#বর্ষণের সেই রাতে পর্ব- ৪২+৪৩
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
.
আদ্রিয়ানের খুব বেশি অসস্তি হচ্ছে। কিছুতেই শান্তি পাচ্ছেনা। আজ ফিনালে বাট কন্টেসস্টেন্ডদের গানের প্রতি কনসেন্ট্রেট করতে পারছেনা ও। ওর মন বলছে অনিমা ভালো নেই বাট শো ছেড়ে ওঠাও সম্ভব না। পাশ থেকে অন্য একজন জাজ বেশ কয়েকবার আদ্রিয়ানকে জিজ্ঞেস করেছে ‘আর ইউ ওকে?’ উত্তরে আদ্রিয়ান শুধু জোরপূর্বক একটা মুচকি হাসি দিয়েছে। কিন্তু ওর টেনশনে অবস্হা এতোটাই খারাপ যে ঠিকভাবে বসতে অবধি পারছেনা। কোনোমতে শো টা কম্প্লিট করে আদ্রিয়ান সেট থেকে একপ্রকার দৌড়ে বেড়িয়ে গেলো, বাকিরা একটু অবাক হলেও ভাবলো যে আর্জেন্ট কিছু হয়তো। রুমে গিয়ে পকেট থেকে ফোনটা বের করে অনিমার নাম্বারে কল করল। কিন্তু অনেক্ষণ ফোন বাজার পরেও কেউ ফোনটা রিসিভ করলোনা। আদ্রিয়ান চারপাঁচ বার একটানা কল করার পরেও ফোন রিসিভ হলোনা ওপাশ থেকে। আদ্রিয়ান এবার ওর বাড়ির সার্ভেন্টকে কল করলো। ফোন বাজার কিছুক্ষণের মধ্যেই কল রিসিভ করলো। কল রিসিভ করতেই আদ্রিয়ান উত্তেজিত কন্ঠে বলল,
— ” তোমার ম্যাম কোথায়?”
মেয়েটি স্বাভাবিক ভাবেই বলল,
— ” স্যার সকালে ব্রেকফাস্ট দিয়ে আসার সময় তো দেখলাম ম্যাম রুমেই ছিলো। আর এখন লাঞ্চ ও নিয়ে যাচ্ছি।”
আদ্রিয়ান একটা শ্বাস ফেললো তবুও মানসিকভাবে শান্তি পেলোনা তাই বলল,
— ” রুমে গিয়ে ম্যামকে বলো আমার ফোনটা রিসিভ করতে আর খাবারে সাথে ঔষধগুলো ঠিকভাবে মনে করে মেশাচ্ছো তো?”
মেয়েটা নিচু কন্ঠে বলল,
— ” জ্বী স্যার।”
আদ্রিয়ান গম্ভীর কন্ঠে বলল,
— ” হুম যাও।”
ফোনটা রেখেই আদ্রিয়ান পায়চারী করতে লাগল কিছুক্ষণ পর ঐ সার্ভেন্ট আদ্রিয়ানকে আবার ফোন করলো। ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে মেয়েটি বলল,
— ” স্যার ম্যাম সারাবাড়িতে কোথাও নেই।”
আদ্রিয়ান অবাক হয়ে চড়া আওয়াজে বলে উঠলো,
— ” নেই মানে কী? ছাদ গার্ডেন এরিয়া সব চেইক করেছো?”
মেয়েটি কাঁদোকাঁদো গলায় বলল,
— ” স্যার আমরা সবাই মিলে সব জায়গায় খুজেছি কিন্তু ম্যাম নেই।”
আদ্রিয়ান চিৎকার করে বলল,
— ” নেই মানে কী ড্যাম ইট? তোমরা কী করছিলে? যদি ওর কিছু হয়না তাহলে একটাকেও বাঁচতে দেবোনা আমি মাইন্ড ইট।”
বলেই ফোনটা কেটে দিলো আদ্রিয়ান তারপর আরেকটা কল করলো। কলটা রিসিভ করতেই আদ্রিয়ান বললো,
— ” আপনাদের দুটো নাম্বার পাঠাচ্ছি রাইট নাও আমাকে নাম্বারগুলোর লোকেশন টা সেন্ট করুন।”
বলেই ফোনটা রেখে সোফায় বসে পরলো আদ্রিয়ান। কিছুক্ষণ পর আদ্রিয়ানের ফোনে মেসেজ এলো। মেসেজটা দেখেই আদ্রিয়ান অবাক হয়ে গেলো কারণ অনিমার লাস্ট লোকেশন আশ্রমের দিকেই ডেডিকেট করছে। আর রিকের নাম্বারের লোকেশনটা রিকের বাড়িতেই। আদ্রিয়ান দুইহাতে মুখ চেপে ধরে বলল,
— ” বারবার বলেছিলাম বাড়ি থেকে বেরিয়োনা কিন্তু মেয়েটা… কিন্তু ও তো আমার কথা অমান্য করার মেয়েনা? তাহলে কী এমন হয়েছিলো?”
কিছু একটা ভেবে আদ্রিয়ান আবার একটা কল করলো। তারপর বলল,
— ” রিক চৌধুরী কখন বেড়িয়েছে বাড়ি থেকে?”
ওপাশ থেকে একটা লোক বলে উঠলো,
— ” সকালে বেড়িয়েছেন আর তো ফেরেনি স্যার।”
আদ্রিয়ান আর কিছু না বলে ফোনটা কেটে সোফায় একটা পাঞ্চ মারলো। তারমানে রিক ওর ইউসিয়াল সিমটা বাড়িতেই রেখেছ যাতে আদ্রিয়ান ট্রাক করতে না পারে। আদ্রিয়ান আবার সেই প্রথম লোকটাকে ফোন করে বলল,
— ” প্রথম যেই নাম্বারটা দিয়েছি তার লাস্ট কার সাথে কথা হয়েছে কী কথা হয়েছে ইমিডিয়েটলি জানাও আমাকে।”
ফোনটা রেখে আদ্রিয়ান চড়া আওয়াজে ওর ট্যামপোরারি সেক্রেটারি কে ডাকল। লোকটা হন্তদন্ত হয়ে এসে বললো,
— ” ইয়েস স্যার।”
আদ্রিয়ান ব্যাগ গোছাতে গোছাতে বলল,
— ” আমি আজকেই ফিরছি। ইমারজেন্সি ফ্লাইটের ব্যাবস্হা করো, ফাস্ট!”
