বালির নীচে জলের শব্দ #পর্ব ২০,২১

0
450

#বালির নীচে জলের শব্দ
#পর্ব ২০,২১

২০

ফ্যানের খটখট আওয়াজটা এমন একটা নিস্তব্ধ পরিবেশে বেশ বিরক্ত লাগছে। আরও বেশী বিরক্ত লাগছে সামনে বসে থাকা মানুষ গুলোর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। বিরক্তিটা রন্ধ্রে রন্ধ্রে পৌঁছে যেতেই চোখমুখ কুচকে ফেললো হিমেল। ভীষণ বিরক্ত নিয়ে বলল
–তোরা যেমনটা ভাবছিস তেমন কিছুই না। কুমুর সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই।

শ্রাবণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বড় করে ফেললো। কঠিন গলায় বলল
–তোমার এই না সূচক শব্দটা মানতে পারছিনা ভাইয়া। তুমি সেদিন থেকে একই কথা বলে যাচ্ছ। কিছুতেই স্বীকার করতে চাইছ না। কিন্তু একের পর এক যা ক্লাইমেক্স দেখছি সেসব কি?

শ্রাবণ থেমে যেতেই সৌরভ থমথমে গলায় বলল
–সম্পর্ক নেই অথচ একে অপরের সাথে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করছ। লুকিয়ে লুকিয়ে যেখানে সেখানে দেখা করছ। একসাথে রিক্সায় ঘুরছ। মেয়েটাও বা কেমন সম্পর্ক ছাড়াই একটা ছেলের সাথে এভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সত্যিই আজকাল কার মেয়েদের…।

–শাট আপ সৌরভ! কারো সম্পর্কে কিছু বলার আগে তার সম্পর্কে ভালভাবে জেনে নেয়া উচিৎ। সব মেয়ে এক রকম নয়। আজকালকার জেসব মেয়েদের কথা তুই বলছিস কুমু সেরকম নয়। সবার থেকে আলাদা।

সৌরভ কথা শেষ করার আগেই হিমেল চেচিয়ে উঠে কড়া গলায় এক নিশ্বাসে বলেই থেমে গেলো। সে থেমে যেতেই ঘরের পরিবেশটা আবারো নিস্তব্ধ হয়ে গেলো। কয়েক মিনিট চলল পিন পতন নিরবতা। তারপর শোনা গেলো সৌরভের অট্টহাসি। তাকে এভাবে হাসতে দেখে কপালে গাড় ভাঁজ ফেলে তাকাল হিমেল। শ্রাবণও কিছুটা অবাক হল। এই সিরিয়াস মোমেন্টে এভাবে হাসার কারণটা বুঝতে না পেরে বিরক্তও হল কিছুটা। হিমেল ভ্রু কুচকে বলল
–এভাবে হাসছিস কেন?

সৌরভ হাসি থামাল। ভ্রু নাচিয়ে বলল
–এখনো কি বলবি বন্ধু কিছুই নেই। কুমু কেমন মেয়ে সেটাও তুই ইতিমধ্যে জেনে গেছিস। কেন এই লুকোচুরি? তুই বলবি সবটা নাকি কুমুকেই জিজ্ঞেস করতে হবে? ভাবছি শাশুড়ি মাকে সবটা খুলে বলবো। তিনি নিজেই কুমুর সাথে কথা বলবেন। জানতে চাইবেন সম্পর্ক বিহীন ঘোরাফেরা কেমন চলছে।

হিমেল দুই হাতে মুখ ঢেকে ফেলল। এই বিষয়টা নিয়ে আর ধোঁয়াশার মাঝে থাকা সম্ভব না। সবটা এখন পরিষ্কার না করলে এরা সত্যি সত্যি তার মাকে জানিয়ে দেবে। আর তখন ভালো কিছু হবে না। হাত সরিয়ে ঠোঁট গোল করে শ্বাস ছাড়ল। কিছুটা সময় চুপ থেকে ক্লান্ত কণ্ঠে বলল
–কি জানতে চাইছিস তোরা?

