মালিনী পর্ব ১৪+১৫+১৬

0
801

# “মালিনী পর্ব ১৪+১৫+১৬

#(নূর নাফিসা)

ফরহাদ বাথরুম থেকে বেরিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এলো। নিজেকে একটু দেখলো ঠিকঠাক আছে কি-না অত:পর বেরিয়ে যাওয়ার জন্য দরজার দিকে যেতেই মলি সাহস করে পথ আটকালো। ফরহাদ মলির হাত থেকে ফোন নিয়ে তাকে সরাতে গেলেও পারলো না। মলি দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে স্থির হয়ে দাড়িয়ে আছে। ফরহাদ বিরক্তি নিয়ে তার দিকে তাকালে সে ফরহাদের কাছে এসে নিজ হাতেই প্যান্টের পকেট থেকে চেইনটা বের করলো। ফরহাদ কিছুই বলছে না শুধু চুপচাপ দাড়িয়ে আছে। মলি কাপা কাপা হাতে ফরহাদের হাত ধরে চেইনটা দিলো পড়িয়ে দেওয়ার জন্য। অত:পর ঘাড়ের চুল সরিয়ে দরজার দিকে ঘুরে দাড়ালো। চোখ বন্ধ করে অপেক্ষায় আছে ফরহাদ কখন চেইন পড়িয়ে দিবে কিন্তু কোনো সাড়া পাচ্ছে না সে! সে কি দিবেনা পড়িয়ে! না দিলে নাই! সেও নড়বে না দরজার সামনে থেকে। হঠাৎ মনে হলো ফরহাদ কারো সাথে কথা বলছে। মলি চোখ খুলে পেছনে তাকিয়ে ফরহাদকে পেলো না। পরক্ষণে দেখলো বারান্দায় দাড়িয়ে ফোনে কথা বলছে। এতোক্ষণ ধরে অযথা দাড়িয়ে ছিলো মলি! চোখের পানি ভালোভাবে মুছতে মুছতে সেও বারান্দায় এলো। রুমের দরজাটাও লাগিয়ে দিলো। ফরহাদের পাশে দাড়াতেই ফরহাদ তাকে দেখে চোখ পাকালো এবং খুব দ্রুত ঠেলে নিজের দেহ ধারা দরজায় চেপে রাখলো। এমন কান্ডে হতম্বর মলি! এভাবে ধাক্কানোর মানে কি! দরজা খোলা থাকলে তো নিশ্চিত আজ হসপিটালে চলে যেতো সে! এভাবে ফ্লোরে পড়লে মাথাতো দুভাগ হয়ে যেতো! ফরহাদ মলিকে চেপে রেখেই বিরক্তি দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে আর ফোনে কথা বলেই যাচ্ছে। এভাবে আটকে রাখার কারণ ও ছাতামাথা কিছুই বুঝতে পারছে না মলি। শুধু এটা বুঝতে পেরেছে যে ফরহাদ অফিসের বিষয়াদি নিয়ে কথা বলছে কারো সাথে। কথা বলা শেষ হতেই পকেটে ফোন রাখতে রাখতে বললো,
– মাথা কি এখন পুরোটাই নষ্ট হয়ে গেছে? নিচে থেকে যে বারান্দা দেখা যায় সেটা কি জানা নেই! বাড়িতে এতো লোকজন আজ, আর কেউ এখন দেখলে কি হতো!
ইশশ! একটুও মনে ছিলো না লোকজনের কথা! তাহলে কি আর হুট করেই এখানে এসে পড়তো! অপরাধী দৃষ্টিতে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো মলি। দরজা খোলার জন্য এক হাত পেছনের দিকে নেওয়ার চেষ্টা করতেই ফরহাদ তার হাত ধরে ফেললো। হাতটা উপরে তুলে দরজায় চেপে রাখলো। অন্যহাত শাড়ির নিচে গমন করে পিঠে অবস্থান করলো। একটু নিচু হতেই ঠোঁট জোড়া স্থিরভাবে বসে পড়লো মলির কপালে। চোখ বন্ধ করে কিছু অনুভব করছে মলি। কিন্তু সেটা কি! এই অনুভূতিটার নাম তার অজানা। এতো ভালো লাগছে কেন এভাবে থাকতে! একটুও ভয় লাগছে না এখন পাশে দাড়িয়ে থাকা মানুষটিকে। সব ভুলে এখন মুহুর্তটা উপভোগ করছে মলি।
হঠাৎ করেই কোন এক শব্দ শুনা গেলো। রুমের মেইন দরজায় কেউ জোরে জোরে থাপ্পড় দিচ্ছে যার ফলে শব্দ এ পর্যন্ত চলে এসেছে। ফরহাদ দ্রুত চেইনটা পড়িয়ে দিতে দিতে বিড়বিড় করে বললো,
– অযথা সময় নষ্ট করা যেন একটা স্বভাব!
পড়ানো শেষ হতেই চেইনের উপর গলায় একটা চুমু দিয়ে দ্রুত দরজা খুলে ধাক্কা দিয়ে মলিকে সহ রুমে এলো সে। মলিকে বাথরুমে রেখে দরজা খুলে দেখলো জেনিফা।
– কি করছিলে তুমি! কখন থেকে ডাকছি!
