#বর্ষণের সেই রাতে পর্ব ৮+৯

0
474

#বর্ষণের সেই রাতে পর্ব ৮+৯
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
.
একঘন্টার লম্বা সাওয়ার নিয়ে কফি বানিয়ে বেলকনিতে দাড়িয়ে আবছা অন্ধকার আকাশটা দেখতে দেখতে ধোয়া ওঠা কফির মগে চুমুক দিলাম। আদ্রিয়ানের সাথে মিট করতে যাবো কি না ঠিক করিনি এখোনো। আপাদত ভোর হওয়া দেখছি। সূর্য কী সুন্দরভাবে পৃথিবীর বুক থেকে রাতের আধার দূর করে নতুন আলো নিয়ে আসে। আমার জীবনেও কী এমন কোনো সূর্য আসবে নতুন আলো নিয়ে নাকি এই অন্ধকারেই চিরস্থায়ীভাবে থেকে যাবে আমার জীবন? মনে মনে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে মুচকি হেসে কফির মগে চুমুক দিলাম। জন্মের পর থেকেই একটু একটু করে যার জীবণ থেকে সব আলো ফুরিয়ে গেছে, তার জীবণে নতুন করে কেউ আলো নিয়ে আসবে সেটা ভাবাও বোকামি। একটু একটু করে সূর্য উঠে গোটা আকাশটাকে আলোকিত করছে সব অন্ধকার কেটে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললাম
— বাবা মা তো কখনো স্বার্থপর হয়না তাইনা? তাহলে তোমরা কেনো হলে? কেনো স্বার্থপরের মতো আমাকে ফেলে চলে গেলে এভাবে? এই স্বার্থপর পৃথিবীতে আমাকে একা ছেড়ে চলে যাবার আগে একবারো ভাবলে না যে আমার কী হবে? মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে চলে যাই তোমাদের কাছে কিন্তু তোমার অপূর্ণ স্বপ্নগুলো পূরণ করার যে দায়িত্ব নিজের কাধে নিয়েছি সেই দায়িত্ব কীকরে এড়িয়ে যাই বলোতো?
এই মুহূর্তে চোখ দিয়ে জল বেড়োচ্ছেনা, বেড়োচ্ছে শুধু দীর্ঘশ্বাস, চোখের জল ও হয়তো ক্লান্ত হয়ে গেছে। কফিটা শেষ করে খাটে হেলান দিয়ে শুয়ে রইলাম। কী করবো সেটাই ভাবছি। আদ্রিয়ান কী সত্যিই ওয়েট করবে আমার জন্যে? যদি সেটা হয় আমি না গেলে সত্যিই খারাপ হবে। কিন্তু যদি ওই লোকটা কোনোভাবে আমাকে খুজে পেয়ে যায়? কিচ্ছু ভাবতে পারছিনা। কেনো দেখা করতে চায় ও আমার সাথে? আমিই বা কী করবো? যাবো নাকি না? নিজের চোখ দুটো বন্ধ করে জোরে জোরে কয়েটা শ্বাস নিলাম।

— আব্বু আব্বু।
বলেই পেছন থেকে চেয়ারে বসে পেপার পড়তে থাকা আব্বুর গলা জরিয়ে ধরলাম।
— কী ব্যাপার মামনী আজকে এতো সোহাগ? নিশ্চই কিছু চাই?
আমি মুখটা ফুলিয়ে আব্বুর গলা ছেড়ে সোফায় বসে বললাম
— তুমি আমাকে এভাবে বলতে পারলে? আমি শুধু কিছু দরকার হলেই তোমাকে আদর করি? যাও কথাই বলবোনা তোমার সাথে।
আব্বু পেপারটা রেখে আমার পাশে বসে বলল
— আরেহ আমিতো মজা করছিলাম মা। আমি হাত ভাজ করে উল্টো ঘুরে বসলাম। আব্বু মুচকি হেসে বলল
— যাহ মেয়তো রাগ করেছে আমার ওপর, কিন্তু একজনের টিউশন থেকে ফিরে আসার অপেক্ষায় যে আমি এখোনো না খেয়ে আছি সেটাকি কেউ জানে?
আমি এবার ভ্রু কুচকে আব্বুর দিকে তাকিয়ে অনেকটা রেগে বললাম
— তুমি এখোনো না খেয়ে আছো? আব্বু তুমি জানো তোমার সুগার ফল করে তবুও?
— আমার মামনীকে না খাইয়ে আমি কীকরে খাই?
— হয়েছে আর বলতে হবেনা।
আমি উঠে গিয়ে একপ্লেটেই আব্বু আর আমার খাবার আব্বুর হাতে এনে দিলাম। আব্বু ভ্রু কুচকে বলল
— এক প্লেটে কেনো?
আমি আব্বুর সামনে ফ্লোরে হাটু ভেঙ্গে বসে বললাম
— তুমি খাইয়ে দেবে আমাকে।
আব্বু হেসে দিয়ে রুটি ছিড়ে আমার মুখে দিয়ে বলল
— তা এবার বলোতো কী চাই তোমার?
— আমার এস এস সি তে প্লাস আসলে তোমার কিন্তু ট্রিট দেবার কথা ছিলো?
— হুম মনে আছে পেয়েছো যখন দেবো তো!