–প্রেম কাহিনী।

একসাথে বলে উঠলো দুজন। হিমেল সরু চোখে তাকিয়ে বলল
–কতবার বলেছি এরকম কিছুই না। যেখানে এখনো প্রেমটাই হল না সেখানে কাহিনী জমবে কিভাবে? আমি নিজেই মনস্থির করে উঠতে পারছি না। কুমুর ব্যাপারটাও ঠিক বুঝে উঠতে পারছিনা।

সৌরভ কিছুটা কড়া গলায় বলল
–মনস্থির করতে পারছিস না মানে? তুই তো মনস্থির করেই ফেলেছিস। শুধু কুমুর দিক থেকে খোলাসা করে কিছু জানতে পারিস নি। এ জন্যই তোর মনে একটা দ্বিধা কাজ করছে। জিজ্ঞেস করে নে সরাসরি।

হিমেল হতাশ হল এমন কথা শুনে। কুমু অন্তর্মুখী মেয়ে। নিজের মনের কথা এভাবে বলার মতো সাহস তার নেই। হিমেল নিচের দিকে তাকিয়ে বলল
–জিজ্ঞেস করলেও খুব একটা লাভ হবে না। তার মনের কথা কখনো মুখ ফুটে বলবে না। মেয়েটা অন্যরকম।

হিমেলের কথা শুনে সবাই ভাবনায় ডুবে গেলো। এর একটা সুরাহা হওয়া দরকার। এভাবে তো আর চলতে দেয়া যায় না। হিমেল কিছুটা নামানো সরে বলল
–এখনই তোরা মাকে কিছু জানাস না। সময় হলে আমি নিজেই বলবো।

শ্রাবণ দাঁত কেলিয়ে বলল
–তোমার কি মনে হয় এখনো মা জানা বাকি থেকে গেছে? তোমার বোন যেখানে জেনেছে সেখানে অনেক আগেই মায়ের কানে পৌঁছে গেছে।

হিমেল অসহায়ের মতো তাকাল। তার মাথাতেই ছিল না যে নিলু মাকে সবটা জানিয়ে দেবে। এখনো সেই কিছু জানতে পারলো না আর তার আগেই মা জেনে গেলো। এখন তার মা ঠিক কিভাবে নেবে সেটাই ভেবে পাচ্ছে না। নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে তার।

———–
কাঠ ফাটা রোদের দুপুরে খাওয়ার পর ফ্যানের নীচে আরাম করে শুয়ে ঘুমানোর কথা থাকলেও এই মুহূর্তে সেটা সম্ভব হছে না। পরিক্ষার জন্য প্রথমেই নোট নিতে যেতে হবে এক বন্ধুর কাছে। তারপর সেখান থেকে টিউশনি। সন্ধ্যার আগে ছাড়া বাড়ি ফেরা সম্ভব না। মৌ বিছানায় হাত পা ছেড়ে ঘুমাচ্ছে। বাড়ির সবাই না ঘুমালেও নিজ নিজ ঘরে শুয়ে রেস্ট নিচ্ছে। কুমু ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে বের হয়ে গেলো। কোন শব্দ না করেই বাইরের দরজা বন্ধ করে সিঁড়ি বেয়ে নামছে। কয়েকটা সিঁড়ি পেরোতেই ব্যস্ত পায়ের আওয়াজে থেমে গেলো। হিমেলকে দেখে দৃষ্টি স্থির করে ফেললো। হিমেল ফোনের দিকে তাকিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠছিল। উপরে তাকাতেই কুমুকে দেখে থেমে গেলো। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে মুচকি হেসে তাকাল। কুমু কোন কথা না বলে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই হিমেল দেয়ালে হেলানি দিয়ে দাঁড়ালো। বলল
–কোথায় যাচ্ছেন ম্যাডাম?

কণ্ঠস্বরটা কুমুকে কেমন কাঁপিয়ে তুলল। চাপা কোন অধিকার বোধ কথার মাঝে। মন মস্তিস্ক সব ভুলে সামনের মানুষটাকে প্রশ্রয় দিতে চাইল। কিন্তু পরক্ষনেই সেদিনের কথা মনে পড়তেই নিজের চিন্তা ভাবনা বদলে ফেললো। এভাবে চলতে থাকলে সবাই বিষয়টাকে খারাপ ভাবছে। শ্রাবণ তাকে সন্দেহ করছে। এই মানুষটাকে কোনভাবেই প্রশ্রয় দেয়া যাবে না। কণ্ঠে কিছুটা কাঠিন্য বজায় রেখে বলল
–কাজ আছে।

–এই ভর দুপুরে কি কাজ শুনি?

