পুষ্পবৃষ্টির_সেই_দিনে💙 #দ্বিতীয়াংশ

0
690

#পুষ্পবৃষ্টির_সেই_দিনে💙
#দ্বিতীয়াংশ
#মাইশাতুল_মিহির

.
গ্রামের মানুষ সাধারনত খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে যে যার কাজে লেগে যায়। ইতিমধ্যে বাড়ির সবাই ঘুম থেকে উঠে পরেছে। দুই ভাই মিলে বাজারে গেলো তরতাজা বাজার আনতে। দুই বউ মিলে রান্না ঘরে নাস্তা বানাতে ব্যস্ত। তাদের কাজে হাত মেলাচ্ছে নিলাশা, নিলা। নিলাশার বিয়ে হয়েছে কয়েক বছর আগে। কিছুদিন বাবার বাড়িতে এসেছে বেড়াতে। তার ছোট একটা ছেলে আছে নাম আয়াশ। শুভ্রতা সাধারনত লাজুক আর শান্ত স্বভাবের। পড়াশোনায় বেশ মনোযোগী। কিন্তু নিলা, নিলু আর শুভ্রা উড়নচণ্ডী স্বভাবের।
.
দরজায় টোকা পরায় নিভ্র এগিয়ে দরজা খুলে। শুভ্রতা কে দেখে বুকে ধুকধুকানি বেড়ে যায় তার। শুভ্রতা মিষ্টি হেসে বলে, ‘নাস্তা করতে আসুন। সবাই নিচে বসে আছে।’ নিভ্র অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। এতো মিষ্টি কন্ঠ কারোর হয়? দেখতে যেমন স্নিগ্ধ তেমনি তার মুগ্ধকর কণ্ঠস্বর। নিভ্র মুখে হাসি রেখে বলে, ‘তুমি শুভ্রতা? কেমন আছো?’

শুভ্রতা কিছুটা ইতস্ততবোধ করছে। মিনমিনে গলায় বলে, ‘জি ভালো। আপনি?’

‘ভালো। অনেক বড় হয়ে গেছো দেখছি। শেষবার যখন দেখেছিলাম তখন একদম পিচ্চি ছিলে। কিসে পরো?’

শুভ্রতার এবার বেশ ভারী লজ্জা লাগছে। কোনো রকমে, ‘ক্লাস টেন। নিচে আসুন।’ বলে চলে যায় এখান থেকে। নিভ্র এবার আরো অবাক হয়। এতো শান্ত স্বভাবের শুভ্রতা? বেশ লাজুক! তার মুগ্ধতায় হেসে বুকের বা পাশে হাত রেখে বিছানায় বসে নিভ্র। আনমনে বলে উঠে,

‘প্রেমে পরেছি আমি। হ্যা ষোড়শী কন্যা শুভ্রতার প্রেমে মাতোয়ারা হয়েছি।’
.
সকালের নাস্তায় ছিলো পিঠাপুলি, বিভিন্ন মিষ্টান্ন, ঘি’তে ভাজা রুটির সাথে সবজি, মাংস ভুনা। নিভ্রের মনে হচ্ছে সে এখানে আরো কিছু দিন থাকলে তার ওজন একশ ছাড়িয়ে মোটু হয়ে যাবে।

বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে উঠানে তাকিয়ে আছে নিভ্র। উঠানের পাশে রান্না ঘরের সামনে বসে দুপুরের রান্নার উদ্যোগ চলছে। পরিবারের বধূ কন্যারা মিলে হাতে হাতে কাজ চালাচ্ছে। কিন্তু নিভ্র উপর থেকে ষোড়শী কন্যাকে দেখতে ব্যস্ত। শুভ্রতা হেসে হেসে লাউপাতার ডাটা বেছে দিচ্ছে। বেনী থেকে কিছু ছোট ছোট চুল অবাধ্য হয়ে মুখের সামনে এসে বিরক্ত করছে তাকে। কয়েক মুহূর্তের জন্য থেমে গেলো নিভ্র। মনে এক নিষিদ্ধ কাজ করার ইচ্ছা পোষণ হলো। ইচ্চে করছে তার মুখের সামনে লেপ্টে থাকা চুল গুলো কানের পিছে গুছে দিতে। নিভ্র নিজের মনের এমন অধম ইচ্ছা কে কয়েকটা গালি দিলো। তার পঁচিশ বছর জীবনে এমন কখনোই হয় নি।

