#আর_একটিবার
#শোভা_আক্তার(লাভলী)
#পর্ব_৭
ইরিনা বিছানায় শুয়ে ছটফট করছে। ভাই নেই টেনশনে তার ঘুম আসছে না। ইর্তেজাকে অনেকবার কল করেছে৷ কিন্তু ইর্তেজা কল রিসিভ করে নি৷ হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ আসলো। ইর্তেজা বাসায় ফিরেছে। কিন্তু ইরিনা অবাক হলো। ইর্তেজা চুপচাপ নিজের ঘরে চলে গেল। সে কখনো এমন করে না। সবসময় বোনের সাথে দেখা করে তারপর নিজের ঘরে যায়। ইরিনার খোটকা লাগলো। কিছু তো হয়েছে। ইরিনা ডাকলো ইর্তেজাকে। ইর্তেজা ডাক শুনে বোনের ঘরে গেল। ইর্তেজার চোখ মুখ লাল হয়ে আছে। কপালে গালে নীলচে দাগ হয়ে আছে। ইরিনা ভয় পেয়ে গেল। দ্রুত উঠে বসার চেষ্টা করলো। ইর্তেজা তার পাশে বসে বলল-
“উঠতে হবে না। শুয়ে থাকো।”
“তোর চেহারার এই অবস্থা কেন? কার সাথে মারামারি করে এসেছিস?”
“কারো সাথে না। ছোট্ট একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে।”
“হায় আল্লাহ্, তুই ঠিক আছিস তো?”
“হ্যাঁ আলহামদুলিল্লাহ, তুমি ঔষধ খেয়েছো?”
“প্রসঙ্গ পরিবর্তন করিস না। সত্যি করে বল কি হয়েছে? তুই ইদানীং আমার থেকে কথা লুকাস। আগে তো এমন করতি না।”
ইর্তেজা তাকাল বোনের দিকে। সত্যি তো বলেছে ইরিনা। ইর্তেজা তার হাত মুঠোয় নিয়ে বলল- “আমি এমন কোনো কাজ করবো না যাতে তুমি কষ্ট পাও।”
“তাহলে আমাকে এত টেনশন কেন দিস বল তো৷ তুই যাওয়ার পর আমি সারাদিন চিন্তা করি তুই ঠিক আছিস কি-না।”
ইরিনা ইর্তেজার গালে হাত রেখে আবার বলল- “ভাই, প্লিজ আমাকে বল তোর মনে কি চলছে৷ সেই ২ বছর আগে তোর চোখে আমি যে কষ্ট দেখতে পেয়েছিলাম আজও সেই রকমই কষ্ট দেখতে পাচ্ছি।”
ইর্তেজা চমকে উঠল। দ্রুত দাঁড়িয়ে বলল-
“এমন কিছুই না। আমি কারো জন্য কষ্ট পাচ্ছি না।”
ইর্তেজা বলেই মুখ ঘুরিয়ে ফেলল। ইরিনা ভ্রু কুঁচকে বলল- “আমি তো বলি নি তুই কারো জন্য কষ্ট পাচ্ছিস।”
ইর্তেজা করুণ দৃষ্টিতে তাকাল ইরিনার দিকে। ইরিনা হাত বাড়িয়ে ভাইয়ের হাত ধরে আবার পাশে বসালো। ইর্তেজা মাথা নিচু করে বসে আছে। ইরিনা তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল-
“আমি তোকে ভালো মতো চিনি। আচ্ছা আর কিছু জিজ্ঞেস করবো না। কিন্তু এবার একটা পরামর্শ দিই।”
ইর্তেজা তাকাল বোনের দিকে। সে জানে তার বোন কোনো পরামর্শ দিলে সেটা নিশ্চয়ই কাজে আসে। ইরিনা ইর্তেজার হাত শক্ত করে ধরে বলল- “গতবারের মতো ভুল করবি না। নিজেকে কষ্ট থেকে শত হাত দূর রাখবি। তুই না বলেছিলি ভালোবাসার জন্য সব করতে পারিস। এবার ত্যাগ না ভোগ করবি।”
ইর্তেজা চেহারা কুঁচকে বলল- “তোমার এমন কেন মনে হচ্ছে আমি কারো প্রেমে পড়েছি?”
