ছায়া নীল!
১.
অনেকক্ষণ ধরেই খাতায় কাটাকুটি করছি। কিছু একটাকে পেন্সিলের কালি ব্যবহার করে কাগজে একটা রূপ দেবার চেষ্টা করেই যাচ্ছি সেই সকাল থেকে। হচ্ছে না কেনো?
আমার মেজাজ খারাপ হচ্ছে। যাকে আমি এতোটা চিনি তাকে কেনো কাগজে রূপ দিতে পারছি না?
যে আমার সেই ছোট্ট বেলা থেকে জানি তাকে কেনো কাগজে রূপ দিতে পারছি না।
পেন্সিল টাকে রুমের এক কোণায় ছুড়ে ফেললাম। আর কাগজ টাকে টুকরোটুকরো করে ছিঁড়ে ময়লার ঝুড়িতে ফেললাম।
পেন্সিল টা দুভাগ হয়ে গেছে। বিছানা থেকে নেমে পেন্সিল টার কাছে গেলাম।
দুই টুকরা পেন্সিল দুইহাতে নিয়ে নিলাম। এটা প্রথম বার নয়। এর আগেও অনেক পেন্সিল ভেঙেছি। অনেক কাগজ ছিঁড়ে টুকরোটুকরো করে ফেলেছি।
তবুও তাকে কাগজে রূপ দিতে পারিনি। কেনো পারছি না?
আচ্ছা, সে কি চায়না আমার কাগজে পেন্সিলের দাগে রূপ নিতে???
দরজায় কে যেনো নক করছে।দরজার কাছে গিয়ে বললাম
– কে??
কথাটা বলেই দরজা খুলে দিলাম। মাকে দেখে আমার খুব রাগ হলো।
মন খুব খারাপ থাকলে দরজা আটকে দিয়ে রুমে চুপচাপ বসে বা শুয়ে থাকি।
কিন্তু মার জন্য আর সেটা হলো না।
দরজা খুলে দিয়ে বিছানায় এসে আসন গেড়ে বসলাম।
মা বললেন
– ১২ টা বাজে। ছেলেপক্ষ চলে আসবে ৩ টার মধ্যে। তুই এখনো বসেই আছিস?
কথা বলার কোনো ইচ্ছা নেই আমার। তাই চুপ রইলাম।
মা আমার ড্রেসিং টেবিলের উপর হলুদ বাটা, লাক্স সোপ আর নতুন গামছা রেখে দিয়ে বলল
– শোনো মেয়ে, এইবার আর কোনো অজুহাত শুনবো না। তোমাকে এইবার বিয়ে করতেই হবে।
আমার জেদ চাপলো। চাপাস্বরে বললাম
– নাহ, বিয়ে আমি করবো না।
মা আমার গালে ঠাস করে চড় মেরে বলল
– গলা বেড়েছে তাই না? এইজন্যই তোমার বাবাকে বলেছিলাম মেয়েদের বেশি পড়াতে নেই। না, সে কেনো শুনবে?
– মেয়েদের পড়াতে হয়। আমি আরো পড়বো।
– আমি আধা ঘণ্টা পর এসে যেনো দেখি তোমার গোসল শেষ হয়েছে। তা না হলে লাত্থি দিয়ে বাসা থেকে বের করে দিবো।
মা রাগে গজগজ করে চলে গেলেন। আমার খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে। বাবাও নেই, বাবাকে মা আমার থেকে দূরে রেখেছেন। যাতে সে আমার বিয়ে ভাঙতে না পারেন।
আমার রুমটা ড্রয়িংরুম এর সাথে লাগানো। বাসায় অনেক মেহমান এসেছে। সবাই আমার আশেপাশে থাকতে চাচ্ছে। কিন্তু আমার তো ভালো লাগেনা এতো মানুষ জন। দরজা খোলাতে মেহমান দের কথাবার্তা কানে আসছে। কেউ কেউ বলছে
– মেয়ের কপাল দেখো? কতো বড় জায়গা থেকে সম্বন্ধ এসেছে?
আমার নানী তাতে তাল মিলিয়ে বলছে
– নাত্নী আমার সুন্দরী বলেই তো এসেছে।
সুন্দরী হওয়াটাই পাপ আমার কাছে। আমি কোনো বড়লোক চাই না। আমি যে তাকেই চাই।
কী করবো বুঝতে পারছি না। আফরোজাকে একটু বলে দেখি।
আফরোজা কে ফোন দিলাম। ফোন রিসিভ হলো। আমি বললাম
– আমি বিয়ে করবো না।
– তোর মা আবার শুরু করেছে?
