#বর্ষণের সেই রাতে পর্ব ২৭+২৮
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
.
হাসান কোতয়াল ওনার কেবিনে গম্ভীর মুখ করে বসে আছে। আর তার সামনে তার টিমের চারজন বসে আছেন। হ্যাঁ চারজন, কারণ গতকাল সকালেই মিতার লাশ পাওয়া গেছে। গতপরশু ও রঞ্জিত চৌধুরীর এক গোডাউনে স্মাগলিং এর কিছু ছবি তুলতে গেছিলো কিন্তু আর ফিরে আসেনি। ফিরে এসছে কাল সকালে তাও লাশ হয়ে। প্রাথমিক পোস্টমডের্ন রিপোর্ট অনুযায়ী গ্যাং রেপ করে তারপর গলা কেটে মার্ডার করা হয়েছে। হাসান কোতায়াল চারজনের দিকে তাকিয়ে বলল,
— ” মিতার মৃত্যুটা সত্যিই মর্মান্তিক আর দুঃখজনক ছিলো। মিতা ওখানে সিকরেটলি ছবি তুলতে যাচ্ছে সেটা শুধুমাত্র আমরা ছয়জন জানতাম। এটা ওদের জানার কথা ছিলোনা যদিনা ভেতরের কেউ ইনফরমেশন টা লিক করে থাকে।”
ইলিয়াস অবাক হয়ে বলল,
— ” কিন্তু স্যার আমাদের মধ্যেকেউ এরকমটা কেনো করবে?”
মুসফিক ও সায় দিয়ে বলল,
— ” হ্যাঁ স্যার আমরা কেনো নিউসটা লিক করবো?”
হাসান কোতয়াল একটা নিশ্বাস ফেলে বলল,
— ” করার অনেক কারণ থাকতে পারে। তবে একটা কথা মনে রেখো অর্থ আর ক্ষমতার লোভে মীরজাফর সিরাজউদ্দৌল্লাহর সাথে প্রতারণা করেছিলো। এতে সিরাজউদ্দৌল্লাহ মারা গেলেও মীরজাফরের অন্তিম পরিণামটাও জানো নিশ্চয়ই?”
সবাই চুপ করে আছে। হাসান কোতয়াল একটা শ্বাস ফেলে বললেন
— ” তবে যাই হোক। দেশের জন্যে সমাজের ভালোর জন্যে ও ওর প্রাণ দিয়েছে। আর তাই এবার আমরা আমাদের মিশন যেকোনো মূল্যেই কম্প্লিট করবো, মিতার ত্যাগ কে আমারা ছোট করে দেখতে পারিনা। রাইট গাইস?”
সম্পা চিন্তিত গলায় বলল,
— ” কিন্তু স্যার মিতা যেই ছবিগুলো তুলতে গিয়েছিলো ওগুলো ছাড়াতো আমাদের আর্টিকেলটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।”
হাসান কোতয়াল গম্ভীরমুখে বললেন,
— ” সেটা আমি বুঝে নেবো বাট যাকে যা কাজ দিয়েছি কম্প্লিট করো। পরশু সকালে নিউসপেপারের ফ্রন্ট পেইজে রঞ্জিত চৌধুরীর আসল চেহারা সবাই দেখবে। ”
আতাউর অবাক হয়ে বলল,
— ” স্যার পরশুই?”
হাসান কোতয়াল সবার দিকে তাকিয়ে বলল,
— ” যদি কারো ভয় থাকে তাহলে সে পিছিয়ে যেতেই পারো। মিতার মৃত্যুর পর আমি আর কাউকে জোর করে রাখবোনা। ”
সবাই একসাথে বলল,
— ” নো স্যার উই ওল আর রেডি?”
হাসান কোতয়াল হালকা হেসে বললেন,
— ” ভেরি গুড। গো টু ইউর ওয়ার্ক ওকে।”
— ” ইয়েস স্যার।”
বলেই সবাই চলে গেলো। হাসান কোতয়াল একটা শ্বাস নিলেন। মিতা মারা যাওয়ার আগেই ওনার ফোনে ছবিগুলো পাঠিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এই চারজনের সামনে কিছু বলেন নি কারণ উনি বুঝতে পারছেন এই চারজনের মধ্যেই কেউ নিউস লিক করছে। মানুষ কতোটা স্বার্থপর। কিন্তু এই স্বার্থপর পৃথিবীতে ওনার মেয়েটাকে কীকরে একা ফেলে যাবেন সেটাই ভাবছেন উনি।
___________________
ক্লাবে লাউড মিউসিক চলছে সেই মিউসিকের তালে তালে একটা মেয়ের সাথে ডান্স করছে রিক চৌধুরীর। এটা ওর নিত্যদিনের কাজ। ডান্স করতে করতে একপর্যায়ে রিক মেয়েটার কোমর জরানো অবস্থায় বলল,
— ” ওয়েট সুইটহার্ট আমি আসছি একটু।”
মেয়েটা রিকের গলা জরিয়ে ধরে নেকা কন্ঠে বলল,
— ” সিউর বেইবি।”
রিক মেয়েটার গালে একটা কিস করে বাই বলে ছাড়িয়ে চলে গেলো ওর বন্ধুদের কাছে। বন্ধুদের কাছে গিয়ে একটা হাসি দিয়ে হাইফাইভ করলো একজনের সাথে। ওদের মধ্যে একজন বলল,
— “তোরই লাক ভাই। আমারা নিজে থেকে মেয়েদের কাছে গিয়েও লাইন পাইনা আর তুই ক্লাবে এসে দাঁড়ালে মেয়েরা লাইন দাঁড়ানোর জায়গাও পায়না।”
রিক বাঁকা হেসে ড্রিংকের গ্লাসে ওয়াইন ঢালতে ঢালতে বলল,
— ” সবাই রিক চৌধুরী হয়না।”
বা পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একজন বলল,
— ” তবে একদিন একটা মেয়ের কাছে গেলে দ্বিতীয়বার সেই মেয়ের ধারেপারেও যাসনা, এটা কোন থিউরি?”
