ছায়া নীল!
১২.
সৌরভ গ্লাসের পানিটুকু এক চুমুকে শেষ করে টেবিলের উপর গ্লাস রেখে বলল
– উমম তোমার কী মনে হয়??
– আমি তোমাকে প্রশ্ন করেছি। তার উত্তর দাও।
গ্লাসটাকে হাত দিয়ে নড়াচড়া করছে, তারপর কিছুক্ষণ ভাবলো। কী ভাবছে জানি না। আমি বললাম
– কী উত্তর দিবে?
– তুমি আমার ২য় নাম্বার প্রেমিকা!
– আমার পরেও তো অনেক আছে তাই না?
– হ্যা আছে।
– তোমার প্রথম প্রেমিকার নামটা শুনি? আর ব্রেকাপ এর কারণ?
– নাম? আচ্ছা তুমি পুরোনো কথা উঠাচ্ছো কেনো?
– উত্তর চাই আমি বুঝেছো?
– ওর নাম বৃষ্টি ! ব্রেকাপ এর কারণ, “আমাকে তার আর ভালো লাগেনা। এক জিনিষ আর কতদিন?? আমার সাথে নাকি তার কোনো মিলই নেই! আমার প্রতি তার আর কোনো ফিলিংস নেই! ”
– শুধু ওর দোষ দিচ্ছো কেনো? তোমার দোষ নেই বুঝি?
– নাহ ছিলোনা, কারণ ও আমার প্রথম ভালবাসা। আমার জীবনে যখন ভালবাসা নামক অনুভূতি টা ওর হাত ধরেই এসেছে। ওকে আমি যতোটা ভালবেসেছি, ততোটা তোমাকে অনন্তকাল ভরেও বাসতে পারবো না।
– আমার পরে কারা আছে শুনি না তাদের নাম?
– এতো নাম মনে নাই। ফোনে নাম্বার সেভ করা আছে পরে দেখে নিও।
– আমার এখানে কেনো এসেছো?
সৌরভ মনে হলো অবাক হয়েছে আমার প্রশ্নে!
– আমার মামা বাড়ি তাই এসেছি।
– এতদিন কেনো আসনি? হঠাৎ আমার বিয়ের দিনই হাজির??
অনেকক্ষণ চলে যাবার পরও এই প্রশ্নের উত্তর পেলাম না। ও গ্লাস টাকে নিয়েই ব্যস্ত আছে। আমার সাথে তাহলে এত নাটক করার কী দরকার ছিলো? আমাকে যদি ভাল নাই বাসতে পারলো তাহলে আমার এখানে কেনো এসেছে?
আমি দ্রুত চেয়ার ছেড়ে উঠতে গিয়ে টেবিলের সাথে কাটা হাতে ব্যথা পেলাম। কী যে অসহ্যকর ব্যথা। সৌরভ সাথে সাথে উঠে আমার হাত ধরে বলল
– একটু সাবধানে থাকলেই পারো।
আমি ওর হাত ছাড়িয়ে দিয়ে বললাম
– যথেষ্ট হয়েছে নাটক আর ভাঁওতাবাজি। আমার সাথে অনেক মজা করা হয়েছে তোমার। এখন আর নাটক করতে হবে না।
– সত্যিটাই তো বললাম। আর যাকে আমি ভালবাসি তার কথা শুনতে চেয়েছো তাই বলেছি।
– খুব সহজ না তোমার কাছে এসব তাই না?
– আরে আমি তো জাস্ট মজা করেছি স্বপ্নে, আর তুমি সেটাই সিরিয়াসলি নিয়ে এতো মহাকান্ড করে বসলে।
– তোমার কাছে মজা ছিলো, আমার কাছে না।
– দেখোই না বৃষ্টি আমাকে ছ্যাকা দিয়েছে বড়লোক এক ছেলের জন্য। আমি তো তার বাস্তব জগতের ছিলাম তাও চলে গেলো।
তাই আমি ভাবলাম তুমিও তাই করবে।
– বের হও বাসা থেকে এখনি।
– আহারে সত্য কথা সহ্য হচ্ছে না। আমার আরো অনেক মেয়ের সাথে সম্পর্ক আছে। তবে তোমার ঝামেলার জন্য তাদের সময় দিতে পারছি না।
– তুমি গতকাল বললা, আমাকে ভালবাসো। আবার আজকেই এই কথা বলছো?
– আরে ওটা সান্ত্বনা ছিলো। তা না হলে পরের মেয়ে মইরা গেলে একটা বিশ্রী ব্যাপার।
– আমার তোমার সান্ত্বনা লাগবে না। ধ্বংস তো করেই ফেলছো আমাকে, এখন কীসের জন্য ওয়েট করছো?
