ছায়া নীল !
২৩.
ও আমার হাত ছেড়ে দিয়ে ফুপুর উদ্দেশ্যে বলল
– তুমি কি সত্যি আমার মা?
ফুপু আমাদের দিকে একটু এগিয়ে এসে বলল
– কেনো এই প্রশ্ন করলি?
ও একটু ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল
– একজন মা তার সন্তানের জন্য সবকিছু করতে পারে। সন্তান ভূতের ভয় পেলে তাকে আগলে রাখে কিন্তু মা তুমি তো উল্টো আমাকে ভূতের ভয় দেখিয়েছো। ছোটোবেলায় আমাকে তুমি লালনপালন করোনি, করেছে বড় খালা। সেই আমাকে মায়ের আদরে বড় করেছে। মায়ের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তার সন্তানের জন্য সকল ত্যাগ স্বীকার। তোমার মাঝে আমি দেখিনি। তুমি সবসময় নিজের টা নিয়ে ভেবেছো।
ও থেমে গেলো।মেজো ফুপু বললেন
– আমি তোকে পেটে ধরেছি, জন্ম দিয়েছি।
ও বিদ্রুপের হাসি হেসে বলল
– জন্ম দিলেই মা হওয়া যায় না। সেটা তুমি প্রমাণ করেছো। বড় খালা আমার সবকিছু দেখাশোনা করেছেন। সেই আমাকে মায়ের আদরে মানুষ করেছেন। সুতরাং তুমি আমার জন্মদাত্রী কিন্তু মা নও। আমার মা হচ্ছে বড় খালা।
মেজো ফুপু ধমকে উঠে বললেন
– লালনপালন তো সবাই করতে পারে। কয়জন পেটে ধরতে পারে? আমি তোর মা, বড় আপা না।
ও চিৎকার করে বলল
– মা হলে, তুমি আমার খুশি, আনন্দ কেড়ে নেয়ার চিন্তা করতে না। তুমি ভালোভাবেই জানো, আমার সুখ – শান্তি সব শারলিনকে ঘিরে। তুমি ওকে প্রতিনিয়ত কষ্ট দিতে পারতে না। ও কষ্ট পেলে আমিও পাই। আমারো খারাপ লাগে। তোমার জন্য ও সুইসাইড করতে গিয়েছিলো। তুমি আমাকে ব্ল্যাক ম্যাজিক শিখিয়েছো। ব্ল্যাক ম্যাজিক যারা করে তাদের জন্য জান্নাত হারাম। তুমি কোনো মায়ের পর্যায়ে পরো না। তুমি একজন স্বার্থপর জন্মদাত্রী।
– তুই জানিস না, ওর মার জন্যে আমি বিধবা হয়েছি। তোর বাবা মারা গেছে।
– ওর মার জন্য না। তোমার নিজের স্বভাবের জন্যে। তুমি নিজে কী সেটা কখনো খেয়াল করেছো? তুমি নিজের দোষ অন্যের উপর কীকারণে চাপাও? তুমি আমার মা নও। শারলিনকে লাগবে তোমার? নিয়ে কী করবে আমি জানি না বুঝি? তুমি কোনো মানুষের পর্যায়ে পরো না।
মেজো ফুপু কোনো কথা বলছেনা। সেই আগের মতো হাসি নেই তার মুখে। মেজো ফুপু আমাদের দিকে এগিয়ে আসলেন।
ফুপুর হাতে একটা কাঁচের বোতল দেখলাম। ফুপুকে এগিয়ে আসতে দেখে সৌরভ বলল
– মা, এসিড কার উপর মারবে?
