#আর_একটিবার
#শোভা_আক্তার(লাভলী)
#পর্ব_২১
চাচীর মুখে ইর্তেজার নাম শুনে মাহাও তাকাল দরজার দিকে। ইর্তেজা শান্ত দৃষ্টিতে সায়ানের হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। মাহার বাহু সে চেপে ধরে রেখেছে। নিশ্চয়ই মাহা ব্যাথা পাচ্ছে। হ্যাঁ মাহা ব্যাথা পাচ্ছে। এটা মাহার চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছে। ইর্তেজার মাথা বিগড়ে হয়ে গেল। ধীরপায়ে হেটে এসে সায়ানের কাছ থেকে মাহাকে ছাড়াল। ইর্তেজা সায়ানের বাহু সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে চেপে ধরলো। সায়ান নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। ইর্তেজা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“তোর সাহস কি করে হলো আমার মাহাকে কষ্ট দেয়ার?”
মাহার চাচু দৌড়ে এসে ইর্তেজার কাছ থেকে সায়ানকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলো। সায়ানকে যত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে ইর্তেজা তাকে তত শক্ত করে ধরছে। মাহা চুপচাপ দেখছে। সে এখন কিছুই বলবে না। অনেক সহ্য করেছে আর না। মাহার চাচু কিছু বুঝতে না পেরে ইর্তেজার পেটে সজোরে ঘু*ষি মারলো। ইর্তেজা সায়ানকে ছেড়ে কিছুটা পিছিয়ে গেল। রাগী দৃষ্টিতে তাকাল মাহার চাচুর দিকে। মাহার চাচু ভয় পাচ্ছে। কারণ সে এর আগেও ইর্তেজার হাতে মা*র খেয়েছে মাহাকে থা*প্পড় মারার কারণে। সায়ান রাগী কন্ঠে বলল,
“এই সেই ছেলে যার সাথে মাহা পালিয়েছিল। কি নির্লজ্জ তোর ভাতিজি। যেই ছেলের সাথে নষ্টামি করেছে তাকেই আবার নিয়ে আসলো।”
মাহা হাত মুঠো শক্ত করে ফেলল। এমন বাজে অপবাদ তার উপর দেয়া হবে সে জানতো। ইর্তেজা মাথা আরো বিগড়ে গেল। সায়ান দিকে তাকিয়ে বলল,
“কি বললি তুই? কে নষ্টামি করেছে?”
সায়ান ভয় পেয়ে গেল। ইর্তেজা মাহার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আ..আমার মাহা নষ্টামি করেছে?”
ইর্তেজা মাথা কাজ করছে না। সায়ানের দিকে তাকাল। ইচ্ছে করছে সামনে থাকা মানুষটাকে মে*রে টুকরো করে ফেলতে। ইর্তেজা আয়মান খলিলের দিকে তাকিয়ে বলল,
“যখন আপনি জেনেছিলেন মাহা যাকে ভালোবাসে সে একজন দরিদ্র ছেলেকে ভালোবাসে আপনি তাকে মে*রে ধরে আমার কাছ থেকে কেঁড়ে নিয়েছেন। আর এখন নিজের বয়সী এক বুড়োর সাথে নিজের মেয়ের মতো ভাতিজির বিয়ে দিতে যাচ্ছিলেন? আপনার মতো খারাপ মানুষ আমি কাজ পর্যন্ত দেখিনি।”
সায়ান তেড়ে এসে ইর্তেজার কলার ধরে বলল,
“তুই বুড়ো কাকে বললি রে? যার পকেটে টাকা থাকে তার রূপ কে দেখতে যাবে? আর তোর কি মনে হয় এই চরিত্রহীন মেয়েকে আমি বিয়ে করবো? আমার মানসম্মান মাটিতে মেশানোর জন্য?”
ইর্তেজা আর নিজেকে সামলাতে পারলো না। সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে সায়ানকে সজোরে ধাক্কা মেরে দূর করলো। তেড়ে গিয়ে কলার ধরে ইচ্ছে মতো চেহারা থা*প্পড় মারতে লাগলো।
“তোর সাহস কি করে হলো আমার মাহাকে চরিত্রহীন বলার?”