রিক গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল
—” এসব সস্তা জিনিস একদিনের ব্যাবহারেরই যোগ্য। দেখছিস না স্কিনে ঘসা মারলে এক সেন্টিমিটার পর্যন্ত মেকাপই পাবি, আর হাত বাড়ানোর আগেই চলে আসে ধরা দিতে, এরা সস্তা ছাড়া আর কী? সাচ আ চিপ গার্ল। এদের নিয়ে আমি জাস্ট টাইমপাস করি নাথিং ইলস।”
ওর বন্ধু এবার হেসে দিয়ে বলল,
— ” আচ্ছা তাহলে বিয়ের পর কী করবি? বিয়ের পর তো একটা মেয়েকে নিয়েই সারাজীবন থাকতে হবে।”
রিক গ্লাসটা টেবলে রেখে বলল,
—” বিয়ে টিয়ে নিয়ে ভাবিনি বাট যদি কখনো করি এসব সস্তা জিনিসকে করবোনা।”
ওদের মধ্যে একজন অবাক হয়ে বলল,
— ” এতো হট হট দামী ড্রেসাপের মেয়েদের তোর সস্তা মনে হয়? তো মামু এক্সপেনসিভ মেয়ের ডেফিনেশনটা বলবে একটু?”
রিক টেবিলে উঠে বসে আলসেমি ঝেড়ে বলল,
— “যাকে দেখেই আমার চোখ আটকে যাবে। এসব মেকাপ সুন্দরী হবেনা। নেচরাল বিউটি থাকবে। নট অনলি দ্যাট সে এইসব মেয়েদের মতো এতো সহজেই আমার হাতে ধরা দিতে চাইবেনা। সি হ্যাস টু হ্যাস হার ওউন পালসোনালিটি। সবার থেকে আলাদা হবে।”
ওরা সবাই অবাক। কোনো মেয়েকে দেখে রিক চৌধুরীর চোখ আটকে যাবে? আবার রিক চৌধুরীকে ধরা দিতেও চাইবেনা? এও সম্ভব? সবাই একসাথে বলল,
— ” এমন জিনিস কোথায় পাবি ভাই?”
রিক হালকা হেসে গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল,
— ” কোথাও তো থাকা উচিত। কিন্তু হ্যা এট লাস্ট তাকে আমার হাতের পুতুল হয়েই থাকতে হবে। নাহলে রিক চৌধুরীর হিংস্রতার পরিচয় ও প্রতি মিনিটে মিনিটে পাবে।”
সবাই একে ওপরের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল অর্থাৎ এ বড় আজব বস্তু। আর ওর নজরে যদি সত্যিই ওরকম কোনো মেয়ে পরে যায় তাহলে সেই মেয়ের কপালে দুঃখ আছে কিন্তু আদোও কী এমন মেয়ে আছে কোথাও?
____________________
অনিমা অনাথ আশ্রমে বাচ্চাদের সাথে মজা করে খেলে যাচ্ছে। কোচিং ক্লাস শেষ করেই এখানে বাচ্চাদের সাথে সময় কাটাতে এসছে। খেলতে থাকা অবস্হায় ওকেও একটা বাচ্চা লাগছে।খেলার মাঝখানে হঠাৎ ওর কাধে কেউ হাত রাখল। অনিমা পেছনে তাকিয়ে দেখলো মাদার দাড়িয়ে আছে। মাদারকে দেখেই হেসে জরিয়ে ধরলো, মাদারও ওকে জরিয়ে ধরল, অনিমা মাদারকে ছেড়ে দিয়ে ওনার গাল টেনে বলল
— ” কেমন আছো আমার সুইট, কিউট, এভার গ্রিন বারবি ডল?”
মাদার অনিমার কান টেনে ধরল, অনিমা এক চোখে বুজে বলল,
— ” আহ মাদার, লাগছে তো আমার।”
মাদার অনিমার কান ছাড়তেই ও মুখ ফুলিয়ে কান ডলতে লাগল। মাদার ওর পিঠে একটা চাপড় মেরে বলল,
— ” ফাজিল মেয়ে, বেশি দুষ্টু হয়ে গেছো আজকাল।”
অনিমা হেসে ওর শার্টের কলার সেট করে বলল,
— ” হামতো এসাই হ্যা ভাইয়া… ও সরি সরি মাইয়া।”
মাদার হেসে দিলো অনিমার কথায় আর অনিমাও হেসে দিলো। এরপর আরো কিছুক্ষণ বাচ্চাদের সাথে খেলে আর মাদারের সাথে গল্প করে সন্ধ্যার দিকে ফিরে এলো ও। বাড়ি দেখলো হাসান কোতয়াল একমনে ল্যাপটপে কাজ করে চলেছে। অনিমা মুচকি হেসে পা টিপে টিপে হাসান কোতয়ালকে পেছনে গিয়ে ‘ভাউ’ বলল। হাসান কোতয়াল আগেই দেখে নিয়েছেন অনিমাকে তবুও মেয়েকে আনন্দ দিতে ভয় পাওয়ার ভান করে বললেন,
— ” বাপরে। মামনী তুমিতো ভয় পাইয়ে দিয়েছো আমাকে।”
অনিমা হেসে দিয়ে সোফায় বসে বলল,
— ” আমি জানি তুমি একটুও ভয় পাওনি। সাচ এ পোর এক্টর।”
হাসান কোতয়াল ল্যাপটপটা রেখে বলল,
— ” সেই। এক্টিং এ যদি ভালো হতাম তো এতোদিনে শাহ রুক খান হয়ে যেতাম। ”
অনিমা একটু এক্সাইটেড হয়ে বলল,
— ” এক্সাক্টলি। ইউ নো হোয়াট আব্বু তুমি না সেই হ্যান্ডসাম আছো। ক্লিন সেভে কী কিউট লাগে তোমাকে। এই বয়সে অনেকেই পেট মোটা হয়ে যায় কিন্তু তোমার হয়নি, নো রিংকেলস, যদিও দুই একটা চুল পেকে গেছে, ও ব্যপারনা। তুমি চাইলে তোমাকে আনমেরিড মেয়েরাও রাজি হয়ে যাবে।”
হাসান কোতয়াল হেসে দিয়ে বলল,
— ” তো কী বলো বিয়ে করে ফেলি?”
