#বর্ষণের সেই রাতে পর্ব ২০+২১

0
469

#বর্ষণের সেই রাতে পর্ব ২০+২১
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

.
অনিমার সামনে ওর মামাতো ভাই অর্ক দাড়িয়ে আছে। অর্ক শয়তানি হাসি দিয়ে তাকিয়ে আছে অনিমার দিকে। সেই হাসিটা অনিমার কাছে বিষের মতো লাগছে, ইচ্ছে করছে ঠাটিয়ে গালে দুটো চড় বসিয়ে দিতে। অর্ক অনিমার হাতটা এখোনো ধরে আছে। অনিমা চোয়াল শক্ত করে বলল
— ” তুমি এখানে কী করছো? আর এখানে কেনো এসছো।”
অর্ক অনিমার হাতে একটু টান দিয়ে এগিয়ে এনে বলল
— ” কেনো? আমি এসে পরায় তোর খুব সমস্যা হয়ে গেলো? খুব ফুর্তিতে আছিস দেখছি।”
অনিমা রেগে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলল
— “ভাইয়া হাতটা ছাড়ো।”
এটা শুনে অর্ক অনিমার হাত ধরে আরেকটু কাছে টেনে বলল
— ” কেনো অন্য ছেলেকে জরিয়ে ধরতে পারিস, রিকের সাথে রাত কাটাতে পারিস, আর আমি একটু হাত ধরলেই দোষ?”
অনিমার চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো সাথে রাগ ও হচ্ছে প্রচুর, ও হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলল
— ” একটুও বদলাও নি তুমি, এখোনো সেই একই রকম আছো।”
অর্ক অনিমার হাতে চাপ দিয়ে ধরে বলল
— ” ও আমি খারাপ আর তুই কোথাকার সতী সাবিত্রী রে? ”
অনিমা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো অর্কর দিকে যদিও ও হাতে ব্যাথা পাচ্ছে কিন্তু অর্ক কী বলতে চাইছে সেটাই বুঝতে পারছেনা ও। অনিমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে অর্ক বলল
— ” কী দেখছিস? ভূল কিছু বলছি? কদিনেই এতোবড় একটা রকস্টারকে পটিয়ে নিলি, আর মন্ত্রীর ছেলেতো তোর জন্যে পাগল, ওর সাথে তো রাত ও কাটিয়েছিস। তাহলে আমি কী দোষ করলাম হ্যা? ওদের মতো অতো টাকা না থাকলেও কম তো নেই? আর দেখতেও ওদের থেকে খুব বেশি খারাপ না তাহলে?”
অনিমার ঘৃণা হচ্ছে সামনে দাড়িয়ে থাকা এই লোকটাকে। একটা মানুষের চিন্তাধারা এতো নিচু হতে পারে? ছিহ। অনিমা অর্কের দিকে তাকিয়ে বলল
— ” এরকম নোংরা চিন্তাধারা শুধু তোমার মতো মানুষেরই আছে।”
অর্ক আরো জোরে চেপে ধরল অনিমার হাত, ব্যাথায় কুকিয়ে উঠলো ও, চোখ দিয়ে না চাইতেও পানি গড়িয়ে পরল। অর্ক দাঁতে দাঁত চেপে বলল
— ” ও তো তুই বলতে চাইছিস রিক তোর সাথে কিছুই করেনি? যতোবার রিক তোকে দেখতে আসতো রুমে গিয়ে দরজা লক করে দিতো, কেনো সেটা বুঝিনা আমরা? এতোটাই বোকা ভাবিস আমাকে?”
একেই হাতে ব্যাথা পাচ্ছে তারওপর অর্কর এসব কথা শুনে অনিমা নিজেকে সামলাতে পারছেনা তাই কেদে দিয়ে বলল
— ” তুমি নিজে যেমন সবাইকে ঠিক সেরকম ভাবো তাইনা?”
— ” ওও তো রিক খুব ভালো, ধোয়া তুলসি পাতা তাইনা?”
অনিমা নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলল
— ” না উনি খারাপ, খুব খারাপ একজন মানুষ। কিন্তু এই দিক দিয়ে তোমার চেয়ে হাজারগুন ভালো। ঐ দুই বছরে উনি চাইলেই আমার সাথে যা খুশি করতে পারতেন, বাধা দেবার ক্ষমতা না আমার ছিলো না অন্য কারো। কিন্তু উনি এমন করেননি, কোনোদিন ঐরকম কোনো উদ্দেশ্যে আমাকে স্পর্শও করেননি। যতোবার আমাকে ছুয়েছেন শুধু মারার জন্যেই ছুয়েছেন। কিন্তু তুমি আমার সাথে কী করেছো সেটা নিশ্চই বলে দিতে হবেনা?”
অর্ক বাকা হেসে অনিমার হাতে আরো চাপ দিয়ে বলল
— “বাহ খুব বুলি ফুটেছে দেখছি? মনের সব ভয় চলে গেছে নাকি?”
অনিমার মনে হচ্ছে ওর হাত ভেঙ্গেই যাবে এতো জোরে চেপে ধরেছে কিন্তু অর্কর এসব কথায় ওর ব্যাথার চেয়ে এখন রাগ বেশি হচ্ছে। তাই ও রাগী কন্ঠে বলল
— ” তোমাকে ভয় পাইনা আমি, আগেও পেতাম না, আর না ভবিষ্যতে পাবো। আমি শুধু তোমাকে ঘৃণা করি।”
অর্ক এবার অনিমার হাত পেছনে নিয়ে মুচড়ে ধরে বলল
— ” তাইনা? তো রিককেও ভয় পাসনা?”
এটা শোনার সাথেসাথেই অনিমার রাগী চেহারায় হালকা ভয় মিশ্রিত হলো, বুকের ভেতর ধক করে উঠল। অনিমার ঐ ফেস রিয়াকশন দেখে অর্ক হেসে অনিমার হাতে আরেকটু মোচড় দিয়ে বলল
— ” কী ওর নাম শুনেই সব তেজ শেষ?”