হঠাৎ আকাশ কালো মেঘে ঢেকে বৃষ্টির ফোটা পরতে শুরু করে সাথে তীব্র বজ্রপাত। উঠোন থেকে যাবতীয় জিনিস গুলো তড়িঘড়ি করে রান্না ঘরে নিয়ে গেলো সবাই। মেয়েরা যে যার রুমে। বড়রা রান্নাঘরে রান্নার আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত। শুভ্রতা রান্না ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে একহাত বাড়িয়ে বৃষ্টির ফোটা ছুঁয়ে দিচ্ছে। নিভ্র মুগ্ধ নয়নে দেখছে। রুম থেকে ক্যামেরা এনে ফ্রেমে বন্ধি করে নিলো পুষ্পবৃষ্টি উপভোগ করা ষোড়শী কন্যাকে।
.
সারাদিন ভাড়ি বর্ষনের পর বিকেলের দিকে নীল আকাশ উকি দেয়। হাল্কা সাদা কালো মেঘ আকাশের আনাচে-কানাচে আনাগোনা করছে। নিলু আর শুভ্রা আসে নিভ্রের রুমে। নিভ্রকে নিয়ে ছাদে যায় দুইজন। নিভ্র ছাদে এসে দেখে রেলিং এর পাশে দাঁড়িয়ে আছে নিলাশা, নিলা আর শুভ্রতা। তাদের আড্ডায় যোগ দিলো সে। গানের আসর বসেছে এখানে। বৃষ্টি চলাকালীন থেকে বৃষ্টি শেষের মুহূর্ত সবচেয়ে বেশি মুগ্ধকর। এই মুগ্ধকর পরিবেশ মাতিয়ে তুলতেই গানের আসর। নিভ্র সবার সাথেই কথা বলছে হাসছে কিন্তু এই ষোড়শীর সাথে কথা বলার সুযোগ পাচ্ছে না। অতিরিক্ত শান্ত মেয়ে, কথা কম বলে। এক এক করে সবাই গান গাওয়ার পর শুভ্রতার গানের পালা আসে। নিভ্রের সামনে গান গেতে সে বেশ ইতস্ততবোধ করছে সেটা নিভ্র খুব ভালো বুঝতে পারছে। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে শুভ্রতার দিকে। অবশেষে বোনদের মিনতির জন্য রাজি হয় গান শুনাতে হুম… হুম… করে সুর তুলে গানের…..

অসময়ি এ বৃষ্টিতে আমি,
অসময়ি এ বৃষ্টিতে তুমি,
কিছু না বলা কথা দিলাম ভাসিয়ে,
ধুয়ে যাক না এ মন অভিমানী।

মেঘলা আকাশ, হাল্কা হাওয়া,
যাই ফিরে আর নিজেকে ফিরে পাওয়া।
আধ খোলা কাচ, বৃষ্টির ছোঁয়াচ,
তোমার নামে মেঘের খামে চিঠি দিলাম আজ।

আধ ভেজা প্রহর, আধ ভেজা শহর,
আধ ভেজা তুমিও আর আধ ভেজা আমার সফর!

মেঘলা দিনে এই বৃষ্টি থামে তো এই বৃষ্টি নামে। এখনও ভাড়ি বর্ষণ শুরু হয়েছে। সবাই নেমে গেলো ছাদ থেকে। নামলো না শুধু শুভ্রতা। নিভ্র ছাদ থেকে নেমে যাওয়ার জন্য দরজার কাছে গিয়েই দারিয়ে পরে। দেখতে থাকে সেই ষোড়শী কন্যার বৃষ্টি বিলাস। শুভ্রতা নিশব্দে রেলিং ধরে নীল আকাশে মুখ দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। কেউ একজন তার দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে সে দিকে তার ধ্যান নেই। ক্যামেরা বন্ধি করতে ভুলেনি নিভ্র। বৃষ্টির পানিতে শাড়ি ভিজে গায়ে লেপ্টে গেছে। হঠাৎ নিষিদ্ধ স্থানে চোখ যেতেই ফিরিয়ে নেয় নিভ্র। বেশ অপ্রস্তুত হয়ে যায় সে। নেমে যায় ছাদ থেকে।
.
সকালে ছোট চাচার সাথে বাজারে যায় নিভ্র। গ্রামীন বাজার হলে কি হবে এখানে প্রায় অনেক কিছুই পাওয়া যায়। নিভ্র একা ঘুড়ে ঘুড়ে দেখছে সব। হঠাৎ চোখ যায় দোকানে থাকা রেশমি চুড়ির দিকে। শুভ্রতা তো এই চুড়ি পরে ভেবেই এগিয়ে গেলো দোকানে। নিভ্রের প্রিয় রঙ নীল আর কালচে সবুজ রঙের দুই মুঠো চুড়ি নিলো। পাশে থাকা পায়েলের দিকে নজর পরে তার। সোনালি রঙের পায়েলে শুভ্রতাকে ভালোই লাগবে। এক জোড়া পায়েল কিনে নিলো। দোকানদার চুড়ি আর পায়েল পেকেটে মুড়িয়ে দিয়েছে।