লোকটি ইতোস্তত করে বললো,
— ” কিন্তু স্যার রাতে পার্টি আছে।”
আদ্রিয়ান অগ্নিদৃষ্টি নিয়ে লোকটার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বললো,
— ” গো টু হেইল উইথ ইউর পার্টি স্টুপিড।”
লোকটা হকচকিয়ে গিয়ে বলল,
— ” ও্ ওকে স্যার আমি যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব এরেঞ্জমেন্ট করছি।”
বলেই একপ্রকার পালিয়ে গেলো। আদ্রিয়ান পাগলের মতো করছে একেকটা মুহূর্ত ওর কাছে বিষের মতো লাগছে। হোটেল রুমের সবকিছু ভাঙতে শুরু করলো ও। দুএক এসছিলো ওকে শান্ত করার চেষ্টায় কিন্তু ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেছে। আদ্রিয়ানের এখন নিজের ওপর রাগ হচ্ছে যে কেনো এলো ও এখানে?
_____________________
একটা ফাঁকা রুমের ফ্লোরে বসে নিরবে কাঁদছে অনিমা। ওর হাত মুখ এখনো বাঁধা। ঘন্টাখানেক আগে রিক ওর ফার্ম হাউজের একটা রুমে বসিয়ে রেখে গেছে ওকে। কী হতে চলেছে ও নিজেও জানেনা। রিকের মাথায় কী চলছে ও সেটাও বুঝতে পারছেনা। আদ্রিয়ান ওকে বারবার বারণ করেছিলো না বেরোতে, কেনো শুনলোনা ও? ওই বা কী করতো যাকে নিজের মায়ের মতো ভালোবাসে সেই মানুষটার বিপদের কথা শোনার পর ওর মাথায় আর কিছুই ছিলোনা শুধু মাদারের কথাই মাথায় ঘুরছিলো ওর। আদ্রিয়ানকে কী ও আর দেখতে পাবে কোনোদিন? নাকি সারাজীবন ওকে এই নরকেই কাটিয়ে দিতে হবে? এসব চিন্তা করতে করতে দরজা খোলার আওয়াজে চমকে উঠলো ও। রিক এসে অনিমার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসলো। অনিমা চোখ নামিয়ে নিলো তারপর ওর সামনে হাটু ভেঙ্গে বসে বলল,
— ” তোমার বাবা খুব বুদ্ধিমানের মতো কাজ করে গেছেন তোমার পাসপোর্ট করে রেখে গিয়ে।”
অনিমা ভ্রু কুচকে তাকালো রিকের দিকে রিক হঠাৎ এই কথা কেনো বললো সেটাই বুঝতে পারছেনা ও। রিক অনিমার মুখের কাপড় টা নামিয়ে দিয়ে বলল,
— ” কিছু বলবে?”
অনিমা কিছু না বলে শুধু তাকিয়ে আছে রিকের দিকে চোখ দিয়ে ধীর গতিতে পানি পরছে ওর। রিক ওর চোখ থেকে পানি নিজের আঙ্গুলে নিয়ে বলল,
— ” এটা দেখতে যে আমার খুব বেশি ভালোলাগে তা কিন্তু না। কিন্তু কী করবো বলো? তুমি এমন সব আজ করো যে আমি নিজেকে ঠিক রাখতেই পারিনা, মাথা গরম করে দাও। এইযে এখন যেভাবে শান্ত হয়ে বসে আছো এভাবে থাকলে আমি তোমার গায়ে হাত তোলা তো দূরের কথা ধমক পর্যন্ত দেবোনা। প্রমিস!”
অনিমা মুখ ঘুরিয়ে নিলো। ওর কেমন জানিনা ইরেটেশন হচ্ছে। ভয়ের চেয়ে বেশি বিরক্ত লাগছে ওর। ওর মাথাটা কেমন যেনো ঝিম ধরে আছে, অদ্ভূত লাগছে। রিক অনিমার ফেস এক্সপ্রেশন দেখে ভ্রু কুচকে ফেললো। ব্যাপারটা কী হলো সেটাই বুঝলোনা ও, এরকম করার তো কথা না। তবুও রিক সেদিকে পাত্তা না দিয়ে ওর একজন লোককে ডাকতেই লোকটা একটা ইনজেকশনে সিরিঞ্জ হাতে নিয়ে এলো। অনিমা সেটা দেখে একটু ঘাবড়ে গেলেও কোনো রিয়াক্ট করলোনা কারণ ও জানে যে রিক যেটা করার সেটা করবেই। রিক ইনজেকশন পুশ করতে অনিমার হাতের খুলে হাতটা ধরে সামনে আনতেই অনিমা চোখ খিচে বন্ধ করে নিলো। রিক আরো একবার অবাক হলো অনিমার রিয়াকশন দেখে, ওর সবকিছু এতোটা ইজিলি মেনে নেওয়াটা ওর নরমাল লাগছেনা। ও অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অনিমার দিকে। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে কাঁপাকাঁপা হাতে খুব ধীরেই ইনজেকশনটা পুশ করলো অনিমার হাতে। অনিমার বন্ধ করে রাখা চোখ দিয়ে একফোটা জল গড়িয়ে পরলো। রিক শুধু দেখছে অনিমাকে কিছুতো গন্ডগোল আছে কিন্তু সেটা কী? রিক এসব ভাবতে ভাবতেই অনিমা ঢলে পরলো। রিক তাড়াতাড়ি ধরে ফেললো ওকে। ও জানতো এমন কিছুই হবে কারণ ইনজেকশনটা এইজন্যেই দিয়েছে। সবকিছু ওর মামার প্লান মতই হচ্ছে কিন্তু রিক শান্তি পাচ্ছেনা। অনিমার আজকের আচরণ বেশ ভাবাচ্ছে ওকে। এমন কিছু কী আছে যেটা ও জানেনা? হঠাৎ এতো শান্ত কেনো হয়ে গেলো মেয়েটা?