মেজো ফুপু কোনো উত্তর দিলেন না। সৌরভের সামনে এসে দাঁড়ালেন ফুপু। আমি ওর পিছনে নিজেকে আড়াল করে দাঁড়ালাম। ফুপু বললেন
– আমি তোকে অনেক ভালবাসি বাবা।
ও বলল
– তোমার কোনো কথাই আমি বিশ্বাস করিনা। তুমি মানুষ যদি হতে তাহলে একজন মৃত ব্যক্তির লাশ ফরমালিন দিয়ে রাখতে পারতে না।
– আগে তো এমন বলতি না। এখন কেনো বলছিস? ওই মেয়ের জন্য বলছিস? এখন আমি পর আর শারলিন কাছের হয়ে গেলো।
– মা তুমি আবারো একই কাজ করছো? তোমার এসব বিশ্রী কর্মকাণ্ড সহ্য করার ক্ষমতা আর নেই। আমি ক্লান্ত মা, খুব ক্লান্ত।
– আমি বিশ্রী কোনো কাজ করছিনা। আমার উপর হওয়া অবিচারের বিচার করছি।
– তুমি নিজেই তোমার উপর অবিচার করেছো।
– চুপ কর। আমার থেকে বেশি বুঝবি না।
– তোমার কোনো কথাই আমি শুনবো না।
মেজো ফুপু হুট করে বোতলের মুখ খুললেন। সৌরভ, ফুপুর কাছ থেকে দূরে সরে দাঁড়ালো। ওর আড়ালে দাঁড়িয়ে ফুপু কী করছেন দেখতে পারছিলাম।
সৌরভ ফুপুর হাত থেকে বোতল কেড়ে নিতে হাত বাড়ালো। দুজনের মধ্যে সেই বোতল নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু হয়ে গেলো। এমনিতেই বোতলের মুখ খোলা তার উপর যেভাবে কাড়াকাড়ি চলছিলো তাতে মনে হলো যেকোনো একজনের গায়ের উপর এসিড পরবে।
বোতল কাড়াকাড়ি করতে গিয়ে ফুপুর শরীরে এসিড পরে গেলো। সাথে সাথে ফুপু চিল্লানো শুরু করলো। মাটিতে পরে গেলেন। সৌরভ নড়াচড়া করছে না,সেই আগের মতো দাঁড়িয়ে আছে। বড় ফুপু এসে মেজো ফুপুকে ধরলেন। বড় ফুপু বললেন
– সৌরভ গাড়ি বের কর। হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
সৌরভ কোনো উত্তর দিলো না। সেই আগের মতোই দাঁড়িয়ে রইলো। বড় ফুপু আবারো সেই কথাই বললেন। কিন্তু ওর কোনো প্রতিউত্তর পেলেন না।
ও মাটিতে বসে পরলো মেজো ফুপুর পাশে।
মেজো ফুপু অসহ্য যন্ত্রণায় চিৎকার করছে। বড় ফুপু বলতে লাগলেন
– মেজো সব ঠিক হয়ে যাবে একটু সহ্য কর। এক্ষুণি হাসপাতালে নিয়ে যাবো।
নীলের উদ্দেশ্যে বললেন
– কীরে গাড়ি বের কর তোর মাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবো।
ওর কোনো পরিবর্তন দেখলাম না। শুধু চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পরলো।
সৌরভ কে অনেক বলার পরও বড় ফুপু কিছু করাতে পারলেন না। বাধ্য হয়ে নিচতলার ভাড়াটিয়া কে ডেকে তুললেন। তাকে দিয়ে এম্বুলেন্স আনালেন।
রাত ১.৩০ এ আমরা হাসপাতালে পৌঁছালাম। সৌরভ সেই আগের মতোই চুপচাপ আছে। ক্রমাগত ওর চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পরছে। ডাক্তার ছিলেন না। কয়েকজন নার্স ছিলেন তারা মেজো ফুপুকে দেখে রীতিমত ভয় পেলেন। এতক্ষণ আমি খেয়াল করিনি এসিড কোথায় লেগেছে। বুক থেকে পেট, পেট থেকে ডান পা পর্যন্ত এসিডদগ্ধ হয়েছে। ভয়ানক অবস্থা। বড় ফুপু ডাক্তার এর নাম্বার নিয়ে ফোন করে রিকুয়েস্ট করলেন আসার জন্য।
ডাক্তার আসলেন রাত ২.৩০ টায়। মেজো ফুপু এর অবস্থা খুবই খারাপ।