– অফিসের একটা ইম্পর্ট্যান্ট কাজ ছিলো। কথা বলছিলাম। তুমি যাও আমি আর দুমিনিট পরেই আসছি।
– তাহলে আমিও থাকি তোমার সাথে।
– আমি কনফারেন্সে কথা বলছি।
– ওহ, আচ্ছা। এসো তাহলে। তোমার ফ্রেন্ডরা বসে আছে।
– হুম, যাও।
জেনিফা চলে গেলো আর এদিকে মলিকে বের করে দিলো রুম থেকে। মলি সিড়ি দিয়ে নেমে আসছিলো হঠাৎ করেই কিছু মনে হলো ফরহাদের! সে দ্রুত দরজা লাগিয়ে এক প্রকার দৌড়েই নিচে নেমে এলো। মলি মাত্রই নিচ তলায় পা রেখেছে। ফরহাদ পাশ দিয়ে যেতে যেতে বললো, “ফিতা বাধো”। মলি চমকে উঠলো! ফিতা না বেধেই চলে এসেছে! লোক হাসানোর ব্যবস্থা হয়ে যেতো এখন! মলি আঁচল টেনে পিঠ ঢেকে আবার দোতলায় চলে এলো। ফিতা বেধে নিচে নেমে এলো। ঘরে বাইরে উভয় জায়গায়ই মেহমান আছে এখন। ফরহাদ সোফায় বসে তার ফ্রেন্ডদের সাথে কথা বলছিলো সাথে জেনিফাও আছে। জেনিফা মলিকে ডাকলে মলি গেলো তার কাছে। পানির জগটা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো, ” কিচেন থেকে পানি নিয়ে আয়।”
মলি বাধ্য হয়ে কিচেনে গেলো এবং পানি নিয়ে এলো। এই মুহূর্তে ফরহাদের মুখে তাকানোর সাহস নেই তার। কি করবে সে! এখন মুখের উপর না করে দিলে সেটা বেয়াদবি হতো। এক জগ পানিই তো আনতে বলেছে। তাছাড়া তাদের দুই বোনের যেই মুখ, যার তার সামনে অপমান করা শুরু করবে। এরই মাঝে ফরহাদ বলে উঠলো,
– মলি, মা মনে হয় তোমাকে খুজেছিলো কিছুক্ষণ আগে। দেখা করেছো?
– না। যাচ্ছি।
মলি চলে যাচ্ছে। এমন সময় তার কানে ভেসে আসলো ফরহাদের কণ্ঠে,
– জেনিফা, খাবারের ব্যবস্থা করো তাদের।
– ব্যবস্থা তো করাই আছে বাইরে।
– বাইরে লোকজন বেশি। তুমি যেহেতু আছো আমার ফ্রেন্ডদের আপ্যায়ন এখানেই ভালো হবে। কিচেনে আছে, নিয়ে এসো।
– আচ্ছা, দেখছি কাউকে বলে।
– বলতে হবে না কাউকে। তুমিই যাও। ভাবি মনে হয় আছে সেখানে। হেল্প করতে পারবে তোমাকে।
জেনিফা চলে গেলো কিচেনের দিকে। সেখানে গিয়ে ঘ্যানঘ্যান করতে লাগলো জেরিনের সাথে, যাতে জেরিন নিয়ে যায় তাদের খাবার দাবার! অত:পর দুজনেই কাজ সাড়লো। শুধু ফরহাদের বন্ধুবান্ধব না, ফারদিনের বন্ধুও ডেকে এনে বসালো ফরহাদ। দু বোনকে খাটাতে পেরে এবার ভালো লাগছে তার কাছে!
ফাহিমার কাছে যেতেই মলিকে খাওয়ার জন্য বসালো ফাহিমা। তারা দুজনেই একসাথে রুমে খেয়েছে সাথে ফাহিমার পরিচিত দুজন মহিলা। তিনি তাদের কাছে মলিকে মেয়ের মতোই পরিচিত করেছেন। অবসর সময় কাটায় এই মেয়েটাকে সাথে নিয়ে, খেতে খেতে আরও নানান গল্প। জিহানের কেক কাটার সময় এ পরিবারের সবাই একসাথে জড়ো ছিলো শুধু মলি পিছনে। ফরহাদের একটু মন খারাপ হলেও জিহানের সাথে আনন্দটা মিস করেনি। সবাইকে কেক খাওয়ানো হলে জিহানের কানে কানেই কিছু বলে দিলো ফরহাদ। অত:পর জিহান এক টুকরো কেক এনে মলির কাছে এলো। বারবার নিচু হতে বলছে কিন্তু মলির খুব অসস্তি লাগছে। সে আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো বাকিরা নিজেরা অন্যজনকে নিয়ে ব্যস্ত তাই দ্রুত নিচু হয়ে কেক মুখে নিলো এবং জিহানের মুখে একটু ভেঙে দিলো। জিহান আবার তার বন্ধুদের কাছে চলে গেলো দুষ্টুমি করতে। মলির পাশেই এক পিচ্চি লাফালাফি করছে বেলুন নেওয়ার জন্য। মলি বললো,
– এইটুকু হয়েই এতো উঁচুতে বেলুন ধরতে চাও! দাড়াও আমি নিয়ে দিচ্ছি।
মলি চেষ্টা করলো তাও যেন নাগালের বাইরে। তবুও পা উচু করে চেষ্টা করছে। হঠাৎ পেটে পড়লো এক চিমটি! “আহ!” শব্দ করে সে পাশে তাকিয়ে দেখলো ফরহাদ দাড়িয়ে। মলির চোখের কোটরে পানি ছলছল করছে, কেননা ব্যাথা পেয়েছে খুব। হাত উপরে উঠে যাওয়ায় একটু পেট দেখা গিয়েছে তাই বলে এভাবে চিমটি দিবে! মলি শাড়ি ঠিক করে একটু একটু মালিশ করতে লাগলো। ফরহাদ বুঝতে পেরেছে, ব্যাথাটা একটু বেশিই লেগেছে। সে বেলুন নিয়ে বাচ্চাটির হাতে দিতেই বাচ্চাটি চলে গেলো। অত:পর খুব সাবধানে মলির পেটে হাত রাখলো ক্ষত জায়গায়। কেউ দেখবে ভেবে মলি হাত সরিয়ে দিলো। ফরহাদকে কেউ ডাকতেই সে জবাব দিলো “আসছি।” এদিকে যেতে যেতে আবার মলিকে বলে গেলো, “কাল চলে যাবো, আমি।”
কথা বলে আর উত্তরের কোনো সময় দিলো না। সে তার বন্ধুবান্ধবদের সাথে বেরিয়ে গেলো। মলি অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার যাওয়ার দিকে। এখন কি করবে সে! তাকে তো কিছু বলার সু্যোগও দিলো না!
মাত্র এই ক’দিনের সম্পর্কেই কেন জানি খুব সহজেই ফরহাদের ইঙ্গিতগুলো বুঝে যায় মলি। হয়তো বা ফরহাদের বলার ভঙ্গিটাই সহজে বুঝার মতো! ফরহাদ যে তাকে থেকে যাওয়ার জন্য বলে গেলো! ওদিকে বাবার অবস্থা বেশি ভালো দেখে আসেনি। মুহিত সকালে যায় আর রাতে ফিরে। বাড়িতে দুজন মহিলা আর কতদিকে সামলাবে! অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিলো থাকা যাবে না এখানে। এমনিতেই ভয়ে ভয়ে রাত দিন পাড় করে এবাড়িতে। তারউপর ওদিকে বেশি প্রয়োজন তার। তাই সে আর থাকলো না। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফাহিমা আন্টির কাছে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেলো।
বাবার সেবাযত্ন নিচ্ছে, ভাবির রান্নার কাজে সাহায্য করছে আবার ফাকে ফাকে কাথা নিয়েও বসছে। ইশার নামাজের পরপরই ফরহাদকে জানানোর জন্য কল করলো মলি। ফরহাদ রিসিভ করেই বললো,
– চলে গিয়েছো না তুমি?