অনিমা সোজা হয়ে বসে বলল,
— ” নাহ বাবা থাক নইলে আমার আম্মুর ভূত এসে তোমার ঘাড় মটকে দেবে।”
হাসান কোতয়াল এবার শব্দ করে হেসে দিয়ে বললেন,
— ” যাও ফ্রেশ হয়ে এসো আমি স্নাকস আর চা করছি।”
— ” আমি করছি তুমি বসো।”
— ” নাহ মা তুমি ক্লান্ত হয়ে এসছো রেস্ট করো।”
অনিমা মুখ ফুলিয়ে বলল
— ” সে তো তুমিও এসছো।”
হাসান কোতয়াল হেসে মেয়েকে এক হাতে ঝ
জরিয়ে ধরে বললেন,
— ” আমি থাকতে আমার মেয়ে কেনো কষ্ট করবে?”
অনিমা মুখ তুলে হাসান কোতয়ালের দিকে তাকিয়ে বলল,
— ” একি কথা তো আমিও বলতে পারি।”
হাসান কোতয়াল অনিমার নাক টেনে বলল,
— ” আমি বড় তাই।”
অনিমা উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
— ” তোমার সাথে কথায় পারবোনা।”
বলে রুমে চলে গেলো ফ্রেশ হতে হাসান কোতয়াল ও চলে গেলেন কিচেনে।
রাতের বেলা হাসান কোতয়ালে সোফায় বসে কাজ করছেন হঠাৎ ফোন বেজে উঠল, কলটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে রঞ্জিত চৌধুরী বললেন,
— ” মিস্টার কোতয়াল। আমি শেষ বারের মতো আপনাকে বলছি থেমে যান।”
হাসান কোতয়াল বুঝতে পারলেন এটা রঞ্জিত চৌধুরী তাই একটা শ্বাস ফেলে বললেন,
— ” আমি থেমে যাওয়ার মানুষ নই, যেটা একবার করবো বলে ঠিক করি সেটা করেই ছাড়ি। মৃত্যু ছাড়া কোনোকিছুই আমাকে থামাতে পারবেনা।”
মিস্টার রঞ্জিত রাগে গজগজ করে বললেন,
— ” ঠিকাছে তাহলে মৃত্যুর জন্যে তৈরী হয়ে যান। একটা কথা মনে রাখবেন ঐ আর্টিকেল আমি পাবলিসড হতে দেবোনা।”
হাসান কোতয়াল শক্ত গলায় বললেন,
— ” আমি তৈরী আছি। প্রত্যেক মূহুর্ত, প্রত্যেক সেকেন্ড মৃত্যুর জন্যে তৈরী আছি আমি। আপনি যা পারেন করুন।”
মিস্টার রঞ্জিত টেবিলে বাড়ি মেরে বলল,
— ” ভূল করছো হাসান। নিজেতো মরবেই নিজের মেয়ের জীবণটাও শেষ করে দেবে তুমি। আমার রোষের স্বীকার কিন্তু তোমার মেয়েও হবে।”
হাসান কোতয়াল এর মনের ভেতর আশঙ্কা বাসা বাধলেও উনি নিজেকে শক্ত করে বলল,
— ” আমার মেয়ের সুরক্ষার ব্যবস্হা আমি করেই গেছি।”
— ” দেখো হাসান আমি চাইনা তোমার কোনো ক্ষতি করতে বাধ্য করোনা আমায়। মরবে কিন্তু।”
হাসান কোতয়াল মলিন হেসে বললেন,
— ” মরার জন্যে তৈরী আছি আমি, কিন্তু পিছিয়ে যাবোনা। ওল দা বেস্ট।”
এটুকু বলেই ফোন কেটে দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো হাসান কোতয়াল। পেছনে তাকিয়েই চমকে গেলেন উনি কারণ অনিমা ছলছলে চোখে তাকিয়ে আছে। উনি কিছু বলবেন তার আগেই অনিমা দৌড়ে গিয়ে জরিয়ে ধরলো ওনাকে। ফুপিয়ে কাঁদতে লাগল। হাসান কোতয়াল অনিমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
— ” কাঁদছো কেনো মামনী? কী হয়েছে?”
অনিমা নাক টেনে টেনে বলল
— ” আব্বু তুমি প্লিজ কোনো আর্টিকেল করোনা প্লিজ, এসবের কোনো দরকার নেই, ওরা মেরে ফেলবে তোমাকে, প্লিজ আব্বু।”
হাসান কোতয়াল অনিমাকে সোফায় বসিয়ে ওর পাশে বসে বললেন,
— ” মামনী তুমি আমার মেয়ে হয়ে এই ধরণের কথা বলছো?”
অনিমা আবারও হাসান কোতয়ালকে জরিয়ে ধরে বলল,
— ” না আব্বু প্লিজ, ওরা খুব খারাপ। তোমার কিছু হয়ে গেলে আমি মরে যাবো।”
হাসান কোতয়াল ওনার মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
— ” আমি যদি কাজটা না করি তাহলে সবাইতো তোমার বাবাকে কাওয়ার্ড বলবে সেটা ভালো লাগবে?”
অনিমা কাদোকাদো গলায় বলল
— ” কিন্তু…”
অনিমাকে থামিয়ে দিয়ে হাসান কোতয়াল বললেন,
— ” চুপ আর কোনো কথা না অনেক রাত হয়েছে। আজ রুমে যেতে হবেনা আজ তুমি আমার সাথে ঘুমোবে। আজ আমি গল্প বলে ঘুম পারাবো তোমাকে।”
অনিমা হেসে বলল,
— ” আমিকি বাচ্চা নাকি?”
হাসান কোতয়াল অনিমার মাথায় টোকা মেরে বলল,
— ” আমার কাছেতো তুই বাচ্চাই তোর মনে আছে ছোটবেলায় রাজকুমারের গল্প বলে ঘুম পাড়াতাম?”