ফজরের আযানের সময় ডাক্তার সাহেব অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হয়ে শুকনো মুখে বললেন
– অবস্থা খুবই খারাপ। এসিড টা তীব্র ছিলো তাই দেহের বাইরে তো দগ্ধ হয়েছেই ভিতরেও হয়েছে। আল্লাহ কে ডাকুন।
বড় ফুপু কাঁদতে লাগলেন। আমার জন্যই এমন হয়েছে। আমি ওর জীবনে না আসলে ওর আর ওর মায়ের এই করুণ পরিণতি হতো না।
হাসপাতালে আসার পর থেকে আমাদের কারোরই চোখে ঘুম ছিলো না। আমার শরীর খারাপ করছে। মেডিসিন খাওয়া হয়নি আজকে।
সকাল ৭ টার সময় একজন নার্স আমাদের বললেন
– আপনারা সকালের খাবার খেয়ে আসুন। এখন আমি আপনাদের রুগীর কাছে আছি।
বড় ফুপু আমাদের নিয়ে হাসপাতালের পাশের একটা খাবার হোটেলে নিয়ে গেলেন।
নীলকে এখন আগের থেকে স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। বড় ফুপু ওকে বললেন
– এখন খাবার খেয়ে নে। তোর মা ঠিক আছে।
ও মাথা নেড়ে সম্মতি প্রকাশ করলো। খাবার খাওয়ার পর বড় ফুপু বিল দিয়ে দিলেন।
তারপর আমাকে আর সৌরভ কে বললেন
– তোরা বাসায় যা। আমি আছি এখানে।
সৌরভ যেতে চাইলো না। বড় ফুপু জোড় করে আমাদের ওনার বাসায় পাঠিয়ে দিলেন।
বাসায় এসে আমি গোসল করে নিলাম। ও বিছানার উপর চুপচাপ বসে আছে।
ওর পাশে বসে বললাম
– আমার জন্যে এতো কিছু হলো। সবকিছুর মূলে আমি। মেজো ফুপু সুস্থ হয়ে গেলে আমি চলে যাবো তোমাদের জীবন থেকে।
ও বলল
– কোথায় যাবা?
– জানি না, তবে ঠিক বলছি আমি চলে যাবো। আমার মতো খারাপ একটা মেয়ের জন্য মা – সন্তানের মধ্যে দন্দ্ব। আমি না থাকলেই সব ঠিক হয়ে যাবো।
– তুমি ভুল বলছো। সবকিছুর মূলে আমার মায়ের হিংসা, প্রতিশোধ নেয়ার প্রবণতা। আর কিছুই না। এসিডদগ্ধ হয়েছে নিজের কারণেই।
– আমি না থাকলে তো এই ঘটনা তো ঘটতো না।
– শুনো শারলিন, আমার মায়ের পাপের বোঝা অনেক বেশি হয়ে গেছে যার ফলাফল গতকালের ঘটনা। কিন্তু ঘটনার আকস্মিকতায় আমি থমকে গিয়েছিলাম। আমি বুঝে উঠতে পারিনি কীভাবে কী ঘটলো। আমার হাত থেকেই কী এসিড পরেছে নাকি দোষ আমার মায়ের। এতক্ষণ ভাবার পর খুঁজে পেলাম আমার কারণে হয়নি। মায়ের হাত থেকেই তার শরীরে পরেছে।
ও আমাকে জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে। তারপর বলতে শুরু করলো
– জানো শারলিন, ছোটোবেলা থেকে মায়ের আদর পাওয়ার অনেক চেষ্টা করেছি। সে আমাকে প্রতিনিয়ত কষ্টই দিয়েছে। আমি একফোঁটা ভালবাসার জন্য দিনের পর দিন মায়ের প্রত্যেকটা কথা শুনেছি। ওনার কথা শুনেই তোমার সাথে আমি খারাপ ব্যবহার করেছি। শারলিন, আমাকে মাফ করে দাও।
– আরে বোকা, মাফ করার কী আছে? পাগলামি করো না। গোসল করে নাও। তারপর মেজো ফুপুর কাছে যেতে হবে আমাদের।
হাসপাতালে মেজো ফুপুর কেবিনের সামনে বেশ ভিড় দেখতে পারলাম।কাছে গিয়ে বুঝতে পারলাম মেজো ফুপু আর নেই। মেজো ফুপুর বেডে সাদা কাপড় দিয়ে তার দেহ ঢাকা। পাশের টুলে বড় ফুপু বসে আছেন।
সাদা কাপড় এর কিছু অংশ রক্তে লাল হয়ে আছে।
চলবে……..!
© Maria Kabir