– হ্যাঁ, মানে বা…
টুট টুট করে কেটে গেলো কল! বলতেই পারলো না আর কিছু! তিনি কি রাগ করলেন নাকি নেটওয়ার্ক এর প্রব্লেম এ কেটে গেলো বুঝতে পারছে না মলি। এরপর আবার কল করলো। ফরহাদ কেটে দিয়েছে। আবার করতেই দেখলো বন্ধ! ফরহাদ রাগ করেই কেটে দিয়েছে বুঝতে পেরে ব্যর্থতার নিশ্বাস ছাড়লো মলি।
পরেরদিন ও বাড়িতে গিয়ে ফরহাদকে দেখতে পেল না। চলেই গিয়েছে তাহলে।
মলি এখন আর সারাদিন কাটায় না ওবাড়িতে। শুধু সকাল বিকাল গিয়ে কাজ করে আসে। বাবাকে ক্লিনিকে নিয়ে যাচ্ছে, হসপিটালে ডাক্তারদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে। অন্যদিকে আবার টাকা পয়সার ব্যবস্থা চলছে। দিন যাচ্ছে আর ফরহাদের প্রতি টান বাড়ছে অথচ ফরহাদ পাশে নেই। সে বাড়িতে পা রাখলেই শুধু মনে হয় ফরহাদের দেখা পাবে। কিন্তু তা আর হয়ে উঠে না। নিজ বাড়িতে থাকাকালীন সংসারের টান, আর ওবাড়িতে থাকাকালীন ফরহাদের অভাব অনুভব! নিজেকে মনে করার সময় ও প্রচেষ্টা একদমই নেই তার। একমাস পেরিয়ে গেছে ফরহাদ বাসায় আসেনা। মলির উপর রাগ করেই সে ঢাকা ফিরে না, এটা মলির ভাবনা। কেননা সে দু সপ্তাহ পরপরই আসে বাড়িতে তাছাড়া ফাহিমা নিজ থেকেই মাঝেমাঝে ছেলেদের নিয়ে গল্প করে মলির সাথে। ফরহাদ বাসায় না আসার কারণ তিনিও সন্দেহ করেছেন কেউ হয়তো কিছু বলেছে যার ফলে ফরহাদ রাগ করে আছে। জেরিন ও ফারদিনকেই সন্দেহ করেন তিনি! হয়তো তাদের সাথে কোন ধরনের ঝগড়া হয়েছে যা তিনি জানেন না! কতবার কল করে বলে আসতে, কাজের অযুহাত দিয়ে ফিরে না সে।
এদিকে এমন কোন দিন বাদ যায়নি যে কল করেনি মলি। সবসময়ই শুধু ফোন বন্ধ পায়! আবার ফাহিমার কাছে মাঝে মাঝে শুনে ফোনে তিনি কথা বলেন। তাহলে সে বন্ধ পায় কেন! নিশ্চয়ই ফরহাদ ব্লক করে দিয়েছে এটা মলির সন্দেহ। কেউ রাগ করে যদি রাগ ভাঙানোর সুযোগই না দেয় তাহলে কিভাবে অবসান ঘটবে এই অভিমানের! সে কি আর কখনোই মলির সাথে যোগাযোগ করবে না! ভুলে গেছে নাকি তার বাগানের মালিনীকে! কিন্তু এই মালিনী যে তার মালিককে ভুলতে পারবে না কখনো! দুদিনের সম্পর্কটা যে অতি গহীনে চলে গেছে। এখন যে চাইলেও আর ভুলতে পারবে না তাকে! একবার এক পলকের জন্য তারই সন্ধান পেতে চায় মন। হয়তো ফরহাদের অভিমানটাই মলির হৃদয়ে আরও বেশি যন্ত্রণা ও উথালপাতালের সৃষ্টি করে দিয়েছে! অজান্তেই ফরহাদ বসে গেছে মলির হৃদ মাঝারে। এটাই হয়তো বিয়ে নামক বন্ধনের এক অসীম শক্তি!


“মালিনী”
পর্ব- ১৫
(নূর নাফিসা)
.
.
অজান্তেই ফরহাদ বসে গেছে মলির হৃদ মাঝারে। এটাই হয়তো বিয়ে নামক বন্ধনের এক অসীম শক্তি!
সকালে বাগান পরিষ্কার করে পানি দিয়ে এসেছে মলি। এখন বিকেলে আবার যাচ্ছে। বাগানে পানি দিয়ে ফাহিমার সাথে দেখা করলো। তারপর বেরিয়ে আসার সময়ই দেখা পেলো তার অপেক্ষার মহারাজকে! গেইট দিয়ে বাড়ির দিকে আসছে! সে কখন এলো! সকালে তো দেখলো না! এখনও তো হাতে ব্যাগ ট্যাগ কিছুই নেই! তাহলে কি দুপুরে এসেছে! মলি আর সামনে পা বাড়ালো না। দরজার সামনেই দাড়িয়ে আছে। ফরহাদ তাকে দেখেছিলো একবার তারপর দৃষ্টি সরিয়ে না দেখার ভান করে ঘরে প্রবেশ করলো। মলি কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু ফরহাদ দ্রুত পাশ কাটিয়ে চলে গেলো! অবহেলাটা মোটেও পছন্দ হলো না মলির। যেভাবেই হোক কথা বলতে হবে তার সাথে। না হলে এই অভিমানের সমাপ্তি ঘটবে না কখনো! কিন্তু কিভাবে বলবে! এখন তো বিদায় নিয়ে চলে এলো ফাহিমার কাছে! কাল যদি আবার ফরহাদ চলে যায়! মলির মাথায় একটা উপায় এসে হোচট খেলো! সে দ্রুত ফাহিমার রুমের কাছে গিয়ে উঁকি দিয়ে বললো,
– আন্টি, ছোট সাহেব বলেছে কফি নিয়ে যেতে।
– ফরহাদ এসেছে বাইরে থেকে?
