ভাড়াটিয়া-১০
ছোটো ছোটো বাতি দিয়ে সারা বাড়ি সাজান হয়েছে। বাড়িটা দেখলেই মনে হয় বিয়েবাড়ি। কেমন একটা সাজ সাজ ভাব বাড়ি জুড়ে। এক মাত্র ছেলের বিয়েতে হাত খুলে খরচ করছেন শাহিন সাহেব।
শাহিন সাহেবের কিছু আত্মীয় স্বজন এসেছেন গ্রাম থেকে। ওদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে বাড়ির ছাদে।
বিয়েটা একটা কমিউনিটি সেন্টারে হবে। সব কিছু আয়োজন করা হয়েছে। ইলিয়াস সাহেব সব কিছু ব্যবস্থা করছেন।
বাড়ির সামনে ছোটো একটা জায়গা আছে। এখানে গায়ে হলুদের আয়োজন করা হয়েছে। গায়ে হলুদ অনুষ্ঠান মূলত কনে বাড়িতে হয়। ছেলেপক্ষ আসে। আবার দুই বাড়িতেই আয়োজন করা হয়।
এখানে কনে বাড়ি আর বরের বাড়ি একটা হওয়ায় এক সাথে আয়োজন করা হয়েছে।
সুইটি কে আজ বেশ সুন্দর লাগছে! হলুদ রংয়ের একটা শাড়ি পরে বসে আছে স্টেজে। হলুদ টুলুদ দেয়া শুরু করে ভাবিরা। বর-কনে কারো কোনো ভাবি টাবি নাই! ভাড়াটিয়ারাই হলুদ দেয়া শুরু করল। গান বাজছে মেয়েরা একে একে কনের গায়ে হলুদ মাখছে।
আনোয়ারা বেগম এবং রাশিদা বেগম দুইজন আজ একসাথেই আছেন। হলুদের জন্য আসা মেহমানদের খাবার আয়োজন করছেন।
শাহিন সাহেব বসে আছেন বারান্দায়। এখান থেকে নিচের হলুদের আয়োজন দেখা যাচ্ছে। ওনার খুব ভালো লাগছে! উনি ভাবছেন ছেলেটা কেমন করে বড়ো হয়ে গেল। আজ ছেলের বিয়ে হচ্ছে।
ফাতেমা হলুদ দিয়ে ওপরে চলে এসেছে। আনোয়ারা এক বাটিতে করে খাবার দিয়ে বললেন, “তোর বাবা কে দিয়ে আয়ত মা।”
“বাবা কোথায় মা?”
“দেখ বারান্দায় বসে আছে।”
ফাতেমা খাবারের বাটি নিয়ে বারান্দায় গেল। শাহিন সাহেব নিচে তাকিয়ে আছেন।
ফাতেমা পাশে দাঁড়িয়ে ডাকল, “বাবা।”
শাহিন সাহেব ফাতেমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন, “কি রে মা?”
ফাতেমা বাবার দিকে বাটিটা এগিয়ে দিলো। “বাবা নাও।”
“কী এনেছিস রে মা?”
“পিঠা।”
শাহিন সাহেব বাটিটা হাতে নিলেন। একটা পিঠা হাতে তুলে নিয়ে আলত করে কামড় দিয়ে বললেন, “তোর মামা কই রে মা?”
“মামা বাইরে গেছে। ”
“এ সময় বাইরে কেন!”
