বাইরে এলেন। আমগাছটার পাশে গাড়ি থেমেছে। ঘোলা চোখে নিয়াজ সাহেব দেখলেন, শাড়ি পরা কোনো রমণী গাড়ি থেকে নামলো। ফারুক তাকে এক হাতে ধরে রেখেছে।
মেয়েটা ঠিকমতো হাঁটতে পারছে না। দু কদম ফেলে নেতিয়ে যাচ্ছে।
নিয়াজ সাহেব দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলেন। অস্থির হয়ে বললেন,
কি হয়েছে? কি হয়েছে আমার নাতনির?
ফারুক ভয়ার্ত গলায় জবাব দিলো,
স্যার, বর্ষা আপার জ্বর। অনেক জ্বর।
নিয়াজ সাহেব বর্ষার গায়ে হাত দিয়ে চমকে উঠলেন,
একিরে! জ্বরে গা পুরে যাচ্ছে। সর্বনাশ করেছিস। মাথায় পানি ঢালতে হবে। জ্বর বাঁধালি কিভাবে?
বর্ষা স্বাভাবিক গলায় উত্তর দিলো,
ইচ্ছে করে বাধিয়েছি। অনেকদিন অসুস্থ হই না। আজকে হতে ইচ্ছে হলো।
নিয়াজ বললেন,
তোর পাগলাটে স্বভাব কি যাবে না?
বর্ষা ফ্যাকাসে হাসলো।
তাকে দ্রুত ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো। মাথায় পানি ঢালা হলো। নিয়াজ করিম ভেবেছিলেন নাতনি কে নিয়ে আজ জোনাকিদের মেলা দেখবেন। কিন্তু প্রচন্ড জ্বরে বর্ষা অচেতন প্রায়। চোখ মেলতে পারলো না। সেদিন রাতে ফার্ম হাউজের লণ্ঠনও নেভানো হলো না। জোনাকি পোকারাও আসলো না।
শিহাবের প্রতিটি কাজকর্ম বাচ্চাদের মতো হলেও সিগারেট খাওয়ার মাঝে ভিন্নতা আছে। অন্যমনস্ক হয়ে হালকা বাদামী ঠোঁটে সিগারেট ছুঁইয়ে ফরফর করে ধোঁয়া ছাড়ে।
এখনো ফিলিং স্টেশনের পাশে দাঁড়িয়ে ধোঁয়া ছাড়ছে সে।
গাড়িতে গ্যাস ভরা হচ্ছে। অফিসের গাড়ি। তাকে সখীপুর পাঠানো হচ্ছে। এক্টেল এর নেটওয়ার্ক খুব ঝামেলা করে এদিকটায়। টাওয়ার বসানো আবশ্যক। সে বিষয়েই কথা বলতে যাওয়া হচ্ছে। এক ভদ্রলোকের বিশাল বড় ফার্ম হাউজ আছে। সেখানেই টাওয়ার বসানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে। কিন্তু ভদ্রলোক রাজি হচ্ছে না। কিঞ্চিৎ জায়গার জন্যেও মাসে মাসে চল্লিশ হাজার টাকা দিতে চাইছে কোম্পানি। তবুও ভদ্রলোকের কোনো আগ্রহ নেই। আজ শিহাবকে পাঠানো হচ্ছে। ক্লাইন্টদের বশে আনার জাদুকরী ক্ষমতা এই ছেলেটার আছে। দেখা যাক, আলোচনাসূত্রে কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় কিনা!
গ্যাস নিয়ে গাড়ি পুনরায় ছুটতে শুরু করলো নির্ধারিত গন্তব্যে।
ড্রাইভারের নাম তুফান। তার নাম নিয়ে শিহাবের বিস্ময়ের সীমা নেই। কৌতুহল মেটাতে একদিন জিজ্ঞাসা করলো,
ভাই আপনার নাম তুফান কেনো?
ড্রাইভার তৃপ্তির হাসি হেসে উত্তর দিলো,
আমি জন্মানোর পর আম্মায় স্বপ্ন দেখছিলো তুফানের নাগালা প্লেন উড়াইতেছি। হের লেইগা নাম রাখছে তুফান। তয় প্লেন তো উড়াবার পারি না। তুফানের নাগাল গাড়ি ছোটাই। ছুটামু?
শিহাব বলল,
ছুটান দেখি।
ড্রাইভার গাড়ির দ্রুত গতিতে চালাতে লাগলো। এত দ্রুত যেনো পাখা লাগিয়ে দিলেই গাড়ি উড়তে শুরু করবে!
শিহাব ভড়কে গেলো। এর পর থেকে ড্রাইভার তুফান গাড়ি চালালেই শিহাব ভয়ে আঁটসাঁট হয়ে বসে থাকে।
এখনো শিহাব সীটের সাথে একেবারে সেঁটে বসে আছে। ড্রাইভার জিজ্ঞেস করলো,
গান শুনবেন ভাই?
না। এখন গান শুনতে ইচ্ছে করছে না। আমাদের পৌঁছাতে আর কতক্ষণ সময় লাগতে পারে?
আধা ঘণ্টার মতন।
খুব ভালো।
শিহাব পকেট থেকে মাউথ ফ্রেশনার বের করলো। দুটো পাফ নিলো।
তুফান লুকিং গ্লাসের দিকে তাঁকিয়ে অবাক চোখে বলল,
ও ভাই। গতরের জিনিস মুখে লন ক্যান?
শিহাব নাক কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
গতর! গতর কি জিনিস? হোয়াট ইজ দ্যাট!
গতর মানে অইলো শইল। শইলের জিনিস মুখে দ্যান ক্যান? ইস্প্রেরে মানুষ শইলে দেয় না। নইলে গন্ধ করে।
ও আচ্ছে! এটা মাউথ ফ্রেশনার। এটা মুখের স্প্রে।
এইডা দিয়ে কি হয়?
এই যে একটু আগে সিগারেট খেলাম, এটা দিলে মুখে সিগারেটের গন্ধটা থাকবে না।
ও! আইচ্ছা।
তুফান ক্ষণিককাল চুপ করে রইলো। তারপর ইতস্তত করে বলল,
ভাই একডা কতা কই?
জ্বি বলেন।
কথাডা অবশ্য লজ্জার। কিন্তু আপনি তো ভাই মানুষ কওয়াই যায় তাই না?
শিহাব বলল,
জ্বি।
ড্রাইভার হতাশ গলায় বলল,
আমার বউডা কাছে গেলেই কয় মুখ দিয়া বিড়ির গন্ধ করে। এইডা দিলে তো আর করবো না তাইনা?
শিহাব বলল,
না।
তাইলে আমি একডা কিনুম।
শিহাব হেসে ফেললো।
চলবে…