– হ্যাঁ, মাত্রই এলো।
– তুই যা, আমি বানিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।
– না, আপনি আবার দোতলায় যাবেন। আমার কাছে দিন, আমি দিয়ে আসি তারপর বাড়ি যাবো। বাগানে আরও কয়েকটা গাছ লাগিয়েছিলাম সেটাও বলবো ছোট সাহেবকে।
– আচ্ছা, তাহলে দাড়া।
ফাহিমা কিচেনে এলো পিছু পিছু মলিও। রান্না বসানোর জন্য জেরিনকেও ডাকলো ফাহিমা। কফি তৈরি হয়ে গেলে মলি কাপ নিয়ে দোতলায় এলো। দরজায় নক করতে যাবে এমনিই ফরহাদ বেরিয়ে এলো রুম থেকে। দরজা চাপিয়ে আবার চলে যাচ্ছে, মলি বললো,
– আপনার কফি।
ফরহাদ কোনো প্রতিক্রিয়াই জানালো না! হনহন করে নিচে নেমে গেলো। এই কফি এখন কি করবে! মলি নিজেই এখানে দাড়িয়ে চুমুক দিতে লাগলো কাপে। “ছি! কি বাজে স্বাদ! খায় কিভাবে এরা!” মলি কোনো উপায় না পেয়ে ফরহাদের রুমে এসে বাথরুমে ফেলে দিলো কফি। অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিলো আজ রাত থেকে যাবে এখানে। সে খালি কাপ নিয়ে নিচ তলায় চলে এলো। এখানে এসে দেখলো ফরহাদ জিহানের সাথে সোফায় বসে টিভি দেখছে আর কফি খাচ্ছে! এবার কি হবে! এখন যদি কেউ জিজ্ঞেস করে কে খেয়েছে তখন কি বলবে! ভয়ে ভয়ে মলি কিচেনে পা রাখলো। ফাহিমা জিজ্ঞেস করলো,
– কিরে কফি দেসনি ফরহাদকে?
এদিকে জেরিন বললো,
– রুম নম্বর ভুলে গিয়েছিস নাকি, যে কফি পৌছায়নি!
– না, মা..মানে কফি পড়ে গিয়েছিলো আমার হাত থেকে।
– কিহ! কাপট বুঝি শেষ করে দিয়েছিস! খেয়াল কোথায় থাকে তোর!
ফাহিমা একটু ধমকের সুরেই বললো,
– আহ, জেরিন চুপ করো তো! কাপ ওর হাতে দেখতে পাচ্ছো না। মলি তোর উপর পড়েনি তো আবার?
– না, আন্টি। আমি ঠিক আছি। এই যে কাপ। আমি ফ্লোর মুছে দিয়ে আসছি।
মলি বেরিয়ে এলো কিচেন থেকে সবার আগে গেলো মেইন দরজার দিকে। জুতা একটা পলিথিনে ভরে তার পার্সে এটে নিলো। অত:পর ফ্লোর মুছার জন্য একটা কাপড় নিয়ে দোতলায় চলে এলো। ফরহাদ হয়তোবা লক্ষ্য করছে আবার হয়তো বা লক্ষ্য করেনি! মলি দোতলায় এসে হাতের কাপড়টা ঢিল দিয়ে ছাদের সিড়ির দিকে ফেলে দিলো এবং দ্রুত ফরহাদের রুমে এসে দরজা চাপিয়ে রাখলো। বারান্দায় এসে দরজা আটকে এক কোনে দাড়িয়ে রইলো, যেদিকটাকে নিচ থেকে দেখা যাবে না সেদিকে দাড়ালো।
পার্সটা দেয়াল ঘেষে মেঝেতে রেখে বারান্দার গ্রিল ধরে দাড়িয়ে আছে মালিনী। কখনো তাকাচ্ছে বাগানে, কখনো গগনে আবার কখনো দৃষ্টি বরাবর যতদূর চোখ যায় ততদূরে! মালিনী হয়ে আছে আনমনা। সব মনই তো চায় একটু শান্তির খুঁজ! পায় কি আর তাহা সবাই! ভাগ্যেই যদি লিখা না থাকে সেই শান্তি আর সুখ! মিলবে কিভাবে তা! মন কখনো ছুটে চলেছে ফরহাদের দিকে আবার কখনো ছুটে চলেছে নিজ আশ্রমে।
মলি পার্সটা হাতে নিয়ে ফোন বের করলো। নীলিমার কাছে কল করে বলে দিলো আজ বাসায় ফিরবে না। পরক্ষণে উপভোগ করতে লাগলো গোধূলিবেলা! সূর্য ডুবে গেছে, পশ্চিমাকাশ টুকটুকে লাল হয়ে আছে। কানে ভেসে এলো মাগরিবের আজানের ধ্বনি। বাসায় থাকলে তো নামাজ আদায় করে নেওয়া যেতো। হঠাৎ দেখলো জানালা দিয়ে বারান্দায় আলো এসে পড়েছে। তারমানে কেউ ফরহাদের রুমে লাইট জ্বালিয়েছে। মলি একটু এগিয়ে জানালা দিয়ে রুমে উঁকি দিয়ে দেখলো ফরহাদ বাথরুমে ঢুকছে। সে কি এখন রুমে যাবে তা নিয়ে দ্বিধায় আছে! ফরহাদ বেরিয়ে এলে মনে হলো সে ওযু করে এসেছে। ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে টুপি টা হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। মলির আর আসা হলো না রুমে। বারান্দায়ই কাটছে তার সময়। কখনো দাড়িয়ে কিংবা কখনো এক কোনে গুটিসুটি মেরে বসে থেকে।
সন্ধ্যা কাটিয়ে রাতের প্রথমভাগে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিয়ে রুমে এসেছে ফরহাদ। দরজা লাগিয়ে ফোনে কথা বলতে বলতে বারান্দার দিকে এসে দেখলো দরজা আটকানো। টানলো কিন্তু খুলছে না। দরজায় দু-তিনবার থাপ্পড় দিতেই মলি জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে ফরহাদকে দেখতে পেলো। তারপর দরজা খুলে দিলো। ফরহাদ মলিকে দেখে বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকালো কিন্তু কিছু বললো না, কেননা ফোনে কথা বলছে সে। বারান্দায় আসতে যাবে আর এদিকে মলি তার পথ আটকাচ্ছে একসময়ে ফরহাদের করা কর্মের অনুসারে। ফরহাদ এপাশে যাচ্ছে তো মলি ওদিকেই চেপে পথ আটকাচ্ছে আবার ফরহাদ এদিকে যাচ্ছে তো মলি এদিকে চেপেই পথ আটকাচ্ছে। ফরহাদ শর্টকাটে কথা বলে তারাতাড়ি কথা শেষ করলো এখানে দাড়িয়ে থেকেই। ফোন রেখে সে মলির হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে নিলে মলি দ্রুত দরজার হাতল ধরে ফেললো। কেননা সে বুঝতে পেরেছে ফরহাদ এখন তাকে রুম থেকে বের করে দিবে! এদিকে ফরহাদ টানছে আর মলি সর্বশক্তি দিয়ে হাতল ধরে রেখেছে! ফরহাদ রেগে গিয়ে এবার দরজাসহ তাকে ঠেলে আবার বারান্দায় পাঠিয়ে ভেতর থেকে দরজা আটকে দিলো!