অনিমা এবার কাদো কাদো গলায় বলল
— ” কেনো এভাবে আমার পেছনে পরে আছো তোমরা? তোমাদের তো আমার বাবার সব প্রপার্টি চাই, আমি তো দিয়েই এসছি সব, ওসবের দাবি নিয়ে তো যাইনি আমি, আর আমি কথা দিচ্ছি কোনোদিন যাবোও না। তবুও প্লিজ চলে যাও এখান থেকে, একটু শান্তি দাও আমায়।” অর্ক শব্দ করে হেসে দিলো অনিমার কথায়, তারপর অনিমার হাতে একটু টান দিয়ে আরো কাছে এনে বলল
— ” তোর খোজ যদি আমরা রিক কে দেই তার বিনিময়ে আমি কী পাবো জানিস? একটা মোটা অঙ্কের ক্যাস।”
অনিমা অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল
— ” শুধু টাকার জন্যে তোমরা..?
— ” হ্যা শুধু টাকার জন্যেই। এবার শোন তোকে একটা সুযোগ দিচ্ছি, চুপচাপ আমার সাথে আমাদের বাড়িতে চল। তারপর আমি রিক কে বলবো যে তুই নিজের ভূল বুঝতে পেরে নিজেই ফিরে এসছিস। এতে হয়তো তোর শাস্তিটা কমে যাবে।”
অনিমা কাদতে কাদতে বললো
— ” তোমরা সত্যিই অমানুষ।”
অর্ক এবারো হেসে দিয়ে অনিমার হাতে আরো চাপ দিয়ে বলল
— ” সেটা তুই আজকে বুঝলি? শোন রিক ঠিক পেয়ে যাবে তোকে খুব তাড়তাড়ি, তাই নিজের ভালো চাইলে যেটা বলছি সেটাই কর। চল।”
এবার হাতের ব্যাথাটা অসহনীয় হয়ে উঠছে অনিমার, তাই হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলল
— ” আমি যাবোনা।”
— ” ওকে ফাইন আমিও দেখছি তুই কীকরে থাকিস। ইচ্ছেতো করছে এখুনি তুলে নিয়ে যাই কিন্তু এটা পাবলিক প্লেস তাই সেটা করতে পারবোনা। তবে দেখে নেবো তোকে।”
এটুকু বলে অনিমার হাতটা ঝারা দিয়ে ছেড়ে দিয়ে ওখান থেকে চলে গেলো অর্ক। আর অনিমা হাত ধরে ওখানেই বসে কাদতে লাগল। হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলো গভীর দাগ হয়ে আছে হাতে। কাদতে কাদতে হিচকি উঠে গেছে ওর। অনেক্ষণ কেদে তারপর উঠে নিজেকে স্বাভাবিক করে চোখে মুখে পানি দিয়ে চলে গেলো ওদের কাছে। তারপরেই তীব্রর গাড়িতেই বাড়ি চলে আসে ও।
______________

ফোনের আওয়াজে নিজের কল্পনা থেকে বেড়িয়ে এলো অনিমা, কান্না থামিয়ে ফোনের স্ক্রিণে তাকিয়ে দেখে অরুমিতার ফোন, নিজেকে স্বাভাবিক করে ফোনটা রিসিভ করে কিছু বলবে তার আগেই অরুমিতা বলল
— ” অনি আজকের নিউস পেপার পড়েছিস?”
— ” নাহ রে সারাদিন তো তোদের সাথেই ছিলাম বার্থডের ঝামেলাতে পড়া হয়নি। কেনো?”
— ” পেপারে তোর আর এডির ছবি বেড়িয়েছে।”
অনিমা যেনো আকাশ থেকে পড়ল, অবাক হয়ে বলল
— ” হোয়াট?”
— ” হ্যা রে আমিও তো জানতাম না, সারাদিন তোর বার্থ ডে নিয়ে বিজি ছিলাম, তাই জানতে পারিনি। তুই দেখ।”
অনিমা কাপা কাপা গলায় বলল
— ” অ্ আচ্ছা রাখছি।”
ফোনটা রেখেই অনিমা তাড়াতাড়ি ল্যাপটপ অন করল তারপর নিউসটা দেখে অনিমা চমকে উঠল। ল্যাপটপের মনিটরের দিকে তাকিয়ে একহাতে মুখ চেপে ধরলো ও, কালকে এতোই খুশি ছিলো যে জার্নালিস্ট এসছে তার ফল কী হতে পারে ওর মাথাতেই আসেনি। ও তো আদ্রিয়ানকে নিয়ে ব্যাস্ত ছিলো, এসব মাথাতেও আসেনি ওর। ল্যাপটপটা অফ করে দুই হাতে মাথা চেপে ধরলো, কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে শব্দ করে কেদে দিলো, কাদতে কাদতে বলল
— ” এবার ও ঠিক পেয়ে যাবে আমাকে। নাহ আমি যাবো না, কোথাও যাবোনা আমি। আমি যেতে চাইনা ওখানে, প্লিজ।”
আচ্ছা ওখানে তো আদ্রিয়ানের ও ছবি আছে, আদ্রিয়ানের কোনো ক্ষতি করে দেবেনাতো রিক? ওর জন্যে আদ্রিয়ান বিপদে পরবে না তো? এসব ভেবেই ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদতে শুরু করলো। ওর মাথায় শুধু একটা চিন্তাই চলছে কী করবে ও? কোথায় যাবে? কার কাছে যাবে? কে বাঁচাবে ওকে?
এসব ভাবতে ভাবতেই আবারো ফোন বেজে উঠলো। পাশে রাখা ফোনটার স্ক্রিণে তাকিয়ে দেখলো আদ্রিয়ান ফোন করেছে। চোখ মুছে কয়েকটা শ্বাস নিয়ে স্বাভাবিক হয়ে ফোনটা রিসিভ করে বলল
— ” হ্যালো।”
— ” হাই। কী খবর আমাকে ভূলেই গেছো মনে হয়? সেইযে রেস্টুরেন্ট থেকে বেড়োলাম একটু খোজও নিলে না আর?”
অনিমা নিজের গলাটা যথেষ্ট স্বাভাবিক রেখে বলল
— ” নাহ আসলে এমনিই।”
আদ্রিয়ানের কেনো জানি মনে হচ্ছে অনিমা ঠিক নেই। তাই একটু চিন্তিত কন্ঠে বলল
— ” কী হয়েছে অনি? আর ইউ ওকে?”