_____________________
রাতে বাংলাদেশে এসে ল্যান্ড করলো আদ্রিয়ান। ও আদিব, আশিস , তীব্র, অরু, স্নেহা সবাইকে বলে রেখেছে ওরা এয়ারপোর্টে বসে আছে গাড়ি নিয়ে। আদ্রিয়ান ওর সিকিউরিটি গার্ডদের অন্যগাড়িতে পাঠিয়ে দ্রুতপদে তীব্ররা যেই গাড়িতে আছে সেই গাড়ির কাছে আসতেই তীব্র ড্রাইভিং সিট ছেড়ে ফ্রন্ট সিটে বসে পরলো আর আদ্রিয়ান ড্রাইভিং সিটে বসে সাথে সাথেই গাড়ি স্টার্ট দিলো। আদ্রিয়ানের চোখ মুখ ভীষণ লাল হয়ে আছে, যে কেউ ওর মুখ দেখলে এখন ভয় পাবে ।অরু আর স্নেহা কেঁদেই যাচ্ছিলো কিন্তু আদ্রিয়ানের চেহারা দেখে ওদের কান্না বন্ধ হয়ে গেলো। আদ্রিয়ান গাড়িটা সবার আগে মাদারের আশ্রমে নিলো। আশ্রমের ভেতরে গিয়ে দেখলো ওখানে পুরো নিরব পরিবেশ, সবকিছুই থমথমে হয়ে আছে আদ্রিয়ান হনহনে পায়ে ভেতরে ঢুকলো পেছন পেছন ওরাও গেলো। ভেতরে গিয়ে দেখে মাদার ওনার চৌকিতে মাথা নিচু করে বসে আছে। আদ্রিয়ান সোজা ওনার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে চেচিয়ে বলল,
— ” মাদার শব্দের অর্থ মা হয় তাইনা? কোন মা এরকম করতে পারে? যে মেয়েটা আপনাকে মায়ের মতো ভালোবাসে তার সেই ভালোবাসার এরকম একটা সুযোগ কীকরে নিলেন?”
আদ্রিয়ানের কথায় মাদার স্হির দৃষ্টিতে তাকালো ওর দিকে তারপর কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল,
— ” আমার কাছে আর কোনো উপায় ছিলোনা। আমি জানি আমি যা করেছি সেটা পাপ কিন্তু আর কোনো পথই খোলা ছিলোনা আমার কাছে।”
সকলেই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো মাদারের দিকে। মাদার সবটা খুলে বলতেই আদ্রিয়ান ওখানের দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে জোরে একটা পাঞ্চ মারলো দেয়ালে। তারপর ঝাঝালো কন্ঠে বলল,
— ” সব দোষ আমার। আমি যদি ফোনটা না দিতাম ওকে তাহলে এসব হতোনা। আমার মাথায় কেনো এলোনা যে এরকম কিছু হতে পারে? এতোটা ডাফার আমি?”
আদিব আদ্রিয়ানকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
— ” এখানে তোর কোনো দোষ নেই। সব কিছু সবসময় সবার মাথায় আসেনা। তুই তো ওকে বলেছিলি বাড়ি থেকে না বেড়োতে এমনকি গার্ডদেরও বলে গেছিলি ওকে যাতে বেড়োতে না দেয়। তুই তো সবরকম ব্যবস্হাই করে গেছিলি কিন্তু অনিমা যে বেড়িয়ে যাবে সেটা কীকরে জানবি তুই? তুই তো মানুষ রোবট নস যে সবকিছু পার্ফেক্ট হবে, ভূল হতেই পারে এটা অস্বাভাবিক কিছু না।”
মাদার কান্নাজরিত কন্ঠে বললেন,
— ” অনির দোষ নেই এখানে। ও ওর মাকে দেখেনি কিন্তু আমাকে দেখেছে। ও আমাকে ততোটাই ভালোবাসে যতোটা একজন তার মাকে ভালোবাসে। আমার কিছু হয়েছে এটা শোনার পরেও ও নিজের কথা কিংবা বসে বসে ঠিক ভুল বিবেচনা করবে এটা ভাবাও চরম বোকামী। কারণ ও স্বার্থপর নয়। নিজের মায়ের বিপদ এটা শুনে কোন সন্তান ভাবতে বসে বলোতো? যদিও আজকালকার স্বার্থপর সন্তানদের কাছে সবই সম্ভব কিন্তু অনিমা সেরকম নয়।”
তীব্র চিন্তিত মুখ করে বলল,
— ” কিন্তু ভাইয়া যদি গার্ডদের অনিমাকে বেরোতে দিতে বারণ করে থাকে তাহলে অনি বেরোলো কীকরে ওদের ওকে আটকে রাখার কথা তাইনা?”
আদ্রিয়ান এবার কিছু না বলে ওখান থেকে বেড়িয়ে গেলো। ওরাও আদ্রিয়ানের পেছন পেছন ছুটলো। আদ্রিয়ান গাড়িতে বসে ড্রাইভ করছে সাত আট জায়গায় ফোন করে সম্ভাব্য প্রত্যেকটা জায়গায় রিকের ফার্মহাউজ, ফ্লাট, গোডাউন ,বাড়ি সব জায়গায় টিম বাই টিম খোজ চালাতে ওর্ডার দিয়ে দিলো। আদিব,আশিস অবাক না হলেও তীব্র অরুমিতা আর স্নেহা বেশ অবাক হলো যে একজন রকস্টার এর এতো সোর্স আর কানেকশন কীকরে?
