#বর্ষণের সেই রাতে পর্ব ১৮+১৯

0
471

#বর্ষণের সেই রাতে পর্ব ১৮+১৯
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

.
অনিমার কাশি থামার নামই নিচ্ছেনা সেটা দেখে আদ্রিয়ান হাসতে হাসতে বলল
— ” আরে আরে এবার থামো, নাহলে পাবলিক তোমাকে যক্ষা রোগী ভাববে।”
আদ্রিয়ানের কথা শুনে অনিমার কাশি আটোম্যাটিক্যালি থেমে গেলো। কাশি থামিয়ে একদম চুপ করে নিচের দিকে তাকিয়ে নখ দেখতে লাগল। সত্যিই জীবণে ও কারো কাছে এতোটা লজ্জা পায়নি যতটা এই ছেলেটার কাছে পেয়েছে, ছেলেটা সবসময় ওকে এতো লজ্জায় কেনো ফেলে? কী শান্তি পায় এরকম করে? সেটাই বুঝতে পারেনা ও। আদ্রিয়ান বুঝতে পারলো যে অনিমা লজ্জা পাচ্ছে তাই মুচকি হেসে বলল
— ” থাক আর লজ্জা পেতে হবেনা। আসছো তো?”
অনিমা নিজেকে সামলে নিয়ে বলল
— ” হ্যা আসবো তো।”
— “আমায় একটু আগে যেতে হবে তাই আমি তোমাকে পিক করতে আসতে পারবোনা। আমি তীব্রকে এড্রেস মেসেজ করে দিয়েছি ও তোমার ফ্লাটের সামনে থেকে তোমাকে পিক করে নেবে। এনি প্রবলেম?”
— ” না চলবে।”
— ” তো বিকেলে দেখা হচ্ছে।”
— ” হুম।”
— ” ওকে বাই ”
— ” বাই”
ফোনটা রাখতেই মুখে মুচকি হাসি ফুটে উঠলো অনিমার। তারপর মনে পরলো তীব্রর আর স্নেহার ব্যাপারটা। নাহ এই দুটোর কিছু করতে, এদের মান অভিমানের পালা এবার শেষ হওয়া উচিত। ফোনবুকে অনেকক্ষণ খুজে স্নেহার নাম্বারটা পেলো, অনেকদিন কথা হয়না মেয়েটার সাথে।
হঠাৎ ফোন বেজে উঠতেই স্ক্রিণে তাকিয়ে অনি নামটা দেখেই স্নেহা ফোনটা তুলে জিবে কামড় দিলো, তীব্র কথা না বলায় মনটা এতোটাই খারাপ ছিলো যে মেয়েটার কথা ভূলেই গেছিলো ও। তাড়াতাড়ি ফোনটা রিসিভ করে বলল
— “হ্যালো এতোক্ষণে ফোন করলি?”
— “তুই কোনসা এসেই দশবার ফোন করে ফেলেছিস?”
অনিমার এই কথার কোনো উত্তর পেলো স্নেহা, হঠাৎ যে অনিমা এভাবে বলে ফেলবে ও ভাবেই নি। স্নেহাকে চুপ থাকতে দেখে অনিমা বলল
— ” তো মিস লাইলি, মজনুর সাথে মান অভিমান এখোনো শেষ হয়নি তাইনা?”
স্নেহা মন খারাপ করে বলল
— “তোর বন্ধুতো কথাই বললোনা আমার সাথে।”
এটা শুনে অনিমা হেসে বললো আরে
— ” নো চাপ আমি আছিতো, কেস পুরো সালটে দেবো।”
স্নেহা তো বড়সর ঝটকা খেলো অনি এভাবে কথা বলছে? তবুও নিজেকে সামলে বলল
— ” কী করবি?”
— শোন তুই আমার ফ্লাটে চলে আয় বিকেলে একটা জায়গায় যাবো।”
— ” কোথায়?”
— ” আয় তারপর সব বলছি।”
_____________

বিকেলে অনিমা খাটে পা ঝুলিয়ে আর স্নেহা আসাম করে অনিমার ফ্লাটে বসে আছে। স্নেহা হা করে তাকিয়ে আছে অনিমার দিকে। অনিমা স্নেহাকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু নাচালো, স্নেহা তাড়তাড়ি নিজেকে সামলে বলল
— ” এডি তোর সাথে এসব করেছে? আর ও তোর এতো ভালো বন্ধু হয়ে গেছে?”
অনিমা চোখ ছোট ছোট করে কোমরে হাত দিয়ে বলল
— ” আমি কোথায় তোদের লাইলি মাজনুকে কীকরে মেলাবো সেই টেনশনে আছি আর তুই এসব ফাউল চিন্তা করছিস।”
স্নেহা মাথাটা একটু চুলকে বলল
— ” আসলে অনেক বড় ফ্যান তো তাই।”
— ” চুপ কর তো ভাবতে দে, তুই কিন্তু যাচ্ছিস আমাদের সাথে।”
স্নেহা চিন্তিত মুখ করে বলল
— ” তীব্র যদি আমাকে দেখে যেতে না চায়?”
অনিমা এস ইউসয়াল দাত দিয়ে নখ কাটছিলো। স্নেহার কথা শুনে বিরক্তির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
— ” ঐ তোর মুখ দিয়ে কী ভালো কথা বের হয়না? বি পসিটিভ ইয়ার এমন কিচ্ছু হবেনা।”
সেন্হা আরো একবার অবাক হলো অনিমার পসিটিভিটি দেখে। ও তো এমন ছিলোনা? এমন পসিটিভ ভাবনা ওর মধ্যে কীকরে এলো? একটু পরেই তীব্র মেসেজ করলো যে ও এসে গেছে। অনিমা স্নেহার দিকে তাকিয়ে বলল
— “তোমার মজনু এসে গেছে। চলো।”
স্নেহা অসহায়ভাবে তাকালো অনিমার দিকে। অনিমা বুঝতে পেরে ওর হাত ধরে বলল
— ” আরে টেনশন নট চল।”
এরপর দুজনেই নিচে নেমে গেলো, তীব্র গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে আছে আর ওদের দেখে অরুমিতা ফ্রন্ট সিট থেকে নেমে পেছনে চলে গেলো। অনিমার সাথে স্নেহাকে দেখেই তীব্রর ভ্রু কুচকে গেলো, বিরক্তিকর কন্ঠে বলল
— ” ও এখানে কী করছে?”
স্নেহা মাথা নিচু করে আছে, অনিমা তীব্রর দিকে তাকিয়ে মেকি হাসি দিয়ে বলল
— “ওও যাচ্ছে আমাদের সাথে।”
তীব্র কিছু বলবে তার আগেই অনিমা ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল
— ” দেখ তোরা যদি ভেবে থাকিস যে দুজন মুখ গোমড়া করে দুদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকবি, আর আমি ব্যাকগ্রাউন্ডে ‘জান নিসার’ গান বাজাবো দেন ইউ গাইস আর রং। এতো সময় নেই আমার হাতে চুপচাপ চল নইলে আমি একদম ভেতরে গিয়ে গিয়ে দরজা লক করে রাখব কিন্তু, সেটা ভালো হবে?”