অনিমার খুব কান্না পাচ্ছে। ওর এখন ইচ্ছে করছে আদ্রিয়ানকে জরিয়ে ধরে ইচ্ছে মতো কাদতে, ওকে বলতে ইচ্ছে করছে আ’ম নট ওকে আদ্রিয়ান, ভালো নেই আমি। পারছিনা আমি আর এসব সহ্য করতে। প্লিজ আমাকে এসবের দূরে কোথাও নিয়ে যান। কিন্তু অনিমা তার কিছুই করতে বা বলতে পারছেনা। অনেক কষ্টে নিজের কান্না আটকে বলল
— ” ইয়াহ আ’ম ওকে।”
আদ্রিয়ান সন্দেহ মিশ্রিত কন্ঠে বলল
— ” আর ইউ সিউর?”
— ” হ্যা।”
— ” কোনো কারণে তুমি ঐ নিউসটার জন্যে আপসেট নও তো? দেখো ওগুলো সিরিয়াসলি নিওনা কিচ্ছু হবে না।”
— “নাহ সেসব কিছু না।”
অনিমা বুঝতে পারছে যে এখন বেশিক্ষণ আদ্রিয়ানের সাথে কথা বললে ও ওর আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেনা তাই বলল
— ” আমার খুব ঘুম পাচ্ছে রাখছি হ্যা?”
আদ্রিয়ান ভ্রু কুচকে ফেলল, কিছুতো গন্ডগল আছে সেটা বুঝতে পারছে ও, তবুও বলল
— ” শোনো? ”
অনিমা ফোন রাখতেই নিচ্ছিলো আদ্রিয়ানের আওয়াজ পেয়ে ফোনটা আবার কানে তুলে বলল
— ” হুম?”
— ” কালকে আমি তোমার ফ্লাটের সামনে থেকে তোমাকে অফিসে ড্রপ করে দেবো।”
— ” না না তার দরকার নেই আমি যেতে পারবো।”
আদ্রিয়ান গম্ভীর মুখে বলল
— ” আমি জিজ্ঞেস করিনি তোমায়, জানিয়ে দিলাম।”
— ” কিন্তু..”
— ” কাল আমি আসছি তোমায় নিতে দ্যাটস ফাইনাল।”
অনিমা আর কিছু বলার আগেই আদ্রিয়ান ফোন কেটে দিলো। অনিমা খাটে হেলান দিয়ে ভাবছে, কী করবে এবার থেকে তো চাইলেই দুদিনে চলে যেতে পারবেনা? আর তাছাড়াও কতোদিনি বা পালাবে ও?
আর ওদিকে আদ্রিয়ান ভাবছে কিছু তো চলছে অনিমার মনে, ও ভালো নেই, কিছুতো আছে যেটা ও গোপন করছে, কিন্তু সেটা কী? ওকেই এবার দেখতে হবে ব্যাপারটা।
______________

মিস্টার রঞ্জিত আর কবির শেখ সবে বাসায় ফিরলো, হঠাৎই মিস্টার রঞ্জিতের মোবাইল বেজে উঠলো। ভ্রু কুচকে ফোনটা রিসিভ করে বলল
— ” হ্যা বলো।”
রিক গম্ভীর কন্ঠে বলল
— ” এখানকার সব কাজ শেষ কালকে আসতে পারবোতো আমি?”
মিস্টির রঞ্জিত ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল
— ” কাজ শেষ হয়ে গেলে আর থাকবে কেনো?”
— ” বাই।”
বলেই ফোনটা রেখে দিলো রিক। তারপর রাগে গজগজ করে বলল
— ” আমি আসছি কালকেই আসছি। বার্থডে সেলিব্রেট করার, অন্য ছেলেকে হাগ করার খুব শখ তাইনা? তোমার সব শখ এবার আমি মেটাবো। আর মিস্টার আদ্রিয়ান আবরার জুহায়ের, আমার জিনিসে হাত দেবার যেই দুঃসাহস তুমি করেছো তার দাম তোমাকে নিজের প্রাণ দিয়ে চোকাতে হবে। আমি নিজের হাতে মারবো তোমাকে, নিজের হাতে।”
এদিকে ফোন কেটে মিস্টার রঞ্জিত কবির শেখকে বললেন
— ” কালকে রিক আসছে।”
কবির শেখ চিন্তিত কন্ঠে বললেন
— ” জিজু ও এবার এসে কিন্তু একটা খুনখারাপি করবেই। আপনাকে একটু চোখ কান খোলা রাখতে হবে।”
মিস্টার রঞ্জিত হেসে বললেন
— ” সেই ব্যবস্হা আমি করে ফেলেছি। যদি রিক ঐ রকস্টার কে খুন করে তো কেউ লাশ ও খুজে পাবেনা।”
কবির শেখ ফোন চাপতে চাপতে বললেন
— ” আর আদ্রিয়ানকে কারা কারা মারতে চায় তার একটা লিস্ট ও আমি বানিয়েছি। কাউকে একটা ফাসিয়ে দেবো।”
মিস্টার রঞ্জিত আর কবির শেখ দুুজনেই দুজনের দিকে তাকিয়ে হাসলেন।
______________

অনিমা পাঁচ মিনিট ধরে নিচে দাড়িয়ে আছে আদ্রিয়ানের আসার জন্যে। কিন্তু ওর মনে কালকে ঘটা ঘটনাগুলোই মাথায় আসছে। এসব ভাবতেই ভাবতেই আদ্রিয়ান চলে এলো। আদ্রিয়ান নেমে গাড়ির দরজা খুলে দিলো অনিমা চুপচাপ উঠে বসল, আদ্রিয়ানও ড্রাইভিং সিটে বষে গাড়ি স্টার্ট করল। আদ্রিয়ান অনিমা দুজনেই চুপ করে আছে, আদ্রিয়ানের নিরবতা অনিমাকে একটু অবাক করছে। বেশ কিছুক্ষণ পর আদ্রিয়ান গাড়ি থামিয়ে দিলো। অনিমা অবাক হয়ে বলল
— “কী হলো এখানে থামালেন কেনো?”
আদ্রিয়ান অনিমার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে বলল
— ” তোমার কী হয়েছে সেটা বলো?”
অনিমা একটু ঘাবড়ে গেলো কোনোমতে নিজেকে সামলে বলল
— ” কী হবে? কিছুই হয়নি।”
— ” বাট তুমি..”
আর কিছু বলার আগেই আদ্রিয়ানের চোখ পরল অনিমার হাতের দিকে। আদ্রিয়ান অনিমার হাতটা সামনে এনে ভ্রু কুচকে বলল
— ” হাতে কী হয়েছে?”