কিনার পর পরেছে বিপাকে। এইগুলো শুভ্রতা কে কিভাবে দিবো? মেয়েটার সাথে তো কথায় হয় না। ঠোট কামড়ে ভাবছে নিভ্র। এমন সময় নিভ্রের চাচা আসায় বাড়ির উদ্দেশ্যে হাটে দুজন।
.
আজকে আকাশ পরিষ্কার। সাদা মেঘের ভেলা ভাসছে চারদিকে সাথে স্নিগ্ধ বাতাস মনকে চাঙ্গা করে তুলার জন্য যতেষ্ট। পুকুর পাড়ের সিঁড়ি তে বসে আছে নিলাশা, শুভ্রতা, নিলা। সিঁড়ির নিচে পানির কাছে বরশী দিয়ে মাছ ধরার চেষ্টা করছে নিভ্র, নিলু আর শুভ্রা। নিভ্র বারবার বরশী ফেলছে কিন্তু মাছ ধরতে পারছে না। নিলু মাছ ধরায় বেশ পটু। সে তো পুটি মাছ ধরেছে বেশ কয়েকটা। নিভ্রের মাছ ধরতে না পারায় হাসিতে মেতে আছে নিলাশা, শুভ্রতা। নিভ্র আড়চোখে শুভ্রতা দেখছে বারবার।

‘প্রেয়সী, মাছ ধরতে না পারার ব্যর্থতায় যদি তুমি মুগ্ধ হয়ে হাসো, তাহলে আমি এই ব্যর্থতা সারাজীবন আঁকড়ে ধরে রাখতে রাজি!’

নিলাশার কথায় শুভ্রতা উঠে দাঁড়ায়। ঠোট চেপে হেসে নিভ্রের কাছে এসে তার থেকে বরশী নিয়ে পানিতে ফেলে। প্রথম বার মাছ না উঠলেও দ্বিতীয় বার ছোট পুটি মাছ উঠে যা দেখে শুভ্রতা এক প্রশান্তির হাসি হাসে। নিভ্র মুগ্ধ হয়ে একহাত বুকের বা পাশে রাখে।

‘ওহে ষোড়শী কন্যা! কি আছে তোমার হাসির মাঝে? নেশা না করেও একরাশ মাদকতা কাজ করে। বক্ষস্থলের বা-পাশ তীব্র থেকে তীব্রতর অনুভূতির শিকার হয়। বারংবার আমাকে ঘায়েল করে।’
.
নিস্থব্ধ রাত! অন্ধকারের কালো রঙ্গে পরিবেশে নিরব করে দিয়েছে। থেমে থেমে মৃদু আওয়াজে আকাসজে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সেই আকাশের বিদ্যুৎচমকের আলোতে পরিবেশ ক্ষণে ক্ষণে দেখা যাচ্ছে। শীতল হাওয়া শরিলে হিমস্রোত বয়ে দিচ্ছে। ষোড়শী কন্যার চিন্তায় ঘুম যেনো সপ্তম আকাশের চূড়ায় চলে গেছে। বিছানা ছেড়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায় নিভ্র। আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবছে আপন মনে ভাবছে সে। হঠাৎ দুতলার শেষের ঘরে লাইট দেখে অবাক হয় সে। রাত দুইটার দিকে ওখানে কে থাকতে পারে? কৌতুহলবশত এগিয়ে যায় সে। নিভ্র ইচ্ছে করে শব্দ করে ঘরে ঢুকে কিন্তু তার কারণে ভয় পেয়ে যায় শুভ্রতা। দরজার কাছে নিভ্রকে দেখে বুকে হাত রেখে স্বস্থির নিশ্বাস ফেলে সে। তারপর বলে, ‘এভাবে কেউ আসে নিভ্র ভাই?’

অবাক হয় নিভ্র। এই প্রথম শুভ্রতা তার সাথে আগ বারিয়ে কথা বলেছে। আর এই ঘরটি সাধারনত লাইব্রেরীর মতো। বড় বড় বুকশেলফ দিয়ে সাজানো ঘরটি। এতো রাতে শুভ্রতা এখানে কি করছে?