“তুই আমার ভাই। আমার থেকে ভালো তোকে কে চিনবে শুনি।”
“এমন কিছুই না আপু। তুমি ভুল বুঝছো।”
“ঠিক আছে, তুই নিজেকেই প্রশ্ন কর। আজ না-হয় কাল উত্তর পেয়ে যাবি।”
“বেশি কথা বলো, ঔষধ দিচ্ছি। খেয়ে ঘুমিয়ে যাও।”
ইরিনা নিঃশব্দে হাসলো। ইর্তেজা ইরিনাকে ঘুম পাড়িয়ে ঘরে চলে গেল। ঘরে আসার পর থেকে ছটফট করছে। শক্ত করে নিজের চুল চেপে ধরলো। মাথা কাজ করছে না। ইরিনা তাকে দ্বিধায় ফেলে দিলো।
.
.
পরেরদিন…..
ইরিনাকে খাইয়ে দিচ্ছে ইর্তেজা। আজ কাজ নেই। সন্ধ্যার পর সাগরিকাকে ডিসচার্জ করবে তখন যাবে হসপিটাল। ইর্তেজাকে চিন্তিত দেখা যাচ্ছে। ইরিনা বলল-
“রাতে না ঘুমিয়ে চিন্তা করেছিস তাই না?”
“এমন কিছুই না। এমনিতেই ঘুম আসছিল না।”
“বল আরো মিথ্যে কথা। দেখি কত মিথ্যে বলতে পারিস।”
“চুপচাপ খাও, আমি ডাক্তারকে কল দিয়ে জিজ্ঞেস করি আজ উনি ফ্রি কি-না।”
“এই একদম না, আমি যাব না কোথাও।”
ইর্তেজা জবাব দিলো না। ইরিনা যতোই বলুক। ইর্তেজা তাকে নিয়ে যাবেই। ইরিনা একা একা বকবক করছে। তার ভালো লাগে না হসপিটাল যেতে, ঔষধ খেতে ভালো লাগে না। ইর্তেজা চুপচাপ শুনছে। কিছুক্ষণ পর সাঈদ আসলো।
“আসসালামু আলাইকুম, বাহ আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য। ভাই যত্ন করে বোনকে খাইয়ে দিচ্ছে।”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম, তুই আজও? প্রতিদিন বেহায়াদের মতো আসার কারণ কি বল তো?”
সাঈদ হাসতে হাসতে এগিয়ে এসে চেয়ারে বসলো।
“আমি তো উনার সাথে দেখা করতে আসি।”
ইরিনা পানি পান করছিল। সাঈদের কথা শুনে থমকে গেল। ইর্তেজা হাসতে হাসতে বলল-
“হয়েছে হয়েছে, নাশতা কর এখন।”
“না আমি শুধু চা খাবো।”
ইরিনা বলল- “ঝর্ণা তোমার জন্য চা বানিয়ে রেখেছে। বলতেও হবে না নিয়ে আসবে এখনই।”
সাঈদ হাসলো ইরিনার কথা শুনে। তখনই ঝর্ণা আসলো। সাঈদকে দেখে লজ্জা মাখা হাসি দিয়ে বলল- “আজ্ঞে আপনে আইসেন”
“হ্যাঁ, এক কাপ চা নিয়ে আসো। চিনি কম দিও তুমি বেশি চিনি দিয়ে দাও। এত মিষ্টি আমার পছন্দ না।
“আপনে নিজেই দেখতে মিষ্টি আপনের আবার মিষ্টি লাগে? এহনই নিয়া আহি।”
ঝর্ণা লাফাতে লাফাতপ চলে গেল। সাঈদ আর ইর্তেজা হাসছে ইরিনা বাদে। তার মাঝে মধ্যে কি হয়ে যায় নিজেও জানে না। ইর্তেজা বলল- “তুই কি ঝর্ণার প্রেমে পরছিস না-কি?”