আয়মান খলিল ভয়ে থামাতে যাচ্ছে না। সে গেলেই মা*র খাবে। এই বয়সে মা*র খাওয়ার ইচ্ছে তার নেই। সায়ানের নাক থেকে রক্ত ঝরছে। ইর্তেজার সেদিকে খেয়াল নেই। সে এলোপাথাড়ি ভাবে মে*রেই যাচ্ছে। মাহা ছুটে গেল। ইর্তেজাকে ধরে সে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু ইর্তেজার কান দিয়ে কথা যাচ্ছে না। তার মাথায় শুধু ঘুরছে মাহার উপর দেয়া অপবাদ গুলো। এক সময় ভুল করে ইর্তেজা মাহাকে ধাক্কা মে*রে দিলো। মাহা গিয়ে পরলো টেবিলের সাথে ধাক্কা লেগে টেবিলের উপর থাকা ফুলদানি পায়ের উপর পড়ে ভেঙ্গে গেল৷ পা কাটে নি। কিন্তু ফুলদানি পায়ে পরায় ব্যাথা পেয়েছে। মাহার চিৎকার করে ইর্তেজার হুঁশ ফিরলো। সে মাহার দিকে তাকাল। সায়ানকে ছেড়ে দৌড়ে গেল মাহার দিকে৷ মাহার চোখ বেয়ে পানি পরছে। ইর্তেজা দ্রুত মাটিতে বসে মাহার পা নিয়ে হাঁটুর উপর রাখলো। মাহার দিকে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,
“বেশি ব্যাথা লেগেছে পায়ে? মাফ করে দাও আমায় মাহা। আমি..আমি বুঝতে পারি নি।”
মাহা দ্রুত পা সরিয়ে বলল,
“থামো ইর্তেজা। পাগল হয়ে গেলে তুমি? কেন মা*রামা*রি করছো বলো তো।”
ইর্তেজা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সায়ানের দিকে তাকাল। সায়ান নাকে হাত দিয়ে সোফায় বসে ঘনঘন নিশ্বাস ফেলছে। ইর্তেজা মাহার দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোমার সম্পর্কে আর একটা বাজে কথা বললে ওকে মে*রে ফেলবো।”
“বলবে না, আর কিছু বলবে না। তুমি প্লিজ শান্ত হও।”
ইর্তেজা মাটির দিকে তাকিয়ে ঘনঘন নিশ্বাস ফেলছে। চাচী মাহার চাচুর দিকে তাকিয়ে বলল,
“তখন তোমাকে অনেক রিকুয়েষ্ট করেছিলাম। মেয়েটাকে যেতে দাও ইর্তেজার সাথে। তুমি শুনো নি। তোমার মনে হয়েচ্ছিল মাহা একটা গরীব ছেলেকে বিয়ে করলে তোমাদের পরিবারের খুব বদনাম হবে। আর এখন? তুমি তোমার বন্ধুর সাথে মাহার বিয়ে দিতে চেয়েছিলে। তোমার কি মনে হয় লোকে তোমার সম্পর্কে মন্দ কথা বলে নি? তোমার মুখের উপর না বললেও তোমার পিঠ পিছে বলেছে। তোমার প্রত্যেক পাপের শাস্তি আমাকে ভোগ করতে হয়েছে। আমার ১ বছরের সন্তানকে আমি হারিয়েছি তোমার পাপের কারণে।”
ইর্তেজা অবাক হয়ে চাচীর দিকে তাকাল। তারপর মাহার দিকে তাকাতেই মাহা বলল,
“রাইসা, আমার চাচাতো বোন। আমজাদ আর রাইসা জমজ হয়েছিল। অনেক ভালোবাসতাম রাইসাকে। ওদের এক বছরের জন্মদিন পালন করছিলাম আমরা। সেদিন অন্যান্য বাচ্চাদের সাথে খেলা করতে যেয়ে সিঁড়ি দিয়ে পড়ে যায় রাইসা। সাথে সাথে মৃ*ত্যু ঘটে ওর।”
বলেই মাহা মাথা করে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। চাচী চোখ মুছে বলল,
“আমার এক মেয়েকে তো হারিয়েছি। আমার আর এক মেয়ের জীবন নষ্ট করো না। তোমার সামনে হাতজোর করছি। ওকে এখন যেতে দাও।”
আয়মান খলিল কি বলছে ভেবে পাচ্ছে না। ইর্তেজা মাহার দিকে তাকিয়ে আছে। মাহা কি সত্যি যাবে তার সাথে? সে কি সত্যি মাহাকে পেতে চলেছে? সায়ান সোজা হয়ে বসে আয়মান খলিলের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোর ব্যবসায় আমি কোটি কোটি টাকা ভাসিয়েছি। যা বলবি ভেবেচিন্তে বলবি।”
আয়মান খলিল সাথে সাথে বলল,
“না, মাহা কোথাও যাবে না।”
ইর্তেজা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“টাকার জন্য নিজের ভাইয়ের মেয়েকে বিসর্জন দিতে চাচ্ছেন। কত টাকা দিয়েছে আপনাকে সে?”