তীব্র আর কিছু না বলে চুপচাপ বসে রইলো। অনিমা স্নেহাকে চোখ মেরে সামনের সিটে বসতে বলল, স্নেহা অবাক হয়ে এই অনিমার সাথে দেড় বছর আগের অনিমাকে মেলানোর চেষ্টায় আছে, মেয়েটা এতোটা বদলে গেলো? কোথায় সেই শান্ত নম্র মেয়েটা? অনিমা খোচা মারতেই স্নেহা সামনে গিয়ে বসল, তারপর অনিমা ব্যাক সিটে অরুমিতার পাশে বসে ওকে থামবস আপ দেখালো অরুমিতাও মুচকি হাসি দিলো। সারারাস্তা তীব্র স্নেহা দুজনেই চুপ করে ছিলো তবে আড়চোখে দেখেছে দুজন দজনকে।
গাড়িটা একটা রেস্টুরেন্টের সামনে থামতেই অনিমারা ভেতরে গিয়ে দেখে আদ্রিয়ান ওরা বসে আছে। ওদের দেখে রাইমা এগিয়ে এলো। অনিমা রাইমাকে টাইট একটা হাগ করে বলল
— ” কনগ্রাচুলেশনস আপু”
— ” থ্যাংক ইউ সোনা।”
এরপর সবাই একে একে আদিব আর রাইমাকে কনগ্রাচুলেট করলো। অনিমা স্নেহার সাথে আদ্রিয়ানের পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল
— ” ও স্নেহা আমার আরেক বুন্ধু।”
আদ্রিয়ান মুচকি হেসে বলল
— “হাই স্নেহা।”
স্নেহা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে, অনিমা স্নেহাকে খোচা মারতেই ওর হুস এলো ওর, হকচকিয়ে বলল
— ” হ্যালো স্যার আই এম ইউর বিগেস্ট ফ্যান। দেড় বছর বিদেশে বসেও আপনার গান শুনেছি। আপনাকে কখোনো সামনাসামনি দেখবো ভাবতেও পারিনি।”
আদ্রিয়ান হেসে দিয়ে বলল
—- ” আচ্ছা হয়েছে আগে একটু শ্বাস নিয়ে নাও।”
অনিমা চোখ গরম করে তাকালো স্নেহার দিকে স্নেহাও বুঝতে পারল যে এক্সাইটমেন্টে বেশিই বকে ফেলেছে। আদ্রিয়ান মুচকি হেসে বলল
— ” তুমি অনি, অরুমিতা আর তীব্রর ফ্রেন্ড, মানে আমাদেরও তাই স্যার না ডেকে আদ্রিয়ান বা আদ্রিয়ান ভাইয়া বলে ডেকো।”
স্নেহা হেসে মাথা নাড়লো। সবাই মিলে হৈচৈ করে খাওয়া দাওয়া করে, বাইরে যে যার মতো আলাদা আলদা কথা বলছে, এক জায়গাতেই তবে একটু দূরে দূরে। আদ্রিয়ান আর অনিমা একটা সিড়ির ওপর বসে কথা বলছে। কথার মাঝে অনিমা এক্সাইটেড হয়ে বলল
— ” আমিতো ভাবতেই পারছিনা রাইমা আপু মা হবে, একটা ছোট্ট বেবি আসবে, ছোট ছোট হাত পা নিয়ে খেলবে, খিলখিলিয়ে হাসবে। ওয়াও।”
অাদ্রিয়ান গালে হাত রেখে বলল
— ” এমনভাবে বলছো যেনো তোমার নিজেরই বেবি আসছে।”
অনিমা হেসে দিয়ে বলল
— ” আসলে তো খুব ভালো হতো কিন্তু বিয়েটাই তো হলোনা।”
আদ্রিয়ান এবার অনিমার দিকে তাকিয়ে হেসে দিয়ে বলল
— ” নিজেই বাচ্চা সে আবার বাচ্চার মা হবে।”
অনিমা মুখ ফুলিয়ে আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল
— “আমি বাচ্চা? আপনি জানেন ঠিক সময় বিয়ে হলে আমার এখন হাফ ডজন বাচ্চা থাকতো?”
আদ্রিয়ান অবাক হয়ে তাকালো অনিমার দিকে, এই মেয়ে নিজেই লাগাম ছাড়া কথা বলে পরে নিজেই পরে লজ্জায় কুকড়ে যায়, হলোও তাই একটু পরেই অনিমা ব্যাপরটা বুঝতে পেরে মাথা নিচু করে ফেলল। আদ্রিয়ান বিড়বিড় করে বলল
— “আগে বিয়েটা হোক তারপর দেখবো কয়বছরে হাফ ডজন দিতে পারো।”
অনিমা ভ্রু কুচকে বলল
— ” কিছু বললেন?”
আদ্রিয়ান একটা মেকি হাসি দিয়ে বলল
— ” নাহ। বাই দা ওয়ে এই তীব্র আর স্নেহা মধ্যে কী হয়েছে? দুজনেই মুখটা গোমড়া করে রেখেছে সেই এসে থেকে কেসটা কী?”
অনিমা তীব্র আর স্নেহার দিকে তাকিয়ে বলল
— ” কেস জন্ডিস।”
— ” মানে।”
— ” অনেক ঘটনা বলবো পরে একদিন।”
এদিকে স্নেহা অরু একসাথে বসে কথা বলছে। হঠাৎ স্নেহা অরুকে বলল
— ” এডি আর অনির মধ্যে কিছু চলছে?”
— ” চলছে তো অনেককিছুই কিন্তু ওদের দুজনে কেউ কাউকে সরাসরি কিছুই বলেনি।”
স্নেহা অনিমা আর আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল
— ” কিন্তু অনির এতো পরিবর্তন কীভাবে? মানে দেড় বছর আগেতো অনিমা ঠিকমতো হাসতোও না আর এখন?”
অরু হেসে বলল
— “এক ম্যাজিশিয়ান এসে ওর জীবণে ম্যাজিক করে দিয়েছে।”
স্নেহা বুঝতে না পেরে বলল
— ” মানে?”
— ” সবেতো এলি কদিন থাক বুঝতে পারবি।”
স্নেহা ভাবছে কে এই ম্যাজিশিয়ান? আর কী এমন ম্যাজিক করেছে? যে এতো ভীতু নরম মেয়েটা এতোটা চঞল আর দুষ্ট হয়ে গেলো?