খুব কষ্ট লাগছে মলির! এতোটা অবহেলা কেন করছে সে! মলি জানালা দিয়েই বলতে লাগলো,
– এমন করছেন কেন আপনি? একটাবার কথা বলার সু্যোগ দিলে কি হয়! একবার তো শুনুন। সেদিনের জন্য আপনি রাগ করে আছেন। বাবার অবস্থা বেশি ভালো ছিলো না, তাই চলে গিয়েছিলাম। আমি অনুষ্ঠানেও আসতাম না, ফাহিমা আন্টি বারবার বলে দিয়েছে তাই বাধ্য হয়েছি আসতে। ভাইয়া তো বাড়িতে থাকে না, কখন কি হয়ে যায় কেউ বলতে পারবে সেটা! সবদিকে দৌড়াদৌড়ি তো আমাকেই করতে হয়। এমন অবস্থায় আমি কিভাবে থাকতাম এখানে!
ফরহাদ নিজের কাজ করেই যাচ্ছে। মলি আর কিছু বললো না, কেউ যদি ইচ্ছে করে না বুঝতে চায় তাহলে আর তাকে বলে কি হবে! কান্না করতে করতে মলি দেয়াল ঘেষে বসে পড়লো। যে কান্নার হচ্ছে না কোনো শব্দ, দু নয়নে শুধু বইছে বন্যা, ভেতরে হচ্ছে আর্তনাদ। কখনো কখনো এমন সময় আসে যখন তার নিজস্ব অনুভূতি সে নিজেই বুঝতে পারে না। কেন এমন লাগছে তার, জানে না সে। বারান্দায় অতিরিক্ত আলো পড়তেই তাকিয়ে দেখলো দরজা খুলে ফরহাদ এসেছে। মলি চোখ মুছতে মুছতে উঠে দাড়ালো ফরহাদ কাছে এসে বললো,
– একবার বলা গেলো না?
– সুযোগ দেয়া হয়নি আমাকে!
– কল করা গেলো না?
– করেছি, ফোন বন্ধ!
– একটা মেসেজ দেওয়া গেলো না?
– ফোন তো বন্ধ!
সব দোষ এখন নিজের, সেটা জেনেও ফরহাদ ইচ্ছে করেই এমনসব কথা বলছে যাতে মলি নিজেকে স্বাভাবিক করতে পারে। সে মলির দিকে তাকিয়ে কথা বললেও মলি নিচের দিকে তাকিয়েই জবাব দিচ্ছে। পরক্ষণে একটানে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে দু’হাতের বন্ধনে শক্ত করে চেপে ধরলো ফরহাদ। মলির ভেতরের সব কষ্ট এবার কান্না হয়ে বেরিয়ে এসেছে। শব্দ হচ্ছে একটু আধটু কিন্তু ফরহাদের দেহে মুখ লুকানো বিধায় সেটা অস্পষ্ট। নিরবে কাটলো কিছু সময়। ফরহাদ জিজ্ঞেস করলো,
– বাবা এখন কেমন আছে?
– ভালো না। অপারেশন করতে হবে।
– কত টাকা লাগবে?
– প্রায় পচিশ হাজারের মতো।
– টাকা আছে কিছু?
– হ্যাঁ। একটু টান আছে হয়ে যাবে ব্যবস্থা।
– জমা কত আছে?
– আছে অনেকটা।
– সেটাই তো জানতে চাচ্ছি!
কথা চাপা রাখতে দেখে ফরহাদ একটু তেজি কণ্ঠেই বললো কথাটা। মলিন সুরে মলি জবাব দিলো,
– দশ-বারো হাজারের মতো।
– এটা অনেকটা জমা আছে!
মলি আর কোনো কথা বললো না। ফরহাদ তাকে ছেড়ে দিয়ে বললো,
– গোসল কখন করেছো?
– দুপুরে।
– তাহলে হাতমুখ ধুয়ে নাও। আমি খাবার এনে দিচ্ছি।
– ক্ষুধা নেই আমার।
– ফরহাদ তার কথায় কান না দিয়ে বাইরে থেকে তালা দিয়ে বেরিয়ে গেলো। মলি হাতমুখ ধুয়ে এসে বসে আছে খাটের এক কোনে। ফরহাদ খাবার নিয়ে এলে খেয়ে নিলো। আজও তাকে সেই শাড়িটা পড়তে হলো। আজকের হুমকি ছিলো শাড়ি না পড়লে রুমে জায়গা হবে না! বিয়ের প্রায় দুমাস পর আজ আবার একসাথে রাত কাটলো তাদের।
ফরহাদের অভিমান ভাঙ্গাতে পেরে আজ সকালটা খুব মিষ্টি লাগছে মলির কাছে। আজ আর সেদিনের মতো গোমড়ামুখো হয়ে বসে নেই মলি, আজ তাকে খুশি মনে হচ্ছে। যদিও ফরহাদের সাথে ততটা ইজি হতে পারেনি, তবুও খুশি। আজ আর ফরহাদকে অসহ্য লাগছে না কিন্তু লজ্জা ও ভয় ঠিকই আছে।
সব দিক ঠিক থাকলেও এখন মাথায় চেপেছে অন্য ভয়, এখান থেকে বের হবে কিভাবে! যদি কারো সামনে ধরা পড়ে যায়! মলি রুম সম্পূর্ণ গুছিয়ে রেখেছে। ফরহাদ রুমে এলো হাতে কফি নিয়ে। রুমে ও বারান্দায় হেটে হেটে এক হাতে মোবাইল আর অন্য হাতে কাপ নিয়ে চুমুক দিয়ে যাচ্ছে। অর্ধেক কাপ শেষ করে সে কাপটা মলির হাতে ধরিয়ে দিলো। মলি কাপ হাতে নিয়ে বসে আছে। তাকে কি খাওয়ার জন্য দিলো নাকি বুঝতে পারছে না! তার সন্দেহ হচ্ছে তাকে খাওয়ার জন্যই দিয়েছে কিন্তু সে তো এটা খেতে পারবে না! তেতো স্বাদ এটার, সম্ভব না তার দ্বারা! ফরহাদ বারান্দায় দাড়িয়ে একটা কল করে রুমে এসে দেখলো মলি কফির কাপ নিয়ে বসে আছে। তা দেখে তেজি কণ্ঠে বললো,
– একটা বিড়ালকে দিলেও এতোক্ষণে চেটেপুটে শেষ করে ফেলতো!
