ভাড়াটিয়া-২০
সকাল থেকে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। ইংরেজিতে যাকে কুকুর বিড়াল বৃষ্টি বলে। মনে হচ্ছে ঢাকা শহর তলিয়ে যাবে পানিতে।
শাহিন সাহেব বসে আছেন বারান্দায়। ওনার পাশে বসা মিলন খন্দকার। দুইজন কে একটু চিন্তিত মনে হচ্ছে। সামনে ছোটো টি-টেবিলে চা দেয়া হয়েছে।
চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে শাহিন সাহেব বললেন, ” চা নাও মিলন।”
মিলন খন্দকার চা তুলে নিয়ে বললেন, “এতো ঝামেলা হয়ে গেল!”
“কীসের আবার ঝামেলা?”
“এখন তোমার বউমারে গ্রেফতার করা লাগব! এটা ঝামেলা না। ভাবি কে দেখে তো মনে হচ্ছে সব ভুলে গেছেন!”
“গ্রেফতার করা লাগব ক্যান!”
“তোমরা না হয় মাফ টাফ করে দিয়েছ। অন্যদের টাকা নিয়েছে সেটা কী হবে শুনি?”
“আমি সবার টাকা ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছি। সাথে ক্ষমা চেয়ে একটা চিঠিও পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।”
“বলো কী!”
‘তুমি অবাক হবা মিলন! সবাই চিঠির উত্তর দিয়েছে, ওরা সবাই মেয়েটাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন! ”
“বাঃ! মানুষ এখনো এত ভালো আছে! তাহলে তো আর কোনো সমস্যা রইল না।”
শাহিন সাহেব কে একটু চিন্তিত মনে হচ্ছে। ” একটু ঝামেলা আছে।”
“আবার কী সমস্যা বলো তো?”
“ইলিয়াস ধরেছে। সে আবার বিয়ের আয়োজন করবে।”
“করলে খারাপ হয় না। তা মেয়ের মার সাথে কথা হয়েছে? ”
“আজ যাব রুবিনার সাথে দেখা করতে। ”
“ওই দুইজন কে তো ছেড়ে দিতে হবে। ওদের বিরুদ্ধে তো কোনো মামলা নেই।”
“অবশ্যই ছেড়ে দিবে। আমি ভাবছি ওনাদের কে দিয়ে একটা নাটক বানাব। অভিনয় তো এরা খারপ করে না!”
হা হা করে হেসে উঠে মিলন খন্দকার বললেন,” তা ঠিক বলেছ!”
শাহিন সাহেব হাসপাতালে এসেছেন। রুবিনার অবস্থা এখন অনেকটা ভালো। সাধারণ বেডে আনা হয়েছে। শাহিন সাহেবের একটু কেমন লাগছে! এতটা বছর পরে রুবিনার মুখোমুখি হতে যাচ্ছেন।
শাহিন সাহেব পায়ে পায়ে রুবিনার বেডের সামনে গেলেন। এখন কেউ নেই। রুবিনা চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন।
শাহিন সাহেব বেডের সামনে কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে রইলেন। রুবিনা অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে! চেহেরায় কেমন বয়সের ছাপ পড়ে গেছে! ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। কী করবেন ঠিক বুঝতে পারছেন না। রুবিনা কে কি ডাকবেন? আর কিছু সময় নীরব কাটল। একটা অস্বস্তি নিয়ে শাহিন সাহেব ডাকলেন,”রুবিনা। ”
চোখবুঁজে শুয়ে থাকে রুবিনা কেঁপে উঠলেন। হুট করে চোখ খুলে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। ধীরে ধীরে ওনার চোখের কোনায় জল জমছে!
অনেকটা সময় পরে ধরা গলায় রুবিনা বললেন, “তুমি!”
শাহিন সাহেব আলগা একটা হাসি দিয়ে বললেন,” কেমন আছ রুবিনা?”
একটা লম্বা শ্বাস ছেড়ে বললেন, “ভালো! তুমি কেমন আছ? ”
শাহিন সাহেবের কন্ঠ কেমন ভারি হয়ে গেছে! “ভালো আছি।”
“তুমি অনেক বুড়ো হয়ে গেছ!”
“হ্যাঁ! বয়স তো কম হলো না রুবিনা! ”
“দাঁড়িয়ে আছ কেন! আমার কাছে এসে বসো একটু।”
শাহিন সাহেব বেডের কাছে এসে রুবিনার মাথার পাশে বসলেন। দুইজনের কেউ কোনো কথা বলছেন না। কতটা সময় নীরব কাটল।
দূর্বল স্বরে রুবিনা প্রথম কথা বললেন, “তুমি আমার ওপরে রেগে আছ শাহিন?”
শাহিন তাকিয়ে আছে রুবিনার দিকে। উনি বেশ অবাক হলেন। রুবিনার প্রতি তার কোনো রাগ নেই! বয়স মানুষ কে অনেক কিছু বুঝতে শিখায়। হালকা একটু হেসে বললেন, ” না তো। হয়ত সে সময় দেখা হলো রাগটা থাকত।”
একটু হাসার চেষ্টা করলেন রুবিনা। “তুমি আমার ঠিকানা খুঁজে পেলে কী করে?”