অনিমা হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলো দাগ হয়ে আছে, কালকে অর্ক এতোই জোরে চেপে ধরেছিলো যে এমন দাগ তৈরী হয়েছে, নখ ও গেধে গেছে দুটো। কিন্তু আদ্রিয়ানকে কীকরে বলবে এসব? অনিমাকে চুপ থাকতে দেখে আদ্রিয়ান বলল
— ” কীহলো বলো?”
অনিমা মাথা নিচু করে বলল
— ” ব্যাথা পেয়েছি।”
আদ্রিয়ান গম্ভীর কন্ঠে বলল
— ” কীভাবে?”
— ” নিজেও জানিনা কীভাবে হলো।”
আদ্রিয়ান অবাক হয়ে বলল
— ” মানে কী?”
অনিমা কী বলবে কীছুই বুঝতে পারছেনা তাই মাথা নিচু করে বলল
— ” অফিসে লেট হয়ে যাচ্ছে আমার।”
— ” কিন্তু..”
— ” প্লিজ।”
আদ্রিয়ান আর কিছু না বলে গাড়ি স্টার্ট করল। ও খুব ভালোই বুঝতে পেরেছে অনিমা কিছু আড়াল করছে কিন্তু এখন এসব জিজ্ঞেস করে লাভ হবেনা সেটাও বুঝতে পারছে। আদ্রিয়ান ভাবছে ওর অফিস শেষে নিরিবিলি কথা বলতে হবে ওর সাথে।
____________

অফিসে এসে অনিমা অরুমিতা বা তীব্রর সাথে কথা না বলেই ডেস্কে কাজে বসে পরলো। অরুমিতা আর তীব্র বেশ অবাক হলো, আজ জেনো আবার সেই অনিমাকে দেখছে ওরা। কিন্তু হঠাৎ কী হলো মেয়েটার? কালকে রেস্টুরেন্টে ওয়াসরুম যাবার আগে অবধিতো কত্তো খুশি ছিলো ও, আজ কী হলো? ওরা অনিমাকে কিছু বলবে তার আগেই অনিমার ডাক পরলো বসের কেবিন। অনিমা একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে উঠে চলে গেলো ওর বসের কেবিনের দিকে। অরুমিতা আর তীব্র ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। অনিমা কেবিনের দরজার সামনে গিয়ে বলল
— “মে আই কাম ইন স্যার?”
— “এসো?
অনিমা ভেতরে গিয়ে দাড়াতেই ওর বস আনোয়ার হোসেন বলল
— ” সিংগার এডি তোমার বার্থডে সেলিব্রেট করেছে?”
অনিমা ইতোস্তত করে বলল
— “জ্বী স্যার।”
অানোয়ার হোসেন বলল
— ” তারমানে উনি তোমার বয়ফ্রেন্ড?”
অনিমা অবাক হয়ে গেলো এই কথায়, অবাক হয়েই বলল
— ” সরি স্যার বাট একটা ছেলে একটা মেয়ের বার্থডে সেলিব্রেট করা মানেই তারা বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড হবে তার কোনো মানে নেই। ওরা বন্ধুও হতে পারে।”
আনোয়ার হোসেন হেসে বললেন
— ” আমি জানি সেটা। কিন্তু ধরো যদি এটাকেই ব্রেকিং নিউস বানানো হয় যে তোমরা একে ওপরকে ডেট করছো এন্ড প্রমাণ হিসেবে তোমার সিকারক্তি থাকে নিউসটা কতো চলবে ভেবেছো?”
অনিমা অবাক হয়ে বলল
— ” মানে?”
— ” মানে তো বুঝেই গেছো। দেখো এই নিউসটার জন্যে টাকাও পাবে তুমি, তুমি নিজে আর্টিকেল লিখবে সেই টাকাও পাবে আর আমাদের কম্পানির ও লাভ তাইনা?”
অনিমার যেনো অবাকের শেষ পর্যায় চলে গেলো। সমাজটা এমন কেনো? মানুষরাই বা এমন কেনো? সবাই আমাদের মানুষ বলে কিন্তু মানবিকতা কোথায়? কীসের ভিত্তিতে আমরা মানুষ? যেখানে নিজের সার্থের জন্যে অন্য কারো চরম ক্ষতি করতেও দুবার ভাবছেনা। হিংস্র পশুল চেয়ে কোন দিক দিয়ে কম অামরা? একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে অনিমা বলল
— ” তো স্যার আমি জার্নালিস্ট নাকি বিজনেসম্যান?”
আনোয়ার হোসেন ভ্রু কুচকে বললেন
— ” হোয়াট ডু ইউ মিন?”
— ” মানে একটা খবরকে বেশি আকর্ষণীয় করতে আর সুস্বাদু করতে তাতে তেল, ঝাল, মশলা মিশিয়ে বাজারে বিক্রি কারাকে তো ব্যাবসাই বলে না স্যার? লাইক ইনভেসমেন্ট আর প্রফিট?”
আনোয়ার হোসেন ধমকে বললেন
— ” অনিমা?”
অনিমা ওর বসের চোখে চোখ রেখে বলল
— ” সরি স্যার। আপনি আমি আমরা দুজনেই জার্নালিস্ট। একজন জার্নালিস্টের কাজ সঠিক তথ্যগুলো সকলের মাঝে পৌছে দেওয়া, সকলকে সত্যের খোজ দেওয়া, মিথ্যা ফাস করে দেওয়া, সমাজের ভদ্র মুখোশ পরা নরপশুগুলোকে সবার সামনে তুলে ধরা। এগুলোই জার্নালিসম স্যার, সত্যের জন্যে লড়াই করাই আসল জার্নালিসম। কিন্তু আমরা কী করছি কোনো সেলিব্রিটির বাচ্চা জন্মানোর খবর, কোথায় কোন সেলিব্রিটি ডিনারে গেলো কার সাথে গেলো, হানিমুনে কোথায় গেলো, বার্থডে পার্টিতে কী হলো, এগুলো প্রচার করি যদি খবর রসালো না হয় নিজেরা একটু রস মাখিয়ে নেই। আর সমাজের মুখশধারী কিটগুলোকে তেল দিয়ে যাই যেনো তারা নিউস কম্পানির জন্যে মোটা অংক ডোনেট করে। এটা কী সত্যিই জার্নালিসম স্যার নাকি বিজনেস? আপনি যদি কোনো নিউসের ইনভেস্টের বিনিময়ে প্রফিটের জন্যে মিথ্যা, বা অর্ধ সত্যগুলোকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে চান, দেন আই এম ভেরি সরি টু সে স্যার আপনার একজন জার্নালিস্ট নয় বিজনেসম্যান হওয়া উচিত ছিলো।”
আনোয়ার হোসেন মাথা নিচু করে আছেন। অনিমা কিছু না বলে বেরিয়ে গেলো কেবিন থেকে। মাথায় আগুন জলছে ওর। কী পেয়েছে কী এরা জার্নালিসম কে ব্যাবসা বানিয়ে রেখেছে। এদের জন্যে জাস্ট এদের জন্যে অনেকেই খবরের কাগজে দেখানো নিউস বিশ্বাস করতে চায় না, জাস্ট এদের মতো জার্নালিস্টদের জন্যে।
.