“মামা বাজি আনতে গেছে। আজ রাতে বাজি ফোটান হবে বাবা। ঝর্ণার মতো বাজি আছে সেগুলো।”
শাহিন সাহেব একটু হাসলেন। ওনার খুব ভালো লাগছে! ইলিয়াস বিয়ের আয়োজনটা ভালোই করছে। বিয়ের বাজার সদাই সব ওই করেছে। একমাত্র ভাগনের বিয়ে বলে কথা। করুক ইলিয়াসের যা ইচ্ছে।
হলুদের অনুষ্ঠানে আসলাম কে দেখা যাচ্ছে না। উনি এখন আছেন অন্য একটা জায়গায়। জিনিসপত্র মোটামুটি সরান হয়ে গেছে। আয় এখানে কম হয়নি। চল্লিশ ভরির মতো স্বর্ন পাওয়া গেছে। বিয়ের বাজার সদাই খারাপ না। সব দামি দামি জিনিসপত্র। নগদ টাকাও ভালো পাওয়া গেছে। ত্রিশ লাখের মতো হবে। সব টাকা এখনো গননা করা হয়নি। এ বাড়িতে কিছুদিন অবস্থান করতে হবে। আসলাম আর ফিরবেন না। রাতটা কাটিয়ে সকালে সুইটি আর রাশিদা চলে আসবে পার্লারের নাম করে।
কিছুদিন ঢাকার বাইরে কোথায় লুকিয়ে থাকতে হবে। সুইটি মেয়েটা বোধহয় ঢাকার বাইরে যেতে পারবে না। ওর ঢাকায় থাকাটা জরুরি।
অনেক রাত অবধি বাজি -টাজি ফুটান হলো। ইলিয়াস সাহেব গুটিকয়েক ছেলে-মেয়ে নিয়ে ছাদে বাজি ফুটালেন। ঝর্না বোমগুলো দারুণ! আগুন ধরিয়ে দিলে ফুস করে অনেক উপরে উঠে যায়। তারপর বিকট শব্দ করে ফেটে যায়। ঝর্নার মতো আলোর ফুলকি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
সবার পরে ঘুমাতে গেল ফাতেমা। ওর মনটা ভালো নেই! রাতে সুইটির মাকে বাসায় দেখেছে। মনে হয় উনি কিছু একটা নিয়ে গেছেন! এ কথা কাউকে বলাটা ঠিক হবে না। আগামীকাল ওনার মেয়ের সাথে রায়হান ভাইয়ার বিয়ে। এ সময় মহিলার বিরুদ্ধে কিছু বললে কেউ বিশ্বাস করবে না! আবার ফাতেমা শতভাগ নিশ্চিত নয়। দেখার মাঝে ভুল হতে পারে।
সকালে প্রথম ঘুম ভাঙলো ফাতেমার। বাড়িতে অনেক মেহমান। সবাই এখন ঘুমাচ্ছে। গভীর রাত পর্যন্ত গায়ে হুলুদের অনুষ্ঠান চলেছে। এমনি তে সকালে ফাতেমা নাস্তা-টাস্তা বানায়। বাসার সবার জন্য চা করে। এখন বাসা ভর্তি মেহমান থাকায় ভিন্ন ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ফাতেমা বাসা থেকে বের হয়ে ছাদে গেল। ছাদের এক পাশে অস্থায়ী থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখানে দেশ থেকে আসা মেহমানরা ঘুমাচ্ছেন। ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে ফাতেমা। এখন কয়টা বাজে কে জানে? সূর্য এখনো উঠেনি। অনেকটা সময় ছাদে কাটিয়ে বাসায় ফিরল ফাতেমা।
বাসায় এসে দেখল আনোয়ারার ঘুম ভেঙেছে। ফাতেমা কে দেখে বললেন,” কখন উঠেছিস?”
“ঘন্টাখানেক আগে মা।”
আনোয়ারা বেগম চুলায় পানি বসালেন চা করার জন্য। সকালের নাস্তা বাবুর্চিরা রান্না করবে। বাড়ির সামনে রান্নার ব্যবস্থা করা হয়েছে। খিচুড়ি রান্না হবে মনে হয়। গরুর মাংস দিয়ে খিচুড়ি খেতে ভালোই লাগে! এ সব বিয়ে বাড়ির কেন জানি খুব স্বাদ হয়।
ইলিয়াস ঘুম থেকে উঠে ঝিম মেরে বসে আছে। তার মেজাজ প্রচন্ড রকমের গরম। কী করবে ঠিক বুঝতে পারছে না! মেজাজ গরম হওয়ার কারণ তার ব্যাগ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যাগের মধ্যে তার পাসপোর্ট, ডলার আর প্রয়োজনীয় সবকিছু ছিলো। আজ ভাগনের বিয়ে। এ সময় ব্যাগ চুরি গেছে! এ সংবাদ তিনি দিবেন কী করে! ফাতেমা ইলিয়াসের ঘরে উঁকি দিয়ে দেখল মামা ঝিম মেরে বসে আছেন।
ফাতেমা ঘরে ঢুকে বলল, “কী হয়েছে মামা?”
ইলিয়াস ফাতেমার দিকে তাকিয়ে শুকনো হাসি দিলেন। ফাতেমা কে ব্যাপারটা বলা যায়। মেয়েটার জ্ঞান বুদ্ধি ভালো। পরিস্থিতি বুঝতে পারে।
“কিছু হয়নি রে মা। তোর কী খবর ভালো?”
ফাতেমা হালকা একটু হাসি দিয়ে বলল, “ভালো মামা।”
“আপা উঠেছে রে?”
“হ্যাঁ, তুমি চা খাবা মামা?”
“পরে খাই। তুই এদিকে আয়ত মা।”
ফাতেমা ইলিয়াস সাহেবের পাশে গিয়ে বসল। ফাতেমা বুঝতে পারছে মামা কিছু বলতে চান। কিন্তু বলতে পারছেন না।
“তোমার কী হয়েছে বলো তো মামা?”
ইলিয়াস সাহেব ফাতেমার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,” আর বলিস না মা। আমার ব্যাগটা খুঁজে পাচ্ছি না!”
চলবে–