– আসলে আমি নিজেও জানি না কী কারণে আমি এখনো তোমার আশেপাশে? আমি চাচ্ছি চলে যেতে বাট পারছি না। কিছু একটা তোমার দিকে আমাকে টানে। আগে তো একটা নেশার মতো ছিলা।
– নেশা কেটে গেলে আমিও কেটে যাবো।
– দারুণ একটা কথা বলেছো। নেশা না কাটা পর্যন্ত আমি যাচ্ছি না।
আমি রান্নাঘরে গিয়ে তরকারি কাটার চাকু এনে ওর হাতে দিয়ে বললাম
– তোমার তো যাওয়ার ইচ্ছা নেশা কবে কাটবে তার ঠিক নেই তার আগেই আমার গলায় খুব জোড়ে একটা পোচ দাও। ব্যাস, সমস্যা সমাধান।
চাকুটা সৌরভ হাতে নিয়ে বলল
– ভালো ধার আছে। তুমি নিজেই তো সাহসী এসব ব্যাপারে। আমাকে শুধুশুধু এসব উটকো ঝামেলায় জড়াচ্ছো কেনো?
– আরে এদেশে আসল খুনি কে পুলিশ ধরতে পারেনা। আর তুমি তো ভালো মানুষ না যে ধরা খাবে।
ও চাকুটা আমার গলায় ধরে বলল
– আমি কিন্তু তোমাকে সত্যি মেরে ফেলতে পারি।
– জানি তো।
– না পারবো না। নেশা কাটুক তারপর জাহান্নাম এ যাও আমার দেখার বিষয় না।
– এখনি বাসা থেকে বের হও।
– যেতে ইচ্ছে করছে না। তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে।
– সৌরভ প্লিজ আমাকে সত্যিটা বলো। আমার না মাথা ফেটে যাচ্ছে। খুব কষ্ট হচ্ছে, খুব।তুমি কি পাগল? একেক সময় একেকটা কথা বলো?
– আরে আমি তো বললামই।
– সৌরভ আমি না তোমাকে খুব ভালবাসি।
হাতের আংগুল গুলো দেখিয়ে বললাম
– দেখোই না তোমাকে কাছে পাবার জন্য আংগুলে আলপিন ফুটিয়েছি। জানো তোমার জন্য আমি অনেক কষ্ট করেছি।
– আমিও করেছিলাম লাভ হয়নি।
– সৌরভ আমি তোমার ভালবাসা না প্রয়োজন? প্লিজ একটা উত্তর চাই আমি। তারপর আমি আর তোমাকে আমার কাছে আসতে বলবো না।
– কোনোটাই না। তুমি আমার স্বভাব।রোজ তিনবেলা তোমার সেই ছবিটা না দেখলে ভালো লাগেনা। দেখতেই হবে। এটাই স্বভাব। তোমাকে স্বপ্নে আনতে হবে এটা আমার স্বভাব।
– আচ্ছা স্বভাবে কি ভালবাসা থাকে না?
– থাকতেও পারে।তোমার সাথে আর কয়দিন এভাবে দেখা সাক্ষাৎ হতে থাকলে সত্যি আমি আবার প্রেমে পড়বো। তবে এবারকার প্রেম হবে ভয়াবহ।
– প্রেম আবার ভয়াবহ হয় নাকি?
– তুমি যা করেছো সেটা কি ভয়াবহ নয়? কোনো স্বাভাবিক মানুষ নিজের দেহকে ক্ষত বিক্ষত করতে পারে না।
– তুমি বলতে চাচ্ছো আমি অস্বাভাবিক?
– হ্যা। যাই হোক বাদ দাও। আমি আপাতত তোমাকে ছেড়ে যাচ্ছি না।
– বাবা আর মা চলে আসবে এখন এখান থেকে ভাগো।
– হ্যা যাচ্ছি। মোবাইল টা নিয়ে আসো।
মোবাইল টা এনে ওর হাতে দিলাম।
সৌরভ হেসে বলল
– একটা মিথ্যা কথা বলেছি তোমাকে।
– কয়টা বলেছো তা কি আমি জানি? একটার বেশিও তো হতে পারে।
– নাহ একটাই বলেছি। সেটা হলো, তোমার পরে আর কোনো মেয়ের সাথে আমি জড়াই নেই।
– বললা কেনো?
– ভাবলাম তোমার প্রতিক্রিয়া টা কেমন একটু দেখা দরকার।
– আর কোনো মিথ্যে কথা বলেছো?
– নাহ। দুপুরে অনেক ঘুমাবা।
– কেনো?