#পর্ব- ২১
.
গাড়িতে মাথা নিচু করে বসে আছে অনিমা। আর আদ্রিয়ান চুপ করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখে চলেছে ওকে। অনিমার ব্রেক টাইমে ওর অফিসে ঢুকে সবার সামনেই হাত ধরে টেনে নিয়ে এসছে ওকে। মেয়েটার চুপ থাকা সহ্য হচ্ছেনা ওর আর, আদ্রিয়ান এবার ধমকের সুরে বলল
— ” আমি অনেকক্ষণ যাবত তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করছি উত্তর দাও।”
অনিমা নিচু কন্ঠে বলল
— ” আমিতো বলেছি আমার কিচ্ছু হয়নি আমি ঠিক আছি।”
আদ্রিয়ান অনিমার হাত ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল
— ” দেখো ডোন্ট ওয়ান্ট টু বি ওভার স্মার্ট ওকে? এ কয়দিনে খুব ভালোকরে চিনেছি আমি তোমাকে। কিছুতো হয়েছে সেটা আমি নিশ্চিত, কিন্তু সেটা কী? ”
অনিমা আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করে বলল
— ” আপনি ভূল ভাবছেন। আসলে দুদিন ধরে আব্বুর কথা একটু মনে পরছে তাই আরকি।”
আদ্রিয়ান চোখ ছোট ছোট করে অনিমার দিকে তাকিয়ে বলল
— ” আই সেইড ডোন্ট ওয়ান্ট টু বি ওভার স্মার্ট।”
অনিমা এবার মাথা নিচু করে বসে আছে। আদ্রিয়ান একটা ছোট্ট শ্বাস ছেড়ে বলল
— ” শোনো আজ রাতে আমার শো আছে তাই ফোন সাইলেন্ট থাকবে, দরকার হলে একটা মিসডকল দিয়ে রেখো আমি ব্যাক করব।”
অনিমা মাথা নেড়ে গাড়ি থেকে নামতে গেলেই আদ্রিয়ান ওর হাত ধরে বলল
— “কিছু বললেনা খুব ভালো কথা। কিন্তু এরপর যদি তোমার কোনো ক্ষতি বা বিপদ হয়, আই উইল নট স্পেয়ার ইউ, মাইন্ড ইট।”
এটুকু বলে হাত ছেড়ে দিলো আদ্রিয়ান অনিমা নামতেই ও গাড়ি স্টার্ট করে চলে গেলো। আর অনিমা অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ওর যাওয়ার দিকে। আর মনে মনে বলল আই এম সরি আদ্রিয়ান, কিন্তু আমাকে এটা করতেই হলো আপনার ভালোর জন্যে।
____________

এদিকে রিকের ফার্মহাউজে বসে ভাঙা হাত নিয়ে রিকের আসার অপেক্ষা করছে অর্ক। আসলে গতকাল সন্ধ্যায় কয়েকজন লোক এসে ওকে মেরে ওর ডান হাত ভেঙে দিয়ে গেছে আর একটা হুমকি চিঠিও ধরিয়ে দিয়ে গেছে। এখন ওর মনে একটা কথাই চলছে কার লোকেরা এসে ওর হাতটা ভেঙে দিয়ে গেলো, আর হুমকি চিঠি দিয়ে গেলো ? রিকের লোক? কিন্তু রিক তো কোলকাতা ছিলো একটু আগে বাংলাদেশে ল্যান্ড করল। অনিমার সাথে ও কেমন বিহেভ করে সেটাতে রিক জানেনা, তাহলে? এসব ভাবতে ভাবতেই রিক চলে এলো। রিককে দেখেই অর্ক দাড়িয়ে গেলো। রিক অর্কর ভাঙা হাতের দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বলল
— ” তোমার হাতের এই অবস্হা কে করল?”
অর্ক বুঝতে পারলো যে রিক এসব করেনি তাহলে কে করল? তবুও সিউর হতে বলল
— ” আসলে পরে গেছিলাম বাথরুমে। আচ্ছা আপনি কী আমায় কোনো চিঠি দিয়েছেন?”
রিক বসে বিরক্ত হয়ে বলল
— ” ফোন, ম্যাসেজের এতো সিস্টেম থাকতে আমি চিঠি দেবো কোন দুঃখে, তাও তোমাকে?”
অর্ক এবার সিউর হলো যে রিক এসব করায়নি। রিক গম্ভীর কন্ঠে বলল
— ” কী বলতে এসছো সেটা বলো?”
