ছায়া নীল পর্ব-১৩

0
278

ছায়া নীল!

১৩.

খাবার যা এনেছে তাতে মনে হচ্ছে বাবা না খেয়েই মার ওখান থেকেই এসেছে। দুটো প্লেটে খাবার বেড়ে টেবিলে রাখলাম। খাবার পানিও প্রায় শেষ। বাইরে টিউবওয়েল আছে ওখান থেকে পানি আনতে হবে। পানির জগ হাতে নিয়ে টিউবওয়েল এর কাছে আসার পর দেখলাম বাবা চোখেরজল মুছছে আর কথা বলছেন ফোনে।
বাবা যদি দেখে ফেলে আমি তাকে এই অবস্থায় দেখে ফেলেছি তাহলে অনেক লজ্জা পাবে। তাই না দেখার ভাব করে টিউবওয়েল থেকে পানি নিলাম। এক হাত দিয়ে কাজ করা কতো যে কষ্ট বুঝতে পারছি। এর থেকেও কষ্ট মনে।
টেবিলে বসে বাবার জন্য অপেক্ষা করছি। আমার ফোন বেজে উঠলো। সৌরভ ফোন করেছে।
রুমে গিয়ে ফোন রিসিভ করলাম। আমি বললাম
– কেনো ফোন করেছো?
– আরে ফোন ধরেই ধমক?
– কী কারণে ফোন করেছো?
– শুনলাম আমাদের বাসায় নাকি আসতেছো?
– হুম। তো?
– আমাদের বাসায় তুমি আসবা না। বড় মামাকে বলো যে,তুমি ওই বাড়িতে যাবে না।
– কেনো আসবো না তোমাদের বাসায়?
– সে কৈফিয়ত আমি তোমাকে দিতে বাধ্য নই।
– আমি তোমাদের বাসায় যাবো না যাবো সেটা আমার ব্যাপার।
– মানে তোমার লজ্জা বলতে কিছু নাই? আমার বাসায় আসতে নিষেধ করছি। আর তুমি বেহায়ার মতো আসার জন্য পাগল হয়ে আছো।
– শুনো আমি তো অস্বাভাবিক মানুষ। অস্বাভাবিক মানুষের লজ্জা থাকেনা। লজ্জা থাকলে তোমার মতো নিচু প্রকৃতির মানুষের সাথে কথা বলতাম না।
– nonsense কোথাকার।
আমি বলতে যবো আর ফোন কেটে দিলো সৌরভ।
বাবা আসছেন মনেহয়। বাবা বললেন
– খেয়ে নে মা। তোকে আজকেই পাঠিয়ে দিবো।
– বাবা তুমিও তো খাওনি।
বাবা আর আমি খেয়ে নিলাম। বাবা বললেন
– তোর ব্যাগ গুছিয়ে রাখ আর মেডিসিন নিতে ভুলিস না। সৌরভ এসে নিয়ে যাবে।
– তুমি নিয়ে গেলেই তো হয়।
– আমি চিনি না রে মা।
বাসার জামা কাপড় পড়েই যাবো। আমার এখন আর সাজগোজ এর মন নেই।
ব্যাগ গুছিয়ে মোবাইল হ্যান্ড ব্যাগে রাখলাম। বাবা বলল
– সৌরভ বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।
বাবা ব্যাগ নিয়ে আগে আগে গেলে। বাবা বলল
– দরজা টা ভালোভাবে লক কর। চাবি এই নে।
বাবা বেড়িয়ে গেলেন আমি লক করে চাবি নিয়ে বাবার পিছনে পিছনে ছুটলাম।
বাবা একটা সাদা রঙের গাড়ির কাছে গিয়ে থেমে গেলে।
বাবা কার সাথে যেন কথা বলছে। কাছে গিয়ে দেখি ড্রাইভার সিটে সৌরভ বসা। সৌরভ বলল
– শারলিন তুমি পিছনে বসো।
বাবাকে বলল
– বড় মামা আপনিও বসুন আপনাকেও পৌঁছে দেই।
বাবা বলল
– নাহ বাবা, আমার মেয়েটার একটু খেয়াল রেখো। তোমার মামী একটু শান্ত হলেই ওকে নিয়ে আসবো।
সৌরভ বলল
– বড় মামা সমস্যা নাই। ও যতদিন ইচ্ছা থাকবে।
বাবা বলল
– তাহলে যাও বাবা।
সৌরভ গাড়ি স্টার্ট দিয়ে এতো দ্রুত গাড়ি ছুটালো যে মনে হলো ওর ট্রেন ছুটে যাবে। আমার এতো গতিবেগে শরীর খারাপ লাগছে। সৌরভকে বললাম
– স্লোলি ড্রাইভ করো।
সৌরভ বলল
– আমি এভাবেই ড্রাইভ করি। অভ্যাস করে নাও।
– সৌরভ আমার খারাপ লাগছে।
– কবে তোমার ভাল লাগছিলো?
মনে হচ্ছে গাড়ি একটু স্লো করেছে ও।
– ঝড়ের বেগে কেউ ড্রাইভ করে?
– কেউ বেড়াতে গেলে ফকিন্নির মতো কাপড় পড়ে?
– আমি তো অস্বাভাবিক মানুষ।
– পাইছো এক ডায়লগ। আল্লাহ আমি কোন মুখে এই কথাটা বলছিলাম।
ছায়া নীল!