____________

আজকে রাতেও অনিমা ল্যাপটপে রঞ্জিত চৌধুরীর এগেইনস্টে আরো সামন্য কিছু প্রুভ এড করে, যেই বিছানায় শুতে যাবে ঠিক তখনি টুং করে ওর ফোনে ম্যাসেজ টোন বেজে উঠল। হাতে নিয়ে দেখে আদ্রিয়ানের মেসেজ। মেসেজটা ওপেন করে দেখলো ওখানে লেখা আছে, “যেভাবে আছো ওভাবেই নিচে চলে এসো ফাস্ট। এন্ড ইয়েস কোনো প্রশ্ন করবে না।” অনিমা একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলল এই ছেলের আবার কী হলো? অনিমা একটা এস কালার হাফ হাতা টিশার্ট আর ব্লাক জিন্স পরে আছে আছে তাও টাকনুর অনেক ওপরে ফোল্ড করা। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো এগারোটা বিশ। এতোরাতে নিচে যাবে? কী আর করার কথা না শুনলে যে ঘরে এসে তুলে নিয়ে যাবে সেটাতো সিউর। তাই শুধু ফোনটা হাতে নিয়ে ফ্লাটে তালা দিয়ে নিচে গেলো। কিন্তু নিচে কাউকে দেখতে না পেয়ে বেশ ঘাবড়ে গেলো। এদিক ওদিক তাকিয়ে আদ্রিয়ান ফোন করবে তার আগেই কেউ ওর মুখ চেপে ধরল পেছন থেকে, ও কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওর চোখ বেধে দিলো। মুখ চেপে ধরে আছে তাই কিছু বলতেও পারছেনা। লোকটা অনিমা পেট জরিয়ে নিজের পিঠের সাথে ঠেকিয়ে বলল
— “হুসসস, ডোন্ট শাউট।”
অনিমা ওর ছটফটানি থামিয়ে দিলো, কারণ কন্ঠটা চিনতে ওর একটুও দেরী হয়নি, এটা আদ্রিয়ান। অনিমা বলল
— ” কী হচ্ছে চোখ বেধেছেন কেনো?”
আদ্রিয়ান অনিমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলল
— ” সারপ্রাইজ। আর একটা কথাও বলবেনা এখন আর বললেও এনসার দেবো না। সো কিপ কোয়াইট। ”
এটুকু বলেই অনিমার হাতও পেছনে নিয়ে বেধে অনিমাকে গাড়ির ফ্রন্ট সিটে বসিয়ে নিজে ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিলো। অনিমা কিছুই বুঝছেনা, এভাবে বেধে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? রাস্তায় অনেকবার অনি জিজ্ঞেস করেছে কী করছে? কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? কিন্তু কোনো জবাব দেয়নি আদ্রিয়ান। একটা অনাথ আশ্রমের সামনে গিয়ে গাড়ি থামলো। অাদ্রিয়ান ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তারপর কাউকে ফোন করে বলল
— “সব রেডি?”
ওপাশ থেকে কেউ কিছু বললো তার উত্তরে আদ্রিয়ান ওকে বলে অনিমাকে নিয়ে ভেতরে গেলো। তারপর ঐ আশ্রমের মাঠের মাঝখানে দাড় করিয়ে। কাউন্ড করা শুরু করলো আদ্রিয়ান আর ওর সাথে তাল মিলিয়ে আশপাশ থেকেও কাউন্টিং এর শব্দ শুনতে পাচ্ছে অনিমা।
— ” টেন, নাইন, এইট, সেভেন, সিক্স, ফাইভ, ফোর, থ্রি, টু, ওয়ান।”
কাউন্ট করতে করতে হাতের বাধন খুলছিলো, আর ওয়ান বলার সাথে সাথেই আদ্রিয়ান অনিমার চোখের বাধনও খুলে দিলো। আর চেচিয়ে সবাই বলে উঠল
— ” হ্যাপি বার্থ ডে।”
অনিমা হা করে সামনে তাকিয়ে আছে, অনেকগুলো বাচ্চা লাইন ধরে দাড়িয়ে আছে তাদের সবার হাতে একটা করে ওয়ার্ড, মানে ওরা একেকেটা ইংলিশ ওয়ার্ড হাতে নিয়ে দাড়িয়ে হ্যাপি বার্থে বানিয়েছে। সবাই স্মাইল ইমুজি মুখোশ পরে আছে। আর আশেপাশে অনেকগুলো বাচ্চা বেলুন নিয়ে দাড়িয়ে আছে, আশ্রমের সঞ্চালকরাও দাড়িয়ে হাততালি দিচ্ছে। সারা মাঠ বেলুন আর মোমবাতি দিয়ে সাজানো। ওর আজ বার্থডে সেটাতো ওর মনেই ছিলোনা। কীকরে থাকবে? ছয় বছর যাবত তো সেলিব্রেটই হয়না ওর বার্থডে, লাস্ট ওর আব্বুই সেলিব্রেট করেছে ওর বার্থ ডে এরপর কেউ না। যদিও তীব্র অরু অনেকবার জানতে চেয়েছে কিন্তু বলেনি ও।
কিন্তু অনিমার আব্বুই তো ওকে এই আশ্রমে নিয়ে এসে প্রতিবার বার্থডে সেলিব্রেট করতো। অনিমা অবাক হয়ে আদ্রিয়ানের দিকে ঘুরে তাকালো, আদ্রিয়ান মুচকি হেসে একটা ফুল অনিমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল
— ” হ্যাপি বার্থডে ম্যাডাম।”
ফুলটা নিয়ে অনিমা অবাক হয়েই তাকিয়ে আছে আদ্রিয়ানের দিকে, সব হুবহু একরকম করে সাজানো, ফুল,বেলুন,মাস্ক সব একরকম। আদ্রিয়ান এসব জানলো কীকরে? এমনিই মিলে গেলো? দুটো মানুষের এতো মিল কীকরে হয়? সবিই কী কাকতালীয় নাকি.. আর কিছু ভাবার আগেই অরু,তীব্র, স্নেহা, আদিব, রাইমা, আশিস সবাই বেড়িয়ে এলো সবাই ওকে উইস করলো। অরুমিতা বললো
— ” শয়তান মেয়ে এডিকে বলতে পারলি আমাদের বলতে পারলিনা তোর বার্থ ডে কবে?”
অনিমা অবাক হয়ে তাকালো আদ্রিয়ানের দিকে ও ভাবছে ও তো বলেনি আদ্রিয়ানকে ওর বার্থডে তাহলে? অনিমা আদ্রিয়ানের সামনে গিয়ে ওকে কিছু বলবে তার আগেই আদ্রিয়ান ওকে সামনের দিকে তাকাতে ইশারা করল, অনিমা সামনে তাকিয়ে একটা মহিলাকে দেখে অবাক হয়ে গেলো, মুখে হাসি আর চোখের কোণে পানি চলে এলো ওর, একমুহূর্ত না দাড়িয়ে ছুটে গিয়ে জরিয়ে ধরল ওনাকে। মহিলাটিও হেসে জরিয়ে ধরে বলল
— ” হ্যাপি বার্থডে মাই চাইল্ড।”
— ” কেমন আছো মাদার?”