— ” আপনাকে একটা খবর দেবার আছে, মানে অনিমার খবর পেয়ে গেছি।”
রিক হেসে দিলো অর্কর কথায়। রিকের হাসি দেখে অর্ক অবাক হলো। হাসি থামিয়ে রিক বলল
— ” অনিমার খোজ আরো পাঁচ দিন আগেই পেয়েছি। কী করছে, কোথায় করছে, কীভাবে করছে সব খবর আছে আমার কাছে। আর আজকেই আমি যাচ্ছি ওকে অানতে। নতুন কিছু বলার থাকলে বলো নইলে যাও।”
অর্ক একটু নিরাশ হলো, কোথায় ভাবলো যে এই খবর দিয়ে মোটা অংকের টাকা হাতাবে সেটা আর হলোনা। রিক বুঝলো অর্ক আর কিছু বলবেনা তাই উঠে বেড়িয়ে গেলো।
অর্ক সেই চিঠিটা বের করে ভাবলো কে হতে পারে? রিকের চেয়েও ভয়ংকর আদোও কেউ আছে? যে এমন হাড় হিম করা হুমকি দিতে পারে? চিঠিতা খুলে আরেকবার পরলো অর্ক তাতে লেখা আছে
” ইচ্ছেতো করছে তোর গলা কেটে দেই। কিন্তু আমার জানতে পারা এটা তোর প্রথম ভূল তাই শুধু হাতটা ভাঙলাম। ওর হাতে যতোটা না লেগেছে তার থেকে একশগুন বেশি আমার বুকে লেগেছে। এরপর ওর গায়ে হাত দেওয়াতো দূর ওর দিকে তাকালে শুধু চোখ দুটো উপড়াবো তাইনা তোর শরীরের একটা রগও অক্ষত থাকবেনা, আই প্রমিস।”
লেখাটা পরে বড়সর একটা ঢোক গিলল অর্ক। আর ভাবতে লাগল কে এই অজ্ঞাত ভয়ংকর ব্যাক্তি?
_____________

অনিমা ডেস্কে গিয়ে বসতে না বসতেই তীব্র বলল
— ” কীরে কী হয়েছে? ভাইয়া তোকে এভাবে টেনে নিয়ে গেলো কেনো?”
অনিমা একটা শ্বাস নিয়ে বলল
— ” আমার কী হয়েছে সেটা জানতে।”
অরুমিতা হতাশ কন্ঠে বলল
— ” সেটাতো আমরাও জানতে চাইছি। কী হয়েছে তোর?”
হঠাৎই তীব্র কিছু একটা ভেবে বলল
— ” এই এক মিনিট? পেপারে তোর ছবি ছেপেছে, তারমানে রিক তোর খোজ পেয়ে যাবে বা গেছে! এইজন্যেই তুই এতো আপসেট? সিট আগে কেনো মাথায় আসেনি?”
অনিমা ছলছলে চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে বলল
— ” কালকে অর্ক ভাইয়াও এসছিলো।”
অরুমিতা অবাক হয়ে অনিমার দিকে তাকিয়ে বলল
— “কী ওই জানোয়ারটা মানে তোর মামাতো ভাই এসছিলো? এইজন্যেই তোর চোখমুখ এমন ছিলো?”
তীব্র ডেস্কে একটা পাঞ্চ মেরে বলল
— ” এরা কী চায়টা কী? একটা মেয়ের জীবণকে নরক বানিয়ে রেখেছে।”
অরুমিতা অনিমার কাধে হাত রেখে বলল
— ” এডি কে বলেছিস কিছু?”
অনিমা মাথা নাড়ল। অরুমিতা রেগে গিয়ে বলল
— ” সমস্যা কী তোর বলতো? কী শুরু করেছিস তুই? ওনাকে সবটা বললেও তো উনি কিছু একটা করতে পারবেন, এভাবে চুপ করে থাকার মানে কী? কী পেয়েছিস কী তুই? কেনো করছিস এসব?”
অনিমা এবার চেচিয়ে বলে উঠল
— ” কারণ আমার খুজ সখ হয়েছে ঐ রিকের কাছে যাওয়ার, দিনরাত ওর টার্চার সহ্য করার। সেইজন্যেই করছি এসব। হয়েছে?”
বলেই কেদে দিলো অনিমা তীব্র উঠে গিয়ে ওকে একহাতে জরিয়ে ধরল। অনিমা কাদতে কাদতেই বলল
— ” হতে পারিনি আমি এতোটা স্বার্থপর। কারণ আমি চিনি আদ্রিয়ান কে। এসব শুনলে ও চুপ থাকবে না। রঞ্জিত চৌধুরী, রিক চৌধুরীর সাথে লড়তে নেমে যাবে। ঢাল হয়ে দাড়াবে আমার সামনে। কিন্তু আমিতো জানি ওই রঞ্জিত চৌধুরীরা কতো ভয়ংকর, কতোটা নৃশংস। আদ্রিয়ান ওদের মতো ক্রিমিনাল নয়, আর না এসব খুনখারাপিতে থাকে। তাহলে কীকরে লড়বে ওদের সাথে? যদি রিক আমাকে ধরেও নেয় তো আমি ওকে বুঝিয়ে দেবো যে আদ্রিয়ানের সাথে আমার তেমন কিছুই নেই, ওকে যাতে কিছু না করে, তার বিনিময়ে যদি আমায় সারাজীবণ রিকের কাছে থাকতে হয় থাকবো আমি, তাহলে রিক ঠিক শুনবে আমার কথা এটুকু জানি আমি। কিন্তু আদ্রিয়ান নিজে এসবে জরালে ওকে ছাড়বেনা ওরা। আমি নিজের চোখে আমার আব্বুর মৃত্যু দেখেছি, আদ্রিয়ানের মৃত্যু দেখতে পারবোনা। পারবোনা আমি।”
বলেই আরো জোরে কাদতে লাগল। এবার অরুমিতাও এসে জরিয়ে ধরল ওকে। এইরকম একটা মেয়েকে কেউ এতো কষ্ট কীকরে দিতে পারে সেটাই ভেবে পাচ্ছেনা অরুমিতা আর তীব্র
_____________

রাতে অনিমা ফ্লাটে এসে দরজা খুলতে গিয়ে দেখলো দরজাটা খোলা এতে বেশ অনেকটাই অবাক হলো ও। ওতো দরজাটা তালা লাগিয়ে গেছিলো খুললো কে? অনিমার আস্তে করে দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকলো, লাইট অফ তাই সব অন্ধকার, ভেতরে ঢোকার পর কয়েক কদম এগোতেই দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ হয়ে গেলো। অনিমা চমকে পেছনে তাকালো তাড়াতাড়ি দরজার কাছে গিয়ে দেখলো দরজাটা বন্ধ, ভয়ে ওর আত্না শুকিয়ে আসছে। কে? দরজাটা কে বন্ধ করলো? ও দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে বলল
— ” হ্যালো? দরজাটা কে বন্ধ করলেন? দেখুন এটা ভালো হচ্ছেনা কিন্তু। খুলুন দরজা। আজব তো এসব কেমন মজা? দরজা খুলুন।”
কিন্তু কারো কোনো সারা না পেয়ে ভয় পেয়ে গেলো ও। কে এমন করল? হঠাৎ করেই রুমে লাইট জ্বলে উঠলো, অনিমা পেছনে ঘোরার আগেই কেউ বলে উঠল
— “কেমন আছো বেইবি?”