মুখটা মলিন করে মলি বললো,
– কফি খেতে ভালো লাগে না আমার। মুখে দিলে কেমন যেন গা গুলিয়ে আসে!
– তো এতোক্ষণ বলা গেলো না! ঠান্ডা হলো কেন!
ফরহাদ কাপ নিয়ে এক চুমুকে পুরোটা শেষ করে টেবিলে রাখলো কাপ। কেমন যেন পচা পচা গন্ধ পাচ্ছে সে। কাল রাতেও পেয়েছিলো এখনও পাচ্ছে। মলিকে বললো,
– তোমার ব্যাগে কি আছে, পচা গন্ধ বের হচ্ছে কেন?
– আমার ব্যাগে! আমার ব্যাগে কিছু নেই। আপনার রুমেই পচা গন্ধ। আমিও পাচ্ছি।
– আমার রুমে তুমি আছো, তাহলে তোমার থেকেই পচা গন্ধ।
মলি চোখ ঘুরিয়ে শুধু তাকালো কিন্তু কিছু বললো না। ফরহাদ চেয়ার টেবিল সরিয়ে দেখতে লাগলো কিছু আছে কিনা! খাটের চিপে, আলমারি ও ড্রেসিং টেবিলের চিপেও দেখতে লাগলো কিন্তু কিছুই পাচ্ছে না। মলিও ঝাড়ু নিয়ে খাটের নিচে যথাসম্ভব নাড়াচাড়া করে দেখতে লাগলো কিছু মরেছে কিনা। ফরহাদ গন্ধটার অনুসন্ধান করে বারবার খাটের দিকেই পাচ্ছে। বেডসাইড টেবিলের দিকে এলেই এটা বেশি পায়। এইপাশে বিছানার আসবাবপত্র নেড়েচেড়ে দেখলো কিছুই নেই। তারপর টেবিলের ড্রয়ার খুলতেই নাক চেপে ধরে দাতে দাত চেপে বললো, “মালিনী!!!”
মলি তারাতাড়ি এদিকে এসে দেখলো সেই যে একটা বিরিয়ানির প্যাকেট রেখেছিলো এটা এখনও তার ড্রয়ারেই আছে! দেখে তার চোখ জোড়া দিগুন আকৃতির হয়ে গেলো!
😁
😁
😁
😁
😁
😁
😁
😁
😁
😁
😁
😁
😁
😁
😁
😁
“মালিনী”
পর্ব- ১৬
(নূর নাফিসা)
.
.
খাবার পচে বিশ্রী অবস্থা হয়ে আছে! ফরহাদ করুন দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে! মলির গলা শুকিয়ে আসছে। নিচের দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বললো,
– আমি তো ভেবেছিলাম আপনি খেয়ে নিবেন। সেটা যে স্পর্শও করেননি আমি কি জানি! সেদিনের পর তো আর রুমেও আসিনি!
– এমন মানুষকে তো খাবার দেওয়াই উচিত না! এই মুহুর্তে আমার ড্রয়ার পরিষ্কার দেখতে চাই। একটু দাগের চিহ্নবিহ্নও যেন না থাকে।
– এখন বাইরে যাবো কিভাবে, একটু পর যাই।
মলি ড্রয়ারটা লাগিয়ে রাখলো। একটু পরেই ডাক পড়লো বাইরে থেকে,
“ফরহাদ, আই’ম কামিং। তুমি কি ঘুমাচ্ছো নাকি? ফরহাদ?”
জেনিফার কণ্ঠ ভেসে এলো বাইরে থেকে! ফরহাদ ল্যাপটপে কাজ করছিলো। জেনিফার ডাক শুনে মলির দিকে একবার তাকালো। কিছু শুনতে পাচ্ছে না কিন্তু চেহারা দেখে বুঝতে পারছে মলি মনে মনে কিছু বলছে!
এদিকে মলি মনে মনে বলছে, “আসছে আরেক চামচিকা! যখনই ফরহাদ এবাড়িতে আসে তখনই হাজির হয়ে যায়! এমন নির্লজ্জ মেয়ে এই প্রথম দেখা! কই, এতোদিন তো একবার চুপিও দিলো না। বড় বোন হয়তো বার্তা পাঠিয়েছে তাই সকাল না হতেই হুড়হুড় করে চলে এসেছে!” এসব বকবক করতে করতে তার মনে ধরা দিলো আরেক ভয়! অন্য কেউ না এলেও তো এই মেয়ে রুমে ঢুকে যায়! যদি তাকে দেখে ফেলে তখন কি হবে! মলি ভয়ার্ত চোখে ফরহাদের দিকে তাকালো, কিন্তু দেখলো ফরহাদ কি নিশ্চিন্তে হেলান দিয়ে মলির দিকেই তাকিয়ে আছে! আর সেদিকে দরজায় ঢাকঢোল পিটিয়েই যাচ্ছে জেনিফা। মলিকে তাকাতে দেখে ফরহাদ ঠোঁটের এক কোনায় হাসি ফুটিয়ে বললো,
– জেনিফা এসেছো?
– হ্যাঁ, দরজা খুলো। কি করছো তুমি?