“আব্বে ধুর কি বলিস এসব? ও তো ছোটো মানুষ। দুষ্টুমি করতে ভালো লাগে ওর সাথে।”
ইরিনা বলল- “কারো মন নিয়ে খেলা করা ভালো না।”
সাঈদ আর ইর্তেজা ইরিনার কথা বুঝতে পারলো না। ইরিনা আবার বলল- “মেয়ে মানুষের আবেগ বেশি। ধরো তুমি দুষ্টুমি করতে করতে ঝর্ণা সত্যিই তোমাকে ভালোবেসে ফেলল তখন? তুমি কি ওকে আপন করে নিবে?”
সাঈদ চুপসে গেল। সে কিভাবে বলবে সে দুনিয়ার কাওকেই আপন করতে পারবে না ইরিনাকে ছাড়া। ইর্তেজা বলল- “আপু ঝর্ণার এখন আবেগের বয়স। অভাবের কারণে মায়ের সংসার নিজে সামলাচ্ছে। কিন্তু ওর বাচ্চামো এখনো যায় নি।”
“ওইযে বললাম মেয়ে মানুষের আবেগ বেশি। ঝর্ণা নিজের আবেগকেই সত্যিকারের অনুভূতি ধরে বসলে?”
“হুম তা ঠিক বললে।”
তখনই ঝর্ণা আসলো চা নিয়ে৷ সাঈদ ঝর্ণার দিকে তাকাল। মেয়েটা শুধু হাসে তাকে দেখে। সাঈদও জবাবে হাসলো। এই দৃশ্য দেখে ইরিনা দাঁতে দাঁত চেপে ধরে মুখ ঘুরিয়ে ফেলল। এত লম্বা ভাষণ দিয়েও তার লাভ হলো না।
.
.
সাগরিকা একা কেবিনে শুয়ে আছে। ক্ষুধায় তার পেটে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে। যদিও নার্স স্যুপ দিয়ে গিয়েছে কিন্তু তার হসপিটালের স্যুপ খেতে ইচ্ছে করছে না। স্যুপ দেখেই তার মন ভরে গিয়েছে। ঘুম থেকে উঠে দেখে শ্রাবণ নেই। সাগরিকা ভেবেছিল এসে পরবে কিন্তু না ২ ঘন্টা হয়ে গিয়েছে শ্রাবণের আসার নাম নেই। সাগরিকা তার মোবাইল দেখতে পেল। ধীরে ধীরে উঠে বসে হাত বাড়িয়ে মোবাইল নিলো। কাকে কল দেবে ভাবতে লাগলো। সূর্যের কথা মাথায় আসতেই কল দিলো। রিং বাজার সাথে সাথেই রিসিভ হলো- “আসসালামু আলাইকুম আপি কেমন আছো তুমি?”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম, আলহামদুলিল্লাহ ভাই তুই কেমন আছিস?”
“ভালো, তুমি এই সময় কল করলে? ক্লাস নেই আজ?”
“সূর্য আমি হসপিটালে।”
“কি? কি হয়েছে? সব ঠিক আছে তো?”
“সব বলবো তুই আগে আয়। আর প্লিজ আমার জন্য কিছু খেতে নিয়ে আসিস আমার প্রচুর ক্ষুধা পেয়েছে।”
“আচ্ছা আচ্ছা আমি আসছি।”
সাগরিকা সূর্যকে হসপিটালের নাম বলে দিলো। সে শুয়ে অপেক্ষা করছে। মোবাইলের দিকে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ। শ্রাবণ কলও করছে না। সাগরিকা তালিচ্ছ্যের হাসি দিলো। এই সেই ব্যক্তি যে বার বার ভালোবাসার দাবী করে কিন্তু এখন খোঁজ পর্যন্ত নিচ্ছে না।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সূর্য আসলো। সূর্যকে দেখেই সাগরিকা কাছে ডেকে জড়িয়ে ধরলো৷ সূর্য কাঁদছে বোনকে জড়িয়ে ধরে।
“কাঁদছিস কেন আমি ঠিক আছি একদম।”
সূর্য সাগরিকাকে ছেড়ে চোখ মুছে বলল- “পরে কথা হবে তারাতাড়ি খেয়ে নাও। আমার ভয় করছে যদি শ্রাবণ এসে পড়ে? তোমার ক্ষতি করে?”