_______________________
গোটা রাত পার হয়ে গেলো আর ঐ একরাতের মধ্যেই শহর অলমোস্ট চিরুনী তল্লাশি হয়ে গেছে বাট অনিকে পাওয়া যায়নি। গোট দেশের সম্ভাবো জায়গাতেও আদ্রিয়ান লোক লাগিয়েছে আজকে সারাদিনের মধ্যে সেখান থেকেও খবর চলে আসবে। পাগল পাগল অবস্হা হয়ে গেছে আদ্রিয়ানের এখন যেই ওর দিকে তাকাবে সেই ভয় পেয়ে যাবে। অরুমিতা আর স্নেহাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে, তীব্র আদ্রিয়ানের সাথেই ছিলো কিন্তু একটু আগে ওকেও বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। আদিব আর আশিস অন্যসব জায়গায় গেছে খুজতে। আদ্রিয়ান এবার ওর ঐ বাড়িতে এলো। সাথে সাথে আদিব আর আশিস এসেও ঢুকলো। ওকে বাড়িতে আসতে দেখে গার্ডরা সবাই চমকে উঠলো কারণ আদ্রিয়ানের আজ রাতে আসার কথা ছিলো। আদ্রিয়ান আদিব আর আশিসকে নিয়ে সোজা ওর সিকরেট রুমে গেলো, তারপর ল্যাপটপ অন করে কালকের পুরো সিসি টিভি ফুটেজটা দেখলো আর যা দেখলো তাতে ওর কপালের রগ ফুলে উঠলেও মুখে ফুটে উঠলো এক ভয়ংকর হাসি। এই হাসি যতোটা রহস্যময় তার চেয়েও বেশি হিংস্র। আশিস অবাক হয়ে বলল,
— ” কতোবড় বেইমান? চল দুটোকে গিয়ে ধরি আগে।”
আদ্রিয়ান স্হির কন্ঠে বলল,
— ” লাভ নেই। পালিয়ে গেছে ওরা।”
বলেই আদ্রিয়ান আবার কোথাও একটা ফোন করে বলল,
— ” দুটো লোকের ডিটেইলস পাঠাচ্ছি। আজ রাতে ওদের আমি আমার সিকরেট হাউসে চাই।”
বলে ফোন কেটে দিলো। আদিব আর আশিস একে ওপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে একটা ঢোক গিললো কারণ ওরা জানে আজ ওই দুটোর কী ভয়ংকর পরিণতি হতে চলেছে।
_____________________
সন্ধ্যা হয়ে গেছে কিন্তু অনিমার কোনো খোজ পায়নি আদ্রিয়ান। এটুকু বুঝে গেছে যে অনিমা বাংলাদেশে নেই। ব্যাপারটা অনেকটাই জটিল হয়ে গেছে এবার। সোফায় বসে দুইহাতে মুখ চেঁপে ধরে বসে আছে ও। কী করবে কিচ্ছু বুঝতে পারছেনা। সবকিছু অসহ্য লাগছে। বারবার অনিমার মুখ ভেসে উঠছে। ওর ভীত চেহারা, মুখ ফুলিয়ে বসে থাকা, আবার ফিক করে হেসে দেওয়া, বাচ্চামো সব খুব বেশিই মনে পরছে। বরবার অনিমার বলা ‘ না গেলে হয়না?’ কথাটা কানে বাজছে। নিজের ওপরেই রাগ হচ্ছে ওর। চোখ দিয়ে নিরব ধারায় এক ফোটা জল গড়িয়ে পরলো। মুখ চেপে ধরেই অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো,
— ” জানপাখি হয়ার আর ইউ?”
হঠাৎ কিছু মনে হতেই আদ্রিয়ান তাড়াতাড়ি সেই সাইকার্টিস্ট কে কল করলো যে অনিমার ট্রিটমেন্ট করছিলো। ফোন রিসিভ করতেই আদ্রিয়ান বলল,
— ” হ্যালো ডক্টর। আচ্ছা অনিমাকে যেই মেডিসিনগুলো দিয়েছিলেন যেগুলো খাবারের সাথে মিক্সট করে দেই আমি সেগুলো যদি হঠাৎ দেওয়া বন্ধ হয়ে যায় তো?”
ডক্টর অবাক হয়ে বললেন,
— ” হঠাৎ এই প্রশ্ন?”
আদ্রিয়ান বিরক্ত হয়ে শক্ত গলায় বলল,
— ” আনসার মি ডক্টর”
ডক্টর একটু গলা ঝেড়ে বললেন,
— ” দেখুন ওনি ভীষণভাবে ট্রমাটাইজড আর বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে উনি খুব স্কেয়ারড ও। যেই ঔষধ উনি নেওয়া শুরু করেছেন সেগুলো খুব পাওয়ারফুল তাই মাঝপথে সেটা একদিনের জন্যেও বন্ধ হয়ে গেলে ওনার মধ্যে চেঞ্জেস দেখা দেবে। উনি মেন্টলি অনেকটাই ডিসটার্বড হয়ে যাবেন, সমস্যাও দেখা দেবে অনেক। লাইক কখনো রিয়াক্ট করা বন্ধ করে দেবেন আবার কখনো ওভার রিয়াক্ট করবেন , কখনো শান্ত থাকবেন আবার কখনো ভাইলেন্ট হয়ে যাবেন। ”
আদ্রিয়ান কিছু না বলে ফোন কেটে দিলো। মাথা টেনশনে ছিড়ে যাচ্ছে। কী করবে সেটাই বুঝতে পারছেনা। আদ্রিয়ান সামনের টি-টেবিলে জোরে একটা বাড়ি মেরে বলল,
— “রিক চৌধুরী তোমাকে অনেকবার সাবধান করেছিলাম আমি। তোমার লোকেরা আমাকে আঘাত করেছিলো কিচ্ছু বলিনি মুখে হাসি রেখেই শুধু একটু আহত করেছি, তুমি আমার দিকে শুট করেছিলে তবুও হাসতে হাসতেই তোমাকে সাবধান করেছিলাম। কিন্তু সেটাকে আমার দুর্বলতা ভেবে খুব বড় ভুল করে ফেলেছো তুমি। কারণ তুমি এটা জানোনা যে আদ্রিয়ানকে কেউ আঘাত করলে ও মুচকি হাসে কিন্তু সেই আঘাত যদি কেউ ওর জানপাখির ওপর করে তাহলে ও কতোটা ভয়ংকর হতে পারে। এবার আমার সেই রূপ দেখবে তুমি যেটা আমি কাউকে দেখাতে চাইনি।”
#পর্ব- ৪৩
.
