#নিখোঁজ_প্রেমের_শহরে (পর্ব ৪)

0
486

#নিখোঁজ_প্রেমের_শহরে (পর্ব ৪)

ঈর্ষা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে ভয়ংকর কিছু ঘটে গেছে। কিন্তু কি ঘটেছে তা বুঝতে পারছে না। অতি ভয়ংকর কিছু ঘটলেই তার বাবার চোখ লালবর্ণ ধারন করে। শ্বাস প্রশ্বাস ভারী হয়ে যায়। গলার স্বর গম্ভীর শোনা যায়। কিছুক্ষণ আগেই ড্রইং রুমের টেলিফোনটা বাজছিলো। টেলিফোন ধরে বাবা হাসিমুখে কথা বলতে শুরু করেন। হো হো হাসির আওয়াজ ঈর্ষা অন্য ঘর থেকে শুনেছে। বাবার চোখ লালবর্ণ হওয়ার সাথে টেলিফোনের যোগসূত্র থাকা অস্বাভাবিক কিছু না। হেফাজত গম্ভীর গলায় ঈর্ষাকে বললেন,
বর্ষা কোথায়?
আপা মনে হয় ছাদে গিয়েছে।
হেফাজত করিম উচ্চস্বরে বললেন,
ওকে এক্ষুণি ছাদ থেকে নামতে বল। আমার সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়ানো হচ্ছে? দুই মিনিটের মধ্যে বর্ষাকে আমার সামনে উপস্থিত হতে বলবি।
রুমানা রান্নাঘরে কাজ করছিলো। বসার ঘরে চিৎকার চেঁচামেচি শুনে সে ছুটে আসলো। নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
কি হয়েছে? কি হয়েছে? এত চেঁচামেচি করছো কেনো?
চেঁচামেচি করবো না? তোমার মেয়ের একবার আমার নাক কেটে শান্তি হয় নি! নতুন করে নাক কাটার পরিকল্পনা করছে। এই ঈর্ষা, তুই দাঁড়িয়ে রইলি কেনো? ছাদে ল্যান্ড করার জন্য কি এখন হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করতে হবে? আর শোন, খবরদার বোনের লেংগুর ধরে এঘরে আসবি না। আমি না বলা পর্যন্ত মায়ের ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে থাকবি।
ঈর্ষা মাথা ঝাঁকিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।
হেফাজত করিম বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,
সব শেষ করে দিলো মেয়েটা আমার। রাস্তায় নেমে মুখ দেখাতে লজ্জা লাগে। বড় হয়ে এমন কাহিনী করবে জানলে গলা টিপে মেরে ফেলতাম।
রুমানা বিস্মিত কণ্ঠে বলল,
কি বলছো তুমি এসব? বাবা হয়ে এমন কথা তোমার মুখ দিয়ে বেরুচ্ছে কিভাবে!
কিভাবে বেরুচ্ছে দেখছো না? সামনেই তো দাঁড়িয়ে আছো! বংশের নাম ডুবিয়েও ক্ষান্ত হচ্ছে না। একদম মিটিয়ে দিতে চাইছে তোমার মেয়ে।
মেয়ের জীবনের চেয়ে সম্মান বড়?
অবশ্যই বড়।
রুমানা অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো। তার উচিত এঘর থেকে এখন বেরিয়ে যাওয়া। এমন অপমানজনক কথার পরেও ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা বেমানান। কিন্তু সে দাঁড়িয়ে আছে তার মেয়ের জন্য। বড় মেয়ের জন্য তার বুকটা ভীষণ পুড়ে

বর্ষা ছাদের কোণায় বসে আছে। এই কোণা থেকে আকাশ দেখতে ভালো লাগে। আকাশ দেখতে দেখতে সে কত কিছু ভাবে। বছরের তিনটে পার হতে পারে নি এর মাঝেই উঁচু উঁচু কয়েকটা বিল্ডিং হয়ে গেছে। সময় যায়, দিন যায়। তার সাথে তাল মিলিয়ে সবকিছু বদলে যায়। নির্দিষ্ট একটি সময়ে সূর্য ওঠে, আবার ডুবে যায়। চাঁদ ওঠে আবার আলো ফুটলে হারিয়ে যায়। গাছের পাতা ঝরে যায়, মরশুম বদলালে আবার নতুন করে গজায়। সবাকিছু নিজের মাঝে নতুনত্ব নিয়ে বেঁচে ওঠে প্রতিনিয়ত। শুধু মানুষের জীবনটা আলাদা। খুব আলাদা। তারা নতুন করে বেঁচে ওঠতে পারে না। অতীতকে সাথে নিয়ে তাদের সামনে অগ্রসর হতে হয়।
বর্ষা ছাদে আসার সময় কিছু খাবারের দানা সাথে করে নিয়ে আসে। আজও এসেছে। সেগুলো ছাদে ছড়িয়ে দিতেই কই থেকে যেনো অনেকগুলো পাখি উড়ে আসলো। পাখিরা হয়তো তার জন্যই অপেক্ষা করছিলো। তারা জানে, দিনের এই সময়টায় এবাড়ির ছাদে খাবার পাওয়া যায়।
সিড়ি দিয়ে কারো আগমনের আওয়াজ সুনিশ্চিত। বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। ঈর্ষা এসেছে। মেয়েটার চোখে মুখে ভয়। সে কাঁপা গলায় বলল,
আপা, বাবা তোমাকে ডাকছে। অনেক রেগে আছে।
গতকাল রাতেও বললি বাবা রেগে আছে। কিন্তু উনি তো রেগে ছিলেন না।
আজ সত্যিই রেগে আছেন। অনেক চিল্লাচিল্লি করছে।
কেনো?
আমি সঠিক জানি না তবে অনুমান করতে পারছি।
কি অনুমান করলি?
একটা টেলিফোন পাওয়ার পর থেকে বাবা রেগে আছে। মনে হয় ছেলের বাড়ি থেকে ফোন দিয়েছিলো। আপা, সত্যি করে বলো তো। তুমি কি এবারো বিয়েটা ভেঙ্গে দিতে চাইছো?
বর্ষা দেখলো ঈর্ষার চোখে পানি টলটল করছে। উপচে পরবে পরবে অবস্থা। ছোট বোনটা তাকে অনেক ভালোবাসে। বর্ষার ভীষণ ইচ্ছে করছে ঈর্ষাকে জড়িয়ে ধরে তার কপালে চুমু খেতে। মাঝে মাঝে ইচ্ছেগুলো ইচ্ছেই থেকে যায়। তা পূরণ করা আর সম্ভব হয় না। সে বড় করে শ্বাস নিলো। ফ্যাকাসে হেসে ঈর্ষাকে বলল,
চল নিচে যাই।