“মনে হয় না আসবে। আমি হসপিটালে আর ও কোথায় গিয়েছে কে জানে।”
“কেয়ারলেস কোথাকার। নিশ্চয়ই ওর বিজনেসে ঠাডা পড়েছে তাই চলে গিয়েছে। আচ্ছা ওকে এখন সাইডে রাখো। সকালে আলু পরোটা বানিয়েছিলাম। তোমার কথা খুব মনে পরছিল৷ তোমার খুব প্রিয় তাই না?”
সাগরিকা মুচকি হেসে সূর্যের গালে হাত রাখলো। সূর্য পরোটা ছিড়ে সাগরিকার মুখে তুলে দিলো। সাগরিকা খেতে খেতে সূর্যকে সব বলল। রাগে ফুঁসছে সূর্য। সে উঠে দাঁড়িয়ে রাগে কটমট করতে করতে বলল- “ওকে আমি আজ জীবিত কবর দিয়ে দেবো। অনেক সহ্য করেছি আর না।”
“কি করবি তুই শুনি?”
“মেরে টুকরো টুকরো করে ফেলবো।”
“একবার বললি জীবিত কবর দিবি আর একবার বললি মেরে টুকরো টুকরো করবি। সত্যি হলো, তুই ওর কোনো ক্ষতি করতে পারবি না।”
“আপু”
সূর্য বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকাল বোনের দিকে। সাগরিকা হাসতে হাসতে বলল- “থাক বাবা রাগ করিস না। এইদিকে আয় আমার কাছে বস।”
সূর্য আবার সাগরিকার পাশে বসলো। সূর্যকে দেখে সাগরিকা যেন একদম সুস্থ হয়ে গিয়েছে। মন খুলে হাসছে সে সূর্যের সাথে কথা বলে। ধীরে ধীরে সময় কেটে গেল।
সন্ধ্যার পর, শ্রাবণ কেবিনে ঢুকে দেখে সাগরিকা আর সূর্য বসে কথা বলছে। এমনিতেই তার মাথা গরম ছিল। সূর্যকে দেখে আরো গরম হয়ে গেল। সাগরিকা চমকে উঠল শ্রাবণকে দেখে। শ্রাবণ ধীরে ধীরে হেটে এসে দাঁড়াল। সূর্য রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শ্রাবণের দিকে। শ্রাবণ সাগরিকার দিকে তাকিয়ে বলল- “তোমার সাথে যখন আমার বিয়ে হয়েছে তোমার বাবাকে বলেছিলাম তারা যাতে কখনো তোমার সাথে দেখা না করে। ওর সাহস কি করে হলো এখানে আসার?”
সূর্য হেটে এসে শ্রাবণের বরাবর দাঁড়িয়ে চোখের চোখ রেখে বলল- “তোর মতো অমানুষ আমি গতকাল পর্যন্ত দেখি নি। কিন্তু আজ দেখে নিলাম।”
শ্রাবণ তালিচ্ছ্যের হাসি দিয়ে সূর্যের দিকে তাকাল। সাগরিকার ভয় করছে। যদি শ্রাবণ সূর্যের কোনো ক্ষতি করে? সাগরিকা বলল- “শ্রাবণ যা বলার আমাকে বলো। আমি ওকে আসতে বলেছি।”
শ্রাবণ সাগরিকার দিকে তাকাল- “কেন?”