সায়ান হেসে বলল,
“কেন রে ভিখারি! তুই আমাকে টাকা ফেরত দিবি?”
“আমার মাহা বাজারে থাকা কোনো জিনিস না যে, যে কেও এসে কিনে নিয়ে যাবে।”
ইর্তেজা রাগে গজগজ করছে। মাহার চোখ বেয়ে পানি পরলো। ইর্তেজা তাকে আজও এত ভালোবাসে? মাহা তাকাল ইর্তেজার দিকে। ভেবে নিয়েছে ইর্তেজাকে আর হারাতে দেবে না। মাহা চোখ মুছে সবার উদ্দেশ্যে বলল,
“আজ সিদ্ধান্ত নেবো আমি। আসছি এখনই।”
মাহা দ্রুত হেটে নিজের ঘরে গেল। সবাই তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। ইর্তেজা চাচীর দিকে তাকাল। চাচী ইর্তেজাকে এক নজর দেখে চোখের ইশারায় শান্ত থাকতে বলল। ইর্তেজার বুক কাঁপছে। মাহা কি ফিরবে না? মাহা ঘটে গিয়ে দেখে খাটের উপর আমজাদ ঘুমাচ্ছে। তাকে এক নজর দেখে আলমারির দিকে হেটে গেল। আলমারি খুলে সম্পত্তির কাগজ বের করলো। বাবা শেষ কথাগুলো মাথায় ভেসে উঠল। বাবা বলেছিল, “মাহা, যে কোনো বিপদ আসুক জীবনে। এই সম্পত্তির কাওকে দেবে না ওয়াদা করো। যত পর্যন্ত এসব তোমার নামে আছে কেও তোমার ক্ষতি করতে পারবে না।” মাহার চোখ বেয়ে পানি পরলো। পড়ার টেবিলে বসে কলম দিয়ে দলিলের ফাঁকা পৃষ্ঠায় কিছু লিখলো। একবার দলিলে চোখ বুলিয়ে আমজাদের দিকে আসল। আমজাদের মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে চুমু দিয়ে উঠে দাঁড়াল। ফিরে গেল হলরুমে। ইর্তেজা মাহাকে দেখে লম্বা নিশ্বাস ফেলল। মাহা তাদের সামনে গিয়ে দলিলের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি, মেহরুন্নেসা মাহা। মরহুম মনিরুল আলম খলিলের একমাত্র মেয়ে এবং এই সম্পত্তির অংশীদার। আমি নিজ ইচ্ছায় আমার নামের সকল ধন-সম্পদ আমার চাচাতো ভাই আমজাদ খলিলের নামে করলাম। আর আমার শর্তানুযায়ী আজমাদ খলিল যত পর্যন্ত ২৫ বছরের না হবে এই সম্পত্তি সামলানোর দায়িত্ব আমার চাচা আয়মান খলিল এবং চাচী রোকসানা বেগমের থাকবে। আমজাদ ২৫ বছর হওয়ার পর তাকে তার সম্পত্তি বুঝিয়ে দেয়ার শর্ত রইল।”
বলেই মাহা তার চাচুর দিকে তাকাল। চাচু তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। মাহা হেটে গেল সেখানে। কান্নাজড়িত কন্ঠে বলল,