আবারো সেই কণ্ঠস্বর! অনুভূতিগুলো এলোমেলো হয়ে উঠছে। সামলানো মুশকিল হয়ে পড়ছে তার জন্য। নিজেকে কিছুটা ধাতস্থ করে নিলো। হিমেলকে রাগিয়ে দিতেই কড়া গলায় বলল
–আপনাকে কেন সবটা বলতে হবে? আমার ব্যাক্তিগত কাজ থাকতে পারে।

হিমেল একটুও রাগ করলো না। উল্টা আরও হাসিটা প্রশস্ত করে বলল
–বললে তো ক্ষতি নেই। তাহলে বলতে কি সমস্যা?

কুমু কিছুটা রাগী সরে বলল
–সমস্যা আছে। আমি বলতে চাইছি না মানে বলবো না। আপনি আমাকে জোর করতে পারেন না। এখন রাস্তা ছাড়ুন আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।

হিমেল এবার বোধ হয় একটু রাগ করলো। কঠিন ভাবে তাকিয়ে থাকলো কয়েক মুহূর্ত। গম্ভীর গলায় অত্যন্ত শান্ত কণ্ঠে বলল
–আমার সাথে এভাবে কেউ কথা বলে না।

কথার ধরনটা একদম অন্যরকম ছিল। গলার আওয়াজটাই কেমন ভয় তৈরি করছে মনে। কুমু বোধ হয় একটু ভয়ও পেলো। তাই একদম নিশ্চুপ হয়ে গেলো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নরম কোমল হয়ে নীচে নেমে গেলো। হিমেল ঐ অবস্থাতে থেকেই একই রকমভাবে বলল
–আমাকে যারা চেনে মানে আমার সাথে সব সময় চলফেরা করে তারা কখনো আমার সাথে এভাবে কথা বলেনা। কারণ আমি নিজেই অপ্রয়োজনীয় কোন কথা বলিনা। যা বলি সবটা গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমার কথায় সবাই গুরুত্ব দেয়। শুধু তোমার কাছেই এখনো কোন গুরুত্ব পেলাম না। একমাত্র তুমিই আমার সাথে এমনভাবে কথা বল। আমি কিছু বলিনা মেনে নেই বলে এটাকে আমার দুর্বলতা ভেবে সুযোগ নিবে না। নাহলে কিন্তু আমিও এই মুহূর্তে তোমার সুযোগ নিতে একবারও ভাববো না।

হিমেলের কথা কানে আসতেই কুমু অর্থটা ধরতে পারলো। চোখ তুলে বড় বড় করে তাকাল। সাথে সাথেই পরপর দুটো সিঁড়ি ভেঙ্গে আবার উপরে উঠে গেলো। কুমুর ভয়টা ধরা পড়ে গেলো হিমেলের চোখে। চমৎকার হেসে নরম কণ্ঠে বলল
–এখন বল কোথায় যাচ্ছ।

মুহূর্তেই গলার স্বরের পরিবর্তন দেখে কুমু একটু সচেতন দৃষ্টিতে তাকাল। কিন্তু ভয়টা দূর হল না। মিনমিনে কণ্ঠে বলল
–বন্ধুর বাসায় যাচ্ছি।

–কেন?

আবারো প্রশ্নে কুমু চোখ তুলে চাইল। কিন্তু হিমেলের স্থির দৃষ্টির আগে টিকতে না পেরে বলল
–নোট আনতে।

–কখন আসবে?

কুমু এবার বিরক্ত হল। কিছুটা বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে চেয়েও পারলো না। মন সায় দিলো না। স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল
–সন্ধ্যা হবে।

হিমেল ভ্রু কুচকে ফেললো। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে ঘড়ি দেখে নিয়ে বলল
–এখন বাজে ২ টা। এখন যাবে আর সন্ধ্যায় ফিরবে কেন? এতক্ষন কি করবে?

