ছায়া নীল !
২২.
আমি যা দেখছি সেটা সত্য না বাস্তব বুঝতে পারছিনা। দৃষ্টিভ্রম হচ্ছে নাকি? নাকি সত্যি?
মেজো ফুপু এখনো হাসছেন। আগের হাসির সাথে এখনকার হাসির মোটেও মিল খুঁজে পাচ্ছি না। এখনকার হাসিটা ভয়ংকর।
আমার ভেতর থেকে কেউ একজন বলছে
– জানালা আটকে দিয়ে সৌরভের পাশে গিয়ে বোস।
হাত পা কাঁপতে শুরু করলো। সেই অবস্থায় আমি জানালা আটকে দিয়ে সৌরভের পাশে বসলাম। ও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ওর কপালে হাত দিয়ে বুঝলাম জ্বর কমেছে।
রুমের দক্ষিণ পাশে ঘড়িটায় দেখলাম রাত ৩ টা বাজছে। ঘুমাতে ভয় করছে, যদি স্বপ্নের ভেতর আবার সেই ভয় পাই তাহলে এবার আর রক্ষা নাই। সৌরভ অসুস্থ আর ঘুমুচ্ছে। আর মেজো ফুপু আশেপাশে ঘুরছে।
ঘড়ির কাটার দিকে তাকিয়ে সেকেন্ডের কাটার ঘোরা দেখছি।
তাছাড়া কিছু করার মতোন নেই। সেকেন্ডের কাটা তার মতো ঘুরছে। একঘেয়েমি লাগছে না আমার। আমার পাশে শুয়ে থাকা মানুষ টার সাথে আমি কতদিন থাকতে পারবো জানি না। আমার বিরাট কোনো ক্ষতি করেই ফুপু ঠাণ্ডা হবেন। আমাকে মেরেও ফেলতে পারেন। আমাকে মেরে ফেললে তার ছেলের কষ্ট হবে, সেটা কী সে বুঝে না?
নাকি তার সেই ধরনের কোনো অনুভূতি নেই। আর মায়ের মুখে তো কোনোদিনও আমার এই মামার কথা শুনিনি।
মা আমাকে খুব কড়া শাসনে রাখতেন। একা কোথাও যেতে দিতে চাইতেন না। কারণ টা আজ খুঁজে পেলাম। আমার চেহারা মেজো ফুপু মতো বলেই আমাকে স্বাধীনতা দেয়া হয়নি। আমি যাতে মেজো ফুপুর মতো বখে যেতে না পারি তাই আমাকে কড়া শাসনে রেখেছিলেন।
আর ব্ল্যাক ম্যাজিক ফুপুই নীলকে শিখিয়েছে।
সৌরভ নড়ে চড়ে উঠলো। আমি ওর দিকে তাকিয়ে দেখি ওর ঘুম ভেঙে গেছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম
– ঘুম আসছে না?
ও উঠে বসে বলল
– মা আশেপাশে আছে। তোমাকে বের করে নেয়ার চেষ্টা করছে।
– তুমি কীভাবে বুঝলে?? তুমি তো ঘুমিয়ে ছিলে?
– মা আমাকে বলেছে, তোমাকে আজকে রাতেই বের করে নিয়ে চলে যাবেন।
– আর কী কী বলেছে?
– তোমার মা যেমন তাকে বিধবা বানিয়েছে ঠিক তোমাকে তো বিধবা বানাতে পারবে না। তাই দূরে নিয়ে বুঝোই তো। স্বামী থাকতেও তার থেকে দূরে থাকা বিধবা হওয়ার থেকেও কষ্টকর।
– আমি তোমার থেকে দূরে থাকতে পারবো না। অনেক কষ্টের পর তোমাকে পেয়েছি।
– হ্যা এটাই তো কথা। মা আরো খেপেছে, বাবার লাশ পুলিশের হাতে দিয়ে দিয়েছি। আজ এতোটা বছর যাবত একজন মানুষের লাশ পৃথিবীর উপর আছে। এটা কোনোভাবেই ঠিক না।
তাই পুলিশ কে দিয়ে বের করে দাফন দিয়ে এখানে আসলাম।
– ফুপু জানেন? আর পুলিশ কোনো ঝামেলা করেনি?