“আব্বু চলে যাওয়ার পর আপনাকেই বাবা মেনেছি। দাদু বেঁচে থাকা পর্যন্ত আপনি সবসময় আমাকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবেসেছেন। দাদু চলে যাওয়ায় যেন আমি আমার চাচুকেও হারিয়ে ফেলেছি। চাচীই ছিল আমার পাশে। ফুপু যা বলতো আপনি তাই করবেন। যাকে ভালোবাসি তার থেকেও আলাদা করেছেন। কিছু বলি নি। উনি বলায় আপনি আমার বিয়ে নিজের বন্ধুর সাথে দিতে চেয়েছিলেন। দাদু চলে যাওয়ার আগে চলেছিল আপনার কথার খেলাফ যদি না হই। তাই চুপচাপ মেনে নিয়েছিলাম। চাচু এবার একটা জিনিস চাই আপনার থেকে। আমাকে মুক্ত করে দিন। আমি আপনাদের সব দিয়ে দিলাম।”
চাচী দ্রুত এসে বলল,
“তোকে চলে যাওয়ার পারমিশন আমি দিলাম। কিন্তু এই সম্পত্তি আমরা চাই না। আমজাদ…”
চাচী পুরো কথা শেষ করার আগেই মাহা বলল,
“সম্পত্তি আমার। আমি যা ইচ্ছে তাই করবো। আপনারা বলার কেও না।”
বলেই মাহা চাচীর হাতে কাগজ দিয়ে দিলো। এক নজর চাচুকে দেখে ঘুরে দাঁড়াল। ইর্তেজা দাঁড়িয়ে আছে। মাহা ইর্তেজার দিকে এগিয়ে গেল। ইর্তেজার বরাবর দাঁড়িয়ে বলল,
“আজ আমার কাছে কিছু নেই। সব ছেড়ে দিলাম।”
মাহা ইর্তেজার দিকে হাত এগিয়ে গিয়ে বলল,
“আমাকে নিয়ে যাবে নিজের দুনিয়ায়?”
ইর্তেজার চোখে পানি টলমল করছে। খুশিতে আজ তার মন নেচে উঠছে। কপালে হাত রেখে হেসে দিলো। চোখ গড়িয়ে পানি পরতেই দ্রুত মুছে ফেলল সাথে সাথে। মাহার হাত ধরে বলল,
“আমি মাহাকে ভালোবাসি। মাহার সম্পত্তিকে না। তখন থেকে এখন পর্যন্ত আমার মনের দুয়ার আর বাড়ির দরজা খোলা তোমার জন্য।”
মাহা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। ইর্তেজা মাহার হাত নিজের দু’হাতের দুঠোয় নিয়ে চুমু দিলো। চাচীর দিকে তাকিয়ে বলল,
“আন্টি আপনার পারমিশন লাগবে। নিয়ে যাচ্ছি আপনার মেয়েকে।”
“আমি তো তখনও পারমিশন দিয়েছিলাম। আজ কিভাবে না করি? মাহাকে নিয়ে যাও ইর্তেজা। তুমি ছাড়া আর কারো উপর আমার বিশ্বাস নেই। তুমিই পারবে আমার মেয়েটাকে আগলে রাখতে।”
মাহা দৌড়ে গিয়ে চাচীকে জড়িয়ে ধরলো। চাচী মন ভরে আদর করে দিলো মাহাকে। ইর্তেজা এগিয়ে এসে চাচীর থেকে বিদায় নিলো। সায়ান বিরক্ত হয়ে বলল,
“ছি, একটা অবিবাহিত মেয়েকে একটা ছেলের সাথে যাওয়ার পারমিশন কিভাবে দিলো তোর স্ত্রী?”