— কালকেতো ফ্রাইডে। কালকে আমরা বাইরে গিয়ে লাঞ্চ করবো।
আব্বু মুখটা ছোট্ট করে বলল
— সরি মামনী। কালকেতো একজনের সাথে আমায় মিট করতে হবে। ঐসময় ব্যাস্ত থাকব আমি।
আমি মুখ ফুলিয়ে রুটি চিবোতে চিবোতে বললাম
— ক্যান্সেল করে দাওনা? যেতে হবেনা কোথাও তুমি আমার সাথেই যাবে।
আব্বু আমার মুখে আরেক টুকরো রুটি দিতে দিতে বলল
— আচ্ছা একটা কথা বলো কেউ যদি তোমার জন্যে ওয়েট করে আর তুমি যদি না যাও সেটাকি ভালো দেখায়? ইস ইট গুড ম্যানার্স?
আমি না বোধক মাথা নাড়লাম। আব্বু হেসে দিয়ে বলল
— সেইজন্যেই আমার তো যাওয়া উচিত তাইতো?
— হুম।
বলে মন খারাপ করে খাবার চিবোতে থাকলাম। আব্বু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল
— লাঞ্চ না হোক ডিনার তো করতেই পারি? কাল আমরা দুজন একসাথে ডিনারে যাবো হ্যাপি?
এটা শোনার সাথে সাথেই আমার সব মন খারাপ দূর হয়ে গেলো, খুশিতে লাফিয়ে উঠে বললাম
— সুপার হ্যাপি।
— হয়েছে আর নাচতে হবেনা এবার চুপচাপ খাও।
আমি ভদ্র মেয়ের মতো বসে পরলাম, আর আব্বু আমাকে খাইয়ে দিচ্ছে আর নিজে খাচ্ছে। হঠাৎ আব্বু বলল
— এইযে আমার হাতের খাওয়ার একটা বদঅভ্যাস বানাচ্ছো, যখন আমি থাকবোনা কে খাইয়ে থেবে শুনি?
এটা শোনার সাথে সাথেই আমার মুখের হাসি উড়ে গেলো, আমি কদোকাদো মুখ করে আব্বুর কোলে মাথা রেখে বললাম
— কেনো এসব বলো তুমি? তুমিতো জানো তুমি ছাড়া আমার কেউ নেই তাও তুমি আমাকে ছেড়ে যাবার কথা বলো?
আব্বু একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল
— সব কিছুতো আমাদের হাতে থাকেনারে মা। না চাইতেও অনেকসময় চলে যেতে হয়।
আমি কিছু না বলে চুপচাপ আব্বুর কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে রইলাম। আর আব্বু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।

হটাৎ আব্বু বলে চোখ মেলে তাকালাম। চারপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম সপ্ন দেখছিলাম। ওসব ভাবতে ভাবতে কখন চোখ লেগে গেছে বুঝতেই পারিনি। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি সাড়ে আটটা বেজে গেছে অলরেডি। দশটায় ওখানে থাকতে বলেছিলো আদ্রিয়ান। যাবো আমি? এসব রুমে পায়চারী করতে করতে এসবই ভাবছি। একবার মন বলছে যাই, আরেকবার মন বলছে যাওয়াটা ঠিক হবেনা। কিছুতেই স্হির কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছিনা। আরো একবার ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি নয়টা বেজে গেছে। খাটে বসে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরলাম। মাঝেমাঝে এমন কিছু পরিস্হিতি আসে যখন না এদিকে যাওয়া যায় না ওদিকে। কী করবো তা নিজেরাই বুঝতে পারিনা। সিদ্ধান্ত নিতে নিতেই সময় পার হয়ে যায়। অনেকক্ষণ ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েই নিলাম। ফোনটা হাতে নিয়ে অরুকে কল করলাম। বাজার একটু পরেই অরু রিসিভ করে বলল
— শরতান্নি, বান্দরনী, পেন্তী, শাকচুন্নি, রাক্ষুসী..
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম
— আরে আরে একটু শ্বাস নিয়ে নে বইন। আমি পালিয়ে যাচ্ছিনা।
— তোর এতোক্ষণে ফোন করার সময় হলো? আমি আর তীব্র কী পরিমাণে টেনশনে আছি জানিস? তীব্র আমাকে এই নিয়ে একশবার ফোন করে জিজ্ঞেস করেছে তুই কিছু জানিয়েছিস কী না।
আমি ভ্রু কুচকে বললাম
— তোদের এতো ইন্টারেস্ট কেনো সেটাইতো বুঝতে পারছিনা ভাই।
— তুই এসব বুঝবিনা এবার বলতো কী ঠিক করলি? অলরেডি নয়টা বিশ বাজে।
— অব্ ব রেডি হয়ে বের হ। আমি ফ্লাটের নিচের রোডে ওয়েট করছি। তীব্রকে ওর গাড়ি নিয়ে আসতে বলিস।
— ওকেহ ওকেহ তুই রাজি হয়েছিস এটাই অনেক। আমি আর তীব্র এক্ষুনি আসছি। থ্যাংকস ইয়ার।
ওর উত্তেজনা দেখে হেসে দিলাম আমি। হাসতে হাসতেই বললাম
— আচ্ছা রাখ।
— আর হ্যা শোন!
— আবার কী?
— আজকে অন্তত একটু সাজিস হ্যা?
