আর একটিবার পর্ব-১৬

0
249

#আর_একটিবার
#শোভা_আক্তার(লাভলী)
#পর্ব_১৬

রাতেরবেলা…….
মাহা পড়ার টেবিলে বসে পড়ছে। আগামীকাল ভার্সিটি যাবে ভেবেছে। সে সপ্তাহে ১ দিন বা ২ দিন ভার্সিটি যায়। গিয়ে পুরো সময় আলিয়া ও বিথির সাথেই থাকে। হঠাৎ দরজা ঠকঠক করার শব্দ আসলো। মাহা পারমিশন দিলো ভেতরে আসার। দরজা খুলে মাহার দাদা উঁকি দিলো।
“আসবো দাদুন?”
মাহা দাদাকে দেখে মুচকি হেসে বলল,
“পারমিশন নেয়ার কি আছে? আসো।”
দাদা ভেতরে প্রবেশ করে মাহার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“চাচী পছন্দ হয়েছে তোমার?”
“ভীষণ, উনি খুব ভালো। খুব মিষ্টি করে কথা বলে।”
“মাশা আল্লাহ মাশা আল্লাহ, তুমি না ঘুমিয়ে পড়ছো যে?”
“অনেক পড়া এখনো কমপ্লিট হয়নি তাই পড়ছিলাম। তুমি বলো কোনো কাজ আছে?”
দাদা কিছুটা অপ্রস্তুত হলো। মাহা বিষয়টা বুঝতে পেরে হেসে উঠে দাঁড়াল। আলমারির সামনে গিয়ে ড্রয়ার খুলে চেকবই বের করলো। পড়ার টেবিলে ফিরে এসে বলল,
“কত লাগবে?”
“ভাবছি তোর চাচুর এনগেজমেন্ট করে ফেলি। বিয়ে নাহয় মেয়ের অনার্স শেষ বর্ষের পরীক্ষার পর হবে।”
“হ্যাঁ আইডিয়া ভালো। কত লাগবে বলো আমি পড়ছি।”
“৫ বা ৬ লক্ষ দিলেই হবে।”
মাহা মুখে হাসি ফুটিয়ে রেখে ৬ লক্ষ লিখে চেক সাইন করে দিয়ে দিলো। দাদা খুশিতে আত্মহারা হয়ে মাহাকে মন ভরে দোয়া করে চলে গেলেন। মাহার মাথায় তার মায়ের কথা ঘুরছে। সে সব জানে। কিন্তু মুখ বন্ধ করে সহ্য করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তার বাবার মৃত্যুর সময় মাহা ৪ বছরের ছিল। বাবার ক্যান্সার ছিল। তাই উনি সব সম্পত্তি মাহার নামে করে দেয়। সম্পত্তি যেহেতু মাহার এটার উপর কারো অধিকার নেই। দাদা, চাচু আর ফুপু মিলে মাহার মাকে দ্বিতীয় বিয়ে দেন। উনি রাজি ছিলেন না। কিন্তু হঠাৎ করেই রাজি হয়ে যায়। মাহার মনে ফুপু অনেক ঘৃণা ভরে দেয় তার মায়ের প্রতি। তাই মাহা মাকে দেখলে রেগে যায়। কিন্তু হাজার হলেও উনি তার মা হয়। তারও মায়ের ভালোবাসা পেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সে সৎ বাবার বাসায় যেতে চায় না। তার একটা সৎ ভাইও আছে। খুব মিষ্টি দেখতে তার ভাই। মাঝে মধ্যে মায়ের সাথে আসে। কিন্তু মাহা কথা বলে না। যতদিন বেঁচে আছে এইভাবেই তার জীবন কাটাতে হবে।

পরেরদিন……..
ইর্তেজা দ্রুত গতিতে ভার্সিটি পৌঁছালো। ক্লাসে গিয়ে পুরো ক্লাসে চোখ বুলালো। মাহা কোথাও নেই। আলিয়া ও বিথিকেও দেখা যাচ্ছে না। আফজাল আর রাফসান জানালার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। ইর্তেজা বেঞ্চের উপর ব্যাগ রেখে তাদের দিকে এগিয়ে গেল। রাফসানের বাম কানের পাশে হালকা নীলচে দাগ দেখা যাচ্ছে। ইর্তেজা জিজ্ঞেস করলো,
“তোর কানে কি হয়েছে?”