একটা আবছা অন্ধকার রুমে দুইটা চেয়ারে দুজন লোককে বেঁধে রাখা হতেছে। দুজনেই অত্যন্ত ভয়ের মধ্যে আছে। ওরা জানে যে আজ ওদের কী ভয়ংকর পরিণতি হতে পারে। ঐসময় এতোগুলো টাকা দেখে লোভ সামলাতে পারেনি কিন্তু এরপর ওদের সাথে কী হবে সেটাই মাথায় আসেনি ওদের। আর যখন বুঝতে পেরেছে যে কতোবড় ভুল করে ফেলেছে তখনি পালিয়ে এসছে ওখান থেকে। কিন্তু বেশিদূর পালাতে পারেনি তারআগেই ওদের ধরে ফেলেছে আর এখানে নিয়ে এসছে। ওদের চারপাশে অনেকগুলো লোক দাড়িয়ে আছে। হঠাৎ ঐ রুমের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো আদ্রিয়ান। অন্ধকার স্তব্ধ রুমে আদ্রিয়ানের পায়ের গম্ভীর আওয়াজ স্পষ্ট। আদ্রিয়ানের পায়ের আওয়াজে ঐ দুজনের বুকের ভেতরে আরো তীব্র কম্পন শুরু হলো। দুজনের ভেতরেই আফসোস হচ্ছে যে কেনো টাকার লোভে পরে এই চরম ভুলটা করলো? আদ্রিয়ান হালকা আওয়াজে সিটি বাজাতে বাজাতে ওদের দুজনের সামনে রাখা চেয়ারটায় বসলো। ওর পেছনে আদিব আর আশিস দাঁড়িয়ে আছে। সামনের দুজন ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে। আদ্রিয়ান মুচকি হেসে পায়ের ওপর পা তুলে বসে ওদের দিকে তাকিয়ে বলল,
— ” তোদের তো আমার বাড়ির গেইটের কাছে থাকার কথা ছিলো? হঠাৎ রেইলস্টেশনে কেনো গেলি বলতো? তাও বিনা নোটিশে?”
লোকদুটো ভীত চোখে তাকিয়ে আছে আদ্রিয়ানের দিকে। আদ্রিয়ান নিজের হাত এগিয়ে এনে নখ দেখতে দেখতে বলল,
— ” দেখ কাজে ফাকি দেওয়া আমি মোটেও পছন্দ করিনা সেটাতো জানিস? তো হঠাৎ উধাও কেনো হলি?”
ওরা আর কী বলবে? আদ্রিয়ানের এই ঠান্ডা গলা ওদের রক্তও ঠান্ডা করে দিয়েছে। আদ্রিয়ান ওদের চুপ থাকতে দেখে ভ্রু কুচকে তাকালো তারপর আবারো ঠান্ডা গলায় বলল,
— ” কতো টাকা দিয়েছিলো?”
লোকদুটো এবার ভয়ে কেঁদেই দিলো, একজন ভয়ে ভয়ে বলল,
— ” ভাই আমরা কিছু জানিনা, আমরা তো গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছিলাম। আপনি ছিলেন না তাই..”
আদ্রিয়ান বাঁকা হেসে সোজা হয়ে বসে বলল,
— ” তারজন্যে উইথ আউট এনি পার্মিশন তোরা পগার পার হয়ে গেলি তাইতো?”
লোকদুটো খুব ভালোভাবে বুঝে গেছে যে ওদের কোনো কথাতেই কোনো লাভ হবেনা। আদ্রিয়ান সবটাই জানে। আদ্রিয়ান পকেট থেকে গান বের করে কপালে স্লাইড করে স্হির দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে বলল,
— ” খাওয়ার থালায় ফুটো করলে নতুন থালা জোগাড় করা যায়। কিন্তু যেই ডালে বসে আছিস সেই ডালেই কুড়াল মারলে কী হয় জানিস? সোজা নিচে..আর তারওপর যদি নিচে লাভা থাকে, তাহলে?”
ওরা এবার খুব ভালোভাবেই বুঝে গেছে যে আজ ওদের কপালে ভয়ংকর রকম দুঃখ আছে। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল,
— ” স্যার এবারের মতো মাফ করে দিন? এই ভুল আর কোনোদিন হবেনা।”
আদ্রিয়ান হেসে দিলো এবার। কিছুক্ষণ হাসার পর নিজেকে সামলে বলল,
— ” আরে আমি জানি সেটা। আর সুযোগ? হ্যাঁ এটা ঠিক যে আমি সবাইকেই একটা সুযোগ দেই। কিন্তু ততোক্ষণ, যতক্ষণ ব্যাপারটা শুধু আমার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু আফসোস তোরা যেই ভুলটা করেছিস সেটা এমন একজনকে ঘিরে যাকে নিয়ে কোনোপ্রকার কম্প্রমাইস করা সম্ভব নয় আমার পক্ষে, আর ক্ষমা তো একেবারেই না।”
বলেই ওরা উঠে দাড়িয়ে বলল,
— ” ভেবেছিলাম তোদের ওপরেই পাঠিয়ে দেবো। কিন্তু পরে ভাবলাম তাতে কী লাভ হবে? শান্তিতে ওপরে চলে যাবি। তারচেয়ে তোদের বাঁচাটাই দুর্বিষহ করে দেই? সেটাই বেটার হবে। আজ তোদের সাথে সেটাই করবো যাতে তোদের দিকে কেউ তাকালে সে তার নিজেরই মালিকের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার কথা চিন্তাও করতেই কয়েকবার। আমার জানপাখিকে ওই লোকটার কাছে পৌছে দিতে দুই হাত পেতে টাকা নিয়েছিলি না?”