— তুই ফোন রাখবি।
— আচ্ছা ঠিকাছে ঠিকাছে
ফোন কেটে আনমনেই হেসে দিলাম আমি। সত্যিই পাগলি। জীবনে সব না পাওয়ার আর হারানোর মধ্যে এই দুজনকে পেয়েছি। ওদের ভালোবাসা কেয়ারিং সবকিছুই আমাকে মুগ্ধ করে। সত্যিই এমন বন্ধু সবার ভাগ্যে জোটেনা এই দিক দিয়ে বলতে গেলে আমি খুব লাকি। আর এইজন্যে প্রত্যেকদিন আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায়ও করি।
একটা সাদা কুর্তি আর কালো জিন্স পরে নিলাম, চুলগুলোও ছেড়ে দিলাম সাইড সিথি করে। ব্যাগ নিয়ে বেড়নোর আগে আয়নার আরেকবার নিজেকে দেখলাম। সাজবো একটু? হটাৎ করেই মুখে গরম পানি ছুড়ে মারার দৃশ্যটা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই কেপে উঠলাম আমি। চোখের কোণের পানিটা মুছে নিলাম। সবকিছু সবার জন্যে না ভেবে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বাইরে গিয়ে কিছুক্ষণ ওয়েট করার পরেই তীব্র ওর গাড়ি নিয়ে চলে এলো। আমি গিয়ে ফ্রন্ট সিটে বসতেই পেছনের সিট থেকে অরু বলল
— কী রে তুই? তোকে বললাম সাজতে আর তুই একটুও সাজলিনা? কাজল আর লিপসটিক তো দিতেই পারতি?
আমি সিটবেল্ট বাধতে বাধতে বললাম
— কী দরকার বলতো?
অরু বিরক্ত হয়ে বলল
— সেটা তুই যদি বুঝতি তাহলেতো হয়েই যেতো। সাজগোজের সাথে তোর কোন জন্মের শত্রুতা বলবি?
তীব্র গাড়ি স্টার্ট করতে করতে বলল
— সাজার কী দরকার? ও এমনিতেই সুন্দর। এতই সুন্দর যে যে কেউ পাগল হয়ে যাবে ওর জন্যে..
এটুকু বলেই থেমে গেলো। অরু চোখ গরম করে তাকালো তীব্রর দিকে। তীব্র ইতোস্তত করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল
— সরি ইয়ার ভূলে গেছিলাম।
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে মুচকি হেসে বললাম
— কোনো ব্যাপার না চল।
এরপর পোনে এগারোটায় আমরা পৌছে গেলাম আদ্রিয়ানের বলা কফিশপে। গাড়ি থেকে নামতেই বুকের ভেতর কেমন করতে লাগল। শহরের নামকরা কফিশপের মধ্যে একটা এটা। অরু আর তীব্র নেমে এলো। আমাকে দাড়িয়ে থাকতে তীব্র বলল
— কীরে কী হলো? চল ভেতরে?
অরুও ভীত কন্ঠে বলল
— দশটায় আসার কথা ছিলো পোনে এগারোটা বাজে। চলে গেছে কী না কে জানে?
আমি একটু বিরক্ত হয়ে বললাম
— গেলে যাক। এতো পেচাল পারিসনা তো।
তিনজনেই কফিশপের ভেতরে ঢুকলাম। এতোবড় যে কোন কোণায় ও আছে সেটা বুঝতে পারা মুসকিল। তীব্র এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে বলল
— একটা ফোন কর ওনাকে কোথায় আছে জিজ্ঞেস কর।
আমি ফোনটা বের করে কললিস্টে ওনার নাম্বারটা খুজে বের করে ফোন দিলাম। রিসিভ করার পর আমি কিছু বলবো তার আগেই উনি বললেন
— গেইটের কাছে দাড়িয়ে থাকো। আ’ম জাস্ট কামিং।
বলেই রেখে দিলো। আজব বুঝলো কীকরে যে এসছি? অরু আমাকে একটা খোচা মেরে বলল
— কীরে কী বলল?
— বলল গেইটের কাছে থাকতে উনি আসছেন।
তীব্র মুচকি হেসে বলল
— মানতে হবে লোকটা এমনিতে খুব ভালো।
আমি কিছু বলবো তার আগেই আদ্রিয়ানকে চোখে পরল। উনি দূর থেকেই হাত নাড়লেন আমাদের দেখে আমি কিছু না বলে মুচকি হাসলাম। আদ্রিয়ান হাসি মুখেই এগিয়ে আসছেন আমাদের দিকে। আজ একটা ব্লাকের মধ্যে হোয়াইট ডিজাইনের টিশার্ট, ব্লাক জিন্স পরেছে, হোয়াইট কেচ আর সানগ্লাসটা টিশার্টের গলায় ঝুলিয়ে রেখেছেন, সিল্কি চুলগুলো বেশ খানিকটা কপালে পরে আছে। অরু মিনমিনিয়ে বলল
— ইয়ার সামনাসামনি তো আরো হ্যান্ডসাম লাগে ওকে।
আমি মুখে হাসি রেখেই অরুকে একটা খোচা মেরে দাতে দাতে চেপে বললাম
— মুখটা বন্ধ কর নইলে থাপ্পড় খাবি।
আদ্রিয়ান আমাদের সামনে এসে মুচকি একটা হাসি দিয়ে বললেন
— হাই। এটলাস্ট এলে তুমি?
আমি মুচকি হাসলাম। আদ্রিয়ান অরু আর তীব্রর দিকে তাকিয়ে বললেন
— আমি জানতাম তুমি একা আসবেনা। পরিচয়তো করিয়ে দাও।
আমি হালকা হেসে অরুর দিকে ইশারা করে বললাম
— ও আমার ফ্রেন্ড অরুমিতা।
আদ্রিয়ান অরুর দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিয়ে হাত বাড়িয়ে বলল
— হায় অরুমিতা।
অরুতো অবাক তাকিয়ে আছে, আমি আদ্রিয়ানের আড়ালে ওকে চিমটি দিতেই ও তাড়াতাড়ি আদ্ররিয়ানের সাথে হ্যান্ডশেক করে বলল
— হাই।
এরপর আমি তীব্রর দিকে ইশারা করে বললাম
— আর ও আমার ফ্রেন্ড তীব্র।
তীব্র আদ্রিয়ানের দিকে হাত বাড়ালো কিন্তু আদ্রিয়ান হ্যান্ডশেক করলো না, উল্টে হাগ করলো ওর সাথে তীব্র প্রথমে একটু অবাক হলেও পরে হেসে দিলো। আদ্রিয়ান তীব্রকে ছেড়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল
— তো ভেতরে যাওয়া যাক?