— ” খুব ভালো তুমি কেমন আছো?”
অনিমা মাদারকে ছেড়ে দিয়ে বলল
— ” ভালো, খুব মিস করি তোমাকে।”
— ” হ্যা তাইতো দেড় বছরেও মনে পরলোনা এই বুড়িকে।”
— ” তুমিতো জানো মাদার আমি কেনো আসতাম না।”
— ” আই নো, নাউ ইনজয় ইউর ডে।”
এরপর আদ্রিয়ান বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে ইশারা করতে সব বাচ্চারা একে একে এসে অনিমাকে ফুল আর বেলুন দিয়ে উইস করল আর অনিমাও এক এক করে সব বাচ্চাদের চুমু দিয়ে ওদের থেকে ফুল আর বেলুনস নিলো। এর মধ্যেই সাংবাদিকরাও এসে গেছে কারণ তারা জানতে পেরেছে আদ্রিয়ান আবরার জুহায়ের কোনো মেয়ে জার্নালিস্টের বার্থডে সেলিব্রেট করছে। আদ্রিয়ান প্রথমে এদের দেখে অবাক হলেও পরে পাত্তা দেয়নি। জার্নালিস্টরা এসে আদ্রিয়ানকে আর অনিমাকে নানারকম প্রশ্ন করতে লাগল, আদ্রিয়ান কেনো অনিমার বার্থডে সেলিব্রেট করছে? ওদের মধ্যে কী সম্পর্ক? ব্লা ব্লা। আদ্রিয়ান অরুমিতাকে ইশারা করলো অনিমাকে নিয়ে যেতে, অরুমিতা নিয়ে গেলো ওকে। তারপর আদ্রিয়ান জার্নালিস্টদের বলল
— ” দেখুন এখন এখানে একজনের বার্থডে সেলিব্রেট হচ্ছে আগে সেটা করি তারপর আপনাদের সব প্রশ্নের উত্তর দেবো। এক্সকিউস মি।”
বলে আদ্রিয়ান ওখান থেকে সরে অনিমা নিয়ে কেকে এর কাছে গেলো। অনিমা কেক কাটলো, প্রথম বাইট মাদারকে দিতে গেলে মাদার আদ্রিয়ানকে বলল অনিমা তাই করল , চারপাশে একবার তাকিয়ে অনিমা নিঃশব্দে কেদে দিলো। ওর আব্বু চলে যাওয়ার পর কেউ এভাবে ওর জন্মদিন সেলিব্রেট করেনি, খুব মিস করছে ওর আব্বুকে ও। অনিমাকে কাদতে দেখে আদ্রইয়ান এসে ওকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে ওর চোখ মুছে দিলো আর অনিমা নিজেকে আটকাতে না পেরে জরিয়ে ধরল আদ্রিয়ানকে। জার্নালিস্ট রাও প্রতি মুহূর্তের ছবি তুলে নিউস বানিয়ে যাচ্ছে।
স্নেহা এবার বুঝতে পারছে অনিমার বদলে যাওয়ার রহস্য, ও হেসে অরুমিতাকে বলল
— ” তুই ঠিকি বলেছিলি অনিমার জীবণে সত্যিই একজন ম্যাজিশিয়ান এসছে। উনি সত্যিই ম্যাজিক জানে।”
অরুমিতা শুধু মুচকি হাসলো। তীব্র, স্নেহা, অরু, আশিস,আদিব,রাইমা সবাই খুব খুশি কারণ ওদের সবার প্রাণ অনিমা আজ খুব খুশি, আদ্রিয়ানের কথা বিশেষ করে আর বলার দরকার নেই।
অনিমা বাচ্চাদের সাথে দুষ্টুমি করে খেলছে, বেলুন মাস্ক নিয়ে মজা করছে আর আদ্রিয়ান হাত ভাজ করে সেই দৃশ্য দেখছে এক অদ্ভুত শান্তি পাচ্ছে ও অনিমাকে এতো খুশি দেখে। হঠাৎ মাদার এসে আদ্রিয়ানের কাধে হাত রাখল, আদ্রিয়ান ঘুরে তাকাতেই বলল
— “গড ব্লেস ইউ মাই চাইল্ড। তুমি জানোনা তুমি কী করেছো। একসময় ওকে দেখে আমিতো ভেবেছিলাম এই মেয়টার জীবণ থেকে সব হাসি হারিয়ে গেছে, সেই দুষ্টুমিষ্টি হাসিখুশি মেয়েটা হারিয়ে গেছে, হয়তো কোনোদিন সেই অনিমাকে ফিরে পাবোনা। বাট আই ওয়াস রং। তুমি পেরেছো ওকে আগের মতো করতে, ওর অন্ধকার জীবণের আলো হতে, ওর রংহীন জীবণের রং হতে, একটা কথাই বলবো, এভাবেই সবসময় আগলে রেখো ওকে, এই অল্প বয়সেই জীবণে চরম সত্যিগুলোর মুখোমুখি হয়েছে ও, অনেক কষ্ট পেয়েছে, অনেক কেদেছে। ওকে আর কষ্ট পেতে দিওনা, সব কষ্ট থেকে দূরে সরিয়ে রেখো, আই নো তুমি পারবে ।”
আদ্রিয়ান মুচকি হাসলো, তারপর অনিমার দিকে তাকিয়ে ভাবলো পারতেতো আমাকে হবেই মাদার, আই এম কমিটেড টু সামওয়ান, কীকরে ভূলবো সেই ওয়াদা? আর এখন তো আমি ওকে ভালোবাসি নিজের সবটা দিয়ে ভালোবাসি।
হঠাৎই জার্নালিস্টরা বলে উঠল
— “স্যার কোনো সেলিব্রেশন হচ্ছে আর আপনার একটা গান হবেনা সেটা হয়? আমরা সবাই আপনার গান শুনতে চাই আর সেটা বার্থডে গালকে ডেডিকেট করে।”
আদ্রিয়ান একটু অবাক হয়ে বলল
— ” বাট..”
— ” প্লিজ স্যার।”
আদিব,আশিস, অরু,তীব্র সবাই সায় দিলো। আদ্রিয়ান অনিমার দিকে তাকিয়ে দেখলো অনিমাও তাকিয়ে আছে ওর দিকে। সবার অনেক জোরাজুরিতে আদ্রিয়ান বলল
— ” ওকে ফাইন আশিস গিটারটা নিয়ে আয় তো গাড়ি থেকে।”
সবাই হাতেতালি দিলো ও রাজী হওয়ায়। আশিস গিটার এনে দিলো আদ্রিয়ানের হাতে। অনিমা এখোনো তাকিয়ে আছে আদ্রিয়ানের দিকে আর ভাবছে কী গান গাইবে আদ্রিয়ান? যেটা শুধুই ওর জন্যে? কিছুক্ষণ গিটারে টোন বাজিয়ে আদ্রিয়ান অনিমার দিকে তাকিয়ে গাইতে শুরু করল
.