কন্ঠটা শোনার সাথে সাথেই অনিমা শিউরে উঠলো, ওর শরীরের রক্ত যেনো হিম হয়ে আসছে, পেছনে তাকিয়ে দেখার মতো সাহস হচ্ছেনা ওর। ও এসে গেছে? এখানে পৌছে গেছে ও? নাহ নিশ্চই কোনো স্বপ্ন দেখছে ও, এটা হতেই পারেনা। এক্ষুনি ওর স্বপ্ন ভেঙ্গে যাবে, কিন্তু এই স্বপ্ন ভাঙছে না কেনো? ও আর পারছেনা এই স্বপ্ন সহ্য করতে। এসব ভাবতে ভাবতেই পেছন থেকে আবার আওয়াজ এলো
— ” কী হলো আমার মুখটা কী এতোই বাজে যে পেছন ঘুরে দেখতেও চাইছোনা?”
অনিমা হালকা কেপে উঠল, তারপর ভয়ে ভয়ে পেছনে তাকালো। আর পেছনে তাকিয়েই অনিমা চমকে গেলো। কারণ রিক সিংগেল সোফায় পায়ের ওপর পা তুলে বসে আছে, ওর মুখে বাকা হাসি। অনিমার হাত পা কাপঁতে শুরু করল, ওর পুরো শরীর যেনো জমে গেছে, নরার সামান্য শক্তিও পাচ্ছেনি এইমুহুর্তে ওর। তিনবছর পর আবার এই লোকটার সম্মখিন হলো ও। রিক আস্তে করে উঠে এগোতে লাগল অনিমার দিকে, অনিমা নিজের অজান্তেই পিছিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। রিক অনিমার দিকে এগোতে এগোতে বলল
— ” তুমি পিছিয়ে যাচ্ছো কেনো? কতোদিন পর দেখা হলো আমাদের কোথায় ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করবে তা না।”
রিকের এই ঠান্ডা গলাও অনিমার কাছে খুব ভয়ংকর লাগছে, ওর শ্বাস আটকে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে কেউ ওর শ্বাসনালী কেটে দিয়েছে। ও কয়েক কদম পিছিয়েই ছুটে দরজার কাছে গিয়ে দরজা খোলার চেষ্টা করতে লাগল আর চেচাতে শুরু করলো। রিক হাত ভাজ করে দেখছে অনিমাকে, অনিমার এই প্যানিক হয়ে যাওয়াটা বেশ ইনজয় করছে ও। মেয়েটা এখনও একি রকম ভয় পায় ওকে। আর ওর এই ভয় পাওয়াটা রিক কে অদ্ভুত শান্তি দেয়। অনেক্ষণ দরজা ধাক্কিয়ে কারো কোনো সারা না পেয়ে অনিমা আস্তে আস্তে পেছনে তাকালো, রিককে ওর দিকে এগিয়ে আসতে দেখে ও ভয়ে দরজার সাথে লেগে দাড়িয়ে রইলো। রিক এসে অনিমার পাশ দিয়ে দরজায় হাত রেখে বলল
— ” বাইরে আমার লোক দাড়িয়ে আছে, আমি বলার আগে ওরা দরজা খুলবে না।” অনিমা অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো রিকের দিকে। গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হচ্ছে না এখন। রিক মুখে হাসি রেখেই বলল
— ” কী ভাবছো? কেনো তাইতো? আসলে তোমার সাথে অনেক কথা আছে আমার, কেও যাতে ডিসটার্ব করতে না পারে সেইজন্যেই এই অবস্হা। ”
অনিমা এখোনো ভীত চোখে তাকিয়ে আছে রিকের দিকে। রিকের এই শান্ত কন্ঠের সাথে পরিচিত ও, এর আগে রিক যতোবার ওর সাথে শান্ত কন্ঠে কথা বলেছে, ঠিক তার পরেই ওর ওপর দিয়ে ভয়ংকর কিছু গেছে। রিক অনিমাকে ধরতে গেলেই অনিমা রিককে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দৌড়ে ওর রুমের দিকে যেতে নিলো কিন্তু তার আগেই রিক ওর হাত ধরে ফেলল, তারপর নিজের দিকে টেনে ওর দুই বাহু ধরে বলল
— ” কী করছো বলোতো? আমি কোথায় তোমার সাথে ঠান্ডা মাথায় কথা বলতে চাইছি আর তুমি ছোটাছুটি করেই যাচ্ছো।”
অনিমা এবার ভয়ে কেদে দিলো, ভয়ে নিজেকে রিকের কাছ থেকে সরিয়ে নিতে চাইছে কিন্তু রিক ছাড়ছেনা। অনিমার কান্না দেখে রিক বলল
— ” আরে বাবা এভাবে ভয় কেনো পাচ্ছো? আমিকি মেরেছি তোমাকে? আর ভয় পাওয়ার নাটক কেনো করছো? তুমিতো এখন খুব সাহসী হয়ে গেছো তাইনা? আমাকে এখন আর তুমি ভয় পাও নাকি? আমার কাছ থেকে পালিয়েছো দেখো কী সুন্দর করে চোখে কাজল দিয়েছো, নিজের বার্থডে সেলিব্রেট করছো তাও অন্য ছেলের সাথে, তারওপর তাকে জরিয়ে ধরছো।”
এটুকু হাসি মুখে বললেও এরপরেই রিকের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো, চোখ লাল হয়ে উঠল, মুখে আবার সেই হিংস্রতা ফুটে উঠেছে। রিককে এভাবে দেখে অনিমা কেপে উঠলো। রিক দাঁতে দাঁত চেপে বলল
— “যদি সত্যিই আমাকে ভয় পেতে এসব করতে পারতে? বলো পারতে? ”
এটুকু বলে ওকে ধাক্কা দিয়ে সোফায় ফেলে দিলো। অনিমা সোফার কর্ণারে পেটে বারি খেয়ে সোফায় পরলো, যার ফলসরূপ পেটের সাইডে বেশ ব্যাথা পেলো ও। অনিমা পেট চেপে ধরে কান্নাজরিত চোখে রিকের দিকে তাকালো। কিন্তু রিকের একটুও মায়া হলোনা। রিক এসে অনিমার পাশ দিয়ে সোফার ওপর এক পা রেখে আরেক হাত দিয়ে ওর গাল চেপে ধরে বলল
— ” খুব সাহস হয়ে গেছে তাইনা? একবারো মাথায় আসেনি আমি জানতে পারলে কী করবো? কে দিলো এতো সাহস ঐ রকস্টার?”