এটুকু বলেই ওর লোকেদের ডেকে বলল ওদের দুটোকে কেমিক্যাল রুমে নিয়ে গিয়ে এসিড দিয়ে ধীরে ধীরে সময় নিয়ে যাতে ওদের হাত দুটোকে গলিয়ে দেয়। ওরা দুজন আদ্রিয়ানের কাছে অনেক আকুতি মিনতি করেছে কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। ওদের অনুরোধকে উপেক্ষা করে বেড়িয়ে এসছে ওখান থেকে । আদ্রিয়ান অন্যকোনো ব্যাপার হলে এদের দ্বিতীয় সুযোগ ঠিকি দিতো কিন্তু ব্যাপারটা অনিমাকে নিয়ে তাই ও ক্ষমার কথা চিন্তাও করেনি। ও নিজেই করতো কাজটা কিন্তু ওর এখন অনিমাকে খুজে বের করতে হবে। প্রতিটা মুহূর্ত ওর কাছে খুব গুরত্বপূর্ণ।
____________________
সকালের সূর্যের আলো চোখে পরতেই অনিমা পিটপিট করে চোখ খুললো, মাথা ভীষণ ভার হয়ে আছে চিনচিন ব্যাথা করছে, খুব দুর্বল লাগছে ওর। দুবার উঠে বসতে গিয়েও পরে গেলো। অনেক কষ্টে বেড ধরে উঠে বসলো ও। খুব বেশিই খারাপ লাগছে ওর, মাথা চেপে ধরে চুপ করে বসে আছে। আস্তে আস্তে সব কিছুই মনে পরলো রিকের ওকে তুলে নিয়ে আসা, এরপর ওই ফার্মহাউজে ইনজেকশন দেওয়া এই অবধি মনে আছে ওর। কোনরকমে মাথা উঁচু করে চারপাশটা দেখলো। ওকে বড় একটা রুমে রাখা হয়েছে, পুরো রুমটাই হোয়াইট পেন্ট করা, সবকিছুই অন্যরকম, একটু বেশিই মর্ডান টাইপ। রিক ওকে আবার কোথায় নিয়ে এলো? এসব ভেবে মাথা ব্যাথা আরো বেড়ে যাচ্ছে ওর। আস্তে করে বেড থেকে নেমে ধীর পায়ে ব্যালকনিতে গিয়ে রেলিং ধরে চারপাশে তাকিয়ে দেখলো আশেপাশে শুধু পানি আর পানি, দেখে মনে হচ্ছে সমুদ্র আর এটা যে বঙ্গোপসাগর নয় সেটা খুব ভালোকরেই বুঝতে পারছে। এটা একটা দ্বীপ সেটাও বেশ বুঝতে পারছে। কাঁদার শক্তির নেই ওর মধ্যে, দাঁড়িয়ে থাকাটাই কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে ওর জন্যে। কোনোমতে দেয়াল ধরে ভেতরে গিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখলো রিক দেয়ালে হেলাম দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসছে। অনিমা ওকে দেখে দাঁড়িয়ে যেতেই রিক সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
— ” দেখা শেষ যে কোথায় আছো? পছন্দ হয়েছে তো জায়গাটা? ”
অনিমা মাথা নিচু করে ফেললো, চোখ দুটো ছলছল করছে যেনো এক্ষুনি জল গড়িয়ে পরবে। রিক অনিমার দিকে এগিয়ে আসতে নিলেই অনিমা ভয় পেয়ে তাড়াহুড়ো করে পেছাতে গিয়ে পরে যেতে নিলো, রিক ধরতে যাবে তার আগেই ও নিজেকে টেবিল ধরে সামলে নিলো। রিক হেসে বলল,
— ” আরে এতো ভয় কেনো পাচ্ছো বলোতো? মারছি আমি তোমাকে?”
বলে অনিমাকে ধরল। অনিমা ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই রিক ওকে ধমক দিয়ে বলল,
— ” ঐ একদম তেজ দেখাবেনা আমাকে। আমি তোমার কী হাল করতে পারি সেটা খুব ভালো করেই জানো তুমি।”
অনিমা কেঁদে দিয়ে বলল,
— ” যেতে দিন আমাকে। ”
অনিমার কথা শুনে রিক চোখ বন্ধ একটা শ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করে বলল,
— ” দেখো এই মুহূর্তে তোমার গায়ে হাত তোলার ইচ্ছে আমার একদমি নেই। তাই বাধ্য করোনা আমাকে।”
অনিমাকে ধরে বেডে বসিয়ে বলল,
— ” লম্বা সময় ধরে কিছু খাওয়া হয়নি তোমার তাই এতো দুর্বল লাগছে। আমি খাবার আনাচ্ছি চুপচাপ খেয়ে নেবে।”
বলেই কাউকে কল করে খাবার আনতে বলল। অনিমা কিছু না বলে হাটু গুটিয়ে চুপচাপ বসে আছে, খুব জোরে কাঁদোতে ইচ্ছে করছে ওর কিন্তু রিকের ভয়ে কাঁদতেও পারছেনা। কিছুক্ষণ পর অনিমা রিকের দিকে তাকিয়ে বলল,
— ” কোথায় আছি আমরা?”
রিক তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে অনিমার দিকে তাকিয়ে শক্ত গলায় বলল,
— ” সেটা তোমার জানার কোনো প্রয়োজন নেই। বেশি কথা বললে কথা বলার মতো অবস্হাতেই রাখবোনা। সো কোয়াইট।”
খাবার আসার পর রিক প্লেটটা অনিমার সামনে রেখে বলল,
— ” ফিনিস ইট।”
এই মুহূর্তে ভীষণ খিদে পেয়েছে অনিমার। কতোক্ষণ আগে কিছু খেয়েছে নিজেই জানেনা। কিন্তু তবুও এখন খাওয়ার ইচ্ছে নেই ওর। সবকিছুই বিষ মনে হচ্ছে ওর কাছে তাই নিচু কন্ঠে বলল,
— ” খিদে নেই আমার।”
রিক এবার অনিমার মুখ চেপে ধরে প্লেট থেকে খাবার নিয়ে ওর মুখে ঢুকিয়ে দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
— ” একটা কথা জেনো দ্বিতীয়বার বলতে না হয় আমাকে। আমার প্রতিটা ওয়ার্ডকে ওর্ডার মনে করবে গট ইট?”