তুমতো দারয়াসাল খাবোকী বাত হোওও
চালতি মেরে খেয়ালো মে তুম সাথ সাথ হোও
মিলতি হ্যা জো আচানাক ও সোয়াগাত হো
তুমতো দারয়াসাল মিঠি সি পিয়াস হোওও
লাগতা হ্যা ইয়ে হামেসা কী তুম আসপাস হোও
ঠ্যাহরা হ্যা যো লাবো পে ও এহসাস হো
তেরে আদা আদা সে মারতি ম্যা
ওয়াফা ওয়াফা সি কারতি কিউ
হাদোসে হু, গুজারতা ম্যা
জারা জারা জারা
তুমতো ডারয়াসাল সাসোকি সাজ হোওও
দিলমে মেরে ছুপা যো ওহি রায রায হোও
কাল ভি মেরা তুমহি হো মেরা আজ হো
কালভি মেরা তুমহি হো মেরা আজ হো
.
বারিশ কা পানি হো তুম, কাগজ কি কাসতি হু ম্যা
তুঝম্যা কাহি ম্যা বেহ যাতা হু
হোওওও মিলনে হু তুমসে আতা, ওয়াপাস নেহি যা পাতা
থোরা ওহি ম্যা রেহ যাতা হুউউ
তুমতো দারয়াসাল এক ন্যায়া নূর হোওও
মুঝমে ভি হো জারা সি জারা দূর দূর হোও
যেইসি ভি হো হামেশা হি মানজুর হো
যেইসি ভি হামেশা হি মানজুর হো
.
হোতা হ্যা এইসা আকসার, ডিল ইয়ে কিসিকো দে কার
লাগতা হাসি সারা শেহের।
হোওওও আব দেখ তেরা হো কার, কেয়া আসার হ্যা মুঝ পার
হাসতা রাহু আটো পেহের
হোওও তুম তো দারয়াসা ইস্ক হো পেয়ার হোওও
আতি মেরি ফাসানো মে তুম বার বার হোও
ইনকার মে যো ছুপি হ্যা ও ইকরার হো
ইনকার মে যো ছুপি হ্যা ও ইকরার হো
ইনকার মে যো ছুপি হ্যা ও ইকরার হো
.
সকলেই হাততালি দিয়ে উঠলো, পুরোটা গান আদ্রিয়ান অনিমার দিকে তাকিয়ে ওর আশপাশ দিয়ে হেটেই গেয়েছে, যেনো এই গানের প্রত্যেকটা ওয়ার্ড ওর জন্যে ছিলো। আর অনিমা মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আদ্রিয়ানের দিকে, সামনাসামনি এই প্রথম আদ্রিয়ানের গান শুনলো ও। আচ্ছা সত্যিই এই গানটা আদ্রিয়ান ওর জন্যে গেয়েছে? এই কথাগুলো অনিমার প্রতি সত্যিই ফিল করে আদ্রিয়ান? সেটা যদি না হয় তাহলে এই গানটাই কেনো গাইলো।

#পর্ব- ১৯
.
গান শেষ হওয়ার পর গিটারটা আশিসের হাতে দিয়ে অনিমার দিকে তাকিয়ে দেখলো অনিমা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। আদ্রিয়ান মুচকি হেসে শিশ বাজাতে বাজাতে অনিমার সামনে গিয়ে চুলগুলো নেড়ে ঠিক করে বলল
— “আজকে আমাকে একটু বেশিই হ্যান্ডসাম লাগছে বুঝি?”
অনিমার কয়েক সেকেন্ড লাগল অাদ্রিয়ানের কথাটা বুঝতে, যখন বুঝতে পারলো যে ওভাবে তাকিয়ে আছে বলে আদ্রিয়ান এ কথা বলেছে ও সাথেসাথেই মাথা নিচু করে ফেলল, সেটা দেখে আদ্রিয়ান হেসে বলল
— ” ইউ নো তুমি আমার সামনে লজ্জা পেয়ে যখন মাথা নিচু করে ফেলোনা তখন খুব কিউট লাগে তোমাকে, গালগুলোতে লালচে ভাব আসে, চোখের এই ঘন পাপড়ি গুলো আরো সুন্দর লাগে, আই জাস্ট লাভ ইট।”
অনিমা অবাক হয়ে একপলক আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে দেখলো আদ্রিয়ান ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে, সেটা দেখে ও হালকা লজ্জা পেয়ে চোখ সরিয়ে নিলো। আদ্রিয়ান হেসে আলতো করে অনিমার গালটা টিপে দিয়ে বলল
— “বাচ্চরা ডাকছে তোমাকে, গো এন্ড ইনজয়।”
অনিমা তাকাতেই আদ্রিয়ান চোখের ইশারায় ওকে যেতে বলল। অনিমা মাথা নেড়ে চলে গেলো বাচ্চাদের কাছে। অনিমা বাচ্চাদের কাছে যেতেই ওরা সবাই অনিমাকে একে একে গিফট দিলো। ওরা সবাই অনাথ আশ্রমের অনাথ বাচ্চা, টাকা দিয়ে গিফট কিনে দেবার মতো সামর্থ ওদের নেই, তাই ওরা কাগজ, কাঠ, বোর্ড, মাটি দিয়ে নিজেদের হাতে ছোট ছোট গিফট তৈরী করে দিয়েছে। কিন্তু এই ছোট ছোট উপহারগুলো পেয়ে অনিমার খুশি দেখে মনে হচ্ছে যেনো ওকে অনেক এক্সপেন্সিভ কিছু দেয়া হয়েছে। আদ্রিয়ান মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে অনিমার সেই হাসি দেখছে। সত্যিই মেয়েটা অদ্ভুত একটু বেশিই অদ্ভুত ছোট ছোট বিষয়ে কতো খুশি হয়ে যায়, কতো ছোট ছোট ওর চাওয়া, কতো সহজ ওকে খুশি করা। সেইজন্যেই তো ও কোনো দামী কমিউনিটি সেন্টার বা রেস্টুরেন্টে বুক না করে এই আশ্রমে এসছে। এতে দুটো লাভ হলো, অনিমাও খুশি হলো আর বাচ্চারাও।
কিছুক্ষণ পর অনিমা আদ্রিয়ানের দিকে তাকালো, এরপর বাচ্চাদের খেলতে বলে ও আদ্রিয়ানের কাছে এসে দাড়ালো, আদ্রিয়ান অনিমার দিকে তাকিয়ে বলল
— ” কিছু বলবে?”
অনিমা নিচের দিকে তাকিয়ে হাত কচলাতে কচলাতে ইতোস্তত করে বললো
— ” আসলে আমিতো জানতাম না এখানে আসার কথা, তাই বাচ্চাদের জন্যে কোনো কিছু আনতে পারিনি। কিন্তু..”