আমি হালকা হেসে মাথা নাড়লাম। ভেতরে গিয়ে একটা টেবিলে গিয়ে দেখি আরো দুইজন বসে আছে। আমরা যেতেই ঐ দুইজন দাড়িয়ে গেলো। আদ্রিয়ান রেড টিশার্ট পরা লোকটার দিকে ইশারা করে বললেন
— ও হলো আমার ফ্রেন্ড আদিব।
আদিব নামের লোকটা আমাদের তিনজনের সাথে হ্যান্ডশেক করে হায় বলল।
এরপর ব্লু শার্ট পড়া একটা লোককে ইশারা করে বললেন
— এ হলো আমার আরেক ফ্রেন্ড আশিস।
আমরা হাই বলতেই আদ্রিয়ান আমার আর অরুর দিকে তাকিয়ে বলল
— গার্লস এর থেকে সামলে থেকো হ্যা? পাক্কা প্লে বয় আছে।
আমরা হেসে দিলাম। আশিস ভ্রু কুচকে বলল
— এই আমার নামে সব জায়গায় কাটি না করলে তোর হয়না?
— না হয়না।
আদিব ভাইয়া বলল
— আচ্ছা হয়েছে ওদের দাড় করিয়ে রাখবি নাকি বসতে দে?
আদ্রিয়ান মুচকি হেসে আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল
— প্লিজ টেক ইউর সিট।
আমরা তিনজন একপাশে বসলাম ওনারা তিনজন ওপর পাশে বসলেন। এরপর মেনু কার্ড দেখে আদ্রিয়ান যার যার পছন্দ মতো কফি ওর্ডার করলেন। কফি খেতে খেতে সবাই বিভিন্ন কথা বলছে, আদ্রিয়ান অরু আর তীব্রর সাথে এমনভাবে কথা বলছে যেনো খুব পরিচিত ওরা। আর আদিব আর আশিস ভাইয়াও বেশ মজা করছে। তীব্র ওনাদের সবাইকে তুমি করে বলার পারমিশন পেয়ে গেছে অলরেডি। আশিস ভাইয়া আমার আর অরুর সাথে ওনার ফ্লির্টি মার্কা কথা বলে বলে সবাইকে হাসাচ্ছে। তবে আশিস ভাইয়া কেনো জানিনা অরুর সাথেই দুষ্টুমি বেশি করছে। অরু এতে বিরক্ত হলেও কিছু বলতে পারছেনা। কথার মধ্যে মধ্যে আমি আদ্রিয়ানকে আড়চোখে দেখছি। আর অবাক করা বিষয় বারবার আমাদের চোখাচোখি হয়ে যাচ্ছে, আর আমরা সাথেসাথেই চোখ সরিয়ে নিচ্ছি।
হঠাৎ তীব্র আদিব ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বলল
— আমার সাথে একটু আসবে?
আদিব ভাইয়া কিছু একটা ভেবে সাথে সাথেই বললেন
— হ্যা হ্যা সিউর চলো।
বলে দুজনে হুরমুরিয়ে চলে গেলো আমি আর অরু হা করে তাকিয়ে আছি কারণ আমরা কিছুই বুঝলাম না। এবার হঠাৎ করেই আশিস ভাইয়া অরুকে বললেন
— এইযে মেডাম চলুন আমরা মিনি ডেট করে আসি?
অরু অবাক হয়ে ভ্রু কুচকে বলল
— মানে?
— মানে যেতে যেতে বোঝাচ্ছি চলো!
বলেই অরুর হাত ধরে একপ্রকার টেনে নিয়ে গেলো আশিস ভাইয়া। অরু বেচারি চেয়েও কিছু বলতে পারোনা। আমি বোকার মতো তাকিয়ে আছি। আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে দেখলাম উনি মিটমিটিয়ে হাসছেন আমি ভ্রু কুচকেই বললাম
— এটা কী হলো?
আদ্রিয়ান ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন
— আমি কী জানি? ওরা এলে জিজ্ঞেস।
আমি আর কিছু বললাম না। অনেক্ষণ ধরে দুজনেই চুপচাপ বসে আছি। আমি একহাতে কফি মগ চেপে ধরে আছি আর আরেকহাতের নখ টেবিলের সাথে ঘষছি। অার মাঝে ওনার দিকে তাকিয়ে সাথে সাথেই চোখ নামিয়ে নিচ্ছি কারণ উনি একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে এক অদ্ভুত ভঙ্গিতে কফি মগে চুমুক দিচ্ছেন। আমার খুব অসস্তি লাগছে, এভাবে তাকিয়ে থাকে কেউ, আর এভাবে মগে চুমুক দেবার মানে কী? অার বাকিরাও কোথায় আছে কে জানে? আরে কেউতো এসে বাঁচাও আমাকে, ভাল্লাগেনা। হঠাৎ করেই আমার টেবিলের ওপর রাখা হাতের ওপর উনি হাত রাখলেন। আমার সারা শরীরে যেনো বিদ্যুৎ খেলে গেলো। হার্ডবিট কয়েকটা মিস হবার পরেই তীব্র গতিতে ছুটতে লাগল। আমি অবাক হয়ে তাকালাম আদ্রিয়ানের দিকে।

#পর্ব: ৯
.