রাফসান মুখ লটকালো। আফজাল ফিক করে হেসে বলল,
“গতকাল মাহার হাতে মার খেয়ে এমন হয়েছে।”
ইর্তেজাও হেসে উঠলো আফজালের কথা শুনে। রাফসান ভেংচি কাটলো। তখনই স্যার আসলেন ক্লাসে। যে যে যার বেঞ্চে গিয়ে বসে পরলো। প্রায় ১০ মিনিট পর মাহা, আলিয়া ও বিথি আসলো। স্যার তাদের তিনজনকে দেখে ভ্রু কুঁচকে বলল,
“আমি কি জানতে পারি ক্লাসের সময় আপনারা কোথায় ছিলেন?”
মাহা বলল,
“স্যার, ন্যান্সিকে দেখতে গিয়েছিলাম। মাশা আল্লাহ তার চারটে ফুটফুটে বাবু হয়েছে।”
স্যার ভীতু গলায় বললেন,
“ন্যান্সি? কোন ন্যান্সি?”
“ডোন্ট ওয়ারি স্যার আপনার গার্লফ্রেন্ড ন্যান্সি না। আমি তো আমাদের ভার্সিটিতে থাকা বিড়ালটার কথা বললাম। আমি তার নাম ন্যান্সি রেখেছি।”
পুরো ক্লাসে হাসির শব্দ ছড়িয়ে পরলো। স্যার চোখের চশমা ঠিক করে বলল,
“ননসেন্স কোথাকার। যাও বেঞ্চে গিয়ে বসো।”
“থ্যাঙ্ক ইউ স্যার”
তারা গিয়ে নিজেদের সিটে বসলো। ইর্তেজা মাহার দিকে এক নজর দেখে হাসলো। মেয়েটা সত্যি অদ্ভুত। ক্লাস চলাকালীন ইর্তেজা বার বার মাহাকে দেখছিল। মাহা খেয়াল করেছে। কিন্তু তার কাছে বিষয়টা খারাপ লাগছে না।

ভার্সিটির শেষে সবাই এক এক করে ক্লাস থেকে বের হলো। ইর্তেজা দাঁড়িয়ে ব্যাগ গুছাচ্ছিল তখনই মাহা আসলো। ইর্তেজা চোখ তুলে মাহাকে দেখে মুচকি হাসলো। মাহা হাসিমুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মাঝেসাঝে এখানে সেখানে দেখছে। ইর্তেজা ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে বলল,
“কিছু বলবে?”
“হুম, সরি বলতে চাই তোমাকে?”
“কেন?”
“প্রথম দেখা থেকেই রুড ব্যবহার করেছি তোমার সাথে। শুধু তাই না তোমাকে মৃত্যুর রাস্তায় পর্যন্ত ঠেলে দিয়েছিলাম। সবকিছুর জন্যই আই এম সরি।”
ইর্তেজা হেসে বলল,
“এতে সরি বলার কি আছে? আমি এসবে মাইন্ড করি না। যেহেতু গতকালের ঘটনার কথা। আমি জানি তুমি আমাকে মরতে দিতে না। ঠিক সময়ে বলতে ইর্তেজা তোকে মাফ করে দিয়েছি আমি। তুইও মনে রাখবি মাহা কত বড়ো মনের মানুষ।”
মাহা মুখে হাত রেখে শব্দ করে হেসে উঠল। ইর্তেজার ঠোঁটে মুচকি হাসি। মাহা হাসতে হাসতে বলল,
“খুব ভালো মতো চিনেছো আমায় দেখছি।”
“ইর্তেজা প্রথম দেখাতেই বুঝে ফেলতে পারে মানুষটা কেমন। কিন্তু তোমাকে পুরোপুরি চিনতে পারি নি।”
মাহা হাসি থামিয়ে বলল,
“মানে?”
“মানে, গতকাল তুমি তোমার ফুপির সামনে এত শান্ত ছিলে। আমি তো ভেবেছিলাম তুমি তোমার পরিবারের সামনেও তুফান। না-কি পরিবারের সামনে ভদ্র হওয়ার নাটক করো?”