এবার কুমু বিরক্ত হল। বিরক্তিকর কণ্ঠে বলল
–কাজ আছে বললাম তো।

হিমেল কিছুটা রেগে ঝাঁঝালো গলায় বলল
–আমি এতক্ষন সেটাই জানতে চাইছি। তুমি অযথা সময় নষ্ট করছ।

কুমু ভীষণ বিরক্তি নিয়ে বলল
–এভাবে প্রশ্ন করার চাইতে আপনি আমার সাথেই চলুন না। তাহলে সবটা নিজে চোখে দেখতে পারবেন।

হিমেল শান্ত চোখে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো। কোন প্রতিক্রিয়া দেখতে না পেয়ে কুমু চোখ মেলে তাকাল। হিমেল হেসে ফেলে বলল
–আইডিয়াটা আমার খুবই পছন্দ হয়েছে। চলো তাহলে।

কুমু অবাক হল। রাগ অসস্তি সব কিছু একসাথেই চেপে বসলো মনে। ক্লান্ত কণ্ঠে বলল
–আবার?

চলবে…

#বালির নীচে জলের শব্দ
#পর্ব ২১

প্রকৃতি নিজের খেয়াল খুশি মতো চলে। কখনো বা মাথা পঁচা গরম আবার কখনো বা হিম শীতল হাওয়া। কিছুক্ষণ আগেই গরমের যে তীব্রতা ছিলো তার ছিটেফোঁটাও এখন নেই। হুট করেই কালো মেঘের আড়ালে ডুবে গেলো রোদ্দুর। শুরু হলো বাতাস। শীতলতা ছেয়ে গেল চারিদিকে। হিমেল আকাশের দিকে তাকাল। মনে হয় বৃষ্টি হবে। এতক্ষণ গরমের তেজে শার্টের উপরের দুইটা বোতাম খুলে রেখেছিল। এখন সেগুলো লাগিয়ে দিলেও খারাপ লাগবে না। অতিষ্ট পরিবেশটা সহনীয় পর্যায়ে এসেছে। এমন একটা পরিবেশ রিক্সায় ঘোরার জন্য উপযোগী। আর সাথে যদি ভালোলাগার মানুষ থাকে তাহলে তো কথাই নাই। বাতাসে কুমুর ওড়না এলোমেলো হয়ে উড়ে যাচ্ছে। সামলাতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। ব্যাগটা ধরবে নাকি ওড়না সামলাবে। আবার নিজেকেও ঠিকঠাক বসে থাকতে হচ্ছে। এভাবে একই রিক্সায় হিমেলের সাথে যেতে তার ভারী অসস্তি হচ্ছে তার। কিন্তু কোন উপায় নেই। হিমেল আজ পাগলামির সমস্ত সীমা অতিক্রম করেছে। হাজার বার বুঝিয়েও কোন লাভ হয়নি। সে কুমুর সাথে যাবে তো যাবেই। কে কি ভাবলো তার যায় আসেনা। অদ্ভুত মানুষ! এভাবে জেদ করার কোন কারণ নেই। অথচ হিমেল নাছোড়বান্দা। অবশ্য বাড়ির সামনে থেকে আজ আর রিক্সা নেয়নি। কিছুটা দুর হেঁটে গিয়ে তারপর রিক্সায় উঠেছে। হিমেল এর কোন সমস্যা ছিল না। কুমুর জন্যই এমন সিদ্ধান্ত। রিক্সায় ওঠার পর কিছুদূর যেতে না যেতেই কুমুর অসস্তি শুরু হয়। এই নিয়ে দ্বিতীয়বার তার সাথে রিক্সায় উঠলেও সেদিন মৌ ছিলো বলেই হয়তো তেমন কিছু মনে হয় নি। কিন্তু আজ ভীষন অসস্তি হচ্ছে। চেষ্টা করছে হিমেলের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে বসার। কিন্তু খুব একটা লাভ হচ্ছে না। কুমুর বিষয়টা হিমেল খেয়াল করলো। আড় চোখে একবার তাকিয়ে বলল
— আর একটু হলে তো পড়েই যাবে। ঠিক হয়ে বসো।

মস্তিষ্ক নানা রকম চিন্তায় ব্যস্ত থাকায় কুমু কথাটা ধরতে পারলো না। সেও আড় চোখে তাকাল। মিনমিনে সরে বলল
— কি বললেন?