আমি আর কিছু বললাম না। অনেক্ষণ ধরে দুজনেই চুপচাপ বসে আছি। আমি একহাতে কফি মগ চেপে ধরে আছি আর আরেকহাতের নখ টেবিলের সাথে ঘষছি। অার মাঝে ওনার দিকে তাকিয়ে সাথে সাথেই চোখ নামিয়ে নিচ্ছি কারণ উনি একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে এক অদ্ভুত ভঙ্গিতে কফি মগে চুমুক দিচ্ছেন। আমার খুব অসস্তি লাগছে, এভাবে তাকিয়ে থাকে কেউ, আর এভাবে মগে চুমুক দেবার মানে কী? অার বাকিরাও কোথায় আছে কে জানে? আরে কেউতো এসে বাঁচাও আমাকে, ভাল্লাগেনা। হঠাৎ করেই আমার টেবিলের ওপর রাখা হাতের ওপর উনি হাত রাখলেন। আমার সারা শরীরে যেনো বিদ্যুৎ খেলে গেলো। হার্ডবিট কয়েকটা মিস হবার পরেই তীব্র গতিতে ছুটতে লাগল। আমি অবাক হয়ে তাকালাম আদ্রিয়ানের দিকে। উনি আমার হাতটা আরেকটু ভালোভাবে ধরে বললেন
— জানো তোমার এতো দেরী দেখে আদিব আর আশিস বলছিলো তুমি আসবেনা কিন্তু আমার কেনো জানিনা মনে হচ্ছিলো তুমি আসবে, তাইতো বসে বসে ওয়েট করছিলাম।
উনি হাত ধরে রাখায় কেমন একটা ফিল হচ্ছে কাপুনি শুরু হয়ে গেছে আমার, তারওপর ওনার এসব কথা। আমি হালকা কাপা কাপা গলায় নিচু কন্ঠে বললাম
— য্ যদি না আসতাম।
উনি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললেন
— দুপুর পর্যন্ত ওয়েট করে তোমাকে কল দিতাম। যদি বলতে আসবেনা তো চলে যেতাম।
আমি কিছু না কফির মগের দিকে তাকিয়ে রইলাম, আদ্রিয়ান এখোনো আমার হাতের ওপর ওনার হাত রেখে দিয়েছেন, আমার কাপুনি ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে, শরীর ঘামছে হালকা। আমি চেয়েও হাতটা সরিয়ে নিতে পারছিনা। আমাকে চুপ থাকতে দেখে উনি নিজেই বললেন
— বাই দা ওয়ে এতো লেইট করলে কেনো? সাজতে যে সময় নেও নি সেটা তোমার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
— না আসলে…
— আসবে কী আসবে না সেটা নিয়ে দ্বিধাবোধ করছিলে, এম আই রাইট?
আমি এবারেরও নিচু কন্ঠে জবাব দিলাম
— হুম
আমার কাপুনি থামছেই না আজকে। আদ্রিয়ান এবার হাতের ওপর একটু চাপ দিয়ে ধরে বললেন
— আর ইউ ফিলিং নারভাস?
আমি মাথা তুলে ওনার দিকে একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলাম। উনি হালকা হেসে বললেন
— এভাবে কাপছো আর ঘামছো কেনো? দেখো তোমার হাতের ঘামে আমার হাতও ভিজে যাচ্ছে।
আমি হাতটা সরাতে চেয়েও পারলাম না কারণ উনি শক্ত হয়ে ধরে রাখলেন। আমি সংকোচবোধ খানিকটা কাটিয়ে উঠে নিচের দিকে তাকিয়েই ওনাকে প্রশ্ন করলাম
— কেনো ডেকেছেন আমাকে?
— সেটাই তো জানিনা।
ওনার এইরকম উত্তর শুনে আমি একটু অবাক হয়ে ওনার দিকে একপলক তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে নিলাম। আদ্রিয়ান এখনো পর্যন্ত আমার হাতের ওপর ওনার হাতটা দিয়ে চেপে ধরে রেখেছে। আমার হাতের ঐ অংশটা ঘেমে গেছে বেশ বুঝতে পারছি, আমার এমন মনে হচ্ছে যেনো আমার হাতের ওপর কেউ বরফ রেখে দিয়েছে।
— এসেছোতো কিন্তু একটু পরে আবার যাই যাই করবে না তো?
আমি ভ্রু কুচকে ওনার দিকে তাকালাম। উনি মুচকি হেসে বললেন
— যেহেতু আজ তোমার আর কোনো কাজ নেই তো আজকে দিনটা তো আমাকে দেয়াই যায় তাই না?
আমি মাথা নিচু করে বললাম
— সারাদিন কী কফিশপে বসে থাকব নাকি?
আদ্রিয়ান হালকা হেসে একহাতে কফির মগে চুমুক দিয়ে বললেন
— তোমাকে সেটা নিয়ে ভাবতে হবেনা তুমি রাজি কী না বলো?
আমি ইতোস্তত করে বললাম
— কিন্তু অরু আর তীব্র?
— ওরাও থাকবে নো প্রবলেম।
— হুম
আদ্রিয়ান কফিতে আরেকটা চুমুক দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে বললেন
— কফিটা খাচ্ছোনা কেনো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে তো?
আমি এবার সংকোচ নিয়ে নিচু কন্ঠে বললাম
— আমার হাতটা তো ছাড়ুন ।
উনি আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন
— তোমার অসস্তি হচ্ছে?
— না মানে..