অনিমা মাথা নিচু করে ফুপিয়ে কান্না করছে। মুখের খাবারটা গেলার শক্তিও নেই ওর মধ্যে। বারবার আদ্রিয়ানের কথা মনে পরছে। ও খেতে না চাইলে আদ্রিয়ানও জোর করেই খাওয়াতো ওকে কিন্তু দুজনের জোর করার পদ্ধতি কতোটা ভিন্ন। রিক ধমক দিয়ে বলল,
— ” মুখের টা শেষ করো।”
রিকের ধমকে কেঁপে উঠলো অনিমা কান্না চেপে রেখে অনেক কষ্টে গিললো খাবারটা। রিক প্লেটটা হাতে নিয়ে দৃঢ় কন্ঠে বলল,
— ” পুরোটা শেষ করবে।”
অনিমাকে খাইয়ে রিক উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
— ” একদম ভদ্র মেয়ের মতো চুপচাপ বসে থাকবে এখানে। ঐ আদ্রিয়ানকে মারার আগে পর্যন্ত এখানেই থাকবে তুমি।”
আদ্রিয়ানকে মারার কথা শুনে শান্ত চোখে রিকের দিকে তাকালো অনিমা। তারপর ধীর কন্ঠে বলল,
— ” আদ্রিয়ানকে মারা আপনার সাধ্যের মধ্যে নেই।”
রিক বেশ রেগে গেলো অনিমার কথায়, ও রেগে অনিমার হাত মুচড়ে ধরে রাগী কন্ঠে বলল,
— ” এতো বিশ্বাস? কদিন আগেও তো ওর প্রাণের জন্যে আমার কাছে হাত জোর করছিলে? আজ কী হলো?”
অনিমা হাতে বেশ ব্যাথা লাগছে ঠোট কামড়ে ধরে সেই ব্যাথা সহ্য করছে ও। কান্নাজরিত কন্ঠেই রিকের দিকে তাকিয়ে বলল,
— ” যদি আপনার সত্যি ক্ষমতা থাকতো তো ওনার উপস্হিতিতেই আমাকে ওনার কাছ থেকে নিয়ে আসতেন। কিন্তু আপনি ওনার না থাকার সুযোগ নিয়ে মিথ্যে নাটক সাজিয়ে আমাকে নিয়ে এসছেন। আগে না বুঝলেও এখন বুঝতে পারছি যে ওনাকে মারা তো দূর সামান্য কোনো ক্ষতি করাও আপনার সাধ্যে নেই।”
রিক এবার মারাত্বক রেগে গেলো, রেগে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো অনিমাকে। খাটের কর্ণারে গিয়ে লাগার কারণে কপালের সাইড দিয়েও অনেকটা কেটে গেলো অনিমার । রিক সেদিকে খেয়াল করেনি ধাক্কা দিয়েই হনহন করে বেড়িয়ে গেছে রুম থেকে। অনিমার মাথা ধরে উঠে বসে হাটুতে মুখ গুজে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগল। এমনিতেই মাথা ব্যাথা করছে ওর তারওপর ব্যাথা পাওয়ায় আরো কষ্ট হচ্ছে।
___________________
রাতে আদ্রিয়ান টেবিলে ল্যাপটপ রেখে ওটাতে কিছু ইনফরমেশন কালেক্ট করছে। হঠাৎ আদিব এলো। আদিবের উপস্থিতি টের পেয়ে আদ্রিয়ান ল্যাপটপে চোখ রেখেই বলল,
— ” কী খবর?”
আদিব চেয়ারে বসতে বসতে বললো,
— ” সবকটা এয়ারলাইন চেক করা হয়ে গেছে কিন্তু সবাই না করছে।”
আদ্রিয়ান একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,
— ” টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করে দিয়েছে।”
আদিব অবাক হয়ে বলল,
— ” এখন কী করবো? এতোগুলো এয়ার লাইনের সবাইকে তো আর চাপ দেওয়া যাবে না?”
আদ্রিয়ান ল্যাপটপ টা বন্ধ করে বলল,
— ” আগে এটা জানতে হবে যে কোনো এয়ারপোর্ট থেকে ওরা গেছে তারপর বাকিটা বার করা আমার বা হাতের কাজ।”
আদিব একটু ভেবে বললো,
— ” আচ্ছা কবির শেখ এর নাম্বার ট্রাক করলে কেমন হয়?”
আদ্রিয়ান একটা শ্বাস ফেলে বলল,
— ” লাভ নেই। খুব চালাক মানুষ উনি। রিকের সাথে উনি ওনার ইউসিয়াল নাম্বার দিয়ে কথা বলবেন না। তুই চলে যা অনেক রাত হয়েছে।”
আদিব কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে থেকে আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,
— ” একটা কথা বলবো?”
অাদ্রিয়ান একটা হাই তুলে বললো,
— ” হুম?”
আদিব ইতস্তত কন্ঠে বলল,
— ” আজকে একটু ঘুমিয়ে নে ভাই। টানা দুদিন ধরে চোখের পাতা এক করিস নি।”
আদ্রিয়ান আদিবের দিকে তাকিয়ে বলল,
— ” ঘুম আসবেনা এখন।”
আদিব ভ্রু কুচকে বলল,
— ” কাম অন আদ্রিয়ান। তোর বডিটাও হিউম্যান বডি। এরকম করলে অসুস্হ হয়ে পরবি। যদি সুস্হই না থাকিস তো অনিকে খুজবি কীকরে?”