— বললাম যে এর আগেও আমার সাথে রিক্সায় উঠেছো। কিন্তু আজ এমন আচরণ করছো যেনো আমি অপরিচিত কেউ। আর আমার সাথে রিক্সায় গেলে সাংঘাতিক রকমের দুর্ঘটনা ঘটে যাবে।

হিমেল এর কথা শুনে কুমু থতমত খেয়ে গেল। একে তো তার অসস্তি হচ্ছে আর এই লোকটা তাকে আজ অসস্তির সাগরে ডুবিয়ে মারার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। রিক্সায় উঠলেও পরিস্থিতি তো আর একরকম ছিলো না। আর সে তো ছেলে। মেয়েদের মনের অবস্থা কিভাবে বুঝবে। হিমেল গম্ভীর গলায় বলল
— ঠিক হয়ে বসো। পড়ে যাবে।

কুমু ওড়নাটা টেনে গায়ে ভালো করে জড়িয়ে নিলো। ব্যাগটা শক্ত করে চেপে ধরে স্থির হয়ে বসলো। হিমেল বিরক্ত হলো তার উপরে। সে ঠিক হয়ে বসতে বলেছে মানে এভাবে নয়। তাদের মাঝের জায়গাটায় অনেকটা দূরত্ব। ছোটো বাচ্চা একজন বসতে পারবে অনায়াসে। মেয়েটা কি তার কথা বুঝতে পারে না নাকি ইচ্ছা করে এমন করে। এখন কিভাবে তাকে বোঝাবে সে ঠিক কি বোঝাতে চেয়েছে। হতাশ শ্বাস ছাড়তেই মেঘের গর্জন শোনা গেলো। হিমেল আকাশের দিকে তাকাল। অবস্থা খুব একটা ভালো না। এখনি বৃষ্টি নামতে পারে। তার ধারণা সত্যি করে দিতেই বুঝি প্রকৃতি প্রস্তুত ছিলো। ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি নামলো ধরণীতে। কুমু উদাসীন চোখে তাকাল আকাশের দিকে। এখন কি হবে? ভাবতে ভাবতেই হিমেল রিক্সাওয়ালাকে উদ্দেশ্য করে বলল
— মামা হুড উঠিয়ে দেন। বৃষ্টি পড়ছে।

— না না। হুড উঠাতে হবে না। এভাবেই ঠিক আছে।

কুমু অস্থিরভাবে কথাটা বলতেই হিমেল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। এমন কথা এই মুহূর্তে সে কোনভাবেই শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলো না। রিক্সাওয়ালা ইতিমধ্যে রিক্সা থামিয়ে অপেক্ষা করছে শেষ পর্যন্ত ঠিক কি সিদ্ধান্ত আসতে পারে সেটা জানার। হিমেল পা থেকে মাথা পর্যন্ত অদ্ভুত ভাবে কুমুকে দেখে নিলো। অসস্তি আরো বেড়ে যেতেই কুমু ওড়নাটা আরো জড়িয়ে নিলো। হিমেল কিছুটা বিরক্তিকর সরে বলল
— এভাবে থাকলে ভিজে যাবে। আর ভেজা কাপড়ে সবাই তাকিয়ে থাকবে। ভালো লাগবে?

কুমু কথাটা বুঝতে পেরেই আর কোন শব্দ উচ্চারণ করলো না। রিক্সাওয়ালা হুড উঠিয়ে দিয়ে তাদেরকে একটা পলিথিন দিলো কোলের উপরে বিছিয়ে রাখার জন্য। সেটা দিয়ে দুজন নিজেদেরকে বৃষ্টি থেকে আড়াল করে নিতেই যেনো কুমু কেপে উঠলো। এতক্ষণ তো শুধু অসস্তি হচ্ছিলো কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। হাত পা কাপছে। হিমেল বিষয়টা কিছুটা সময় নিয়েই খেয়াল করলো। বুঝে যেতেই ভীষন বিরক্ত হলো। কুমুর দিকে মুখ ঘুরিয়ে গম্ভীর গলায় বলল
— মেয়েরা কি সবাই এরকম নাকি তুমিই আলাদা? এমন আচরণ করছো যেনো মনে হচ্ছে আমি তোমার সুযোগ নিচ্ছি। তুমি কিন্তু আমাকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলছো কুমু। একটু স্থির হও। বিষয়টা আমার জন্য সত্যিই অন্যরকম।

হিমেল এর কথা কুমু বুঝতে পারলেও নিজেকে কিছুতেই স্থির করতে পারলো না। অনেকটা সময় নিয়েও সম্ভব হলো না। বৃষ্টির ছাঁট বাতাসের তোড়ে গায়ে এসে পড়তেই আরেকদফা কেপে উঠলো কুমু। এবার হিমেল বিরক্তির চরম সীমায় পৌঁছে গেলো। এতক্ষণ কুমুকে নিজের মতো সহজ করার চেষ্টা করেও লাভ হলো না। কুমুর আচরনে এখন তার নিজেরই অসস্তি হচ্ছে। এতক্ষণের রিক্সা ভ্রমণটা কেমন বিরক্তিকর হয়ে উঠলো। হিমেল বিরক্ত হয়ে বলল
— তুমি কোথায় যাবে?

