ফ্ল্যাট নাম্বার নয় ছয়পর্বঃ ৪৫
লেখকঃ লামইয়া চৌধুরী।
আদুরী প্রশ্ন করল, “ঠিক আছে তুই যেখানেই আছিস ঠিকঠাক আছিস এতেই হলো। কিন্তু প্রশ্ন হলো তুই গাট্টি নিয়ে কেন গেলি?”
শায়েরী মনমরা কণ্ঠে বলল, “আমার ফ্যামিলিতে একটা সমস্যা হয়ে গেছে। ওই কুটনা বুড়াটা আমার মায়ের কানে আমার নামে বিষ ঢেলেছে। তাই আম্মা এখন শাহী ফরমান জারি করেছে যেন তোদের সাথে আর না থাকি।”
আদুরী চেঁচিয়ে বলল, “বুলশিট!”
মৌন অবশ্য কিছু বলল না। সে জানে ঘটনা এটা না। কেলেঙ্কারিটা বেঁধেছে আদুরীর বিষয়টা নিয়েই। শায়েরী সেটা চেপে গেছে। আদুরী খেঁকিয়ে বলল, “কি এমন বলেছে ঐ বদটা? আমার তো তোর কোনো দোষ চোখেই পড়ে না। তোর নামে কিছু বলবে তাও কি হয়?”
শায়েরী খানিক ভেবে বলল, “সেটা তোদের নাহয় পরে বলব। এখন ফোন রাখ। আমাকে রুচিদের বাসায় যেতে হবে। গতকাল এক্সামের কারণে যাওয়া হয়নি।”
শায়েরী তড়িঘড়ি করে ফোন রেখে দিলো। আদুরীকে কিছু জানানো যাবে না। আদুরী জেনে গেলে রেগে যাবে, ভীষণ রেগে যাবে!
.
নক্ষত্রের সাথে রাগারাগি করে বিপাশা নিজের বাসায় ফিরে এসেছে। বাসায় ফিরে দেখলো শায়েরী একদম টিপটপ হয়ে তৈরী হয়ে আছে। বিপাশা ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “নাস্তা করা হয়েছে?”
শায়েরী জবাব দিলো “জ্বি আপু, আন্টির সাথেই নাস্তা সেরে ফেলেছি। আপনার জন্য অপেক্ষায় থাকলে আমার দেরি হয়ে যেত।”
“ইটস ওকে তুমি যাও।”
শায়েরী দুষ্টুমীর সুরে বলল, “নক্ষত্র ভাই কি খাইয়েছে আপনাকে? এক প্লেট ঝাঁড়ি নাকি এক মগ ধমক?”
বিপাশা কপাল চাপড়ে বলল, “ওই বলদের কথা আর বলো না। বাই দা রাস্তা তুমি কি করে জানলে আমাদের ঝগড়া হয়েছে?”
শায়েরী অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে বলল, “আপনার চেহারা দেখেই বুঝেছি।”
বিপাশা কিঞ্চিৎ আগ্রহী হয়ে বলল, “তুমি লোকের চেহারা পড়তে জানো? নক্ষত্রের চেহারাবন্দি ভাবনাগুলো কি কি আমায় সেগুলো বলতে পারবে?”
“ওরে বাবা উনার ভাবনা নিয়েও আমি ভাবতে চাই না। আমি তো উনাকে নিয়েই কিছু ভাবতে চাই না। উনার কথা ভাবলেই আমার মন খারাপ হয়ে যায়।”
বিপাশা অবাক হয়ে বলল, “কেন? মন খারাপ হয় কেন তোমার?”
“যা করে আমার সাথে! সারাটা সময় আমার দোষ খুঁজে বের করে। আমি এভাবে কেন হাঁটি? ওভাবে কেন কথা বলি? এভাবে কেন বসি, ওভাবে কেন দাঁড়াই! এটাসেটা আরো যে কত কি! ভাইকে দেখলেই মনে হয় আমি হলাম ত্রুটিবিচ্যুতির কারখানা। আর উনি ম্যাকনিক। আমার কনফিডেন্স লেভেল ফুট্টুশ করে দিতে উস্তাদ তিনি।”
বিপাশা ভ্রুকুটি করে বলল, “তোমার কথা বলায় কি দোষ?”
“আমি নাকি দাঁত কেলিয়ে কথা বলি। আচ্ছা আপনিই বলুন হেসে হেসে কথা বলাটা কি গুণ নয়? এটা কি কোনো দোষের কিছু হতে পারে?”
বিপাশা মুচকি হাসলো। মনে মনে বলল, “অত সুন্দর হাসাটা দোষেরই বটে!”