বলেই ইর্তেজা হাসলো। মাহার চেহারায় হঠাৎ বেদনার ছাপ দেখা গেল। ইর্তেজা হাসি থামিয়ে ভাবলো সে ভুল কিছু বলে ফেলল না তো? মাহা এক নজর ঘড়ি দেখে বলল,
“আমার দেরি হচ্ছে আমি আসি।”
বলেই মাহা দ্রুত হেটে ক্লাস থেকে বের হলো।ইর্তেজা অবাক না হয়ে পারলো না। সেও মাহার পেছনে দৌড়ে গেল। মাহা হনহন করে এগিয়ে যাচ্ছে। ইর্তেজা দৌড়ে গিয়ে তার সামনে দাঁড়াল। মাহা থেমে গেল ইর্তেজাকে দেখে।
“আমার কোনো কথায় মন খারাপ হলে সরি। প্লিজ রাগ করো না।”
ইর্তেজার কথা শুনে মাহা মাথা নিচু করে ফেলল।লম্বা নিশ্বাস ফেলে আবার মাথা তুলে বলল,
“আমি ভার্সিটিতে আসি কম। কারণ সবসময় শক্ত থাকতে পারি না। হঠাৎ করে এমন কিছু মনে এসে পড়ে, নিজেকে তখন স্বাভাবিক রাখতে কষ্ট হয়।”
ইর্তেজা এক কদম এগিয়ে মাহার বরাবর দাঁড়াল। ইর্তেজার চোখের দিকে তাকাতেই মাহা নিশ্চুপ হয়ে গেল। এমন নিষ্পাপ ও মুগ্ধকর চাহনি সে আজ পর্যন্ত দেখেনি। ইর্তেজা মাহার চেহারায় চোখ বুলিয়ে বলল,
“তোমাকে সবসময় হাসিখুশি দেখতে ভালো লাগে। এভাবে মন খারাপ করে রাখলে আমার ভালো লাগবে না। তোমার ব্যক্তিগত জীবনের সম্পর্কে জানতে চাই না আমি। আচ্ছা এখন এসব ছাড়ো, ফ্রেন্ডস?”
ইর্তেজা হাত বাড়িয়ে দিলো মাহার দিকে। মাহা এক নজর ইর্তেজার হাতের দিকে তাকিয়ে আবার ইর্তেজার দিকে তাকাল। মুচকি হেসে হাত এগিয়ে দিলো।

———-

সময় নিজের গতিতে গড়িয়ে যাচ্ছে। ইর্তেজা, মাহা, আলিয়া, রাফসান, বিথি ও আফজালের মাঝে বেশ সুন্দর বন্ধুত্ব সৃষ্টি হয়েছে। তারা এখন একে অপরের জানপ্রাণ। ইর্তেজার জন্য মাহা ও তার সম্পর্ক বন্ধুত্ব থেকেও বেশি এটা সে কিছুতেই বলতে পারছে না। মেয়েটার প্রতি ইর্তেজা খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে। মাহার একটুখানি কষ্ট সে সহ্য করতে পারে না। কিছুদিন আগের ঘটনা। একটা ছেলে মাহার জামা নিয়ে বাজে মন্তব্য করেছে ইর্তেজা তাকে মেরে হসপিটাল পাঠিয়ে দিয়েছে। মাহা ইর্তেজার এমন রূপ আগে কখনো দেখেনি। সেদিন থেকে মাহার মনে ভয় সৃষ্টি হয়েছে। ইর্তেজার ভাবসাব তার মোটেও সুবিধার মনে হচ্ছে না।

মাহা গাছের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার মাথায় আজ এমন কিছু ঘুরছে যার দ্বারা ইর্তেজার মনের কথা সে জানতে পারবে। কিছুক্ষণ পর রাফসান ও ইর্তেজা আসলো। রাফসান এদিক সেদিক চোখ বুলিয়ে বলল,
“মাহা, বাকিরা কোথায়?”
মাহা মাথা নিচু রেখেই বলল, “জানিনা আমি”
“বলিস কি? আচ্ছা আমি খুঁজে নিয়ে আসি।”
রাফসান চলে গেল। ইর্তেজা মুচকি হেসে মাহার পাশাপাশি দাঁড়িয়ে গাছের সাথে হেলান দিলো। বেশ কিছুক্ষণ সময় কেটে গেল। মাহা এখনো চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ইর্তেজা বিরক্ত হয়ে বলল,
“কি হয়েছে তোর? বলেছি না এভাবে মুখ গোমরা করে রাখবি না? আমার তোকে এভাবে দেখতে মোটেও ভালো লাগে না।”
মাহা তবুও চুপ রইলো। ইর্তেজা হেলান ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
“কি হয়েছে মাহা বল আমায়। কেও কিছু বলেছে? নাম বল একবার। তাকে তো আমি….”
“আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে ইর্তেজা।”
ইর্তেজা চমকে উঠল। অবাক দৃষ্টিতে তাকাল মাহার দিকে। রাফসান ও বাকিরাও আসছিল। মাহার কথা শুনে তারাও থমকে গেল। বিথি ও আলিয়া দ্রুত এসে মাহার পাশে দাঁড়াল। বিথি রাগী কন্ঠে বলল,
“কি? তুই আমাদের আগে বলিস নি কেন?”
মাহা মাথা তুলে ইর্তেজার দিকে তাকাল। ইর্তেজার অবাক হওয়ার অংশবিশেষ এখনো শেষ হয়নি। মাহা বিথির দিকে তাকিয়ে বলল,
“হঠাৎ হয়েছে সব।”
“তুই রাজি?”
মাহা ইর্তেজার দিকে তাকিয়ে হুম বলল। চারপাশে নিরবতায় ঢেকে গেল। কারো মুখ দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না। ইর্তেজা মাহার বরাবর এসে দাঁড়াল। মাহা অন্য দিকে তাকিয়ে আছে। ইর্তেজা মাহার গালে হাত রেখে নিজের দিকে চেহারা ঘুরালো। ইর্তেজার চোখের দিকে তাকাতেই মাহা চমকে উঠল। ইর্তেজার চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। ইর্তেজা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
“তুই সত্যি রাজি?”
“হুম”
“মন থেকে বলছিস? কেও জোর করেনি তো তোকে?”
মাহা ইর্তেজাকে হালকা করে ধাক্কা দিয়ে বলল,
“এত প্রশ্ন করার কি আছে? বলেছি না আমি রাজি?”
ইর্তেজা রাগে গর্জে উঠল,
“কেন রাজি তুই? বল আমায় কেন রাজি তুই?”
সবাই ভয় পেয়ে গেল ইর্তেজার চিৎকার দেখে। আশে পাশের সবাই হা হয়ে গিয়েছে। মাহা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ইর্তেজার দিকে। ইর্তেজা হনহন করে মাহার দিকে হেটে এসে চোখে চোখ রেখে বলল,
“তুই আজই তোর পরিবারকে বলবি তুই এই বিয়েতে রাজি না।”
ভয়ে মাহার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। তবুও কোনোমতে নিজেকে স্বাভাবিক রেখে ভ্রু কুঁচকে বলল,
“যেহেতু আমি রাজি তো না বলবো কেন?”
“কারণ আমি বলেছি।”
“আমি তোর কথা কেন শুনবো? কে তুই? শুধুমাত্র বন্ধু তাই না?”
“দেখ মাহা, আমি তর্ক করতে চাই না। তুই না বলবি দিবি নাহলে ভালো হবে না বলে দিচ্ছি।”
সবাই থতমত খেয়ে তাদের তর্কবিতর্ক দেখছে। মাহা ইর্তেজার কলার চেপে ধরে বলল,
“কেন ভালো হবে না শুনি? আমার উপর এত অধিকার ফলাচ্ছিস কেন তুই?”
ইর্তেজা মাহার হাত ঝাড়ি মেরে ছাড়িয়ে চিৎকার করে বলল,
“কারণ আমি ভালোবাসি তোকে।”
সবার মুখ নিমিষেই হা হয়ে গেল। ইর্তেজা আবার বলল,
“তুই অন্য কারোর হলে আমি কি করে বসবো নিজেও জানি না।”
মাহা হঠাৎ ঠাশ করে ইর্তেজার গালে চড় মেরে দিলো। যদিও আস্তে মেরেছে কিন্তু শব্দ বেশ জোরে এসেছে। ইর্তেজা মাহার দিকে তাকাল। মাহার রাগী কন্ঠে বলল,
“তুই পুরুষ না? আগে বলা যেত না এই কথা? তোর এই এক বাক্য শোনার জন্য আমার এত নাটক করতে হলো।”
“নাটক?”