সাগরিকা কিছু বলার আগেই সূর্য উচ্চ স্বরে বলল- “এই অমানুষ কোথাকার। কোথায় ছিলি তুই? আমার বোন এখানে সকাল থেকে না খেয়ে ছিল আর তুই কল দিয়ে জিজ্ঞেস পর্যন্ত করিস নি আপু কেমন আছে।”
“মরে যায় নি তোর বোন। আর তুই ছোটো মুখে অতিরিক্ত কথা বলছিস না? তুই জানিস না আমি কি কি করতে পারি?”
“খুন করতে পারিস। খুনী কোথাকার। আমাকেও খুন করবি? কর, তোকে থামিয়েছে কে শুনি?”
শ্রাবণের রাগ আরো বেড়ে গেল। সূর্যের শার্টের কলার চেপে ধরে বলল- “অনেক শুনেছি আর না। ওয়ার্নিং দিচ্ছি চলে যা এখান থেকে। আর কখনো তোর চেহারা আমার নজরের সামনে আসলে সাথে সাথে টুকরো করে নদীতে ভাসিয়ে দেবো।”
সূর্য এখনো রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শ্রাবণের দিকে। শ্রাবণ ঝটকা মেরে সূর্যকে ছেড়ে বলল- “যা এখন, তুই ছোটো বলে বেঁচে গেলি। নাহলে…”
“তোর অনেক অহংকার তাই না? নিজেকে বাদশা ভাবিস সবসময়।”
“বাদশা ভাবি না। কারণ আমি বাদশা। কি না আছে আমার কাছে তুই জানিস না?”
“হুম, সব আছে তোর কাছে। আরে উপর ওয়ালা তোকে কি না দিয়েছে। যদিও সব অবৈধ কাজ করে কামিয়েছিস৷ তোর কি ইচ্ছে করে না ভালো মানুষ হতে?”
শ্রাবণ সাগরিকার পাশে বসে সূর্যের দিকে তাকিয়ে বলল- “ভালো মতো তাকিয়ে দেখ সূর্য, সব আছে আমার কাছে।”
বলেই শ্রাবণ সাগরিকার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিলো।
“আমার বোনকে তো তোর জেল থেকে বের করেই ছাড়বো আমি।”
শ্রাবণ দাঁড়িয়ে সূর্যের চোখে চোখ রেখে বলল- “পারলে বের করে দেখা।”
সূর্য তালিচ্ছ্যেস হাসি হেসে বলল- “তোকে তোর যোগ্যতা দেখানোর জন্য কেও না কেও নিশ্চয়ই আসবে।”
শ্রাবণ শব্দ করে হেসে বলল- “কে আসবে শুনি।”
তখনই দরজা খোলার শব্দ আসলো। তারা তিনজন দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে বড়ো একটা ব্যাগ নিয়ে ইর্তেজা প্রবেশ করলো। ইর্তেজা ব্যাগটা মাটিতে রেখে লম্বা নিশ্বাস ফেলে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল- “বস আপনি যা যা বলেছেন সব নিয়ে এসেছি।”
সাগরিকা ইর্তেজাকে দেখে যেন ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। শ্রাবণ ইর্তেজার দিকে হেটে এসে বলল- “তুমি আমার সাথে রাগ করো নি এর জন্য ধন্যবাদ।”
“বস এভাবে বলে আমাকে লজ্জিত করবেন না।”
শ্রাবণ মুচকি হেসে ইর্তেজার কাঁধে হাত রাখলো। ইর্তেজাও জবাবে মুচকি হেসে সাগরিকার দিকে তাকাল। সাগরিকার চাহনি দেখে ইর্তেজা বলল- “কি হলো ম্যাম আপনি ঠিক আছেন?”
“ইর্তেজা তুমি বেঁচে আছো?”
“জি ম্যাম আমার কি হবে?”
“গতকাল যা হল, ভাবলাম শ্রাবণ আর তোমাকে জীবিত ছাড়বে না।”
শ্রাবণ সাগরিকার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল- “কেন আমি কি অন্ধ যে সত্য দেখতে পারবো না?”