আয়মান খলিল সায়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোকে তোর টাকা এবার ফিরিয়ে দেবো। তারপর তোর সাথে আমার সম্পর্ক সারাজীবনের জন্য শেষ। তোর টাকা শোধ করতে পারতাম না বলে মাহাকে তোর সাথে বিয়ে দিতে রাজি হয়েছিলাম।”
“বাহ আয়মান, তুইও পল্টি নিলি? নিবি না কেন? সম্পত্তি তো এখন তোর হাতের মুঠোয়।”
আয়মান খলিল কিছু বলল না। চাচী এসব দেখে ইর্তেজাকে বলল,
“তোমরা এখন যাও। আমি তোমাদের সাথে মাঝেমধ্যে দেখা করতে যাবো।”
“চাচী আমজাদকেও নিয়ে যাবে।”
মাহা কথা শুনে চাচী মুচকি হেসে মাথা নাড়াল। বিদায় নিয়ে মাহা আর ইর্তেজা হাতে হাত রেখে বাড়ি থেকে বের হলো। মাহার মনে হচ্ছে সে এখন মুক্ত পাখি। ডানা মেলে উড়ে যাচ্ছে তার ভালোবাসার জগতে। ইর্তেজা হাঁটতে হাঁটতে বলল,
“এই কেমন চমৎকার হলো মাহা? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না আমি তোকে পেয়ে গিয়েছি।”
মাহা ইর্তেজার দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হেসে কাঁধে মাথা ঠেকালো।
.
.
শ্রাবণ কপালে হাত দিয়ে বসে আছে। সূর্য আসবে আজ। সাগরিকা সূর্যের জন্য ঘর গুছাচ্ছে। সূর্য আসবে এই নিয়ে শ্রাবণ চিন্তা করছে না। শ্রাবণ চিন্তা করছে ভবিষ্যতের কথা ভেবে। আজমাইনের কথা জানতে পারলে সাগরিকা কি করবে? শ্রাবণ সোজা হয়ে বসলো। অস্থিরতা কাজ করছে তার ভেতর। বাহির থেকে আওয়াজ আসলো। হয়তো সূর্য এসেছে। শ্রাবণ উঠে বাহিরে গেল। সূর্যকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখলো। এসে পরেছে তার শত্রু। প্রতিদিন এখন খোটা শুনতে হবে তার। আর কিছু বলতেও পারবে না। সাগরিকা নাহলে রাগ করবে। সূর্য শ্রাবণকে সালাম দিলো। শ্রাবণ অবাক হয়ে সালামের উত্তর নিলো। তার বিশ্বাস হচ্ছে না সূর্য তাকে সালাম দিয়েছে। সাগরিকা সূর্যকে নিয়ে ঘরে গেল। শ্রাবণ পকেটে হাত রেখে লম্বা নিশ্বাস ফেলল। এখন তো সাগরিকার কাছে সময়ের অভাব হয়ে যাবে তার জন্য। সাগরিকা সূর্যকে ঘরে রেখে বাহিরে আসলো। শ্রাবণ বিরক্ত চেহারা দেখে বলল,
“তুমি পারমিশন দেয়ায় আমি সূর্যকে আসতে বলেছি। আর এখন নিজেই মুখ ফুলিয়ে রেখেছো।”
“কোথায়? না তো! আমার ভীষণ ভালো লাগছে সূর্যকে দেখে। আমি অফিসে থাকলে তুমি সূর্যের সাথে কথা বলে সময় কাটাতে পারবে।”
“হ্যাঁ ঠিক বললে। আচ্ছা তুমি বসো আমি গিয়ে দেখি বিরিয়ানি হয়েছে কি-না। তারপর একসাথে সবাই লাঞ্চ করবো।”
বলেই সাগরিকা চলে গেল। শ্রাবণ লম্বা নিশ্বাস ফেলল।
.
.
সাঈদ ইরিনার দিকে তাকিয়ে আছে। ইরিনা সাঈদকে এলবাম দেখাচ্ছে। সময় গুলো কত মধুর ছিল। ঝর্ণা টিভি দেখছে আর বিস্কুট খাচ্ছে চা দিয়ে। সে আড়চোখে সাঈদের দিকে তাকাল। সাঈদ এলবাম না দেখে ইরিনাকে দেখছে। ঝর্ণা সাঈদকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“দুনিয়াতে বেহাইয়া মাইনষ্যের বড্ড অভাব।”
ইরিনা আর সাঈদ দুজনই ঝর্ণার দিকে তাকাল। সাঈদ ঝর্ণার চাহনি দেখে চোখ ফিরিয়ে নিলো। ঝর্ণাকে দেখে মনে হচ্ছে সে এখনই তাকে কাঁচা চিবিয়ে খাবে। ইরিনা ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কি বলছো আবল তাবল?”