— “মনে আছে তো। এক রাক্ষস রাজা আর রাণীকে মেরে রাজকুমারীকে বন্দী করে রেখেছিলো। ওই রাক্ষসটা রাজকুমারীকে প্রচুর অত্যাচার করতো। একদিন এক শক্তিশালী রাজকুমার এসে সব দুষ্টু রাক্ষসগুলোকে মেরে রাজকুমারীকে বাঁচিয়ে নিয়েছিলো।”
— “তাহলে চলো আজকেও শোনাবো।”
বলে অনিমাকে নিয়ে গিয়ে একদম ছোটবেলার মতো করে গল্প বলে ঘুম পাড়িয়ে দিলো। আজ অনিমাও যেনো ফিরে গেছিলো ওর ছোটবেলাতে। অনিমা পুরো ছোটবেলার মতোই নানারকম প্রশ্ন করছে আর হাসান কোতয়াল ধৈর্যধরে উত্তর দিচ্ছেন। মেয়ের আড়ালেই নিজের চোখের কোণের জলটা মুছে নিলেন উনি।”
এদিকে রঞ্জিত চোধুরী ফোন রেখে কবির শেখের দিকে তাকিয়ে বললেন
— ” কী করবো এবার?”
কবির শেখ একটা শ্বাস নিয়ে বললেন,
— ” কী আর করার? ওপরে পাঠিয়ে দিতে হবে। আর সাথে মেয়েটাকেও।”
_____________________
বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে হালকা হালকা বাজও পরছে। অফিসের কাজ শেষ করে কার ড্রাইভ করে বাড়ি ফিরছেন হাসান কোতয়াল। হঠাৎই ওনার সামনে দুটো সাদা গাড়ি এসে থামলো, উনি তাড়াতাড়ি ব্রেক করতেই গাড়ি থেকে কিছু লোক নেমে এলো। উনি খুব বুদ্ধিমান আর বিচক্ষণ লোক ছিলেন তাই বুঝতে পারলেন এরা কারা আর কেনো এসছেন। কিন্তু ওনার মাথায় এখন নিজের প্রাণের চিন্তা নেই ওনার মেয়ের চিন্তা ঘুরছে। তাই উনি সাথেসাথেই গাড়ি ঘুরিয়ে শর্টকাট পথে চলে গেলেন ওই দুটো গাড়িও ওনার পেছন পেছন আসছে। উনি খুব দ্রুত ড্রাইভ করছে। ড্রাইভ করতে করতেই কাউকে একটা ফোন দিলেন উনি। ফোনটা রিসিভ করতেই উনি বললেন,
— ” আমার হাতে সময় নেই এটাই হয়তো আমার তোমাকে বলা শেষ কথা, আমার মেয়েটাকে দেখে রেখো ওকে এই পশুদের হাত থেকে বাঁচানোর দ্বায়িত্ব তোমাকে দিয়ে গেলাম। আমার বিশ্বাস তুমি তোমার কথা রাখবে। ভালো থেকো।”
ওপাশ থেকে লোকটা উত্তেজিত হয়ে অনেক কথা বলছে কিন্তু উনি ফোন কেটে আবার ড্রাইভিং এ মনোযোগ দিলেন। বাড়ি পোছেই উনি দৌড়ে ভেতরে ঢুকলেন। ঢুকে দেখলেন অনিমা সোফায় বসে পড়ছে। উনি তাড়াতাড়ি গিয়ে বললেন
— ” মামনী তুমি পালাও এখান থেকে।”
অনিমা অবাক হয়ে দাড়িয়ে বলল,
— ” আব্বু কী হয়েছে?”
মিস্টার রঞ্জিত একটা কাগজ বার করে অনিমার হাতে দিয়ে বললেন,
— ” এটা রাখো, তোমার মামা বাড়িতে চলে যাও। তারপরে এই নম্বরে যোগাযোগ করবে আর লোকটি যা বলবে ঠিক তাই করবে। এখন যাও পালাও।”
অনিমা ব্যাপারটা কিছুটা বুঝতে পেরে বলল,
— ” মানে কী? কী বলছো তুমি এসব? আমি যাবোনা তোমাকে একা রেখে।”
হাসান কোতয়াল জানেন ওনার মেয়ে কতো জেদি তাই বললেন,
— ” মামনী ধরে নাও এটাই তোমার কাছে আমার শেষ চাওয়া প্লিজ যাও।”
অনিমা কাঁদতে কাঁদতে বলল,
— ” আব্বু প্লিজ?”
কারো আওয়াজ পেয়ে হাসান কোতয়াল বলল,
— ” ওরা এসে গেছে তুমি পেছনের গেইট দিয়ে যাও।”
— ” কিন্তু আব্বু…”
হাসান কোতয়াল চেচিয়ে বলল,
— ” মামনী যাও।”
অনিমার ইচ্ছা না থাকলেও বাদ্ধ হয়ে পেছনের গেইট দিয়ে বেড়িতে গেলো। ওর কলিজা ফেটে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে ওর জীবণটাই ও ভেতরে রেখে এসছে। ভীষণ জোরে জোরে বজ্রপাত হচ্ছে। বৃষ্টিতে ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে ও। কিন্তু দুর্ভাগ্যবসত একটু এগোতেই ওর সামনে রঞ্জিতের লোকেরা চলে এলো। সবাই ওর সামনে ওকে ঘিরে দাড়িয়ে আছে। অনিমা অন্যদিকে দৌড়লো ওদের কাছ থেকে বাঁচার জন্যে কিন্তু রাস্তার ইটের সাথে আটকে পরে গেলো ও, উঠতে চেয়েও উঠতে পারলোনা পায়ের চোটের জন্যে। এসবের মধ্যে কাগজটাও পরে গেছে কোথাও। লোকগুলো ওর কাছে এসে ওকে ঘিরে ধরতেই ও হালকা পিছিয়ে ভয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
— ” প্লিজ আমাদের ছেড়ে দিন। আমার আব্বুকে মারবেন না প্লিজ।”
ওর কথা শুনে ওরা সবাই অট্টহাসি দিলো, তারপর বলল,
— ” ওর বাপ যতোটা চালাক ও দেখছি ততোটাই বোকা! আরে খুকুমনি তোমাকে ছাড়ার হলে আমরা ধরবো কেনো? আর তোমার বাবার এতোক্ষণে ইহকাল সমাপ্ত হয়ে গেছে।”
অনিমা চমকে গেলো। চিৎকার করে উঠলো ও। কাদতে কাদতে বলল,
— ” প্লিজ আব্বুকে ছেড়ে দিন প্লিজ।”
লোকগুলো ওর কথায় পাত্তা না দিয়ে মিস্টার রঞ্জিতকে ফোন করে বলল,
— ” স্যার মেয়েটাকে পেয়ে গেছি, এখন কী করবো?”