আদ্রিয়ান হেসে অনিমার দুই কাধে হাত রেখে বলল
— ” আমাকে তোমার এতোটাই ইরেস্পন্সিবল মনে হয়?”
অনিমা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই আদ্রিয়ান অনিমার মাথায় টোকা দিয়ে বলল
— “আমি সব বাচ্চাদের জন্যে, আশ্রমের সবার জন্যেই গিফট এনেছি। যাওয়ার আগে সবাইকে দিয়ে দিও।”
অনিমা একটু অবাক হলেও মুচকি হেসে বলল
— ” হুম। ওদের কী খাওয়ানো যায় বলুনতো?”
— ” সেই ব্যাবস্হাও করেছি, বাট তার জন্যে তোমাকে একটু কষ্ট করতে হবে।”
— ” সেটা কী?”
— ” রান্না করতে হবে সবার জন্যে বিরিয়ানী, পারবে?”
অনিমা হেসে দিয়ে বলল
— ” অবশ্যই পারবো। বাট দু একজনের হেল্প লাগবে এতো মানুষের রান্না তো।”
— “ডোন্ট ওয়ারি দুই একজন থাকবে তোমার সাথে।”
— ” ওকে।”
অনিমা বিরিয়ানী রান্না করতে চলে গেলো, আদ্রিয়ান বাচ্চাদের সাথে খেলছে। আশিস অরুমিতাকে পেছন পেছন ঘুরছে আর বিরক্ত করছে, অরুমিতা বিরক্ত হওয়ার ভান করলেও মোটেও বিরক্ত হচ্ছে না বরং আশিসে আড়ালে মুচকি মুচকি হেসে যাচ্ছে। তীব্র আর স্নেহা দুজন দুদিকে বসে আছে তবে একে ওপরের আড়ালে একে ওপরকে দেখে যাচ্ছে, ভালোবাসাগুলো হয়তো এমনি হয় শত অভিমান থাকলেও একে ওপরের থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখা যায় না। আদিব আর রাইমাও আশ্রম সঞ্চালকদের সাথে কথা বলছে। আর জার্নালিস্টরা ওদের কাজ করেই যাচ্ছে।
__________

কোলকাতার ফ্লাটে ফ্লোরে বসে মোবাইল স্ক্রিণে অনিমার ছবির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ড্রিংক করছে রিক। বোতলে একটা চুমুক দিয়ে বলল
— ” হ্যাপি বার্থ ডে সুইটহার্ট! আজ যদি এখানে আসতে না হতো তাহলে তোমাকে নিয়ে তোমার বার্থডে সেলিব্রেট করতে পারতাম। কিন্তু সব ভেস্তে গেলো এই ড্যাডের জন্যে।”
এটুকু বলে ছবিটা সরিয়ে আরেকটা ছবি বার করল, সেই ছবিটার দিকে তাকিয়ে হাত দিয়ে ছুয়ে বলল
— ” আমার কাছে থাকা অবস্হায় তোমার লাস্ট বার্থ ডে তে তোমায় মেরেছিলাম আমি, একটু বেশিই মেরেছিলাম। কী করতাম? তোমার কলেজের বন্ধুরা কেক নিয়ে বার্থডে সেলিব্রেট করতে চলে এসছিলো ঐ বাড়িতে, সব মেয়ে বন্ধু হলেও মানা যেতে কিন্তু দুজন ছেলেও ছিলো, ছেলে কেনো থাকবে? হোয়াই? তাইতো রাগের মাথায় তোমাকে মেরেছি। ভূলটা কী করেছি? একবার জাস্ট একবার তোমাকে নিজের কাছে নিয়ে আসি তারপর তোমাকে কোথাও বেড়োতেই দেবোনা, দরকারে শিকল পরিয়ে রুমে আটকে রাখব তোমাকে কিন্তু কোথাও যেতে দেবোনা, কোথাও না।”
এটুকু বলে বাকা হেসে বোতলে চুমুক দিতে দিতে একপর্যায়ে ফ্লোরেই বসেই খাটে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পরল ও।
__________

সব বাচ্চারা, আশ্রমের সঞ্চালকগন, আদিব, আশিস, তীব্র, রাইমা, অরুমিতা, স্নেহা সবাই দুই সারিতে লাইন ধরে কলাপাতা সামনে নিয়ে বসে আছে। জার্নালিস্টদের আগেই বিদায় দিয়ে দিয়েছে আদ্রিয়ান। অনিমা আর আদ্রিয়ান সবাইকে খাবার সার্ভ করে দিচ্ছে। অনিমা সবাইকে বিরিয়ানী দিচ্ছে আর আদ্রিয়ান সবাইকে শসা, টমেটো আর লেবু দিচ্ছে। সবাই বারণ করেছিলো ওদের এসব করতে কিন্তু ওদের জেদ ওরাই সার্ভ করবে, তাই সবাইকে মানতে হলো। খাবার সার্ভ করতে গিয়ে একে ওপরকে দেখছে বারবার আড়চোখে। সবাইকে খাবার সার্ভ করে আদ্রিয়ান আর অনিমাও খেতে বসল। খাওয়া দাওয়া শেষে এবার যাওয়ার পালা। আদ্রিয়ান অনিমার হাতে গিফ্টটের প্যাকেটগুলো দিলো, অনিমাও সবাইকে গিফটগুলো দিয়ে, সব বাচ্চাদের আদর করে বিদায় নিলো। আদিব, রাইমা আর আশিস একগাড়িতে চলে গেলো, তিব্র অরু আর স্নেহাকে ড্রপ করে দেবে। অনিমাকে এস ইউসিয়াল আদ্রিয়ানই ড্রপ করবে। গাড়ি আপন গতিতে চলছে অনিমা আর আদ্রিয়ান দুজনেই চুপচাপ বসে আছে। নিরবতা ভেঙ্গে আদ্রিয়ান বলল
— “অনিমা এবার বলোতো তীব্র আর স্নেহার ব্যাপারটা কী? যতটুকু দেখে বুঝলাম দে লাভ ইচ আদার, তাহলে এভাবে দুজন দুজনকে ইগনোর কেনো করে?”
অনিমা সামনের দিকে তাকিয়েই মুচকি হেসে বলল
— ” আসলে ওদের সেই কলেজ লাইফ থেকেই প্রেম চলছে। কিন্তু স্টাডি কম্প্লিট হবার পর স্নেহার বাবা চেয়েছিলো যে ও ফ্যাশন ডিজাইনিং নিয়ে একটা কোর্স করুক এবরোট থেকে, আর বাবার জোরাজোরিতে রাজি হয়ে ও চলে গেছিলো এবরোট তীব্রকে না জানিয়েই।”
— ” এইজন্যেই রাগ করেছে?”