‘এখানে কি করছো?’

শুভ্রতা বুকশেলফে তিনটি বই রেখতে রাখতে বলে, ‘এই তিনটি বই পড়া শেষ তাই রাখতে আসলাম।’ নিভ্র বিস্মিত হয়ে বললো, ‘এতো রাত জেগে শুধু উপন্যাসের বই পরছিলে?’ শুভ্রতা নিভ্রের দিকে তাকিয়ে শীতল কন্ঠে বলে,

‘নিস্থব্ধ পরিবেশে প্রিয় কবির বই পড়ার মতো আনন্দ আর নেই। বর্ষাস্নাত শান্ত গভীর রাতে নিজেকে বইয়ের মাঝে লুকিয়ে রাখার সার্থকতা এই পৃথিবীতে আর কোথাও খোঁজে পাওয়া যাবে না।’ ❤️
.
আজ পাঁচ দিন হলো নিভ্র গ্রামের বাড়িতে আছে। ওইদিকে সেমিস্টার এক্সামের সময় বেশি দিন বাকি নেই। কালপরশু ঢাকা ফিরতে হবে। কিন্তু মন চাইছে না তার নিজ গন্তব্যে যেতে। কারণ টা হয়তো এই ষোড়শী কৃষ্ণকন্যা। কিন্তু শুভ্রতার জন্য কিনা চুড়ি আর পায়েল তো দেওয়া হলো না। কিভাবে দিবো এগুলো?

‘তোমার প্রেমে আমাকে খুব বাজে ভাবে আসক্ত করে ফেলেছো কৃষ্ণকন্যা। এই আসক্তির নাম কি হবে? মুগ্ধতা নাকি ভালোবাসা?’
.
নিভ্র চলে যাবে বিধায় পরিবারবে সবার মাঝে কালো মেঘ নেমে এলো। বিদায় দিতে সবাই ব্যস্ত। চাচিরা এটা দিবে ওটা দিবে বলছে কিন্তু নিভ্র নাছোড়বান্দা। সে তার নিজস্ব ব্যাগ ছাড়া অন্য কিছু নিবে না।

নিভ্র বিকেলে লাইব্রেরী তে গিয়ে দেখে সেখানে বসে আছে শুভ্রতা। সে গিয়ে শুভ্রতার সামনের চেয়ারে বসে। বিনিময়ে শুভ্রতা ভুবনভুলানো হাসি দিলো। নিভ্র যেনো আবার নতুন করে প্রেমে পরলো। সে ভিতরে ভিতরে আওড়াচ্ছে পায়েল আর চুড়ি গুলো কিভাবে শুভ্রতাকে দিবে। বেশ কিছুক্ষণ পরে শুভ্রতা বলে উঠে, ‘কিছু বলবেন?’

নিভ্র আমতা আমতা করে বললো, ‘আসলে আমি কাল সকালে চলে যাচ্ছি।’

‘হ্যা জানি! আরো কিছু দিন থেকে গেলেও পারতেন।’

‘নাহ! সেমিস্টার এক্সাম চলে এসেছে। পড়ার চাপ অনেক তাই যেতে হবে। নাহলে থেকে যেতাম।’

আবার নিরবতা নেমে এলো তাদের মাঝে। নিভ্র জিব দিয়ে ঠোট ভিজিয়ে বলে, ‘শুভ্রতা?’

বই থেকে চোখ তুলে নিভ্রের দিকে তাকায় শুভ্রতা। নিভ্র পাশ থেকে কাগজের পেকেট শুভ্রতার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘এইগুলো আমার তরফ থেকে। আশা করি আমি চলে গেলেও মনে রাখবে।’

শুভ্রতা কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই চলে যায় সে। শুভ্রতা শান্ত চোখে পেকেট টির দিকে তাকিয়ে আছে।
.
রুমে এসে যেনো নিভ্র হাফ ছেড়ে বাচলো। নিজের এমন বেহায়া কান্ডে নিজেই বিরক্ত। নিজেকে শ’খানেক গালি দিতে দিতে ব্যাগ গুছিয়ে নিলো সে।

রাতের খাবার খাওয়ার সময় শুভ্রতার সাথে চোখাচোখি হলো তার। শুভ্রতা খুব আন্তরিকতার সাথে নিভ্রকে খাবার বেরে খেতে সাহায্য করলো। ভালো লাগলো নিভ্রের। সময়টাকে এখানেই থামিয়ে রাখতে চাইলো সে।

চলবে??

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here