বর্ষা ড্রইং রুমে ঢুকলো। হেফাজত করিম এর মাঝেই নিজেকে কিছুটা শান্ত করেছেন। চিৎকার করে আর যাই হোক এই সমস্যার সমাধান হবে না। মেয়ের সাথে খোলসা করে কথা বলা প্রয়োজন। সে স্বাভাবিক গলায় মেয়েকে বলল,
বোস।
বর্ষা বসলো।
পাত্রের মা ফোন করেছিলেন। তিনি বললেন, তুই ছেলেকে কন্ট্র্যাক্ট ম্যারেজের অফার দিয়েছিস। কথা কি সত্যি?
প্রতিটা ম্যারেজই কন্ট্র্যাক্ট বাবা। সিভিল কন্ট্র্যাক্ট।
অতিরিক্ত কথা বলবি না। শুধু হ্যা অথবা না জাতীয় উত্তর দিবি।
আচ্ছা।
ছেলেকে কন্ট্র্যাক্ট ম্যারেজের অফার দিয়েছিস?
হু।
কেনো? ছেলেকে তোর পচ্ছন্দ হয় নি?
বর্ষা চুপ করে রইলো।
হেফাজত এবার উঁচু গলায় বললেন,
চুপ করে থাকবি না অসভ্য মেয়ে কোথাকার! এই ছেলেকে পচ্ছন্দ না হওয়ার কোনো কারণ আমি দেখছি না। তাও যদি পচ্ছন্দ না হয়ে থাকে আমা্কে সরাসরি বলতে পারতি। মানুষের সামনে আমার সম্মান নিয়ে ফুটবল খেলে বেড়াচ্ছিস! এমনিতেই তোর বিয়ে নিয়ে নানা ঝামেলা পোহাতে হয়। নিজের সম্মানের মাথা তো আগেই খেয়েছিস। লোকে দেখে নাক সিটকায়। দশজনকে দাড়া করিয়ে তোর সম্পর্কে জানতে চাইলে আটজনই যাচ্ছেতাই বলে দিবে। আল্লাহর করুনায় যাও দু একটি জাতের প্রস্তাব আসে। কদিন পর তাও আসবে না। তখন কি করবি?
যেটাই করি অন্তত তোমাদের গলার কাটা হয়ে থাকবো না।
এসব ফিল্মি ডায়লোগ আমার সামনে দিও না। অসভ্য মেয়ে কোথাকার। বাস্তবতা সম্পর্কে কি ধারনা আছে তোমার? মুখের ওপর তর্ক করছো!
বর্ষা সহজ কণ্ঠে বলল,
বাস্তবতা সম্পর্কে জ্ঞান না থাকলেও নৈতিকতা আছে আমার মাঝে।
কিসের নৈতিকতার কথা বলছিস তুই?
আমি অতীত ছাপিয়ে কাউকে বিয়ে করতে চাই না, বাবা। আর সত্যিটা জেনে তোমার জাতের পাত্ররা আমাকে বিয়ে করবে না।
তাহলে তুই কি করতে চাস? আজীবন আমার ঘাড়ে বসে খেতে চাস?
না। তোমার ঘাড়ে বসে আর খাবো না। আমাকে কটা দিন সময় দাও, নিজের ব্যবস্থা আমি নিজে করে নিবো।
কি করবি তুই?
প্রয়োজনে ভিক্ষা করবো। তাও তোমার কাছ থেকে একটা টাকাও আমি নিবো না।

বর্ষা নিজের ঘরে ফিরে এসে দরজা লাগিয়ে দিলো। বুক ভেঙ্গে কান্না আসছে তার। মাথার বালিশ কোলের ওপর রেখে মুখ চেপে ধরলো সে। হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। তার কান্নার শব্দ চার দেয়ালের মাঝেই বন্দী হয়ে রইলো।

লেখনীতে, আতিয়া আদিবা

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here