– হ্যা। আমি অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু নিজেকে ঠিক করতে পারছি না।
– দ্যাখ আর কতোবার বিয়ে ভাঙবি? তুই এবার বিয়েটা করে ফ্যাল।
– আমি পারবো না।
– দ্যাখ, তুই যার আশায় আছিস সেটা কেবলি একটা ভ্রম।
– সে ভ্রম না, সে ছায়া নীল।
ও কিছু বলার আগেই ফোন কেটে দিলাম। বাধ্য হয়ে গোসল করলাম হলুদ বাটা আর লাক্স সোপ দিয়ে।
আমি তো এমনিতেই ফর্শা, আমার তো হলুদ বাটা লাগে না। তারপর ও মার আমাকে হলুদ মাখাতেই হবে।
আচ্ছা ছায়া নীল তুমি কী দেখছে পারছো? আমার আজ বিয়ে?
গোসল করে বের হবার সাথে সাথেই মা এলেন আমাকে সাজাতে।
সাথে আমার বড় খালা আর ছোটো ফুপু। আমার আরো একজন ফুপু আছে। তবে সে অনেক আগেই মারা গেছেন।
আমি নাকি তার মতো দেখতে, বাবা বলেন।
সাজানোর সময় বিড়বিড় করে বলছি। দেখো না ছায়া নীল আমাকে সাজাচ্ছে।
তুমি কী আসবে না??
আমার রুমেই আমি বসে আছি। হঠাৎ সবার চ্যাঁচামেচি বেড়ে গেলো। বাসার বাচ্চারা বলতে লাগলো – বর এসেছে, বর এসেছে।
বুঝতে পারলাম,
ছেলে পক্ষ চলে এসেছে। তাদের কথাবার্তা সবই আগে থেকেই হয়ে আছে। আজকে শুধু কাবিন করাবে। পারলে আমাকে একেবারে উঠিয়ে নিয়ে যাবে। কথা গুলো আমার জানা ছিলো না। সবার কথাবার্তায় বুঝতে পেরেছি।
বড় খালা আমার রুমে এলেন। সবাই আজ খুব সেজেছে। পুরো বাড়িটাকে সাজানো হয়েছে। বড় খালা বললেন
– কোনো ঝামেলা যেন না হয়। বুঝতে পারছিস?
আমি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালাম।
বড় খালা চলে গেলেন আর আমাকে ছোটো ছোফার উপর বসিয়ে দিয়ে গেলেন।
আমাকে মা বলেছিলো – শুধু দেখতে আসবে।
তবে আমি জানি মা মিথ্যে বলেছে, যাতে আমি খারাপ কিছু না করে বসি।
ছেলে আমার সাথে নাকি কথা বলবে। ছেলের ছবি আমাকে মা দিয়েছিলো। আমি দেখিনি, ছিঁড়ে ফেলেছি।
আমি চেহারা দেখতে চাই না, দেখতে চাই তার ছায়া।
কানে কারো পায়ের শব্দ আসছে। মনে হয় সেই ছেলে আসছে। ধীরেধীরে শব্দটা আমার রুমের দিকে আসছে।
তারপর শব্দটা আর নেই। এর অর্থ, আমার রুমের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তারপর
ছেলে আমার সামনের ছোফায় এসে বসলো। আমি তাকাবো না, আমি তো দেখবো তার ছায়াকে।না তাকিয়েও বোঝা যাচ্ছে, ছেলে বেশ লম্বা আর অনেক ফর্শা।
আর আমিও তো কম ফর্শা না। আয়নায় যখন নিজেকে দেখি নিজেরই চোখ সরে না।
আচ্ছা নীল, তোমারও কি চোখ সরে না আমাকে যখন দেখো?
একটু পরই আমার বিয়ে, তুমি আমাকে নিতে আসবে না?
ছেলে বলল
– আমার নাম তুহিন। আপনার নাম?
– শারলিন।
– আপনি খুব সুন্দর। বিশেষ করে আপনার চোখ।
হ্যা হ্যা, আমার চোখ খুব সুন্দর। কিন্তু সে তো জানে না? জানে?
আমার কোনো উত্তর না পেয়ে তুহিন বলল
– আমি পেশায় একজন ব্যবসায়ী। অনেক নাম ডাক আমার।
– হুম। আমি ইন্টার পাশ। মেয়েদের বেশি পড়তে নেই।
– আপনার মতো সুন্দরীদের তো ঘরে আটকে রাখাটাই ভালো।
– হ্যা, পায়ে শিকল দিয়ে।
– শুনো একটু পরেই কাবিন হবে এবং তার পর পরই তোমাকে নিয়ে যাবো। আর আমার সাথে কোনো ত্যাড়া কথা চলবে না।
– এতো তাড়াতাড়ি তুমিতে নামলেন?
– আচ্ছা, আমি যাই।
বলেই তুহিন লোকটা চলে গেলো। এখনো এই দুনিয়াতে বিয়ের জন্য মেয়েদের অনুমতি নেয়া হয়না।
দেখো না কীভাবে আমাকে জোড় করে বিয়ে দেয়া হচ্ছে, নীল?
নীল তুমি আমাকে বুঝতে পারছো না?
তুমি কি শুধুই ভ্রম হয়েই রবে? নাকি………..
চলবে……..!
© Maria Kabir