ওপাশ থেকে কিছু বলতেই লোকটা আচ্ছা বলে ফোন রেখে দিলো। তারপর অনিমার হাত ধরে টেনে তুলে বাকিদের উদ্দেশ্যে বলল,
— ” নিয়ে যেতে বলেছে ওখানে।”
ওরা সবাই অনিমাকে টেনে নিয়ে ওদের বাড়িতে সোজা হাসান কোতয়ালের বেডরুমে নিয়ে গেলো। আর ওখানে গিয়ে সামনে তাকাতেই অনিমা স্তব্ধ হয়ে গেলো, ওর পৃথিবী ওখানেই থেমে গেলো, ওর মনে হচ্ছে ওর মাথায় কেউ ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করেছে, একটা লোক ওর হাত ধরে আছে তবুও ফ্লোরে বসে পরলো ও দাড়িয়ে থাকার শক্তি নেই ওর। কারণ ওর সামনে সিলিং ফ্যানে ওর আব্বু অর্থাৎ হাসান কোতয়ালের লাশ ঝুলছে।
#পর্ব- ২৮
.
কিছুক্ষণ স্হির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার পর অনিমার মস্তিষ্ক ওকে ধীরে ধীরে জানান দিলো যে ওর চোখের সামনে ওর বাবার মৃতদেহ ঝুলছে। তখনি ধীরে ধীরে নিশ্বাস ভারী হয়ে উঠল ওর। ” আব্বু’ জোরে চিৎকার করে উঠল অনিমা। অনিমার আওয়াজ শুনে মিস্টার রঞ্জিত পেছন ঘুরে তাকালো। অনিমার একদৃষ্টিতে ঝুলন্ত লাশটার দিকে তাকিয়ে আছে, ওর শরীর অসার হয়ে উঠছে। বাইরে জোরে বজ্রপাত হচ্ছে, আকাশে মেঘেদের মধ্যে তান্ডব চলছে আর অনিমার মনেও, ওর কিশোরী মন এতোবড় ধাক্কা নেওয়ার জন্যে মোটেই তৈরী ছিলোনা। মিস্টার রঞ্জিত এগিয়ে এসে বাঁকা হেসে বললেন
— ” এই তাহলে ওর মেয়ে?”
অনিমার হাত ধরে রাখা লোকটা বলল
— ” জ্বী স্যার, পালানোর চেষ্টা করছিলো ভাগ্যিস আমারা পেছনের দিনটায় ছিলাম।”
— ” পালিয়ে আর যেতো কোথায়? আমাদের কাছ থেকে পালানো এতো সহজ নয়।”
ওদের মধ্যে একজন বলে উঠল,
— ” স্যার মেরে দেই একে? ”
রঞ্জিত চৌধুরী দৃঢ় কন্ঠে বললেন,
— ” নাহ এখানে নাহ। তাহলে সবাই বুঝে যাবে এটা মার্ডার। এখান থেকে নিয়ে যেতে হবে ওকে।”
মার্ডার শব্দটা শুনেই অনিমার মাথায় আবারো ধাক্কা লাগলো। ওর মস্তিষ্ক আবারো ওকে বলছে ওর সামনে ওর আব্বুর লাশ ঝুলছে, ওর আব্বুর। ওর আব্বু আর নেই। ও উঠে ওর হাসান কোতয়ালের দিকে যেতে চাইলো কিন্তু ওই লোকটা ওর হাত ছাড়লোনা। অনিমা কাদঁতে কাঁদতে বললো,
— ” আব্বুহ! আব্বুর কষ্ট হচ্ছে, প্লিজ নামিয়ে দিন আব্বুকে, আব্বু মরে যাবে।”
মিস্টার রঞ্জিত অনিমার কাছে এসে বলল,
— ” তোমার আব্বুর কোনো কষ্ট হচ্ছেনা। আর মরেও যাবেনা কারণ তোমার আব্বু মরেই গেছে, দেখো ভালো করে।”
অনিমা হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলল,
— ” মিথ্যে বলছেন আপনারা কিচ্ছু হয়নি আমার আব্বুর। আপনি মিথ্যে বলছেন। ছাড়ুন আমাকে প্লিজ।”
মিস্টার রঞ্জিত দুঃখ পাওয়ার ভান করে বলল,
— ” আহারে। খুব কষ্ট লাগে এই দৃশ্য দেখলে। কিন্তু আমরা কী করবো? এইসব লোকেরা বুঝতেই চায়না। এতোবার বললাম থেমে যান, থেমে যান। কিন্তু এরা শোনেই না। ওনার এই একরোখামী নিজের প্রাণটা তো দিলোই আর বাচ্চা মেয়েটাকেও এখন ভূগতে হবে।”
অনিমা এবার চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
— ” প্লিজ আমাকে যেতে দিন আব্বুর কাছে, প্লিজ।”
মিস্টার রঞ্জিত অনিমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
— ” চিন্তা করোনা মা। তোমাকে তোমার আব্বুর কাছে পাঠানোরই ব্যাবস্হা করছি আমরা, চলো।”