– ডান্স করছি।
জেনিফা হেসে বললো,
– আমাকেও নাও সাথে।
– আচ্ছা, তার আগে একটা কাজ করো। মলিকে একটু ডেকে নিয়ে আসো। জরুরী কাজ আছে।
– মলিকে কোথায় পাবো!
– একটু আগে দেখেছিলাম বাগানে। দেখো এখন ঘরে এসেছে কিনা, নাকি সেখানেই আছে।
– ওকে। দরজা খুলো।
– আগে ডেকে আনো, তারপর দরজা খুলছি।
জেনিফা চলে গেলো। ফরহাদ দরজা খুলে দিলো। কিছুক্ষণ পর জেনিফা ফিরে এসে দেখলো মলি ফরহাদের রুমেই আছে।
– এই মালিনী, কোথায় ছিলি তুই! আমি খুজে এলাম!
– ম্যাডাম, আমি তো ছাদে।
– ছাদে কেন?
– উপর থেকে বাগান দেখতে খুব সুন্দর দেখা যায়। তাই একটু দেখতে গিয়েছিলাম।
– কাজে ফাকি দেওয়ার ধান্ধা সব! ফরহাদ তুমি ডেকেছো কেন, তারাতাড়ি বিদায় করো এখান থেকে। আর শুনো আজকে কিন্তু আমাকে নিয়ে বেড়াতে যেতে হবে। অনেক দিন পর এসেছো তুমি।
– হুম, শিওর! তার আগে এক কাজ করো।
– কি?
– ড্রয়ারটা একটু খুলো।
– সাপ টাপ কিছু রাখোনি তো!
– নাহ!
জেনিফা ড্রয়ার খুলতেই নাক চেপে ধরে দু কদম পিছিয়ে এলো।
– ছি! কি পচা গন্ধ! ফরহাদ এসব কি! তুমি আমার সাথে এমন করতে পারো না!
– আমি আবার তোমার সাথে কেমন করলাম! আমি তো শুধু দেখাতে চাচ্ছিলাম যে, আমি কতটা নোংরা! দুমাস আগে খাবার রেখেছি, পচে শুকিয়ে দুর্গন্ধ ছরিয়েছে! তবুও কি তুমি আমাকে পছন্দ করো! কতো জ্বালাতন করবো আমি তোমাকে বিয়ের পর, ভাবতে পারছো জেনিফা! তখন তো তুমি এসব নিয়ে সারাক্ষণ ঝগড়া করবে আমার সাথে!
– একটুও ঝগড়া করবো না। দেখে নিও তুমি।
– পারবে সবকিছু সামলাতে?
– হুম। মালিনী এগুলো পরিষ্কার করে দে।
মলি ড্রয়ারের কাছে যেতে নিলে ফরহাদ বললো,
– দাড়াও মলি। জেনিফা, মনে করো তুমি এখন বিবাহিত। তাহলে তোমার আমার সব কাজ নিশ্চই তুমি করবে। সেখানে নিশ্চয়ই তৃতীয় কোন ব্যাক্তিকে ডাকবে না। রাইট?
– হুম।
– তাহলে একটু প্রমাণ করে দেখাও। বিয়ের পর তো রুমটা তোমার আমার হবে। তাহলে নিজের রুম পরিষ্কার করার দায়িত্ব তোমার। এখন করে দেখাও কেমন পারো। এটা বাইরে নিয়ে যাও এবং পরিষ্কার করে আনো।
– ফরহাদ, এটার বিশ্রী গন্ধ! আমি পারবো না।
– জেনিফা আমি কিন্তু কোনো কাজের লোক রাখবো না বলে দিচ্ছি। তারমানে অফিস ও ঘরের কাজ সব আমাকেই করতে হবে এইতো?
– না। আমিও কাজ করতে জানি।
জেনিফা এক হাতে নাক চেপে ধরে অন্যহাতে ড্রয়ার খুলে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। ফরহাদ পেছন থেকে বললো,
– সাবধানে পরিষ্কার করো। আবার আমার ড্রয়ার ফেলে দিয়ে এসো না!
ফরহাদ মলির দিকে তাকাতেই মলি মিটিমিটি হেসে দ্রুত বেরিয়ে এলো এবং জেনিফার পিছু পিছু নিচে নেমে এলো। জেনিফা বাইরে এসে কোনোমত ঝাড়ু দিয়ে ঝেড়ে পরিষ্কার করে নিলো ড্রয়ার। মলি চলে গেলো বাগানে পানি দেওয়ার জন্য। জেনিফা ড্রয়ার রেখে বাইরে কিছুক্ষণ হাটাহাটি করলো বিশুদ্ধ বায়ু গ্রহণের জন্য। মলি মিটিমিটি হাসছে আর বাগানে পানি দিচ্ছে। পানি দেওয়া শেষ হলে মলি এসে ড্রয়ারটা হাতে নিলো। জেনিফাও এসে বললো,
– মালিনী এটা রেখে আয় জায়গামতো। আমি আর পারবো না ধরতে। পেটের নাড়িভুড়ি উল্টে আসছে!
মলি ঝাড়ু আর কাঠি নিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে ভালোভাবে পরিষ্কার করলো। জেনিফা বললো,
– এতো ময়লা ফেললাম, এখনো ময়লা আছে! আস্ত একটা খাটাস ফরহাদ।
মলি ও জেনিফা দুজনেই ঘরে প্রবেশ করলো। এদিকে দেখলো ফরহাদ টেবিলে খেতে বসেছে। সেখান থেকেই ফরহাদ বললো,
– জেনিফা, এতোক্ষণ লাগলো তোমার এটা পরিষ্কার করতে! ঠিকমতো পরিষ্কার করেছো?
মলি জবাব দিলো,
– হ্যাঁ, ছোট সাহেব। একদম ঝকঝকে পরিষ্কার।
জেনিফা টেবিলের দিকে যেতে যেতে বললো,
– তুমি আর কথা বলো না। কি অবস্থা করেছো ড্রয়ারের।
– ক্লান্ত হয়ে গেছো নাকি! এসো, নাস্তা করো।
– না, করে এসেছি বাসা থেকে।
মলি জিজ্ঞেস করলো,
– ছোট সাহেব, এটা কি রেখে আসবো?
ফরহাদ বললো,
– যাও।
মলি দোতলায় চলে গেলো। জেনিফা চেয়ার টেনে বসে পানি খেতে লাগলো। জেরিন জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে। আর জেনিফা শুরু করে দিলো বকবক! এরই মাঝে ফরহাদ প্লেট নিয়ে উঠে বললো,
– দেখে আসি, মলি আবার আমার ড্রয়ার ভেঙে ফেলে কিনা!