“তো আর কি? তোর কি মনে হয় মাহা এতোই বাধ্য মেয়ে যে পরিবারের কথায় ঢ্যাং ঢ্যাং করে যেয়ে বিয়ে করে ফেলবে?”
কথাটা বলতে সময় লেগেছে কিন্তু মাহার গালে চড় পরতে সময় লাগে নি। মাহা গালে হাত দিয়ে হা হয়ে ইর্তেজার দিকে তাকিয়ে রইল। ইর্তেজা রাগে গজগজ করতে করতে বলল,
“তোর জান টেনে ছিঁড়ে ফেলবো ফা*জিল মেয়ে কোথাকার।”
মাহা মুখ বানিয়ে বলল,
“তুই আমাকে মারলি?”
ইর্তেজা মাহার চোখে চোখ রেখে বলল,
“এখন তো চড় মারলাম। আজকের পর থেকে এমন মজা আবার করলে তোর সাথে কি করবো নিজেও জানি না।”
মাহা গালে হাত রেখেই কেঁদে উঠল। থাপ্পড়টা ভালো মতোই লেগেছে। ইর্তেজার রাগ নিমিষেই শেষ হয়ে গেল। দ্রুত মাহাকে বুকের মাঝে ভরে নিলো। মাহা ইর্তেজার বুকে ইচ্ছে মতো মেরে বলল,
“দূর হয়ে যা আমার সামনের থেকে। লাগবে না তোর ভালোবাসা আমার।”
“চুপ থাক নাহলে আবার আর এক গালে চড় মেরে বসবো।”
মাহা চুপসে গেল। ইর্তেজার বুকে মুখ ডুবিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সে। আফজাল আর রাফসান সিটি বাজিয়ে উঠল। বিথি দ্রুত মোবাইল বের করে তাদের ভিডিও করছে। আলিয়া হাসছে তাদের কান্ড দেখে। মাহা একবার মুখ তুলে সবার দিকে তাকাল। জীবনে প্রথম তার লজ্জা লাগছে তার বন্ধুদের সামনে। ইর্তেজাকে ছেড়ে দূরে সরে দাঁড়াল। ইর্তেজা পকেট থেকে রুমাল বের করে মাহার হাত ধরে নিজের কাছে নিয়ে আসলো। পরম যত্নে মাহার চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বলল,
“ভালোবাসার শুরু হলো দুজন দুজনকে চড় মেরে। জানি না ভবিষ্যতে আছে কত মা*রপি*ট করতে হবে তোর কারণে?”
“মা*রপি*ট? হা হা হা নিজেকে দেখেছিস আয়নায়?”
“আর লাগবে না দেখা। যার জন্য জন্মেছি এখন তার হয়েই থাকতে চাই।”
“তুই শিওর তুই আমার জন্য জন্মেছিস?”
“হুম, ইর্তেজা মাহার না তো কারো না।”
“যদি এমন হয়। তাহলো মাহা-ও ইর্তেজার না তো কারো না।”
ইর্তেজা মুচকি হাসলো মাহার কথা শুনে।

———–

বর্তমানে……
মোবাইল টন বাজার শব্দ শুনে ইর্তেজার ধ্যান ভাঙলো। পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখে শ্রাবণ। কিন্তু রিসিভ করার আগেই কেটে গেল। বাদশাহ বলল,
“ভাই এরপর কি হলো? আপনারা আলাদা হলেন কিভাবে?”
“সেটা আর একদিন জানাবো।”
“আমার তো এখনই জানতে ইচ্ছে করছে।”
ইর্তেজা বাদশাহ’র কাঁধে হাত রেখে মুচকি হেসে বলল,
“সব বলবো, আমাদের ভালোবাসা অসম্পূর্ণ কেন রয়েছে আমি জানি না। নিয়তি কেন মাহাকে আবার আমার জীবনে নিয়ে আসলো আমি সেটাও জানি না।”
ইর্তেজা মাহার দিকে তাকিয়ে আবার বলল,
“যদি #আর_একটিবার সুযোগ পাই। ওকে আর নিজের থেকে দূর করবো না।”
ইর্তেজার মোবাইল আবার বেজে উঠল। শ্রাবণ আবার কল করছে। রিসিভ করে কানে ধরতেই শ্রাবণের ধমকের স্বর ভেসে আসলো।
“ইর্তেজা তোমরা কাকে তুলেছো? আয়মান খলিলের স্ত্রী তো এখন তাদের বাসায়।”
তার মানে মাহা আয়মান খলিলের স্ত্রী না। ইর্তেজার মন যেন ঠান্ডা হয়ে গেল। স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
“বস, ভুল অন্য কাওকে তুলে নিয়ে এসেছি আমরা। কিন্তু ইনি আয়মান খলিলের কি হয় আমরা জানি না।”
“ইর্তেজা তোমার উপর আমার বিশ্বাস করা ভুল হয়েছে। ছোট্ট একটা কাজ করতে বলেছিলাম সেটাও পারলে না?”