— ” আরে না ফোনে পরে বলেছে তীব্রকে, তীব্র একটু আলগা রাগ দেখালেও অতোটাও রাগ করেনি দুদিনেই ঠিক হয়ে যেতো সব।”
আদ্রিয়ান ভ্রু কুচকে অনিমার দিকে একবার তাকিয়ে আবার সামনে তাকিয়ে বলল
— ” তাহলে সমস্যা কী ছিলো?”
— ” তার কয়েকদিন পরেই স্নেহা বাবা ওর এনগেইজমেন্ট করিয়ে দেয় অন্য একটা ছেলের সাথে, সেন্হাও ওর বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে না করতে পারেনি। আর এটা শোনার পরেই তীব্র রেগে যায়।”
— ” সো ও এনগেইজড?”
— ” ছিলো বাট কোনো এক কারণে ছেলেটা এনগেইজমেন্ট ভেঙ্গে দিয়েছে, বেচারি তীব্রকে অনেকবার সরিও বলেছে কিন্তু তীব্রর অভিমান কমেনি।”
— ” হুম বুঝলাম।”
এরপর দুজনেই বেশ অনেক্ষণ চুপ করে ছিলো, কিন্তু অনিমা মুচকি হেসে বলল
— ” থ্যাংকস ”
আদ্রিয়ান একটু অবাক হয়ে বলল
— ” কেনো?”
— ” এতো সুন্দর করে বার্থডে টা সেলিব্রেট করার জন্যে। আজ ছয় বছর পরে এভাবে নিজের বার্থডে সেলিব্রেট করলো। এরঅাগে আব্বু করতো।”
— ” আমি জানি।”
অনিমা অবাক হয়ে বলল
— ” কী?”
আদ্রিয়ান অনিমার প্রশ্নে একটু মুচকি হাসলো তারপর ড্রাইভ করতে করতে বলল
— ” এস পার আই নো, বন্ধুত্বে থাংক্স, সরি শব্দগুলো মানায় না। বাট তবুও থ্যাংক বলছো, নট ফেয়ার। ”
— ” সরি আর বলবোনা।”
আদ্রিয়ান ভ্রু কুচকে তাকাতেই অনিমা বুঝতে পারলো ব্যাপারটা তাই মাথা চুলকে বলল
— ” আই মিন ঠিকাছে আর বলবোনা।”
আদ্রিয়ান হেসে দিলো আদ্রিয়ানের হাসি দেখে অনিমাও হেসে দিলো।
____________

সকালে চা খেতে খেতে সবে পেপারটা খুলেছেন মিস্টির রঞ্জিত, আর পাশেই বসে আছেন কবির শেখ ও। ফ্রন্ট পেজে নিউসটা দেখে ওনার চোখ আটকে গেলো, বড়বড় করে লেখা, “আদ্রিয়ান আবরার জুহায়েরের ইনকারেই ইকরার,কে এই তুরুণী?” অনিমা আদ্রিয়ান একে ওপরকে জরিয়ে ধরে আছে সেই ছবিও বড় করে ছাপা, তাড়াতাড়ি বিনোদন পেজে গিয়ে বিস্তারিত পড়ে অবাক হয়ে গেলেন, সেটা দেখে কবির শেখ বললেন
— ” কী হয়েছে জিজু?”
মিস্টার রঞ্জিত কিছু না বলে পেপারটা এগিয়ে দিলেন কবির শেখ এর কাছে। পেপারটা দেখে কবির শেখ চমকে গেলেন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন
— ” মেয়েটার কী ভয় ডর সব উড়ে গেছে? একেই পালিয়েছে বলে বাবাই রেগে আছে তারওপর এখন এসব করে বেরাচ্ছে?”
— ” আরে আমি ভাবছি এই রকস্টারের কথা।”
কবির শেখ হেসে বললেন
— “সেই, এই ছেলের মরণ তো নিশ্চিত হয়ে গেলো, আর মেয়েটার কী হাল হবে রিক বাবাই ভালো জানে।”
মিস্টার রঞ্জিত রেগে বললেন
— ” তুমি এসব ভাবছো? আমি ভাবছি এতো বড় একজন রকস্টার খুন করলে সেটা ধামাচাপা দেবো কীকরে? ওর এতো ফ্যান, সবাই ক্ষেপে উঠবে।”
কবির শেখ হেসে বললেন
— ” টেনশন নিচ্ছেন কেনো জিজু? কিচ্ছু হবেনা। এমনিতেও একে তো অনেকেই মারতে চায়, কাউকে ফাসিয়ে দেবো। আর রিকের বিরুদ্ধে প্রমাণ তো তখন পাবে না যখন ঐ সিংগারের ডেড বডিটা কেউ খুজে পাবে।”
বলেই হেসে দিলো কবির শেখ, মিস্টার রঞ্জিত ও হাসলো। অন্তত ভয়ংকর সেই হাসি যেখানে না আছে দয়া আর না আছে কোনো সহানুভূতি আছে শুধু হিংস্রতা আর অমানবিকতা।
____________

একটা রেস্টুরেন্টে বসে আছে অনিমা, আদ্রিয়ান, আদিব, আশিস, রাইমা,তিব্র, অরুমিতা, স্নেহা। অনিমা বার্থডে উপলক্ষেই আদ্রিয়ান ওদের সবাইকে স্পেশাল ট্রিট দিচ্ছে। সবাই নানারকম কথা বলছে কিন্তু তীব্র আর স্নেহা মুখ গোমড়া করে বসে আছে। হঠাৎ আদ্রিয়ান
তীব্র স্নেহাকে উদ্দেশ্য করে বলল
— ” তীব্র, স্নেহা তোমাদের আমার কিছু বলার আছে।”
তীব্র আর স্নেহা তাকালো আদ্রিয়ানের দিকে, আদ্রিয়ান মুচকি হেসে বলল
— ” অনির কাছে তোমাদের সমস্যাটা অনেকটা শুনেছি, দেখো জীবণটা খেলা নয়, গোলাপের বিছানাও না যে সব আমাদের মন মতো ইচ্ছে মতো হবে। অনেক সময় অনেক কিছু হয় যেটা আমাদের হাতে থাকেনা, না চাইতেও অনেককিছু মেনে নিতে হয়। আর কাছের মানুষকে ইচ্ছে করে দূরে সরিয়ে রাখাটা বোকামী। আমি বলবোনা সব ভূলে এক হয়ে যাও, সেটা তোমাদের সিদ্ধান্ত, আমার কোনো উপদেশই কাজে লাগবেনা যদি তোমরা নিজে থেকে ব্যাপারটা না বোঝো। সো টেইক ইউর টাইম এন্ড থিংক। জীবণ একটাই সেটা নিজের মতো বাচো..”