কিন্তু সামনাসামনি বলল, “এই দেখো গল্প করতে করতে তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। আগে কাজে যাও তারপর এসো গল্পসল্প করা যাবে।”
শায়েরী বিপাশার কথায় সায় দিয়ে বলল, “আমি তাহলে আসি আপু। আসলেই দেরি হয়ে যাচ্ছিল।”
শায়েরী রুচিদের বাসার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল। সেখানে পৌঁছুলো সাড়ে এগারোটায়। রুচির দাদী রুচিকে তখন বকাবকি করছিলেন। শায়েরী সালাম দিয়ে জানতে চাইল, “কি করেছে আমার ছাত্রী?”
রুচির দাদী রাগে গজগজ করতে করতে বললেন, “কি করছে মানে? ফেইল করছে।”
শায়েরী হতভম্ব হয়ে রুচির দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে রইল। রুচিকে খুব বেশি বিচলিত মনে হলো না। সে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, “ম্যাম আমার ঘরে চলুন।”
শায়েরী বিস্মিত গলায় বলল, “কোন সাবজেক্টে?”
“উচ্চতর গণিত ম্যাম সাথে রসায়নও”
শায়েরী হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “আপাতত কদিনের জন্য তোমার আর্ট শিখাটা বন্ধ রাখো। এসএসসির পর আবার নাহয় শুরু করো।”
রুচির দাদী ঝঙ্কার দিয়ে বললেন, “এইডাই তো আমি গতকাল থিক্কা মাইয়ারে বুজাইতাছি কিন্তু মাইয়ার ঘাড়ের রগখান ত্যাড়া।”
রুচি প্রতিবাদ করে বলল, “আর্ট শেখানো বন্ধ করে দেওয়া হলে আমি পড়াশুনাই করব না।”
রুচির কথায় রুচির দাদী ভীষণ ক্ষেপে গেলেন। দাদী নাতনীর তর্ক-বিতর্ক চলতেই লাগলো। রুচির মা এসে দুজনকে থামিয়ে বললেন, “ডিসিশন নিবে রুচির বাবা। তাই আপনারা দুজন হাজার ঝগড়া করলেও কোনো লাভ হবে না।”
রুচি গাল ফুলিয়ে বলল, “ঠিক আছে ম্যাম আপনি চলে যান। আমার আর আর্ট শেখার প্রয়োজন নেই।”
শায়েরী সান্ত্বনার সুরে বলল, “আচ্ছা তোমাকে যদি এমন একজন টিচার দেওয়া হয় যিনি একসাথে তোমায় গণিত আর রসায়ন পড়াবেন আবার আঁকাআঁকিটাও দেখিয়ে দিবেন তবে কি তুমি মন দিয়ে পড়াশুনা করবে?”
রুচি চমকে গিয়ে বলল, “ম্যাম আপনি আমাকে এই বিষয়গুলোও পড়াবেন?”
“না না আমি তো আর্টসের। আমার সাবজেক্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞান। আমি তোমায় এগুলো কি করে পড়াব?”
“তাহলে আপনারা ঐ বান্ধবীটা যেকিনা কেমিস্ট্রিতে পড়ে সে পড়াবে?”
“না না মৌন তো আঁকাআঁকি পারে না।”
“তবে?”
“আমার কাজিন আছে। সে তোমায় পড়াবে। আমার আঁকাআঁকির হাতেখড়ি তার হাতেই। আমার চেয়েও দারুণ আঁকে সে। বুয়েটে পড়ে। এক ঢিলে দুই পাখি বুঝলে সোনামণি?”
রুচি একগুঁয়ের মতন বলল, “আমি আপনার কাছেই শিখব। আর কারো কাছে পড়তে আমার ভালো লাগে না।”
রুচির দাদী ফের চটে গেলেন।বকাঝকা শুরু করলেন। শায়েরী দাদীকে থামিয়ে বললেন, “দাদী আমি ওকে বুঝাচ্ছি। আপনারা চলে যান এখন। দেখবেন সে ঠিকই রাজি হয়ে যাবে।”
রুচি অমত করে বলল, “কখনো রাজি হব না।”
রুচির দাদী আবারো ক্ষোভে ফেটে পড়ার আগে শায়েরী ইশারায় তাদের চলে যেত বলল। রুচির দাদী আর মা দুজনই চলে গেলেন। শায়েরী রুচিকে নিজের কাছে টেনে এনে কাঁধে হাত রেখে বলল, “শুনো সামনে তোমার এক্সাম রুচি। ভালো করে না পড়লে লোকে তোমায় এসএসসি ফেইল বলবে।”
“আমি তো পড়িই ম্যাম।”
“না তুমি পড়ো না, সারাদিন আঁকাআঁকি করো। আমি কি বলি মন দিয়ে শুনো। আমি যদি এখন আলাদা করে এসে তোমাকে আর্ট শেখাতে যাই তবে তোমার অনেকটা সময় অপচয় হবে। তারচেয়ে একজনই এসে তোমাকে একসাথে দুটো দেখিয়ে যাবে এটা ভালো না?”