“আপা গো এইযে টিভিতে যে মানুষটা আছে হেইর কথা কইলাম। তুই মাইয়াডারে ভালোবাসোস বইলা দে। তা না কইরা ফিলিমের নায়কগো মতো ঢং করতাসে।”
ইরিনা হেসে বলল,
“ও তো ফিল্মের নায়কই।”
সাঈদ টিভির দিকে তাকিয়ে থতমত খেয়ে বলল,
“কিন্তু এটা তো ডিসকভারি চ্যানেল। একটা বাঘ হরিণ শিকার করছে। তুমি নায়ক নায়িকা কোথায় পেলে?”
ইরিনা টিভি দেখে বলল,
“হ্যাঁ তাই তো।”
“মনে হয় ঝর্ণার মাথা সত্যি সত্যি আউট হয়ে গিয়েছে।”
বলেই সাঈদ শব্দ করে হেসে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু ব্যর্থ হলো। ঝর্ণা এখনো তার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সাঈদ চুপসে গেল। তখনই দরজা ঠকঠক করার শব্দ আসলো। ঝর্ণা উঠে গিয়ে দরজা খুলে খুশি মনে বলল,
“আপা, ইর্তেজা ভাই আইসে।”
সাথে একটা মেয়ে দেখে হাসি উড়ে গেল তার।
“লগে হয়তো আমাগো ভাবীরে নিয়া আইসে।”
সাঈদ আর ইরিনা একে অপরের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে একসাথে বলল, “ভাবী?”
সাঈদ দ্রুত দাঁড়াল। ইর্তেজা ভেতরে ঢুকে ঝর্ণার দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোমার আজগুবি কথা বার্তা বন্ধ করে না তাই না?”
ইর্তেজা মাহার দিকে তাকিয়ে ভেতরে আসতে বলল। মাহার ভয় করছে। ধীরপায়ে হেটে ভেতরে গেল। মাহাকে দেখে ইরিনা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। সে যেন নিজের চোখে বিশ্বাস করতে পারছে না সে মাহাকে দেখছে। মাহা ইরিনাকে দেখে থমকে গেল। ইরিনা হুইলচেয়ারে কেন বুঝতে পারছে না সে। মাহা দ্রুত হেটে ইরিনার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
“আপু তুমি..তুমি হুইলচেয়ারে? কি..কি হয়েছে তোমার?”
মাহা ইর্তেজার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল,
“আপুর কি হয়েছে ইর্তেজা?”
“বলবো, তুমি গিয়ে আশে ফ্রেশ হও।”
মাহা দাঁড়িয়ে বলল,
“না, আগে বলো আপুর কি হয়েছে।”
ইর্তেজা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল,
“যেদিন আমাদের সম্পর্কে তোমার চাচু জানায় আমাকে মা*রধ*র করে বাসা থেকে বের করে। আমি সেদিন রাস্তায় মাথা ঘুরে পড়ে যাই। কয়েকজন আমার মোবাইল দিয়ে আপুকে কল দেয়। আমার অবস্থার সম্পর্কে জানার পর আম্মু আর আপু আসতে নেয়। রাস্তায় উনাদের রিকশার এক্সিডেন্ট হয়। আমার জ্ঞান কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসে। বাড়িতে ফিরে আসার সময় দেখি রাস্তার মাঝে ভিড়। ভিড় ঠেলে ভেতরে গিয়ে দেখি আপু আম্মু দুজনই র*ক্তা*ক্ত অবস্থায়। আমি যত দ্রুত সম্ভব উনাদের হসপিটাল নিয়ে যাই।”
“ওয়েট ওয়েট, আমি তোমাকে সেই রাতেই কল দিয়ে বলেছিলাম আমাকে যেভাবেই হোক নিয়ে যেতে কিন্তু তুমি যাও নি আমাকে নিতে।”
“হ্যাঁ কারণ সকালেই ডাক্তার বলে আম্মু আর বেঁচে নেই। আর আপুর জ্ঞান কবে ফিরবে উনারা জানেন না। আমি এত বিপদের মধ্যে ছিলাম যে সেদিন পারি নি তোমাকে নিয়ে আসতে। কিছুদিন পর তোমাকে কল দিয়েছিলাম কিন্তু নাম্বার বন্ধ ছিল।”
মাহা অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেদিন থেকে সে ইর্তেজাকে কতোই না দোষারোপ করেছিল। সে একবারো ভাবে নি ইর্তেজা হয়তো বিপদে আছে। মাহা ইরিনার দিকে তাকাল। ইরিনা ভেজা চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। মাহা হাঁটু গেড়ে বসে ইরিনাকে জড়িয়ে ধরলো। ফুপিয়ে কাঁদছে ইরিনাকে জড়িয়ে ধরে। সাঈদ ইর্তেজার উদ্দেশ্যে বলল,
“তুই মাহাকে কোথায় পেলি?”