গাড়ির স্পিড আবার বেড়ে গেলো। সৌরভ কে বললাম
– আরে কমাও না প্লিজ।
– দেখো আমাদের বাড়ি অনেক দূরে। স্লো স্পিডে চালালে অনেক রাত হয়ে যাবে।
– কই থাকো তোমরা?
– একটু শহর থেকে দূরে গ্রামের কাছাকাছি। সিট বেল্ট বেধে নাও।
জানালা দিয়ে রাতের শহর দেখছিলাম। ও দেখতে খারাপ না। তবে স্মার্ট, লম্বা, গায়ের রঙ শ্যামলা। তবে চলাফেরাতে একধরনের আভিজাত্য প্রকাশ পায়। ও দেখতে যেমনি হোক না কেনো, আমি ওকে ভালবাসি। গাড়ি থেমে যাওয়াতে একটু সামনে ঝুকে গেলাম।
আমি বললাম
– চলে এসেছি?
সৌরভ হেসে বলল
– নাহ। যেতে অনেক দেরি।
– তাহলে থামলে যে??
– কী খাবে বলো?
– না কিছুই খাবো না।
– দেখো শারলিন, পরে খুদা লাগলে কিন্তু ভালো কিছু পাবা না। এটাই লাস্ট ভালো খাবারের হোটেল।
– আমি আসার আগেই খেয়েছি।
– যদি খুদা লাগে আর আমার কাছে খাবার চাও তো পুকুরে ফেলে দিয়ে চলে যাবো।
সৌরভ গাড়ি থেকে নেমে গেলো।
কথায় কথায় রাগ দেখানো একটা বদ অভ্যাস। ওর সাথে বাধ্য হয়ে যাওয়া। এর থেকে তুহিন লোকটাকে বিয়ে করলেই হতো। কত শান্তিতে থাকতাম।
হাতে খাবারের প্যাকেট নিয়ে গাড়িতে ঢুকলো। ও বলল
– খবরদার খাবারের দিকে তাকাবা না।
– আমার ওরকম স্বভাব নেই।
গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বলল
– আমার প্রথম প্রেমিকা ছোঁচা ছিলো। বিশ্বাস করবা না শারলিন। ঘুরতে বের হলেই তার খুদা লেগে যেতো। আর আমার পকেট ফাকা হতো।
– হ্যা, তোমার ভালবাসার মানুষের জন্য তুমি সামান্য টাকা ভাঙতেই পারো।
– হ্যা, জীবন দিলেও বা কী? তুমি যেমন টা করেছো।
– অনেক বড় ভুল করেছি। বিয়েটা করে নিলেই হতো। মাও রাগ হয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতো না আর বাবাকে এতো কষ্ট করতে হতো না।
– তোমার মা তো সেরা পাব্লিক।
আমি আর কিছুই বললাম না। আমার মৃত্যুই এখন সবাইকে শান্তি দিবে। মাও বাঁচবেন সৌরভ ও।
প্রায় ১ ঘণ্টা পর আমার মোবাইলের রিংটোন বেজে উঠলো। আফরোজার ফোন। রিসিভ করলাম। আফরোজা বলল
– কিরে কেমন আছিস?
– আছি ভালোই। তুই?
– ভালো। আংকেল বাসায় এসেছিলো।
– কী বলল?
– তোকে তোর মেজো ফুপুর বাসায় পাঠানোর কথা।
– হুম। রাখি, পরে কথা বলবো।
সৌরভ কোকাকোলার মাঝারি বোতল আমার দিকে ছুড়ে দিয়ে বলল
– ক্যাচ।
ক্যাচ ধরতে গিয়ে কাটা হাতের উপর বোতল এসে পরলো।
কাতরে উঠলাম, মুখ দিয়ে ব্যথা পাওয়ার উঁহু শব্দ বের হয়ে আসলো। আর ব্যান্ডেজ লাল হয়ে যাচ্ছিলো। সৌরভ গাড়ি থামিয়ে পিছনে এসে আমার পাশে বসলো। তারপর বলল
– ক্যাচ ও ধরতে পারো না।
– পারি তো কিন্তু হাতে যে ব্যথা।