অনিমা নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলে যাচ্ছে, তবুও হিচকি উঠে গেছে ওর। রিক ওর গাল ছাড়তেই ও সোফার ওপর দু পা উঠিয়ে একটু গুটিয়ে বসে অস্ফুট স্বরে বলল
— ” প্লিজ ছেড়ে দিন আমাকে।”
রিক হেসে দিলো অনিমার কথায় তারপর অনিমার দিকে হালকা ঝুকে বলল
— “তোমাকে যদি ছাড়ারি হতো তাহলে পাঁচ বছর আগেই ছেড়ে দিতাম। আমার নজর একবার যেই জিনিসের ওপর পরে সেটা আমি নিজের করেই ছাড়ি।”
— ” আমি কোনো জিনিস নই।”
রিক ধমক দিয়ে বলল
— ” ওই একদম মুখে মুখে কথা না ওকে? বেশি কথা বললে কথা বলার অবস্হাতেই রাখবোনা তোমাকে।”
অনিমা বুঝতে পারছে রিকের হাত থেকে আজ ওর নিস্তার নেই। নাহ ও যাবেনা এই লোকটার সাথে, কিছুতেই না। ওকে যেভাবেই হোক বাঁচতেই হবে। অনিমা ওর শরীরের সব শক্তি দিয়ে রিককে ধাক্কা দিলো। রিক ভাবতেও পারেনি অনিমা এই মুহূর্তে এটা করবে, প্রস্তুতি একেবারেই না থাকায় এই ধাক্কায় নিচে পরে গেলো রিক। অনিমা দৌড়ে ওর রুমে গিয়ে দরজা লক করে দিলো। দরজার দিকে তাকিয়ে পেছাতে পেছাতে খাটে ধপ করে বসে পরল শব্দ করে কেদে দিলো ও। এদিকে রিক উঠেই দরজা জোরে ধাক্কানো শুরু করলো, রিকের মেজাজ অতিরিক্ত মাত্রায় খারাপ হয়ে আছে। এই মেয়ের এতো সাহস কীকরে হয়? ওকে ধাক্কা মারে তার ওপর দরজাও লক করে রেখেছে? রিক রাগে গজগজ করে বলল
— ” অনিমা দরজা খোলো। ভালো হচ্ছেনা কিন্তু খোলো দরজা। খোলো! নইলে তোমার কপালে কী আছে তুমি কল্পনাও করতে পারবেনা। ওপেন দা ডোর।”
রিকের কথা আর দরজায় বারি পরার আওয়াজে ভয়ে বারবার কেপে উঠছে অনিমা, বেডের ওপর গুটিসুটি মেরে বসে ফুপিয়ে কেদে চলেছে। কী করবে ও এখন? রিক ক্রমাগত দরজায় বাড়ি মেরেই যাচ্ছে আর নানারকম হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। অনিমার মাথা কাজ করছেনা, ভয়ে জমে যাচ্ছে, হঠাৎ করেই আদ্রিয়ান এর কথা মনে পরল, ওকে ফোন করবে? কিছু না ভেবেই কাধ থেকে ব্যাগটা নামিয়ে ফোনটা বের করল অনিমা। বারবার কল দেওয়ার পরেও আদ্রিয়ান ফোনটা রিসিভ করছেনা, এদিকে রিক দরজায় আঘাত করেই চলেছে। অনিমা ভাবছে আদ্রিয়ান ফোনটা ধরছেনা কেনো? এমনিতে তো কল করতে না করতেই ফোনটা রিসিভ করে ফেলে আজ কী হয়েছে? তারপর ওর মনে পরলো যে আদ্রিয়ান বলেছিলো আজ ওর শো আছে। এটা মনে পরতেই অনিমা ফোনটা খাটে ছুড়ে ফেলে ফ্লোরে বসে পরলো।
এদিকে আদ্রিয়ান স্টেজে দাড়িয়ে শো করছে। কিছুক্ষণ পরেই শো শেষ হবে, ওর পার্সোনাল ফোন ওর প্যান্টের পকেটে বারবার ভাইবারেট হচ্ছে কিন্তু স্টেজে চলতি গান ছেড়ে ও ফোন পিক করতে পারছেনা। কিন্তু ওর কেমন একটা ফিল হচ্ছে, ভেতরটা অস্হির লাগছে। বারবার মন বলছে ওর গানটা খুব তাড়াতাড়ি শেষ করা দরকার, খুব দরকার কিন্তু কেনো এমন মনে হচ্ছে আদ্রিয়ান জানেনা।
রিক দরজায় জোরে একটা বারি দিয়ে বলল
— ” অনিমা ফর লাস্ট টাইম বলছি ভালোয় ভালোয় দরজা খোলো, তোমার ফ্লাটের মেইনডোর খুলতে পেরেছি এটা খোলা বড় ব্যাপার হবেনা আমার কাছে, দরজা খোলো।”
অনিমা কাদতে কাদতে চিৎকার করে বলল
— ” প্লিজ চলে যান, প্লিজ! আমি যেতে চাইনা আপনার সাথে, দয়া করুন আমায়।”
এই কথাগুলো রিকের রাগ আরো বাড়িয়ে দিলো, রিক রেগে গিয়ে বলল
— ” এভাবে শুনবে না তুমি তাইনা? ঠিকাছে নাও জাস্ট ওয়েট। ”
কিছুক্ষণ পর একটু অন্যরকম শব্দ হতে লাগল দরজায় ভয়ে অনিমার পুরো শরীর কাপছে, ফ্লোরে হাটু গুটিয়ে বসে কেদে চলেছে ও। ওর মনে হলো আদ্রিয়ানকে একটা মেসেজ করা উচিত, ও উঠতে নেবে হঠাৎ ফোন বেজে উঠল, আদ্রিয়ান হ্যা নিশ্চই আদ্রিয়ানই ফোন করেছে, একটু আশার আলো দেখলো অনিমা, উঠে তাড়াতাড়ি ফোন ধরবে তার আগেই ধরাম করে দরজাটা খুলে গেলো।
.
#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here