– নাহ আমার চেনাজানা তো। সেটা আমি ব্যবস্থা করেছি। ফরমালিন থেকে বের করার পর বাবার লাশ দ্রুত পঁচতে শুরু করেছে।
কেউই গোসল করাতে চায়না। শেষ পর্যন্ত আমি আর রাসেল মিলে নাকে কাপড় বেধে কোনোরকম গোসল করিয়েছি।
তারপর কাফনের কাপড় পড়ানোর কিছুক্ষণ পর থেকে পেট ফেটে গেলো।
কবর দিতে অনেক ঝামেলা হয়েছে।
– তোমার খুব খারাপ লাগছে তাই না?
– নাহ। চোখের সামনে অনেক কিছু দেখেছি তাই এখন আর খারাপ লাগেনা। একবার তো মা আমাকে জোড় করে শ্মশানঘাটে নিয়ে গেলো।তখন আমি মাত্র ১০ বছরের।
– তারপর?
– আর কী? সারারাত ওখানে কাটিয়ে দিলাম।সাহস তো আর সহজে হয়নি।
– তুমি তার সাথে কেনো থাকলা?
– ভেবেছিলাম মাকে ঠিক করতে পারবো কিন্তু পারিনি। তোমার যেন কোনো ক্ষতি না করেন, তাই তোমাকে বিয়ে করলাম। ভাবলাম নিজের ছেলের বউ হলে হয়তোবা কিছু করবেনা। না এবারো আমি ভুল।
– এগুলা বাদ দাও। কিছু খাবা?
– হ্যা খুদা লেগেছে কিন্তু খেতে ইচ্ছে করছেনা।
– বড় ফুপু তোমার জন্য বিরিয়ানি রান্না করেছেন। আনি?
– হ্যা আনতে পারো। তুমি তো খাওনি আবার খালাও খায়নি।
– হ্যা।
– বড় ফুপুকে ডেকে আনো। আমরা একসাথে খাই। আর বাড়ির বাইরে যাবা না।
শেষ রাতে আমরা খাবার খেতে বসলাম। ও তৃপ্তির সাথে খাচ্ছে। বিরিয়ানি অসম্ভব স্বাদের হয়েছে।
বড় ফুপু আর ও সমস্যা সমাধানের জন্য আলোচনা করছে। কোনোভাবেই তারা ভালো কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছেনা।
আমিও খুঁজে পাচ্ছিনা। মেজো ফুপু হচ্ছে এমন একজন মানুষ যে,নিজের ভুল, দোষত্রুটি গুলোর দিকে না তাকিয়ে অন্যের ভুল, দোষত্রুটি খুঁজে বেড়ায়। ওনার নিজের ভুলের কারণে বিধবা হয়েছেন আর দোষ চাপাচ্ছেন আমার মায়ের উপর।
আর আমার উপরে সেই জ্বালা মেটাচ্ছেন। শেষ পর্যন্ত বড় ফুপু আর সৌরভ মিলে ঠিক করলো দেশের বাইরে কয়েকমাসের জন্য চলে যাওয়ার।
এই ফাঁকে যদি ফুপু শুধরে নেন নিজেকে।
কিন্তু পাসপোর্ট, ভিসা করতে সময় লাগবে।
সকালে উঠে সৌরভ বেড়িয়ে পরলো। আর আমাকে কড়া নিষেধ করে গেলেন
– যেন বাসা থেকে এক পাও বের না হই।
সারাদিন বাসায় বড় ফুপুর সাথে ভালোই কাটলো। মানুষ টা এতো রসিক আগে জানা ছিলো না। কিছুক্ষণ পর পর হাসি চেপে বলছে
– কীরে সুখবর কবে দিবি?