সাগরিকা কিছু বলার আগেই সূর্য বলল- “অন্ধ-ই তো। নাহলে কী যার তার সাথে দেখে আমার বোনকে সন্দেহ করতেন? আমি আপুর আপন ভাই না হলে আমাকে দিয়েও সন্দেহ করতেন তাই না? জঘন্য মানুষ কোথাকার।”
শ্রাবণ রেগে তেড়ে গেল সূর্যের দিকে। সূর্যের কলার ধরতেই ইর্তেজা গেল ছাড়াতে৷ শ্রাবণকে সূর্য থেকে দূর করে বলল- “বস কী করছেন? ও ছোটো মানুষ।”
শ্রাবণ গর্জে উঠল- “ও ছোটো তো ছোটোদের মতো থাকতে পারে না?”
সাগরিকা রাগী কন্ঠে বলল- “খবরদার শ্রাবণ তুমি আমার ভাইয়ের গায়ে হাত তুলবে না।”
ইর্তেজা সাগরিকার দিকে তাকিয়ে বলল- “ম্যাম প্লিজ আপনি অসুস্থ শান্ত হোন।”
শ্রাবণ নিজেকে ইর্তেজার কাছ থেকে ছাড়িয়ে ডান হাত দিয়ে নিজের চুল চেপে ধরে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। ইর্তেজাকে উদ্দেশ্য করে বলল- “ওকে দূর করো আমাট চোখের সামনে থেকে। নাহলে এখনই ওকে মাটিতে পুঁতে ফেলব।”
ইর্তেজা মাথা নাড়িয়ে সূর্যের দিকে হেটে গেল। নিচু স্বরে বলল- “এখন চলে যাও। নাহলে পরিস্থিতি বিগড়ে যাবে।”
সূর্য ইর্তেজার কথা শুনে বোনের দিকে তাকাল। সাগরিকা তাকে ইশারায় বলল চলে যেতে। সূর্য সাগরিকার দিকে গিয়ে বোনকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলো। শ্রাবণ এমন দৃশ্য দেখে বিরক্ত হলো। মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে ফেলল সে। ইর্তেজা মুচকি হাসলো তাদের দেখে। হঠাৎ করে ইরিনার কথা মনে পরছে তার। সূর্য বোনের হাত মুঠোয় নিয়ে চুমো দিয়ে বলল- “নিজের খেয়াল রেখো। যত পর্যন্ত সুস্থ না হবে তুমি ভার্সিটি যাবে না।”
“ঠিক আছে, তুই এখন ঠিক মতো বাসায় যা। আর নিজের অনেক অনেক খেয়াল রাখবি।”
সূর্য মাথা নাড়িয়ে হাঁটা ধরলো। যাওয়ার আগে শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল- “যেদিন আপনার মনে হবে আমার বোন আপনার জন্য বোঝা হয়ে গিয়েছে একবার আমাকে কল দিয়ে বলে দিয়েন। কিন্তু তার কোনো ক্ষতি করবেন না প্লিজ।”
সাগরিকা নিচের ঠোঁট কামড় দিয়ে ধরে মুখ ঘুরিয়ে ফেলল সূর্যের কথা শুনে। সূর্য চোখ মুছতে মুছতে চলে গেল। শ্রাবণ বিরক্ত মুখ বানিয়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছে। ইর্তেজা সাগরিকার দিকে তাকাল। সাগরিকা কাঁদছে। ইর্তেজার ভীষণ খারাপ লাগলো সূর্যের কথা শুনে। সে শ্রাবণের দিকে তাকাল। ১ বছর হবে সে শ্রাবণের সাথে কাজ করছে। আগে তার ফ্যাক্টরির সুপারভাইজার ছিল। সে সবসময় শ্রাবণকে একজন ভালো মানুষ রূপেই দেখেছে। হ্যাঁ সে জানে শ্রাবণের সব কাজ অবৈধ। আগে মার্ডার পর্যন্ত করতো। কিন্তু এখন এসব করে না। ইদানীং শ্রাবণের ব্যবহার তাকে অবাক করছে। সে যেন নতুন শ্রাবণ আহমেদকে দেখছো। শ্রাবণের ডাকে ইর্তেজার হুশ ফিরলো।
“কখন থেকে ডাকছি। কোথায় হারালে?”