– রাত জাগতে হবে। সারারাত ফোনে কথা বলবো।
– আমার পক্ষে সম্ভব না। আমি অসুস্থ।
– তোমার চোখে আমার জন্যে যা দেখেছি সেটা মিথ্যে না।
– আমি তোমার মতো মিথ্যে বলি না।
– ১ টাই বলেছি তাতেই মিথ্যেবাদী?
– ওই কথায় আমি খুব কষ্ট পেয়েছি।
আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল
– আহারে। Sorry শারলিন আর হবে না।
– আমাকে ছাড়ো। ভালবেসে আমাকে স্পর্শ করবে। যদি না পারো তাহলে স্পর্শ করবে না।
– আচ্ছা আচ্ছা ছেড়ে দিলাম।
এই কথা বলে আমাকে ছেড়ে দিলো। তারপর সৌরভ চলে গেলো।
দরজা আটকে দিয়ে বাবা আর মা আসার অপেক্ষায় রইলাম। দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকাল হচ্ছে বাবার খোজ নেই। এদিকে আমি রান্নাও করতে পারছি না। খুদায় অসহ্য লাগছিলো। এক হলো মনের অশান্তি ২য় হলো শরীরের যন্ত্রণা।
বিকালবেলা কলিংবেল বাজলো। বাবা এসেছে মনে হয়। সাথে মাও এসেছে মনে হয়।
দরজা খুলে দেখি বাবা একা। বাবার চেহারা দেখেই বুঝতে পারলাম ঝামেলা একটা হয়েছে। বাবার হাতে খাবারের প্যাকেট।
দরজা আটকে দিয়ে বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম
– মা আসেনি?
বাবা বললেন
– তুই এই বাড়িতে থাকলে সে আসবে না।
কথাটা শুনে বুঝতে পারলাম, আমি অনেক বড় ভুল করেছি। বাবা আমাকে অনেক ভালবাসেন। আমার সব ভুল, দোষ ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখেন।
কিন্তু মা আমাকে পছন্দ করেন না। বুঝতে শেখার পর থেকেই বুঝেছি।
মা চাইতেন ছেলে হোক। কিন্তু মেয়ে হলো।আমার পরে তার একটা ছেলে হয়েছিল কিন্তু সে জন্মের পরেই মারা যায়। এরপরে মা আর কোনোদিনও সন্তান নিতে পারলেন না। তার নাকি রক্তে আরএইচ প্রব্লেম না কী যেন আছে।
সে আমাকে এমনিতেই পছন্দ করতো না তার উপর আমার চেহারা নাকি মেজো ফুপুর মতো।
আর আমিও কোনোদিন মা পছন্দ করে এমন কাজও করিনি। তাই আমার প্রতি মায়া তার কমেছে দিনদিন, বাড়েনি।
বাবাকে বললাম
– তুমি আমাকে ছোটো ফুপুর বাসায় কয়েকদিনের জন্যে রেখে আসো। মার রাগ ঠাণ্ডা হলে আমি চলে আসবো।
– বলেছিলাম তোর ছোটো ফুপুকে কিন্তু সে রাজি হয়না। বলে, ওরকম পাগল খারাপ মেয়ে আমার বাসায় আনবো না। কোনো দুর্ঘটনা ঘটিয়ে বসলে, দায়ী কে হবে?
– বড় খালা তো মায়ের মতোই। সে তো আমাকে আগাগোড়াই পছন্দ করেন না।
– কী বলবো রে মা, কপাল আমার তোমার মায়ের মতো একজন বউ পাইছিলাম। পুরো জীবন কষ্ট করতে করতেই গেলো আমার। এই পুরো সম্পত্তি তোর মায়ের নামে। চাইলেও তো তাকে তালাক দিতে পারছি না। চাকরী যা করি তাতে তোর আমার চলবেও না।
– বাবা আমাকে কোনো হোস্টেলে পাঠিয়ে দাও।
– তোর মেজো ফুপুর বাসায় পাঠিয়ে দেই কয়েকদিনের জন্য।
– মেজো ফুপু?? উনি রাজি হবে তো?
– দেখি। খাবার টা খেয়ে নে। আমি কথা বলে আসি।
বাবা চলে গেলেন ফোন হাতে নিয়ে।
আমার জীবন টা এমন হয়ে গেলো? নিজের বাড়িতে নিজেই থাকতে পারছি না। সম্পত্তি বাবারই কিন্তু মা তার নিজের নামে লিখিয়ে নিয়েছেন যদি ছেলের আশায় আরেকটা বিয়ে করেন তখন কী হবে?
আমার জীবন টা একটা অদ্ভুত বিন্দুকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। আমি জানিনা, আমার বাবা কবে সুখের দেখা পাবেন!
আমার নিজের সুখ তো নিজেই ধ্বংস করেছি। আমার জন্মটাই অলক্ষুণে।
চলবে…….!
~ Maria Kabir