— না? তাহলে আর সমস্যা কী? তুমি কফি খাও।
কথাটা বলেই আবার কফি খাওয়ায় ব্যস্ত হয়ে গেলেন। আমি পুরো বোকার মতো তাকিয়ে আছি ওনার দিকে। এতো ভালো শেয়ানা। বাট হাত ধরে রেখে কী লাভ কে জানে? আদ্রিয়ানের দিকে তাকাতেই উনি চোখ দিয়ে ইশারা করে আমাকে কফি খেতে বললেন। আমি অসহায়ের মতো একহাত দিয়েই কফি খেতে শুরু করলাম। বেশ কিছুক্ষণ ধরেই দুজনে একেবারেই চুপ ছিলাম। হঠাৎ করেই উনি বললেন
— অনিমা?
ওনার এই হঠাৎ ডাক শুনে চমকে গেলাম। আমি হকচকিয়ে বলে উঠলাম
— জ্ জ্বী?
— আই ওন্না টেইল ইউ সামথিং..
ভ্রু অটোমেটিক্যালি কুচকে গেলো আমার, কী এমন বলতে চান উনি যে এভাবে জিজ্ঞেস করে নিচ্ছেন? জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম
— বলুন?
এরমধ্যেই অরু লম্বা লম্বা পা ফেলে এসে আমার পাশে মুখ ফুলিয়ে বসে পরল। আমি অার আদ্রিয়ান অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে একে ওপরের দিকে তাকিয়ে আবারো ওর দিকে তাকালাম। আমরা কিছু বলার আগেই প্রায় ছুটতে ছুটতে আশিস ভাইয়া এসে আদ্রিয়ানের পাশে বসে জোরে জোরে শ্বাস নিলো। আমি আর আদ্রিয়ান কিছুই বুঝতে পারছিনা তাই বোকার মতো ওদের দিকে তাকিয়ে আছি। আদ্রিয়ান ভ্রু কুচকে আশিস ভাইয়াকে বলল
— কী ব্যাপার বলতো দুইজন দুই মুডে দুই স্টাইলে একই জায়গা থেকে এলি?
আশিস ভাইয়া হাফাতে হাফাতে বললেন
— বাপরে বাপরে জীবণে এতো মেয়ে সামলেছি কিন্তু এরকম জিনিস প্রথমবার দেখলাম।
আদ্রিয়ান আশিসের মাথায় একটা চাটা মেরে বললেন
— ওই জিনিস কী হ্যা? ডু রেসপেক্ট।
আশিস ভাইয়া মাথায় হাত ঘষতে ঘষতে মুখ ফুলিয়ে বসে রইলেন। আদ্রিয়ান অরুর দিকে তাকিয়ে বললেন
— এই গাধাটা কী করেছে তোমার সাথে?
অরু মাথা নিচু করে বলল
— নাহ ভাইয়া কিছু করেনি।
— ওকে আমি খুব ভালোকরে চিনি। নিশ্চয়ই অনেক জালিয়েছে তোমাকে?
অরু আশিস ভাইয়ার দিকে বিরক্তিকর দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে মাথা নিচু করে ফেলল। আদ্রিয়ান কিছু বলবে তার আগেই তীব্র আর আদিব ভাইয়া এসে পরলেন। আদিব ভাইয়া বসতে বসতে বললেন
— সরি গাইস লেট হয়ে গেলো আস..
টেবিলের দিকে তাকিয়ে ওনার কথা থেমে গেলো। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন টেবিলের দিকে। ওনার এইরকম দৃষ্টির মানে কেউ বুঝতে পারলোনা তাই সবাই ওনার দৃষ্টি অনুসরণ করে টেবিলে তাকালেন। সকলেই তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলো অরু তো চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। আমিও ওদের এইরকম দৃষ্টি দেখে ভ্রু কুচকে টেবিলের দিকে তাকাতেই এদের এইরকম চাহনীর রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারলাম। আসলে আদ্রিয়ান এখনো আমার হাতের ওপর ওনার হাত দিয়ে রেখেছেন। আদ্রিয়ান দিকে তাকিয়ে বুঝলাম উনি এতোক্ষণে খেয়াল করলেন ব্যাপারটা। আর খেয়াল করতেই হাত সরিয়ে নিলো। আমিও টেবিল থেকে হাত নামিয়ে মাথা নিচু করে ফেললাম। আমাদের কান্ড দেখে সবাই মিটমিটিয়ে হাসছে। আদিব ভাইয়া হাসি থামিয়ে বলল
— আরে আরে হাত সরালি কেনো? আমরা কেউ কিচ্ছু মনে করিনি এম আই রাইট গাইস?
সবগুলোতেই আমাদের পিঞ্চ করে একসাথে বলল
— ইয়াহ।
আমার বেশ লজ্জা লাগছে এই মুহূর্তে। সাথে খানিকটা রাগও লাগছে আদ্রিয়ানের ওপর, তখন বললাম হাতটা ছাড়তে কিন্তু ছাড়লেননা। তখন ছাড়লে এমন পরিস্হিতে পরতে হতো? আদ্রিয়ান এবার বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন
— মজা নেওয়া শেষ? নাকি আরো চলবে?
সকলেই এবার চুপ হয়ে রইলো। আমি এবার সকলের দিকে তাকিয়ে বললাম
— বাট আপনারা কোথায় গিয়েছিলেন বলুনতো আমাদের একা রেখে?
আশিস ভাইয়া কফি মগ ঘোরাতে ঘোরাতে বললেন
— একা না রেখে গেলে একান্তে কথা হতো কীকরে?
এটা শুনে আমি অবাক হয়ে বললাম
— মানে?
আদ্রিয়ান কফির মগটা রেখে রাগী চোখে তাকালো আশিস ভাইয়ার দিকে। আদিব ভাইয়া বলল
— ওকে গাইস অনেক্ষণতো হলো কফিশপে এবার অন্যকোথাও যাই?