কুমু চমকে উঠলো। হিমেল এর এবার রাগ হলো খুব। চোখ বন্ধ করে নিজের রাগটা দমন করার চেষ্টা করলো। কুমু মিনমিনে কণ্ঠে উত্তর দিলো
— ঐতো সামনের গলিতে।

হিমেল দাতে দাঁত চেপে বলল
— আমি নেমে যাচ্ছি। তুমি যাও।

কুমু অবাক হলো। এতক্ষণের সমস্ত অসস্তি ভাবটা কেটে গেলো নিমেষেই। বৃষ্টির বেগ বেড়েছে। এই অবস্থায় মানুষটা নেমে কোথায় যাবে? বাড়ি থেকেও অনেকটা দূরে চলে এসেছে। এখানে রিক্সা পাওয়া এখন অসম্ভব। হিমেল কাগজটা ভাঁজ করে নিতেই কুমু বলল
— আপনি এখানে কোথায় নেমে যাবেন? রিক্সা পাবেন না তো। আমাকে সামনের গলিতে নামিয়ে দিয়ে এই রিক্সাতেই যেতে পারেন।

হিমেল উত্তর দিলো না। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি কুমুর দিকে তাক করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নেমে গেলো। কুমু এবার প্রসঙ্গ পাল্টে বলল
— আপনি খামাখা আমার সাথে এলেন। না এলেই এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হতোনা। এখন এই বৃষ্টিতে বাসায় যাবেন কিভাবে?

হিমেল ততক্ষণে ভিজে একাকার হয়ে গেছে। কুমু আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বলল
— আপনি তো ভিজে যাচ্ছেন। উঠে আসুন। ঠান্ডা লেগে যাবে।

হিমেল শক্ত হয়েই দাড়িয়ে থাকলো। কঠিন গলায় বলল
— আমাকে নিয়ে ভাবতে হবেনা। তুমি নিজের কথা ভাবো। নিজেকে ঠিক রাখার চেষ্টা করো। আশেপাশের মানুষের যা হয় হোক। সেটা নিয়ে তোমার ভেবে মাথা ব্যাথা বাড়ানোর কোন দরকার নেই।

এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলেই থেমে গেলো হিমেল। কুমু নিস্পলক তার দিকে তাকিয়ে আছে। হুট করেই মানুষটা এমন রেগে গেলো কেনো? সে তো কোন উল্টা পাল্টা কথা বলে নি। ভালো কথাই বলেছে। তাহলে এভাবে রেগে যাওয়ার কি আছে। হিমেল এর অমন হিম শীতল দৃষ্টি দেখে বলল
— আমি রাগ করার মতো কিছু বলিনি। আপনি খামাখা আমার উপরে রাগ করছেন। আপনার জন্য চিন্তা হচ্ছে বলেই বললাম। আপনার জায়গায় অন্য কেউ হলে বলতাম না।

হিমেল কয়েক সেকেন্ড ওভাবেই তাকিয়ে থাকলো। তারপর খুবই শান্ত গলায় বলল
— আমার জন্য এতো চিন্তা হলে এতো কিছু না ভেবে একটা উপকার করো তাহলেই আমি খুশি হবো।

কুমু সচেতন দৃষ্টিতে তাকাল। কৌতূহলী কণ্ঠে বললো
— কি উপকার?

হিমেল হতাশ শ্বাস ছাড়লো। ক্লান্ত কণ্ঠে বলল
— নিজেকে একটু সময় দাও। মনের কথাটা চেপে না রেখে খোলাসা করে বলতে শেখো। আমার জন্য খুব উপকার হয়। এভাবে আর সম্ভব হচ্ছে না কুমু। আমি ভেতরে ভেতরে জ্বলে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাচ্ছি। আর সেটা তোমার চোখেই পড়ছে না। কিভাবে মেনে নেই আমি?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here