“সব বলবো, ঝর্ণা তুমি মাহাকে আপুর ঘরে নিয়ে যাও। আপুর একটা জামা বের করে দিও মাহা ফ্রেশ হবে।”
ইরিনা মাহাকে শান্ত করে বলল গিয়ে ফ্রেশ হতে। বাকি কথাবার্তা পরে হবে। মাহা চোখ মুছে উঠে দাঁড়াল। ঝর্ণার সাথে ইরিনার ঘরে গেল সে। মাহা যেতেই ইরিনা ইর্তেজাকে বলল,
“মাহার এই অবস্থা কেন ইর্তেজা? কি হয়েছে পুরো কথা বল এখনই।”
ইর্তেজা চেয়ারে বসে সব বলবো ইরিনা আর সাঈদকে। ইরিনা রাগে গজগজ করছে। রাগী কন্ঠে চিৎকার করে বলল,
“কিড*ন্যাপ? ইর্তেজা তুই এত বাজে কাজের সাথে কিভাবে জড়িত হলি?”
“আপু, বিশ্বাস করো এর আগে কখনো আমি এত বাজে কাজ করি নি। এই প্রথম ছিল। আর আমি ওয়াদা করছি এটাই শেষ। আমি আজই শ্রাবণ আহমেদকে গিয়ে বলল আমি আর উনার জন্য কাজ করবো না।”
ইরিনা কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। রাগের বশে কান্না আসছে তার। সাঈদ ইরিনার মাথায় হাত রাখলো। ইরিনা সাঈদের দিকে তাকাল। সাঈদ ইরিনাকে চোখের ইশারায় শান্ত থাকতে বলল। ইরিনা ঘনঘন নিশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করলো।
মাহা বাহিরে এসে দেখে ইর্তেজা নেই। সাঈদ কপালে হাত দিয়ে বসে আছে। মাহা ভার্সিটির লাইফে মাত্র একবার সাঈদের সাথে কথা বলেছিল। তাও ভিডিও কলে ইর্তেজার সাথে। ইরিনা চুপচাপ বসে আছে। মাহা গিয়ে ইরিনার সামনে দাঁড়াল। ইরিনা মাহাকে দেখে মুচকি হেসে ইশারায় বলল বসতে। মাহা বসলো ইরিনার কথার মতো। মাহা ইরিনার হাত ধরে বলল,
“আমাকে মাফ করে দিও আপু। সেদিন আমার কারণে হয়েছে এসব।”
“তোমার কারণে কিভাবে?”
“সেদিন যদি আমি সাহস করে ইর্তেজার হয়ে চাচুকে থামাতাম তাহলে সেদিন ইর্তেজা রাস্তায় মাথা ঘুরে পরতো না। আর তোমরাও এক্সিডেন্ট হতে না।”
“মাহা, ভাগ্যে যা লিখা থাকে তাই হয়। আর কখনো নিজেকে দোষারোপ করবে না, বুঝলে?”
সাঈদ বলল,
“হুম ঠিক, ভাগ্যের উপর কারো হাত নেই। তাই আমাদের সাথে যা-ই হোক আমাদের মন খারাপ করতে নেই।”
মাহা সাঈদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“সাঈদ ভাইয়া, মাত্র একবার আলাপ হয়েছিল আপনার সাথে।”
“বাহ, তুমি আমাকে মনে রেখেছো?”