অনিমা চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
— ” ছাড়ুন আমাকে, আব্বুহ।”
এবার রঞ্জিত চৌধুরীর ধমক দিয়ে বললেন,
— ” ঐ চুপ! ঘ্যান ঘ্যান করেই যাচ্ছে তখন থেকে। এই এটাকে নিয়ে বাইরে চল। আর দুজন এখানের ধস্তাধস্তি আর বাকি প্রমাণগুলো মিটিয়ে তারপর আয়।”
এরপর ঐ লোকগুলো অনিমাকে টেনে নিয়ে যেতে নিলেই অনিমা বলল,
— ” নাহ আমি আমার আব্বুকে ছেড়ে যাবোনা, আমাকে ছাড়ুন প্লিজ।”
কিন্তু অনিমার কোনো কথা না শুনেই ওকে নিয়ে বাইরে চলে এলো। বাইরে বৃষ্টি আর বজ্রপাত থামার নামই নিচ্ছেনা। অনিমা মাথায় এসব কোনো চিন্তা নেই যে ওর সাথে কী হতে চলেছে ওর মাথায় শুধু চলছে যে ওর আব্বুকে ও ভেতরে রেখে এসছে। আর সেইজন্যেই সমানে চিৎকার করে কেঁদে চলেছে ও মিস্টার রঞ্জিত এবার ওনার ছেলেগুলোকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
— ” একে গোডাউনে নিয়ে যা, যা খুশি কর কিন্তু কাল সকালে যেনো ও বেঁচে না থাকে। অনেককিছু যেনে গেছে ও, তাই ওকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে না।”
ওরা সম্মতি জানিয়ে অনিমাকে টেনে গাড়িতে তুললো। অনিমার কান্নাকাটি, আকুতিমিনতি কোনোকিছুই ওর ওপর এফেক্ট ফেললো না। বেশি চিৎকার চেচামেচি করছিলো বলে ওর হাত মুখ বেধে দিলো। অনিমা নিঃশব্দে চোখের জল ফেলছে। নিজের চোখের সামনে নিজের বাবার মৃত্যু দেখার পর সন্তানের মানসিক পরিস্হিতি ধারণা করাও অসম্ভব। এই মুহূর্তে ছটফট করার মতোও মানসিক শক্তি নেই অনিমার মধ্যে। ওকে গোডাউনে নিয়ে এক কর্ণারে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো। অনিমা একটু গুটিয়ে বসে অসহায়ভাবে তাকিয়ে রইলো লোকগুলোর দিকে। ও ভাবতেও পারছেনা এদের মনে কী চলছে। ওদের মধ্যে একজন বললো,
— ” বহুত দিন পর এরকম জিনিস পেলাম ভাই। এতো পুরো এটম বোম।”
আরেকজন সায় দিয়ে বলল,
— “সত্যি ভাই আজ রাতে ফুলটু মাস্তি হবে।”
এদের কথার ধরণ শুনেই অনিমা খুব ভালোকরেই বুঝতে পারছে ওর সাথে কী হতে চলেছে কিন্তু ওর মধ্যে কোনো অনুভূতি কাজ করছেনা। ওর চোখের সামনে শুধু ওর আব্বুর মুখটাই ভেসে উঠছে। ওর আব্বু আর নেই এই কথাটাই ওর মস্তিষ্কে বারবার বাড়ি মারছে। ওর মস্তিষ্ক আর এই চাপ সহ্য করে উঠতে পারলোনা। ধীরে ধীরে নেতিয়ে পরতে শুরু করলো আর একপর্যায়ে অজ্ঞান হয়ে গেলো। অনিমাকে মাটিতে ঐভাবে লুটিয়ে পরতে দেখে ওদের মধ্যে একজন বলল,
— ” আরে এতো অজ্ঞান হয়ে গেলো।”
আরেকজন ভ্রু কুচকে অনিমাকে তুলে দেয়ালে হেলান দিয়ে শুইয়ে দিয়ে বলল,
— ” যা বাকেটে করে পানি নিয়ে আয়। দেখি কতোক্ষণ অজ্ঞান থাকে।”
লোকটা যেই পানি আনতে যাবে তার আগেই গাড়ির হর্নের আওয়াজ পেলো। ওরা অবাক হয়ে বলল,
— ” এখন আবার কে এলো?”
হঠাৎ ওদের মধ্যেই একজন এসে হাফাতে হাফাতে বলল,
— ” রিক স্যার এসছে।”
এটা শুনেই ওরা সবাই ছুটলো গেটের দিকে। গিয়ে দেখে রিক আসছে। ওদের একজন রিকের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,
— ” আরে স্যার আপনি এখানে?”
রিকের ওদের সবাইকে একজায়গায় দেখে ভ্রু কুচকে বলল,
— ” কী ব্যাপার? সব একজায়গায় যে? আজ আবার কোনো মেয়েকে তুলে নিয়ে এসছিস নাকি?”