আশিস ভাইয়া ভ্রু কুচকে বললেন
— যাবো তো ভালো কথা কিন্তু এই রকস্টারকে নিয়ে পাবলিক প্লেসে বের হবো কীকরে?
এটা শুনে আদিব ভাইয়া একটা বাকা হাসি দিয়ে আদ্রিয়ান এর দিকে তাকালেন। আদ্রিয়ান মুচকি হেসে টিশার্ট থেকে সানগ্লাসটা চোখে পড়লেন আর কালো রং এর একটা ক্যাপ মাথায় পরে নিলেন। আমিতো হা করে তাকিয়ে আছি একেতো এখন চেনাই যাচ্ছেনা। এক্কেবারে গভীরভাবে লক্ষ্য না করলে কেউ বুঝতেই পারবেনা যে এটাই আদ্রিয়ান। আদিব ভাইয়া মুচকি হেসে আমাদের দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচালেন অর্থাৎ ‘কেমন দিলাম’? তীব্র আর অরু ইশারাতেই বললো ‘ওয়াহ ভাই ওয়াহ’। এরপর সবাই মিলে বেরিয়ে একটা লেকপার্কে ঢুকলাম। বিশাল বড় পার্ক এটা। বিশাল লেকের পাশ দিয়ে যাওয়া রাস্তা দিয়ে আমরা বিভিন্ন কথা বলতে বলতে হাটছি। হঠাৎ করেই আদ্রিয়ান আমার হাত ধরে আমাকে থামিয়ে দিলেন। আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই আমার ইশারা করে চুপ থাকতে বললেন। আর হাত ধরে টেনে অন্যদিকে নিয়ে গেলেন। একটা নিড়িবিলি সাইডে এনে আমাকে দাড় করাতেই আমি বেশ অবাক হয়ে ভ্রু কুচকে বললাম
— এটা কী হলো?
আদ্রিয়ান ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে ক্যাপ ঠিক করতে করতে বললেন
— কী হলো?
আমি হাত ভাজ করে বললাম
— ওদেরকে ছেড়ে আমরা এখানে কেনো এলাম?
— ওরা ওদের মতো গল্প করে করুকনা আমরা আমাদের মতো করে সময় কাটাই।
— মানে?
— আরেহ চলো তো।
বলে আমার হাত ধরে হাটা দিলো, আমার হাত ধরে লেকের পাশ দিয়ে চুপচাপ হেটে যাচ্ছেন উনি। উনার দৃষ্টি চারপাশের পরিবেশে আর আমার দৃষ্টি ওনার দিকে আর আমার সেই হাতটার দিকে যেটা উনি ধরে রেখেছেন। হালকা ফুরফুরে বাতাস বইছে চারপাশ দিয়ে। বেশ কিছুক্ষণ হাটার পর লেকের একপাশে সুন্দর করে বসার জায়গা বানানো হয়েছে সেদিকে ইশারা করে আদ্রিয়ান বললেন
— চলো ওখানে গিয়ে বসি।
আমি কিছু না বলে শুধু মাথা নাড়লাম। উনি আমার হাত ধরেই আমাকে নিয়ে লেকের পাশে বসলেন। দুজনের দৃষ্টিই লেকের পানির দিকে। বেশ কিছুক্ষণ সময় চুপচাপ বসে থাকার পর। হঠাৎ পেছন দিয়ে একটা লোক বুটভাজা বিক্রি করতে করতে যাচ্ছে। আদ্রিয়ান একবার পেছনে ঘুরে তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন
— বুটভাজা খাবে?
আমি বেশ অবাক হয়ে বললাম
— আপনি খান এসব?
— কেনো? এগুলো কী মানুষ খায়না?
— না মানে…
আমাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে লোকটাকে উদ্দেশ্য করে বললেন
— চাচা?
লোকটা আমাদের দিকে এগিয়ে এসে বললেন
— জ্বে সাহেব?
— কী সাহেব, বাবু বলে ডাকো বলোতো? একটু বাবা, মানিক বলেও তো ডাকতে পারো?
আমি বেশ অবাক হয়ে তাকালাম আদ্রিয়ানের দিকে লোকটাও যে বেশ অবাক হয়েছে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আদ্রিয়ান সেদিকে পাত্তা না দিয়ে বললেন
— এক প্যাকেট বুড ভাজা দাওতো!
লোকটা বুড ভাজা রেডি করে কাগজে নিয়ে আদ্রিয়ানের হাতে দিতেই আদ্রিয়ান প্যাকেট টা আমার হাতে দিয়ে লোকটাকে জিজ্ঞেস করলেন
— কতো হয়েছে চাচা?
— দশ টেহা।
আদ্রিয়ান মানিব্যাগ বের করে সেটা থেকে পাচশ টাকার একটা নোট বের করে লোকটাকে দিলেন, লোকটা নোটটা দেখে বললেন
— এতো টেহা তো ভাঙতি নাই আমার কাছে।
— ভাঙতি তো আমার কাছেও নেই চাচা। কী আর করার তুমি পুরোটাই রেখে দাও।
— না বাবা এতো টেহা কেমনে নেই?