“জি, ইর্তেজা আমাকে শুধু আপনার কথা-ই বলতো। যা আমি কখনো ভুলি নি।”
তখনই ঝর্ণা আসলো। মাহাকে দেখে দাঁত বের করে হেসে বলল,
“আপনে ভাবী? ইর্তেজা ভাইয়ের এত সুন্দর বউ। মাশা আল্লাহ মাশা আল্লাহ।”
মাহা লজ্জা পেলো ঝর্ণার কথা শুনে। সাঈদ হেসে বলল,
“হ্যাঁ ঝর্ণা ঠিক বললে। উনি আমাদের ভাবী। খুব জলদি আমরা ইর্তেজা আর মাহার দিয়ে দেবো।”
“বিয়া? আইজকাই আম্মারে কমু নয়া কাপড় কিনা দিতে।”
তখনই ইর্তেজা আসলো। ঝর্ণা কথা শুনে বলল,
“কেন ঝর্ণা? কার বিয়ে যে তুমি নতুন জামা কিনবে?”
“আপনের”
ইর্তেজা থতমত খেয়ে গেল। ইর্তেজার চেহারা দেখে সাঈদ ফিক করে হেসে দিয়ে বলল,
“দেখুন ইরিনা, ইর্তেজা লজ্জায় লাল হচ্ছে।”
ইর্তেজার সত্যি লজ্জায় হাসি আসছে। হাসি থামানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে বলল,
“আমি কেন লজ্জা পাবো শুনি?”
“তোর মুখে থাকা মুচকি হাসি-ই বলে দিচ্ছে।”
ইর্তেজা সাঈদের মাথায় থাপ্পড় মেরে বলল,
“চুপ থাক বেয়াদব।”
“ওই শা*লা সম্মান দে আমায়।”
“কেন তুই কি আমার দুলাভাই লাগিস যে তোকে সম্মান দেবো?”
সাঈদ আর কিছু বলল না। হেসে বিষয়টা ধামাচাপা দিলো। আড়চোখে ইরিনার দিকে তাকাল। সত্যি যদি ইর্তেজার দুলাভাই হতে পারতো সে কতোই ভালো হতো।
বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে সাঈদ চলে গেল। ইরিনা যত দ্রুত সম্ভব মাহা আর ইর্তেজার বিয়ে দিতে চায়। এক বাড়িতে দুজন অবিবাহিত ছেলে মেয়ে থাকা বিষয়টা বাজে দেখা যায়। যদিও সে তার ভাই আর মাহাকে খুব ভরসা করে। কিন্তু এলাকার মানুষেরা জানতে পারলে বাজে খবর ছড়াবে। মাহা আর ইর্তেজা বসে কথা বলছে। ইরিনা ভাবলো তারা কিছুক্ষণ একা সময় কাটাক। ঝর্ণাকে বলায় ঝর্ণা ইরিনাকে নিয়ে তার ঘরে আসলো। ইরিনাকে ধরে খাটে বসালো। ইরিনা হেলান দিয়ে বসে বলল,
“আমি কিছুক্ষণ বিশ্রাম করি। তুমি গিয়ে দেখো তাদের কিছু লাগবে কি-না।”
ঝর্ণা মাথা নাড়িয়ে চলে গেল। হঠাৎ ইরিনার চোখ গেল খাটের উপর থাকা একটা ওয়ালেটের দিকে। ইরিনা সোজা হয়ে বসে খুব কষ্টের হাত এগিয়ে ওয়ালেটটা নিলো। সে সাঈদের কাছে দেখেছিল এই ওয়ালেট। লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল, “এত কেয়ারলেস এই ছেলেটা? কাল আসবে নিতে জানি।”
ইরিনা ওয়ালেটটা তার বালিশ সরিয়ে নিচে রাখতে নিলো। তার মনে হচ্ছে ওয়ালেটের ভেতরে কারো ছবি দেখেছে সে। তার মনে আকুপাকু শুরু হয়ে গেল। কারো ব্যক্তিগত জিনিস দেখতে নেই। কিন্তু তার মন মানছে না। দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে কেও আসছে না। ভাবলো একবার দেখেই রেখে দেবে। ইরিনা ওয়ালেট খুলল। খুলতেই সে চমকে উঠল।
চলবে…….
[প্র্যাকটিক্যাল চলছে তাই ব্যস্ত আছি। গল্প অর্ধেক লিখা ছিল তাই গতকাল দিতে পারি নি। ভুল ত্রুটি ধরিয়ে দিয়েন।]