“সরি বস”
“রাখো তোমার সরি। আমি খোঁজ করি তুমি কাকে তুলেছো। তার আগে মানুষটার খেয়াল রাখো তোমরা।”
“চিন্তা করবেন না বস। নিজের জানপ্রাণ দিয়ে তার রক্ষা করবো।”
শ্রাবণ ভ্রু কুঁচকে মোবাইলের দিকে তাকাল। সে মাঝেমধ্যে ইর্তেজাকে একদমই বুঝতে পারে না। ইর্তেজা মোবাইল পকেটে রেখে মাহার দিকে এগিয়ে গেল। চেহারা থেকে এখনো মায়া ভাব যায়নি। কিন্তু অনেক শুকিয়ে গিয়েছে মাহা। ইর্তেজা মাহার দিকে হাঁটু গেড়ে বসলো। তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে তার মাহার দিকে। ইর্তেজা মাহার ডান হাত ধরলো। কিছু বলার আগেই তার দৃষ্টি মাহার হাতের মেহেদীর দিকে গেল। ডান হাতের তালুতে ইংরেজি বড়ো অক্ষরে লিখা “SHAYAN”। ইর্তেজার চোখে অশ্রু জমে গেল। মাহার হাত আস্তে করে ছেড়ে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। মাহা তাহলে অন্য কারোর আমানত। ইর্তেজার দম বন্ধ হয়ে আসছে। মাথা ভার হয়ে আসছে তার। রাগ হচ্ছে অনেক রাগ। ইর্তেজা কাঁধে স্পর্শ অনুভব করলো। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে বাদশাহ। বাদশাহ বলল,
“ভালোবাসা পাখির মতো হয়। তাই ভালোবাসাকে খাঁচায় বন্দী করে না রেখে খোলা আকাশে উড়িয়ে দিতে হয়। পাখি যেমন উড়ে নিজের ঠিকানা নিজে খুঁজে নিতে পারে। ঠিক তেমনই, ভালোবাসাও নিজের ঠিকানা নিজে খুঁজে নিতে জানে।”
ইর্তেজা মাহার দিকে তাকাল। চোখের কোণায় জমা অশ্রু গড়িয়ে পড়তেই বলল,
“এর মানে আমার ভালোবাসাও নিজের ঠিকানা খুঁজে পেয়ে গিয়েছে।”
.
.
সন্ধ্যার সময়…..
সাগরিকা খাটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। রাগ, অভিমানে কলিজা ছিঁড়ে কান্না আসছে তার। যতবার বিশ্বাস করে শ্রাবণের উপর। শ্রাবণ ততবার তার বিশ্বাস ভাঙ্গে। হঠাৎ কলিংবেলের শব্দ আসলো। সূর্য বাহিরে গিয়েছিলো। হয়তো সে-ই ফিরে এসেছে। সাগরিকা গিয়ে কে এসেছে জিজ্ঞেস না করেই দরজা খুলল। দরজা খুলতেই তার রাগের পাল্লা আরো ভারি হয়ে গেল। শ্রাবণ দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে। সাগরিকা দরজা বন্ধ করতে নিলেই শ্রাবণ দরজা ধরে থামিয়ে দিলো। সাগরিকা দরজা খুলে রাগী কন্ঠে বলল,
“কি হয়েছে? কি সমস্যা তোমার?”