“একটা কথা ভাবছিলাম। বলুন বস।”
“গিয়ে গাড়িতে বসো আমরা আসছি।”
ইর্তেজা মাথা নাড়িয়ে বেরিয়ে গেল।
ইর্তেজা যেতেই শ্রাবণ সাগরিকার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকাল। সাগরিকার কোনো অনুভূতি নেই৷ সে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। শ্রাবণ ব্যাগটা তুলে ধীরপায়ে হেটে গিয়ে সাগরিকার পাশে বসলো। ব্যাগ থেকে জামা বের করে সাগরিকার হাতে দিয়ে বলল- “আমার যেমন কেও নেই তুমি ছাড়া। ঠিক তেমনই তোমারও কেও থাকবে না আমি ছাড়া।”
“আমার ভাই কি তোমার অবৈধ সম্পত্তি লুটে খাবে? চিন্তা করো না। আলহামদুলিল্লাহ আমার ভাই সৎ পথে চলার মানুষ। হারাম ওর হজম হয় না। তাই তো সেদিন তুমি তাকে কলেজে ভর্তি হওয়ার টাকা দেয়ায় তোমার চেহারায় ছুঁড়ে মেরে বলেছিল ও আর পড়াশোনা করবে না। আর এখন ছোটো বাচ্চাদের পড়িয়ে নিজের খরচ নিজে চালায়।”
“আমি বলেছিলাম তোমাকে আমি ধীরে ধীরে সব ছেড়ে দেবো৷ আমি চেষ্টা করছি তোমার মনের মতো হওয়ার। কিন্তু তুমিই চেষ্টা করছো না আমাকে বোঝার।”
বলেই শ্রাবণ উঠে দাঁড়াল। লম্বা নিশ্বাস ফেলে আবার বলল- “যাও জামা বদলে আসো বাসায় যাব আমরা।”
সাগরিকা নিঃশব্দে খাট থেকে নেমে ধীরে ধীরে হেটে বাথরুমে চলে গেল।
.
.
ইর্তেজা গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেটে লম্বা লম্বা টান দিচ্ছে।বার বার সাগরিকার কান্না তার চোখে ভাসছে। সে কারো কান্না সহ্য করতে পারে না। কিন্তু সাগরিকার কান্না সে মেনেই নিতে পারছে না। সে চাচ্ছে শ্রাবণ অনেক ভালো মানুষ হয়ে যাক। যাতে সাগরিকা সবসময় হাসিখুশি থাকে। হঠাৎ পেছন থেকে শ্রাবণের কন্ঠ ভেসে আসলো। ইর্তেজা পেছনে ফিরে দেখে শ্রাবণ সাগরিকাকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ইর্তেজা দ্রুত সিগারেট মাটিতে ফেলে পা দিয়ে নিভিয়ে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলো। সাগরিকা গাড়িতে বসতে বসতে বলল- “ইর্তেজা তোমার এখনই গিয়ে চিকিৎসা করানো দরকার।”
“কিন্তু কেন ম্যাম? আমি তো সুস্থ আছি।”
“যে হারে সিগারেট টানছিলে মনে তো হচ্ছে একটা কিডনি ফেইল হওয়ার পথে।”
ইর্তেজা লজ্জা পেল সাগরিকার কথা শুনে। সাগরিকা আর শ্রাবণ উঠে বসলো গাড়িতে। ইর্তেজা দরজা বন্ধ করে ড্রাইভিং সিটে বসলো।
.
.