— দেখো আমি ফ্রিতে কিছু খাইনা। আর আমার কাছেও চেন্জ আই মিন ভাঙতি
নেই তাই ওটাই নিয়ে যাও।
আমি অবাক হয়েই আদ্রিয়ানকে দেখছি। অসাধারণের মধ্যেও যে এমন অনন্য সাধারণ সত্তা লুকিয়ে থাকতে পারে সেটা ওকে না দেখলে বুঝতাম না। আদ্রিয়ান লোকটাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে টাকাটা দিয়ে পাঠিয়ে দিলো। আমি ততোক্ষণে প্যাকেট খুলে খাওয়া শুরু করে দিয়েছি। আদ্রিয়ানও প্যাকেট থেকে নিয়ে খাওয়া শুরু করলো। দুজনেই চুপচাপ বুটভাজা খাচ্ছি, এক অদ্ভুত নিরবতা কাজ করছে দুজনের মধ্যে। বেশ কিছুক্ষণ পর আমি নিজেই বললাম
— আপনি কিন্তু এখোনো বললেননা কেনো ডেকেছেন।
আদ্রিয়ান সামনের দিকে তাকিয়েই বুট চিবোতে চিবোতে বললেন
— বললাম তো নিজেও জানিনা। এক অদ্ভুত মায়া আছে তোমার মধ্যে। একরাতেই সেই মায়ায় জরিয়ে গেছি জানো? ঐরাতের পর থেকে শুধু তোমার কথাই মনে পরে। সেদিন রাত তিনটে বাজে তোমাকে শুধু ধন্যবাদ দিতে ফোন করিনি তোমার গলার আওয়াজ শোনার জন্যে ফোন করেছিলাম।
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে উনি এবার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন
— জানিনা কেনো তোমার ঐ ভীতু চেহারা, হটাৎ করেই হেসে দেওয়া, অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকা সব কিছুই খুব মনে পরছিলো। কিছু তো একটা আছে তোমার মধ্যে যেটা আমি ভূলতে পারছিনা। আই্ আই এম সার্টিং টু মিস ইউ ইয়ার।
আমি পুরো থ হয়ে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে উনি আমাকে মিস করছিলেন? কিন্তু কেনো? কী চলছে ওনার মনে? উনি মুচকি হেসে ভ্রু নাচিয়ে বললেন
— কী ভাবছো?
আমি কোনোরকমে মাথা নাড়লাম অর্থাৎ কিছু না। কিন্তু ওনার বলা কথাগুলো শুনে যে আমার হার্টবিট কতোটা বেড়ে গেছে সেটা আমিই জানি, এখন ওনার পাশে বসতেও আনইজি লাগছে আমার। উনি হয়তো আমার অবস্হাটা বুঝতে পারলেন তাই বললেন
— যাওয়া যাক ওরা খুজছে নিশ্চই?
— হুম।
বলে দুজনেই ওদের কাছে চলে গেলাম। আমাদের দেখে ওরা পিঞ্চ মেরে কিছু কথাও বলল কিন্তু আমার মন নেই সেদিকে আমিতো শুধু আদ্রিয়ানের বলা কথাগুলো ভাবছি। এরপর ওখানেই সবাই মিলে দুপুরের লাঞ্চ সেরে ফিরে এলাম। আসার সময় আদ্রিয়ান শুধু কানের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বললেন
— রাতে ফোন করব ঘুমিয়ে পরো না ঠিকাছে?
সেটা শুনে আমি শুধু একপলক তাকিয়েছিলাম ওনার দিকে কিন্তু কিছু বলিনি। তবে বুকের ধুকপুকানি আরো তীব্র হয়েছিলো।

কলমে লাস্ট মার্ক টেনে ডাইরিটা বন্ধ করে একটা শ্বাস নিলো অনিমা। তিনদিন ধরে ডাইরী লেখা হয়নি কারণ আগের ডাইরিটা শেষ হয়ে গেছে নতুন ডাইরী আজকে কিনে এনেছে আদ্রিয়ানের সাথে দেখা করে আসার সময়। গত তিনদিনে ঘটা বিশেষ ঘটনাগুলো লিখে রাখল ডাইরীতে। এটা ওর অভ্যাস প্রতিদিনকার বিশেষ ঘটনাগুলো ও ডাইরীর পাতায় আটকে রাখে, এতেই এক অদ্ভুত শান্তি পায়, হালকা লাগে নিজেকে। ডাইরীটা টেবিলে রেখে মুচকি হেসে আদ্রিয়ানের ফোনের ওয়েট করতে লাগল অনিমা। কেনো করছে সেটা ও জানেনা তবে করছে, এক মধুর অপেক্ষা। যেই অপেক্ষায় বিরক্তি নেই, ক্লান্তি আছে শুধু শান্তি আর একরাশ ভালোলাগা।

প্রচুর নেশা করে রুমের সবকিছু ভেঙ্গে তচনছ করে ফেলছে রিক। তার মাথায় আগুন জ্বলছে। তীব্রতর আগুন। কিছুতেই সেই আগুনকে নেভাতে পারছেনা সে। তার ইশারায় এতো এতো বড় বড় মাথা চলে আর সেখানে একটা সামান্য মেয়েকে হাতের মুঠোয় আনতে পারছেনা সে? এটা মানার মতো নয় মানা যায় না এটা। ঐ মেয়েকে হাতে পেলে ও এমন শিক্ষা দেবে যে ওর কাছ থেকে পালানোর চিন্তা করলেও রুহু কেপে উঠবে মেয়েটার। এসব ভেবেই বিছানার সাথে হেলান দিয়ে বসে কাচের বোতলটা হাতের মুঠোয় নিয়ে চাপ দিয়ে ধরল রিক। গরগর করে পরতে থাকা রক্তের দিকে তাকিয়ে বলল
— যতো খুশি উড়ে নাও বেইবি। কারণ আবারও খাচায় বন্দি হবার সময় এসে গেছে তোমার। আমি খুব শিঘ্রই তোমাকে বলব ‘ওয়েলকাম ব্যাক টু মাই হেল সুইটহার্ট’। এতো বড় বুকের পাটা এখনো কারো হয়নি যে আমার হাত থেকে তোমাকে বাচাবে। কারো হয়নি ! কারোর না।
#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here