রক্তে ব্যান্ডেজ ভিজে যাচ্ছে। ও ব্যান্ডেজ খুলে ফেলল। আমার ওড়নার এক পাশ দিয়ে রক্ত মুছে দিয়ে ওর প্যান্টের পকেট থেকে রুমাল বের করে হাত বেধে দিলো।
তারপর বলল
– বাসায় গিয়ে আমি ব্যান্ডেজ করে দিবো। তুমি কীভাবে হাত এভাবে কাটতে পারলে?
হাত ধুয়ে খাবারের প্যাকেট থেকে খাবার বের করে বলল
– মা রান্না করেছে কিনা ঠিক নেই। তাই এখন খেয়ে নাও।
ফাস্টফুড এনেছি। সবজির স্যুপ টা খাও।
কিন্তু বাটি ধরলাম এক হাতে কিন্তু খাবো কোম হাত দিয়ে? ওই হাত তো নাড়াতেই পারছি না।
আমার এই অবস্থা দেখে ও আমার হাত থেকে বাটি নিয়ে বলল
– আমি খাইয়ে দেই। আমার জন্যেই তো নিজেকে শেষ করে দিয়েছো।
১০.৩০ টায় পৌছালাম। এত অন্ধকার আশেপাশে।ও বলল
– আমার পিছনে পিছনে আসো।
গাড়ি থেকে নেমে দেখলাম গাছপালা দিয়েই ভরা।
– শুনো না?
– বলো।
– বাড়ি কই তোমাদের?
– একটু ভিতরে। আগে বাগান তারপর…
– লাইট তো নেই, এতো অন্ধকার।
– মা লাইট জ্বালাতে ভুলে গেছেন।
ওর পিছনে হাটছি, এতো বড় বড় গাছ। ঝিঝিপোকার ডাকে পরিবেশ থমথমে হয়ে গেছে।
একটু পর মনে হলো ও আমার সামনে নেই। কই গেলো?
অন্ধকারের মধ্যে ওর হাতের টর্চের আলোতেই যাচ্ছিলাম। এখন সেই আলোও দেখছি না আর ওকেও দেখছি না।
হাতে মোবাইল এতবার লক বাটন চাপলাম কিন্তু ফোনে আলো জ্বললো না।
খুব ঘামতে শুরু করলাম। আমি এগোতেও পারছি না আমার পিছাতেও পারছিনা। কাটা হাত থেকে মনে হচ্ছে রক্ত পরছে।
আশেপাশে তাকিয়ে অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখতে পারছিনা।
দূর থেকে একটা ছায়া আমার দিকেই আসছে। ছায়া দেখে মনে হলো, ও আসছে।
আমার কাছেই এসে বলল
– তুমি এখানে কেনো?
বাসার ভিতরে ঢুকে পিছন ফিরে দেখি তুমি নেই।
– তুমিই তো আমাকে ছেড়ে চলে গেলে।
– মজা করার সময় এখন না।
– আমি মজা করছিনা। সত্যি আমি তোমার পিছনেই ছিলাম কিন্তু হুট করে তুমি উধাও হয়ে গেলে।
– আমি তো ভূত তাই না?
– হতেও পারো। যা যা করে আসছো এতদিন তাতে তো স্বাভাবিক মানুষ মনে হয়না।
– বাসায় গিয়ে আলোচনা করা যাবে।আমার পিছনে পিছনে আসো।
– তুমি এবারো আমাকে ফেলে চলে যাবা।
আমাকে কোলে তুলে নিয়ে বলল
– এবার উধাও হলে একসাথে হবো।
– একি এই অবস্থায় কেউ দেখলে?
– মা ঘুমাচ্ছে আর কেউই নেই। শারলিন তুমি অনেক হাল্কা।
– হয়েছে হয়েছে আমাকে নামাও।
– চুপ থাকো।
ও হাটছে আমি বললাম
– তোমাদের বাড়িটা না হরোর মুভিতে দেখানো বাড়ির মতোই।
– তুমি এখনো বাড়িটা দেখোনি।
– ঠিক কিন্তু গাছপালা আর বাড়িতে যেতে..
– পাগলী একটা। অতিমাত্রায় হরোর মুভি দেখার ফলাফল।
– আমার মজা লাগে দেখতে।
– আমার কাছে আছে। আজকে দেখা যাবে একসাথে।

চলবে………!

© Maria Kabir

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here