আদ্রিয়ান মুচকি হেসে বলল,
— ” আচ্ছা চেষ্টা করবো। তুই যা এখন। রাইমা একা আছে। এইসময় ওকে সময় দেওয়া উচিত তোর।”
আদিব চলে যেতেই আদ্রিয়ান উঠে ব্যালকনিতে চলে গেলো। রেলিং ধরে কিছুক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। আর ওর ঐ শূণ্যদৃষ্টির চোখ থেকে এক ফোটা জল ধীর গতিতে গড়িয়ে পরলো। সবার সামনে স্ট্রং থাকলেও ভেতর দিয়ে ভেঙ্গে গুড়িয়ে যাচ্ছে ও। মেয়েটা কোথায় আছে, কীভাবে আছে, কী হচ্ছে ওর সাথে কিছুই বুঝতে পারছেনা ও। খুব বেশি মিস করছে ও ওর জানপাখিকে। আকাশের দিকে তাকিয়ে আদ্রিয়ান ভাঙা গলায় বলল,
— ” আ’ম সরি মিস্টার সিনিয়র। আমি জানি আমি তোমাকে দ্বিতীয়বার নিরাশ করেছি। তোমার মামনীকে ঠিকভাবে আগলে রাখতে পারিনি আমি। শুরুতে আমার একটা ভুলের কারণে চারটা বছর মেয়েটা কষ্ট পেয়েছে।আজ আরেকটা ছোট্ট ভুলের কারণে ওকে আবারও বিপদে পরতে হলো। তুমি ঠিক মানুষকে দায়িত্ব দিয়ে যেতে পারোনি। কিন্তু কথা যখন দিয়েছি তখন আমি ঠিক তোমার মেয়েকে সুরক্ষিত অবস্হায় নিয়ে আসবো। সাত বছর আগে ও শুধু আমার দায়িত্ব ছিলো, কিন্তু আজ ও আমার ভালোবাসাও। আমি তোমার মেয়ের কিচ্ছু হতে দেবোনা, কিচ্ছু না। ”
____________________
অনিমা খাটে মাথা চেপে ধরে বসে আছে। মাথা ভিষণ ব্যাথা করছে ওর, ভার হয়ে আসছে সকাল থেকেই। সবকিছু অসহ্য লাগছে ওর কাছে। সবকিছু ভেঙ্গে ফেলতে ইচ্ছে করছে ওর এই মুহূর্তে। রিক খাবার নিয়ে অনিমার রুমে এসে অনিমাকে ওভাবে মাথা চেপে ধরে ছটফট করতে দেখে। খাবারটা টি-টেবিলে রেখে ওর সামনে বসে ও মাথায় হাত রেখে বলল,
— ” এরকম করছো কেনো? মাথা ব্যাথা করছে?”
অনিমা হাত ঝারা দিয়ে সরিয়ে ঝাঝালো কন্ঠে বলল,
— ” জাস্ট লিভ মি এলোন।”
রিক অনেকটা অবাক হলো। যেই মেয়েটা ওর দিকে চোখ তুলে তাকাতেও ভয় পায় সেই মেয়েটার হঠাৎ এইভাবে কথা বলা সত্যিই স্বাভাবিক নয়। তাছাড়া এখন এমন কিছুই করেনি ও যার জন্যে এরকম করবে। হঠাৎ এই ওভার রিয়াক্ট করা দেখে রিকের মনে প্রশ্ন উঠলেও ব্যবহারটা ওর ইগোতে লাগলো। রিক ওর হাত ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,
— ” সাহস কীকরে হলো আমার সাথে এভাবে কথা বলার?”
অনিমা কিছু না বলে হাত সরিয়ে দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে বসে রইলো। রিক ভ্রু কুচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো অনিমার দিকে। তারপর প্লেট হাতে নিয়ে বলল,
— ” হা করো।”
অনিমা রিকের দিকে না তাকিয়েই বলল,
—” খাবোনা।”
রিক অনিমার মুখ নিজের দিকে ঘুরিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
— ” বেশি কথা না বলে চুপচাপ খেয়ে নাও।”
অনিমা এবার ধাক্কা দিয়ে প্লেট টাই ফেলে দিলো। এটুকুই যথেষ্ট ছিলো রিকের সেই ভয়ংকর রাগ ওঠানোর জন্যে। রিক রক্তবর্ণ চোখে অনিমার দিকে তাকালো অনিমা অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। রিক ওর চুলের মুঠি ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে একটা থাপ্পড় মারলো। অনিমা মুখ থুবড়ে বিছানায় পরে গেলো। ওর ঠোঁটের কোণ এমনিতেই কাটা ছিলো এই থাপ্পড়ে নতুন করে না কাটলেও পুরোনো ক্ষত থেকে রক্ত বেড়িয়ে গেলো। রিক ওর হাত ধরে টেনে তুলে গাল চেপে ধরে বলল,
— ” যতই ভাবি যে তোমার গায়ে হাত তুলবো না কিন্তু তুমি তো চড় থাপ্পড় ছাড়া শুধরাবার মেয়েই নও। কিছু না বললেই সাহস বেড়ে যায় তাইনা?”
অনিমা কান্নাজরিত চোখে তাকিয়ে আছে রিকের দিকে। রিক ওকে ধাক্কা দিয়ে বেডে ফেলে বলল,
— ” তৈরী খাবার সামনে পাচ্ছিলে বলে মাথায় চড়ে গেছো রাইট? এবার তুমি তখনি খাবার পাবে যখন অামার কাছে খাবার ভীক্ষা চাইবে। তার আগে খাবার তো ছাড়ো একফোটা পানিও পাবেনা তুমি।”
এটুকু বলে রুম থেকে বেড়িয়ে শব্দ করে দরজাটা বন্ধ করে চলে গেলো রিক। অনিমা বালিশে মুখ গুজে শব্দ করে কাঁদতে শুরু করলো। আশেপাশের বাতাসও ওর কাছে বিষাক্ত লাগছে । ও কী করছে নিজেই বুঝতে পারছেনা। মাথায় অসহ্য রকম যন্ত্রণা হচ্ছে। ও নিজেও জানেনা এই যন্ত্রণার শেষ কোথায়?
#চলবে…