লোকটা মাথা নিচু করে বলল,
— ” না আসলে রঞ্জিত স্যার একটা মেয়েকে মারতে বলেছে তাই..। স্যার মেয়েটা কিন্তু সেই আপনি চাইলে…”
রিক রাগী চোখে তাকাতেই লোকটা থেমে গেলো। রিক শক্ত গলায় বলল,
— ” আমার এসব ফালতু ইন্টারেস্ট নেই। হোয়াটএভার দুটো ড্রাগসের বস্তা বের করে রাখ সকালে ক্লাইন্ট আসবে।”
লোকটা ভীত হয়ে হকচকিয়ে বলল,
— ” জ্বী স্যার।”
বলেই ওরা বস্তা বার করতে চলে গেলো। রিক হেটে হেটে গোডাউনটা দেখতে লাগল। দেখতে দেখতে হঠাৎ অনিমাকে দেখলো, মেয়েটার পেছন সাইড দেখা যাচ্ছে। রিক বুঝলো এই সেই মেয়ে ও ইগনোর করে যেতে নিয়েও থেমে গেলো। কেনো জানিনা মেয়েটাকে পেছন থেকে দেখেই ওর মেয়েটার মুখ দেখার ইচ্ছে হলো। ও নিজের অজান্তেই ধীরপায়ে মেয়েটার দিকে এগিয়ে গেলো। মেয়েটার সামনে গিয়ে দেখে, মেয়েটার ভেজা চুলগুলো ওর মুখের ওপর পরে আছে। রিক এক হাটু ভেঙ্গে মেয়েটার সামনে বসে ওর মুখের চুলগুলো সরাতে গিয়েও থেমে গেলো। ও ভাবছে কী করছে ও এগুলো? কেনো করছে? পাগল টাগল হয়ে গেলো নাকি? এসব ভেবে উঠে যেতে নিয়েও আবার তাকালো মেয়েটার দিকে। মুখটাই তো দেখবে এতে ক্ষতি কী? এসব চিন্তা করে ও আলতো হাতে মেয়েটার মুখের ওপর থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিলো। আর মেয়েটার মুখ দেখার সাথেসাথেই ওর চোখ স্হির হয়ে গেলো। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অনিমার দিকে, অনিমার সারামুখে বিন্দু বিন্দু পান জমে আছে, ওর হালকা গোলাপি ভেজা ঠোটগুলো ঠান্ডায় কাপছে, বড় বড় চোখের পাপড়িতে পানি জমে আছে, চুল বেয়ে বেয়ে পানি পরছে, হালকা কেঁপে কেঁপে উঠছে ও। রিক মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছে মেয়েটাকে, এতোটা মায়ামাখানো কোনো মুখ হতে পারে? ওর চোখ সরাতেই ইচ্ছে করছেনা। কিছুক্ষণ পর ওই লোকগুলোর মধ্যে দুইজন এসে এইদৃশ্য দেখে থেমে গেলো। দুজনে দুজনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে বলল,
— ” কীরে ভাই স্যার এর আবার কী হলো?”
আরেকজন দাঁত কেলিয়ে বলল,
— ” দেখ হয়তো আজ রাতের জন্যে নিয়ে যাওয়ার সখ হয়েছে।”
ওপর লোকটি ধমকির স্বরে বলল,
— “চুপ। স্যার শুনলে বারোটা বাজিয়ে দেবে। চল আয়।”
ওরা রিকের কাছে গিয়ে রিককে উদ্দেশ্য করে বলল,
— ” স্যার বস্তাগুলো নামিয়ে দিয়েছি।”
কিন্তু রিক একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অনিমার দিকে। একটু জোরে ডাকতেই রিকের হুস এলো, চমকে তাকিয়ে বলল,
— ” হ্ হ্যাঁ বল।”
লোকটা মাথা নিচু করে বলল,
— ” বস্তা নামিয়ে নিয়েছি।”
রিক নিজেকে সামলে একটু ইতস্তত করে বলল,
— ” অব্ হুম।”
ওরা যেতে নিলেই রিক থামিয়ে দিয়ে বলল,
— ” ঐ শোন।”
ওরা পেছন ঘুরে তাকালো, রিক অনিমার দিকে তাকিয়ে বলল,
— ” মেয়েটাকে কোথা থেকে এনেছিস বললি?”
ওরা একটু অবাক হলেও বলল,
— ” রঞ্জিত স্যার এর সব জানেন এর ব্যাপারে।”
রিক অনিমার দিকে তাকিয়েই বলল,
— ” তোরা এখন সবাই চলে যা এখান থেকে। আজ কাউকে এখানে থাকতে হবেনা।”
ওদের একজন হকচকিয়ে বলল,
— ” কিন্তু স্যার রঞ্জিত স্যার তো বলেছেন ওকে…”
রিক শক্ত গলায় বলল,
— “আমি যেতে বলেছি তোদের।”
ওরা জানে এখন আর কথা বাড়ালে রিক ওদের এখানেই মেরে পুতে দেবে তাই কথা না বাড়িয়ে সবাই চলে গেলো। ওরা চলে যেতেই রিক ওর ফোন বের করে রঞ্জিত চৌধুরীকে কল করল, কল রিসিভ করতেই রিক বলল,
— ” আজকে যেই মেয়েটাকে গোডাউনে পাঠিয়েছো ও কে?”
মিস্টার রঞ্জিত চৌধুরী ভ্রু কুচকে বললেন,
— ” কেনো? সেটা দিয়ে তোমার কী কাজ?”
রিক বিরক্ত হয়ে বলল,
— ” উফ ড্যাড। যেটা জিজ্ঞেস করছি বলো।”
মিস্টার বুঝতে পারলেন ছেলে সিরিয়াস মুডে আছে তাই বললেন,
— ” ঐ যে হাসান কোতয়াল এর কথা বলেছিলাম না তার মেয়ে।”
রিক সোজাসাপ্টা ভাবে বলল,
— ” ওকে মারার প্লানটা ক্যান্সেল। আর ওকে আমি ছেড়ে দিচ্ছি।”
মিস্টার রঞ্জিত অবাক হয়ে বলল,
— ” কী বলছো কী তুমি? হাসানের খুনের ওই একমাত্র সাক্ষি। ওকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে না।”
রিক শক্ত গলায় বলল,
— ” শধু সাক্ষী থাকলেই হয়না প্রমাণও থাকতে হয়।”
মিস্টার রঞ্জিত বুঝতে পারলেন যে তার ছেলে কী বলতে চাইছে তবুও বললেন,
— ” কিন্তু..”