জেনিফা হেসে বললো,
– হেটে হেটে খাবে নাকি তুমি!
– সে আর নতুন কি!
ফরহাদ চলে গেলো প্লেট নিয়ে আর তারা এখানেই বসে কথা বলতে লাগলো। ফরহাদ দোতলায় এসে দেখলো মলি ছাদে উঠার সিড়ির পাশে বসে ভেজা কাপড় দিয়ে ড্রয়ার মুছে দিচ্ছে। ফরহাদ পাশে এসে দাড়িয়ে বললো,
– বেশি ভালো, ভালো না।
মলিও তার কথার ভঙ্গি বুঝে গেছে। এ কথা বলার একটাই কারণ, ফরহাদ জানে ড্রয়ারটা মলিই পরিষ্কার করে এনেছে। মলি নিজের কাজ করতে করতে বললো,
– ভালো না হলে আপনার ড্রয়ার নোংরাই থেকে যেতো। তাছাড়া আমার ভুলের জন্য আপনি খাটাশ উপাধিতে ভূষিত হয়ে গেছেন।
মলি উঠে ড্রয়ার নিয়ে রুমে চলে গেলো। ফরহাদ পিছু পিছু এসে বললো,
– ওটা পড়ে লাগাও। এদিকে ঘুরে দাড়াও।
মলি কারণ বুঝতে না পেরে তার দিকে ঘুরে দাড়াতেই ফরহাদ এক লোকমা খাবার এগিয়ে ধরলো মলির মুখের সামনে। মলি হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ফরহাদের দিকে! চোখ তার ছলছল করছে! এমন কিছু সময়ও আসবে তার জীবনে সেটা ভাবেওনি কখনো! মুহূর্তেই যেন জগৎটা সুখ নামে পরিচিত হয়ে গেছে তার কাছে!
এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ফরহাদ বললো,
– হাওয়া খেয়ে কি পেট ভরে নাকি! সময় নেই আমার, নিচে যেতে হবে। হা করো।
মলি ওষ্ঠ জোড়া ফাক করে খাবার মুখে নিয়ে নিলো। দৃষ্টি তার ফরহাদের দিকেই আছে। দুচোখে বর্ষন হচ্ছে সুখের অশ্রু! ইচ্ছে করছে খাবারটা সারাজীবন মুখে রেখে দিতে। এতে যেন মিশে আছে অতৃপ্তিময় স্বাদ!
ফরহাদ তার মুখে লোকমা তুলে দিয়েই দরজার বাইরে এসে দাড়ালো। মলি চোখ মুছে ড্রয়ারটা হাতে নিলো। ফরহাদ আবার রুমে এসে বললো,
– এতোক্ষণ লাগে খাবার গিলতে! আমি কোনো বাচ্চাকে খাওয়াতে আসিনি!
মলির মুখে ফুটে উঠেছে মৃদু হাসি। সে খাবার চিবাতে চিবাতে ড্রয়ার লাগিয়ে দিলো। সোজা হয়ে দাড়াতেই ফরহাদ আরেক লোকমা সামনে ধরলো। মলি বললো,
– আপনি খেয়ে নিন।
– আমারটা দেইনি তোমাকে। তোমার রিজিক তুমি নিবে আর আমার রিজিক আমি। হা করো চুপচাপ। দশ সেকেন্ডে গিলবে।
মলি মুখে নিলো খাবার। ফরহাদ আবার দরজার পাশে এলো দেখতে কেউ আসে কিনা। প্লেটের সবটুকু খায়িয়ে দিয়ে সে নিচে নেমে এলো। মলি এখানে বসেই পানি খেয়ে নিলো। সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছে সে নিজের উপর! কেননা এখন যতটুকু কথা বলেছে ফরহাদের সাথে, একটু আটকায়নি। বরং খুব ভালো লেগেছে! অন্যান্য দিন তো তার সামনে কিছু উচ্চারণই করতে পারেনা!
মলি নিচ তলায় এসে দেখলো নেয়ামত উল্লাহ ও ফারদিন বেরিয়ে গেছে জিহানকে নিয়ে। ফরহাদ খাচ্ছে আর পাশে বসে আছে জেরিন, জেনিফা ও ফাহিমা। জেরিন বলছে,
– ফরহাদ বিয়ে করবে কবে? বয়স তো এখন তোমার পারফেক্ট।
– বুড়ো হলে।
সবাই হেসে উঠলো। জেরিনও হাসতে হাসতে বললো,
– আমি সিরিয়াসলি বলছি আর তুমি ফান করছো!
– কেন, তখন দিবে না তোমার বোনকে বিয়ে?
– ফরহাদ! ফানটা আপাতত অফ রাখো। জেনিফার কিন্তু অনার্স কমপ্লিট হয়ে গেছে। তাই বাবা বলেছিলো তোমাকে জিজ্ঞেস করতে।
– বাবাকে বলে দিও। এ বছর আর বিয়ে করছি না।
– গত তিন বছর ধরে একই উত্তর তোমার।
– আমি তো আমার সুবিধা অসুবিধা বুঝেই বলছি। তোমাদের এতো তাড়া কিসের। জেনিফা, তুমি কি রান্নাবান্নাসহ সকল কাজ করতে শিখে গেছো? বিয়ের পর কিন্তু এখানেই থাকতে হবে। মায়ের সেবাযত্ন নিবে। তা না পারলে তো আর যোগ্য বউ হতে পারলে না।
জেনিফা কিছু বলার আগে জেরিন বললো,
– এখন কি আর কেউ কাজ না করতে পারে! অন্তত ঘরের কাজকর্ম সব মেয়েরাই পারে।
ফরহাদ বললো, https://www.facebook.com/profile.php?id=100058759920318
– পারে কিনা উত্তরটা জেনিফার মুখ থেকেই শুনতে চাই।
জেনিফা মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,
– হ্যাঁ, পারবো না কেন। অনেক কিছুই জানা। আর যেগুলোতে একটু পিছিয়ে করতে করতে শিখে নেওয়া যাবে। কিন্তু ফরহাদ, তুমি ক?

প্রেমঘোর ২ , সব পর্বের লিংক
https://www.facebook.com/134546008438296/posts/290934329466129/?app=fbl

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here