কলেজের স্টুডেন্টদের পড়ানো এত কঠিন। সাঈদ জানলে কখনো এই চাকরি নিতো না৷ আগামী সপ্তাহ থেকে কোচিং-ও শুরু হবে। সে ইরিনার সাথে দেখা করার সময় কিভাবে বের করবে ভাবতে পারছে না। বারান্দায় দাঁড়িয়ে পলকহীন চোখে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। সেদিন কথায় কথায় ইর্তেজা বলেছিল ইরিনার জন্য পাত্র খুঁজবে সে। এই কথা জানার পর থেকে সাঈদের মনে ভয় কাজ করছে। এখন পর্যন্ত সে ইরিনার মনে নিজের প্রতি ভালোবাসা তৈরী করতে পারলো না। আর ইর্তেজা এখন থেকেই তার সংসার শুরু হওয়া ভেঙ্গে দিচ্ছে। সাঈদ রেলিংয়ে হাত রেখে মাথা নিচু করলো। কি করবে কিছু ভাবতে পারছে না। হঠাৎ তার মোবাইলে মেসেজ টন বেজে উঠল। সাঈদ সেখানে খেয়াল করলো না। সিম কোম্পানি থেকে সারাদিনে শতবার মেসেজ আসে এতে নতুন কিছু না। কিন্তু অবাকের বিষয় হলো। প্রতি মিনিটে মেসেজ টন বাজছে। সাঈদ দ্রুত তার মোবাইল পকেট থেকে বের করে দেখে একটা আননোন নাম্বার থেকে মেসেজ আসছে। মেসেজগুলো খুব আজব। প্রতি মেসেজে মাত্র একটা করে শব্দ লিখা। সাঈদ ভ্রু কুঁচকাল। মেসেজ একটার পর একটা আসতেই আছে। সে প্রতিটি শব্দ পড়লো। কিন্তু কিছুই মাথায় ঢুকছে না। শব্দগুলো উলটপালট হয়ে আছে। এক সময় মেসেজ আসা বন্ধ হয়ে গেল। এত গুলো মেসেজ এসেছে যে সে গণনা-ও করতে পারলো না। সাঈদ ঘরে গেল। খাতা আর কলম নিয়ে শব্দগুলো সাজিয়ে লিখতে লাগলো। ১৫ মিনিট লাগলো তার শব্দগুলো সাজাতে।মনোযোগ দিয়ে পড়া শুরু করলো-
“এক রাজ্যের রাজপুত্র আসে অন্য রাজ্যের রাজকন্যাকে বিয়ে করতে। তারা একে অপরকে ভালোবাসে, বিয়ে করে। তারপর সুখে সংসার করে। এসবই রূপকথার গল্প। আমি এসব বিশ্বাস করি না৷ কিন্তু মনে মনে ঠিক একটি রাজপুত্র চেয়েছি। যবে থেকে আপনাকে দেখেছি আমার মনে হয় আমার রূপকথার গল্পের রাজপুত্র একমাত্র আপনি। আপনার মধ্যে যেন আমি আমার গল্পের রাজপুত্রকে দেখতে পাই। প্রতিদিন আপনাকে দেখলেও আমার সাহস হয় না আপনাকে নিজের মনের কথা বলার৷ সাঈদ, আপনার সাথে আমি আমার বাস্তব রাজ্য সাজাতে চাই। আপনি কী হবেন আমার কল্পনার সেই রাজপুত্র?”
সাঈদের মাথা বিগড়ে গেল। তার কাছে বিষয়টা খুব জঘন্য লাগলো। সে দ্রুত কল করলো সেই নাম্বারে কিন্তু কেও রিসিভ করছে না। অনেকবার ট্রায় করলো কিন্তু কোনো কাজ হলো না। সাঈদ রাগে ফুঁসছে। কিছুক্ষণ পর আবার মেসেজ টন বাজলো। সাঈদ মেসেজ অন করে দেখে ছোট্ট একটি মেসেজ লিখা, “ভালোবাসি”।
চলবে…….