“বাসায় একা ভালো লাগছে না আমার।”
“তুমি আবার ড্রিংকস করেছো। ওয়াদা করেছিলে ছেড়ে দেবে। যাকগে, আমি আর কোনো কিছুর আশা করবো না তোমার থেকে।”
শ্রাবণ সিগারেট মাটিতে ফেলে নিভিয়ে হেলেদুলে এগিয়ে গেল। সাগরিকা রাগে ফুসছে। হাত আড়াআড়ি ভাবে ভাজ করে দাঁড়িয়ে রইল সে।
“মাফ করে দাও। আর ফিরে চলো প্লিজ।”
“না ফিরলে কি করবে শুনি।”
“এভাবে বলো না। আমার অনেক খালি খালি লাগছিল বাসায়।”
“হ্যাঁ, এই দুঃখে ম*দ খেয়েছো। একটুর মধ্যে দেবদাস হতে ইচ্ছে করে তাই তো?”
শ্রাবণ হেসে মাথা হ্যাঁ সূচক নাড়াল। তখনই সূর্য ফিরে আসলো। শ্রাবণ দেখে বিরক্ত হয়ে বলল,
“ইনি এসেও পরেছে? আমাকে বলল তোমার রাগ কম হলে আসলে। ভুল হয়েছে আমার তাকে কল দেয়া।”
“ভুল তোর না। ও ভালো মতোই জানে তুই ছাড়া আমার কেও নেই। তাই এই বাসা ছাড়া আর কোথাও যাব না আমি।”
“এত বিশ্রী গন্ধ কোথা থেকে আসছে?”
শ্রাবণ নিজের কলার ধরে বলল,
“একটুখানি ম*দ পড়েছিল এখানে।”
“আস্তাগফিরুল্লাহ আপু, আমি ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি। ঘর বাড়ি সবসময় পবিত্র রাখি। আর এই ব্যক্তি… আপু প্লিজ বের করো ওকে।”
“ও কখনো একা ফিরে যাবে না। আমারও যেতে হবে ওর সাথে।”
“কিন্তু আপু…”
“‌সূর্য আমি আবার আসবো। তুই নিজের খেয়াল রাখিস।”
সূর্য আর কিছু বলল না। সাগরিকা শ্রাবণকে ধরে বাসা থেকে বের হলো। বাহিরে গিয়ে সাগরিকা আশে পাশে চোখ বুলিয়ে বলল,
“গাড়ি আনো নি?”
“উঁহু, হেটে হেটে এসেছি।”
“যাক ভালো হয়েছে। এই অবস্থায় ড্রাইভ করে আসলে অঘটন নিশ্চিত ঘটতো।”
সাগরিকা রিকশা ডেকে নিলো। শ্রাবণকে ধরে রিকশায় বসিয়ে নিজেও বসলো। শ্রাবণ একা একা বকবক করেই যাচ্ছে। শতবার সরি বলছে তাকে। পুরো রাস্তা সাগরিকা চুপ ছিল। বাসায় পোঁছে শ্রাবণকে নিয়ে ঘরে গেল সাগরিকা। ঘরে যেতেই তার চোখ কপালে উঠে গেল। আলমারির সব জামা বের হয়ে মাটিতে পড়ে আছে। খাটও উলটপালট হয়ে আছে। সাগরিকা শ্রাবণকে ধাক্কা দিয়ে খাটে বসিয়ে বলল,
“এসব কি? আমি ঘরবাড়ি যত পরিষ্কার রাখার চেষ্টা করি তুমি তত নোংরা করো।”
“ভু..ভুল হয়েছে, সরি।”
সাগরিকা লম্বা নিশ্বাস ফেলে চুল হাত খোঁপা করতে করতে এগিয়ে গেল। আলমারির সব জামা গুছিয়ে ঠিক মতো রেখে ঘুরে দাঁড়াল। শ্রাবণ উপুর হয়ে শুয়ে একটা বালিশ বুকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে। সাগরিকা ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল। শ্রাবণের এই ঘুমন্ত চেহারা দেখে মনে হচ্ছে না মানুষটা শত শত পাপ করেছে। সাগরিকা বসলো শ্রাবণের পাশে। আলতো করে শ্রাবণের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। শ্রাবণ এখনো নিষ্পাপ বাচ্চাদের মতো ঘুমিয়ে আছে। সাগরিকার মন গলানোর জন্য এই চেহারাই যথেষ্ট। মুচকি হাসলো সাগরিকা।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here