“আমার তো গ্রুপের সাবজেক্টগুলোর জন্য টিচার আছেই?”
“আহা বোকা মেয়ে গ্রুপের সাবজেক্টস এর টিচার গ্রুপের সাবজেক্ট দেখালো আর আমি দেখালাম আর্ট তখন তোমার ডাবল টাইম ওয়েস্ট হলো না? এই সময়টায় তুমি আরেকটু বেশি পড়তে পারবে।”
“না না দরকার নেই আমার।”
শায়েরী ভিতরে ভিতরে রাগে লাল হয়ে গেল। মনে মনে কষে দুটো চড়ও বসালো রুচির গালে। কিন্তু সামনাসামনি শান্ত থেকে বলল, “তোমার ওই পাগলটার কথা মনে আছে?”
“কোন পাগলটা?”
“ওই যে আমাকে ব্যাথা দিয়েছিল। খেতে পায় না অনেকদিন যে পাগলটা।”
রুচি মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ ওই পাগলটার কথা তো ঘুমোতে গেলেও আমার মনে পড়ে। কি যে মায়া লাগে!”
শায়েরী খানিক ইতঃস্তত করে বলল, “ওই পাগলটা আমার কাজিন। ব্রিলিয়ান্ট পাগল। তবে টিউশনির অভাবে খেতে পায় না। তুমি যদি দয়া করো তবে টিউশনিটা সে পেয়ে যাবে।”
রুচি বিস্ময়াকুল হয়ে বলল, “ইয়া আল্লাহ্ তাই নাকি! আমাকে আগে বলবেন না?”
শায়েরী দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে বলল, “হ্যাঁ আগেই বলা উচিত ছিল। ম্যামের ভুল হয়ে গেছে।”
রুচি খানিক চিন্তায় পড়ে গেল। শায়েরী রুচির চিন্তামগ্ন চেহারাখানার দিকে তাকিয়ে বলল, “কি ভাবছ রুচি? এখন তো রাজি?”
রুচি গম্ভীরভাবে বলল, “আমি তো রাজি তবে দাদী আমায় নগ্ন পাগলের কাছে পড়তে দিতে রাজি হবে না।”
শায়েরী ঠোঁট কামড়ে হাসি আটকে বলল, “আমি ওকে কাপড় কিনে দিয়েছি। কাপড় পরেই তোমাকে পড়াতে আসবে।”
রুচি আশ্বস্ত হয়ে বলল, “তাহলে ঠিক আছে ম্যাম।”
হঠাৎ মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিতে শায়েরী বলল, “শুনো ভালো করে পড়াশুনা না করলে পাগল কিন্তু তোমার হাতেও কাঁটাচামচ বসাবে, এমনকি মাথায় প্লেট, বাটিও ভাঙতে পারে।”
রুচি ঢোক গিলে বলল, “না না আমি তবে পড়ব না।”
শায়েরী মিষ্টি করে হেসে বলল, “ধ্যাত ভয় পেও না তো। এমনিতে অনেক ভালো। দেখে তোমার মনেই হবে না সে পাগল। বরং দেখে মনে হবে ম্যাম পাগল তাই উনাকে পাগল বলেছে। শুধু মন দিয়ে পড়াশুনা করবে তাহলেই হবে। তুমি মন দিয়ে পড়াশুনা করলে একটা পাগল যদি দুবেলা খেতে পায় তাতে তোমার ক্ষতি কি?”
রুচি অস্ফুট স্বরে বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে।”
“আর শুনো এটা জানো তো পাগলকে কোনোদিন পাগল বলতে নেই?”
“রুচি উপর নীচ মাথা নাড়িয়ে বলল, “হ্যাঁ জানি।”
“গুড গার্ল! পাগল যেন না বুঝে যে সে পাগল।”
রুচি ফের ঢোক গিলে বলল, “ওকে ম্যাম।”
চলবে…
বিঃদ্র লেখিকা গল্প টি কোন কারণবশত আপলোড দেয় নি অথবা কোনো কারণবশত ডিলিট করে দিয়েছে তাই গল্পটা এত টুকির ভিতরেই সীমাবদ্ধ