রিক মিস্টার রঞ্জিতকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
— ” কোনো কিন্তু নয় ড্যাড। আমার যা বলার বলে দিয়েছি। বাকি খেলাটা তোমারা সাজাও।”
এটুকু বলে ফোন রেখে দিলো রিক। তারপর অনিমার দিকে তাকালো। তারপর বাকা হেসে বলল,
— ” সো স্যাড বেবি কী তুমি আমার নজরে পরে গেছো। এখন আমিও তোমাকে আমার হাত থেকে বাঁচাতে পারবো না।”
এদিকে ফোন রেখে রঞ্জিত চোধুরী কবির শেখকে সবটা খুলে বললেন। সবটা শুনে কবির শেখ কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর ওনার সেই হাসি দিয়ে বললেন,
— ” আমার একটা পরিকল্পনা আছে জিজু।”
____________________
রোদের আলো চোখে লাগতেই ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকালো অনিমা। চোখ খুলে নিজেকে বন্ধ করে নিজেকে সেই গোডাউনে আবিস্কার করলো। মাথা চেপে ধরে উঠে বসতেই ওর কালকে রাতের সব কথা মনে পরলো। আর ওর আব্বুর কথা মনে পরতেই কেঁদে দিলো ও। ওকে এখানে তো মেরে ফেলতে এনেছিলো তাহলে ছেড়ে দিলো কেনো? আর ওরাই বা কোথায়? এসব ভাবার মানসিকতা নেই এখন অনিমার, হঠাৎ কিছু মনে হতেই ও দেয়াল ধরে উঠে দাড়ালো। তারপর অনেক কষ্টে বাইরে বেড়িয়ে রাস্তাটা খুব সহজেই চিন্তে পারলো কারণ এই রাস্তাটা দিয়েই ও কলেজ যেতো। শরীর খুব দুর্বল লাগছে ওর কিন্তু তবুও দৌড় লাগালো বাড়ির উদ্দেশ্যে ওর আব্বুর কাছে যে ওকে যেতেই হবে। ওর মন শুধু বলছে একটা জাস্ট একটা মিরাক্কেল হোক আর ও যাতে গিয়ে দেখে ওর বাবা একদম ঠিক আছে। দু তিনবার রাস্তায় হোচট খেয়ে পরেও গেছে তবুও দৌড়চ্ছে ও। পা কেটে রক্তও পরছে কিন্তু ওর হুস নেই। আধা ঘন্টারো বেশি সময় লেগেছে বাড়ি পৌছতে। বাড়ির গেইটে ঢুকেই অনিমা চমকে গেলো কারণ বাড়িতে অনেক ভীর। প্রেস আর পুলিশ ও আছে। ওদের ঠেলে সরিয়ে ভেতরে গিয়ে অনিমা থমকে গেলো কারণ হাসান কোতয়ালের বডি নিচে শুইয়ে রাখা হয়েছে।অার তার পাশে ওর মামা, মামী আর অর্ক বসে আছে অনিমা তারচেয়েও বেশি অবাক হয়েছে রঞ্জিত চৌধুরীকে এখানে দেখে। তবুও ওর আব্বুর দিকে তাকিয়ে আছে। ওর মন এখোনো বলছে যে ওর আব্বু এক্ষুনি উঠে বলবে ‘মামনী সারারাত কোথায় ছিলে? জানো কতো টেনশন করেছি? এমন কেউ করে?” অনিমা ওর হাসান কোতয়াল এর সামনে বসে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
— ” আব্বু? এই আব্বু? প্লিজ ওঠো! আমি না কাল রাত থেকে কিচ্ছু খাইনি জানো। তুমিতো জানো তুমি না খাইয়ে দিলে আমি খেতে পারিনা প্লিজ ওঠো, আমার খিদে পেয়েছে তো।”
এরকম নানা কথা বলার পরেও যখন উঠলোনা ইচ্ছেমতো ডাকতে লাগল ওর আব্বুকে, ওর মামা মামী ওকে বোঝাচ্ছে ওর আব্বু আর নেই, কিন্তু ও শুনছেই না। অনিমা পাগলের মতো চিৎকার করে কেঁদে যাচ্ছে। একপর্যায়ে ও নিজেই শান্ত হয়ে গেলো, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ডেডবডিটার দিকে। কিছুক্ষণ পর এক অফিসার বলল,
— ” ইট’স মাইট বি সুইসাইড।”
সুসাইড শব্দটা শুনেই অনিমা চোখ মছে উঠে দাড়লো তারপর ঐ অফিসারের কাছে গিয়ে বলল,
— ” এটা সুইসাইড নয় অফিসার আমার আব্বুকে মার্ডার করা হয়েছে।”
অফিসার অবাক হয়ে বললেন,
— ” হোয়াট? বাট কে করেছে?”
অনিমা রঞ্জিত চৌধুরীর দিকে ইশারা করে বললেন,
— ” উনি! উনি খুন করেছে আমার আব্বুকে।”
মিস্টার রঞ্জিত অবাক হওয়ার ভান করে অনিমার কাছে এসে বলল,
— ” কী বলছো কী মামনী? আমি কেনো তোমার আব্বুকে মারতে যাবো?”
অনিমা মিস্টার রঞ্জিতকে কিছু বলভে তার আগেই অফিসার বললেন,
— ” আপনি কীসের ভিত্তিতে একজন মিনিস্টিরের বিরুদ্ধে এতোবড় এলিগেশন আনছেন? আপনার কাছে কোনো প্রমাণ আছে?”
অনিমা চোখ মুছে বলল,
— ” আমি নিজেই আব্বুর মৃত্যু নিয়ে মিথ্যে বলবো? আরে আমি নিজের চোখে দেখেছি। ওরা তো আমাকেও মারার জন্যে তুলে নিয়ে গেছিলো।”
পেছন থেকে অনিমার মামা বলে উঠলেন,
— ” কী বলছিস কী তুই অনিমা? তুই কীকরে দেখবি? তুইতো কাল রাতে আমাদের বাড়িতে ছিলি। মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি তোর?”
অনিমা অবাক হয়ে তাকালো ওর মামার দিকে। মামা এসব কী বলছে? কেনো বলছে? ও তো সারারাত গোডাউনেই পরে ছিলো, তাহলে মিথ্যে কেনো বলছে মামা? এদিকে মিস্টার রঞ্জিত আর কবির শেখ একে ওপরের দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাসি দিলো।
.
#চলবে…
.
(রি-চেইক করার সময় হয়নি। তাই টাইপিং মিস্টেক গুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। ভেবেছিলাম আজ অতীত শেষ করে দেবো বাট হলোনা তবে কালকের পার্টে হয়ে যাবে।
হ্যাপি রিডিং 😊)