সুইটি কি রুবিনা কে কিছুই বলেনি? “তোমার মেয়েকে দেখে। দেখতে একাবারে তোমার মতোই হয়েছে! ”
রুবিনা মুখটা ঘুরিয়ে নিলেন। মনে হয় একটু লজ্জা পেলেন! একটা ছোটো শ্বাস ছেড়ে বললেন, ” তুমি সেই মানুষ! মেয়ের কথা শুনে খুব অবাক হয়েছিলাম এমন মানুষ আছ দুনিয়ায়! ”
তারমানে সুইটি সব কিছু বলেছে রুবিনা কে। শাহিন ভাবছেন সুইটি যদি রুবিনার মেয়ে না হয়ে অন্য কারো মেয়ে হতো। তিনি কি পারতেন এমন করে ক্ষমা করতে? হয়ত পারতেন না! তার মনে হলো আনোয়ারার কথা। আনোয়ারা তো জানে না সুইটি কার মেয়ে? ও তো ঠিকই সব কিছু মেনে নিলো! সত্যি আনোয়ারা ভিন্ন এক মানুষ!
“এ সব কথা থাক রুবিনা। তোমার ভাবি চাচ্ছে মেয়েটাকে ঘরে রেখে দিতে। ছেলে আমার খারাপ না। এখন তুমি কি বলো?”
“এ তো আমার মেয়ের সৌভাগ্য শাহিন! আমার মতো ওর কপালটা পুড়া না।”
শাহিন ভাবছে রুবিনা কে কি জিজ্ঞেস করবে? কেন সে সময় অমন করে গায়েব হয়েছিল! থাক কী হবে? সে সব জেনে! সময় তো আর ফিরে আসবে না। রুবিনা যে সুখি হতে পারেনি তা তো দেখাই যাচ্ছে। মিছেমিছি ওকে আর কষ্ট নাইবা দিলো।
“আমি আজ তাহলে উঠি রুবিনা?”
রুবিনা শাহিনের দূর্বল চোখে তাকাল। ভাঙ্গা গলায় বললেন,” চলে যাবা! বসো আর কিছুক্ষন। এত বছর পরে তোমায় দেখে খুব ভালো লাগছে! ”
রায়হান ঘরে বসে আছে। সুইটির ফেরার কথা তাকে জানান হয়েছে। মেয়েটা টাকা পয়সা ফেরত দিয়ে ক্ষমা টমা চেয়েছে। রায়হানের সাথে অবশ্যা এখনো দেখা হয়নি! মেয়েটা ওকে ভালোবাসে কি-না কে জানে?
রায়হানের চা খেতে খুব ইচ্ছে করছে। এ সময় ফাতেমা চা নিয়ে আসে কিন্তু আজ এখনো আসেনি। ফাতেমা কে ডাকলে অবশ্য চা দিয়ে যাবে। ডাকতে ইচ্ছে করছে না! বইটা পড়তে ভালোই লাগছে! বইটা শেষ করে যাওয়া যাবে। ও বই পড়ায় মন দিলো।
একটা ট্রে হাতে সুইটি রায়হানের ঘরে ঢুকল। কেমন জানি একটু লজ্জা লাগছে ওর! আনোয়ারা বেগম ওকে পাঠালেন রায়হানের ঘরে।
ঘরে ঢুকে ট্রেটা বিছানার ওপরে রাখল সুইটি। রায়হান এখনো টের পায়নি। পড়ায় মগ্ন হয়ে আছে। সুইটি চুপ করে বসে আছে। রায়হান কে ডাকতে কেমন অস্বস্তি হচ্ছে।
হঠাৎ রায়হানের চোখ গেলে সামনে বসা সুইটির দিকে। হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল কিছুটা সময়।
বড়োবড়ো চোখ করে বলল, “তুমি এখানে!”
সুইটি কিছু বলল না। অপরাধীর মতো একটু হাসল।
রায়হান একটু কড়া করে বলল, “আবার টাকার দরকার পড়েছে বুঝি?”
সুইটি বিছানার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর চোখ দিয়ে টপটপ করে অশ্রু ঝরছে! দৃশ্যটা দেখে রায়হানের খুব খারাপ লাগল! মেয়েটা কে এভাবে কষ্ট না দিলেই হতো! কাছে এসে বসল রায়হান। সুইটির হাতটা ধরে বলল, “আরে বোকা আমি তো মজা করেছি। ”
একটু অভিমানী কন্ঠে সুইটি বলল, “আমি সব বুঝি!”
রায়হাম সুইটির চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,” সত্যি কি সব বোঝ সুইটি?”
ভেজা চোখে সুইটি রায়হানের দিকে তাকিয়ে রইল। দুইজন কোনো কথা বলছে না। অনেকটা সময় পরে সুইটি বলল, “তোমার চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে! ”
ইলিয়াস বসে আছে নিজের ঘরে। বিয়ের অনুষ্ঠানটা আবার আয়োজন করতে হবে। সবাইকে দাওয়াত টাওয়াত দেয়া হয়ে গেছে। ফাতেমা চা নিয়ে মামার ঘরে ঢুকল।” কী করো মামা?”
“কে ফাতেমা। আয় মা। কিছু করি না রে মা।”
“তোমাকে বেশ চিন্তিত মনে হচ্ছে?”
“না ভাবছি এবার বিয়েটা হবে তো?”
ফাতেমা হালকা হেসে বলল, “হবে মামা।”
“এখন বলতো মা, সুইটি মেয়েটা কে এখন তোর কেমন মনে হচ্ছে? ”
“ভালোই মনে হচ্ছে মামা। আগের লুকোছাপা ভাবটা নেই। সরল মনে হচ্ছে এখন।”
“তুই ঠিক কথাই বলেছিস রে মা।”
সমাপ্ত