প্রথমে প্রশ্নটা আমি বুঝতে পারিনি। অনেকক্ষণ ভাবার পর বুঝতে পেরেছি। বুঝতে পারার সাথে সাথে আমার খুব লজ্জা লাগতে শুরু করেছে। বড় ফুপুর দিকে তাকাতে পারছি না।
সৌরভ আসলো সন্ধ্যায়। ওর মুখে বিষাদের ছায়া খেলা করছে। মাকে যে ও খুব ভালবাসে সেটা বুঝতে পারছি। ও ওর
সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করছে ফুপুকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে কিন্তু পারছেনা।
আচ্ছা ও কী জানে? ঘুমন্ত মানুষকে ডেকে তোলা যায় কিন্তু যে ঘুমের ভান ধরে তাকে ডেকে তোলা যায়না।
বড় ফুপুর সাথে কী নিয়ে কথা বলল বুঝতে পারলাম না। খুব আস্তে আস্তে কথা বলল। হয়তোবা তারা চাচ্ছেনা আমাকে জানাতে।
ও রুমে চলে গেলো। বড় ফুপু আমাকে বলল
– আরে রুমে যা, ব্যাটাছেলে বাড়ি ফিরলে তাদের সাথে সাথে থাকতে হয়।
কথাটা শুনে আমি কিছুক্ষণ অবাক চোখে তাকিয়ে রইলাম।
আমাকে ঠেলে ঠুলে রুমে পাঠালো।
আমাকে দেখে ও বলল
– আচ্ছা শারলিন, আমাকে নীল বলে ডাকতে পারবে?
– হ্যা।
ও হঠাৎ এই কথা কেনো বলছে??
– তুমি দূরে কেনো? পাশে বসো। আর খাওয়া দাওয়া করছো?
– হ্যা, দুপুরবেলা খেয়েছি। তুমি খাও নি?
– নাহ, সারাক্ষণ মনে হচ্ছিলো তোমাকে হারিয়ে ফেলবো।
আমি বিছানার উপর ওর পাশে গিয়ে বসলাম।
ও আমাকে কাছে টেনে নিলো। চুলগুলোতে বিলি কাটতে কাটতে বলল
– তুমি গুছিয়ে থাকতে পারো না? নাকি সারাক্ষণ আমার চিন্তায় থাকো। কখন আমি আসবো। তাই না?
আমি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালাম।
ও যে কতোটা অস্থির হয়ে আছে সেটা নিশ্বাসের উঠানামায় বুঝতে পারছি।
আমি বললাম
– নীল বললে হ্যাপি হবা?
ও বলল
– হ্যা হবো। আর তুমি আমার ছায়া, দুজনের নাম মিলে কী হয় জানো তো?
– হ্যা জানি।
– বলো তাহলে।
– ছায়া নীল।
ও বিড়বিড় করে ছায়া নীল শব্দটা উচ্চারণ করছে।
জানি না, ও পাগল হয়ে গেলো নাকি? পাগলরা নাকি একই কথা বারবার বলে।
হঠাৎ মনে হলো কেউ আমাকে ডাকছে। কেউ আমাকে জানালার দিকে টানছে। এদিকে ও আমার হাত খুব শক্ত করে ধরে আছে।
আমি উঠে যেতে চাচ্ছি কিন্তু ও দিচ্ছেনা।
কোনোভাবেই উঠতে পারলাম না।
ও বলল
– খবরদার এখান থেকে নড়বা না।
একসময় ও জানালার কাছে গিয়ে জানালা খুলে দাঁড়ালো। তারপর কী যেন খুঁজতে শুরু করলো।
তারপর একটু জোড়ে বলল
– মা তুমি কোথায় ? মা শুনতে পাচ্ছো?
কী চাও বলোতো??
কিছুক্ষণ পর ও আমাকে টেনে নিয়ে বাড়ির বাইরে নিয়ে গেলো।
জানালার নিচটাতে ও আর আমি এসে দাঁড়ালাম। ও ওর মাকে উদ্দেশ্য করে বলল
– মা, তোমার ওকে লাগবে তো? নাও নিয়ে এসেছি। এখন তো সামনে আসো।
মেজো ফুপু গাছের আড়াল থেকে বের হয়ে আমাদের থেকে দূরে দাঁড়ালেন।
চোখেমুখে হাসি খেলা করছে। মেজো ফুপু নীলকে উদ্দেশ্য করে বলল
– সত্যি দিয়ে দিবি?
নীল বলল
– হ্যা, তবে শর্তটা মনে আছে তো?
মেজো ফুপু হাসতে হাসতে বললেন
– হ্যা অবশ্যই। তুই কথা রেখেছিস আমিও রাখবো।
চলবে……….!
~ Maria Kabir