হঠাৎই ওর ফোন এলোও রিসিভ করে কথা বলতে গেলো। এতোক্ষণ সবাই মুগ্ধ হয়ে আদ্রিয়ানের কথা শুনছিলো। তীব্র স্নেহা ও ভাবনায় পরে গেলো। অনিমা ভাবছে এই ছেলেটা সত্যিই অসাধারণ যার কোনো তুলনা হয়না। এরমধ্যেই আদ্রিয়ান এসে বলল
— ” গাইস আই হ্যাভ টু গো, কাজ পরে গেছে তোরা থাক। তীব্র অনিকে ড্রপ করে দিও।”
তীব্র মাথা নাড়লো, আদ্রিয়ান চলে গেলো। সবাই কথা বলছে তার কিছুক্ষণ পরেই অনিমার ওয়াসরুমে যাবার দরকার হলো তাই বলল
— ” তোরা বস আমি একটু আসছি।”
সবাই মাথা নাড়তেই অনিমা চলে গেলো ওয়াসরুমে চলে গেলো। বেশ অনেক্ষণ পর এলো অনিমা। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে চোখ লাল হয়ে আছে, ফুলেও আছে খানিকটা, সারা মুখে বিন্দু বিন্দু পানি বোঝাই যাচ্ছে অনেক কেদেছে তারপর মুখে পানি দিয়েছে, অরুমিতা এসে ওকে ধরে বলল
— ” কি হয়েছে তোর।”
অনিমা উত্তর না দিয়ে তীব্রর দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলল
— “আমাকে একটু বাড়িতে ড্রপ করে দে প্লিজ।”
সবাই বুঝতে পারলো অনিমা এখন কারো কথার উত্তর দেবেনা তাই এখন না জিজ্ঞেস করাই ভালো পরে জেনে নেবে এখন আপাদত ওকে বাড়ি পৌছে দিক।
____________

কাজ করে এসে ল্যাপটপে ইন্টারনেটে নিউস পেপার পড়ছে রিক। সবে গ্লাসে পানি খেতে নিয়েছিলো কিন্তু একটা নিউস দেখে ওর মাথা হ্যাং হয়ে গেলো, হেডলাইনটা যতোটা না পোড়াচ্ছে, তার চেয়ে বেশি পোড়াচ্ছে ছবিটা। রাগে চোখ লাল হয়ে উঠেছে ওর, শরীর থরথর করে কাপছে। হাতের চাপে গ্লাসটাও ভেঙ্গে গেলো, মুহুর্তেই ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেলো ওর হাত, টপটপ করে রক্ত পরতে লাগল। রাগে গজগজ করতে করতে দাঁতে দাঁত চেপে বলল
— “কাজটা তুমি ঠিক করোনি সুইটহার্ট। খুব বড় ভূল করে ফেলেছো। খুব সাহস হয়ে গেছে তোমার তাইনা? ডানা গজিয়ে গেছে, আমাকে আর ভয় পাওনা? সাজতে শিখেছো, অন্য ছেলেটা জরিয়ে ধরেছো? বুক কাপলোনা তোমার? কোনো ব্যাপারনা এবার কাপবে। তোমার ঐ আশিক কে তো তোমার চোখের সামনে ওপরে পাঠাবো, তোমাকে তো তারপর পরে দেখবো। এই কাজের অনেক বড় দাম দিতে হবে তোমায় বেইবি এমন দাম যে তুমি সারাজীবণ কেদেও কূল পাবেনা। জাস্ট ওয়েট।”
বলেই পাগলের মতো হাসতে শুরু ওও হাসতে হাসতেই একপর্যায়ে রাগে রুম কাঁপিয়ে গর্জন করে উঠল। রাগে ল্যাপটপটা ফ্লোরে আছাড় মেরে ভেঙ্গে ফেললো। বদ্ধ এক উন্মাদ লাগছে ওকে।
_____________

গরম লোহার রড কেউ ওর জামার ওপর দিয়েই পিঠে চেপে ধরেছে এমন সপ্ন দেখেই চিৎকার করে উঠে বসল অনিমা, সারা শরীর ঘেমে একাকার হয়ে গেছে। অনেকদিন এই দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্ত ছিলো ও কিন্তু আজ আবার দেখলো। থরথর করে কাপছে ওর শরীর বাইরে বৃষ্টিও হচ্ছে। মাথা এতোটাই ব্যাথা করছে যে সহ্য করতে না পেরে ওয়াসরুমে শাওয়ার ছেড়ে নিচে বসে পরল অনিমা, চিৎকার করে কাদতে ইচ্ছে করছে কিন্তু কান্না জেনো সব গলায় আটকে আছে। একটা বাথরোব পরে ওয়াসরুম থেকে বেড়িয়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাড়ালো ও তারপর উল্টো ঘুরে বাথরোবটা সরিয়ে নিজের পিঠের দিকে তাকালো দাগগুলো এখোনো পুরোপুরি যায়নি আবছা রয়ে গেছে। কিছু ওর মামীর দেয়া কিছু রিকের। এই দাগগুলোই ওর ওপর হওয়া প্রতিটা অন্যায়ের সাক্ষি। আস্তে করে ড্রেসিং টেবিলের সাথে হেলান দিয়ে ফুপিয়ে কেদে উঠল ওও। কেনো এমন হয় ওর সাথে, ও তো ভূলতে চায় সব কেনো পারছেনা? কেনো ওর অতীত ওর পিছু ছাড়েনা? কেনো? আচ্ছা দুপুরে ওয়াসরুমে ও যা বলে গেলো সেটাই হবে না তো? নাহ ও পারবেনা সহ্য করতে এসব আর পারবেনা, ও চায়না ওই নরকে আবার ফিরে যেতে। ও বাঁচতে চায় জীবন্ত লাশ হয়ে বাচতে পারবেনা ওও। এসব ভাবতে ভাবতে ওর কান্নার বেগ বেড়ে গেলো।
____________
আসলে তখন ও ওয়াসরুম থেকে বেড়িয়ে বেসিনে মুখ ধুতে যাবে, হঠাৎ ওর কোমরে কেউ খুব বাজে ভাবে টাচ করলো। অনিমা রেগে পেছন ঘুরে থাপ্পড় মারতে গেলেই লোকটা ওর হাত ধরে ফেলল। লোকটাকে দেখে চরম অবাক হলো অনিমা, রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো অনিমার, এই লোকটাকে ও পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করে। রিক কেও এতোটা ঘৃণা করেনা ও যতটা এই লোকটাকে করে। এখনও সেই একি বাজে দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে যেভাবে আগে দেখতো, কিন্তু ও এখানে কীকরে এলো? এসব ভেবে অনিমা অবাক হয়ে বলল
— “ভাইয়া?”
.
#চলবে…
.
( শেষের এই ক্যারেক্টার না নতুন কোনো ক্যারেক্টার না। এই ক্যারেক্টার সম্পর্কে পর্ব-৪ থেকেই বলা হয়েছে। আজকে এন্ট্রি দিলাম আরকি। যাই হোক
হ্যাপি রিডিং😊)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here