#বিষাক্তফুলের_আসক্তিপর্ব-০৫
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
খবরের কাগজ হাতে থম মেরে সোফায় বসে আছে ইকবাল খান। প্রত্যেকটা নিউজপেপারে তাজের নামে জঘন্য থেকে জঘন্যতম নিউজ ছাপা হয়েছে। টিভি অন করে সোফাতে বসে আছে ইরিনা রহমান। ছেলের নামে এমন জঘন্য কথা শুনতে হবে কোনোদিন কল্পনা করেনি দুজনের কেউই। যে ছেলের জন্য একদিন গর্বে বুক ভরে এসেছিলো আর সেই ছেলের জন্য লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে। ইকবাল খান অফিসে যেতে ভয় পাচ্ছেন। মানুষের কথা শোনার ভয়ে সে বাড়ি থেকেই বের হতে চাইছেন না।
ইকবাল খান হতাশ গলায় বললো, ইরি এসব দেখার জন্যই কী বেঁচে ছিলাম ?
ইরিনা কী বলবে, সে নিজেই স্তব্ধ হয়ে গেছে।
ইকবাল পুনরায় বললো, তাজ কোথায় ?
ইরিনা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, সার্ভেন্ট বললো সকালেই তাজ বেড়িয়ে গেছে মেয়েটাকে নিয়ে।
ইকবাল অবাক হয়ে বললো, কোথায় গেছে ?
সেটা তো জানি না। তবে সার্ভেন্ট বললো মেয়েটাকে নাকি এক প্রকার টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেছে, অনেক রেগে ছিলো তাজ।
ইকবাল নিউজপেপার রেখে বললো, মহিবুলের সাথে একবার কথা বলা দরকার কিন্তু কোন মুখে তাদের সাথে কথা বলবো। মৌয়ের কী অবস্থা সেটাও জানা প্রয়োজন।
মেয়েটা সেই ছোটবেলা থেকে তাজকে ভালোবাসে কিন্তু তাজ কখনো ওকে বুঝার চেষ্টাই করেনি। মেয়েটা অনেক বড় আঘাত পেয়েছে। মহিবুল অনেক শান্ত প্রকৃতির মানুষ। মহিবুলের জায়গায় অন্যকেউ হলে হয়তো অনেক সমস্যা করতো।
বুঝলে ইরি, জীবনে এমন কিছু পরিস্থিতি আসে মানুষ সেই পরিস্থিতির কাছে অসহায় হয়ে যায়। চাইলেও কিছু করার থাকে না। আমি অফিসে যাচ্ছি, পরিস্থিতি খারাপ বলে তো আর ব্যবসা বানিজ্য বন্ধ করে বাড়িতে বসে থাকা যাবে না। সেলিব্রিটিদের জীবন বরাবরই আমার পছন্দ নয়, তার বড় একটা কারণ হচ্ছে এদের পার্সোনাল লাইফ বলতে কিছু নেই। এদের বেডরুমের কথাও মানুষের নখদর্পনে।
ইকবাল খান রুমে চলে গেলেন অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হতে। ইরিনা রহমান বসে রইলেন সোফায়। মহিবুল ইরিনা রহমানের ছোট চাচার ছেলে। তাজ আর মৌ সম্পর্কে মামাতো ফুপাতো ভাইবোন হয়।
ব্রেকফাস্ট করে রায়হান বসে আছে মৌয়ের কাছে। হালকা খাবার খাইয়ে মেডিসিন দেওয়া হয়েছে মৌকে। জ্বর কমতে শুরু করেছে, মৌ এখন ঘুমাচ্ছে। মৌয়ের বাবা-মা গেছে ব্রেকফাস্ট করতে।
রায়হান মৌয়ের হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো, কী ভেবেছিলি মৌমাছি ? আমাকে ফাঁকি দিয়ে তাজের হয়ে যাবি ? ছোটবেলার সেই বোকা রায়হান নই রে আমি। তোর ধোঁকা খেতে খেতে বুঝতে শিখে গেছি, নিজের জিনিস কীভাবে নিজের করতে হয়। এখন বোকা তুই নাকি আমি সেটা বুঝতে পারছি না। দেখ তাজের তোকে নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই, তবু তুই তাজের জন্য পাগল। আমি তোকে এতোটা ভালোবাসি সেটা সারাজীবন তুই শুধু ব্যবহারই করে গেছিস। এদিকে তুই আমার থেকে পালাই পালাই করিস কিন্তু আমি তোকে ছাড়তে পারছি না আর কোনো দিন পারবও না। এখন বোকাটা কে বল তো। তুই আমাকে বাধ্য করেছিস এই নোংরা খেলাটা খেলতে। আমার এতে দোষ নেই রে মৌমাছি।
৭.
কারো উচ্চস্বরে পড়ার শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো আহানের। কানের উপর বালিশ চাপা দিয়ে আবার ঘুমানোর চেষ্টা করেও লাভ হলো না।
Jhony, Jhony.
Yes papa ?
Eating sugar ?
No papa.
Telling lie ?
No papa.
Open your mouth.
Ah, ah, ah.
বিরক্ত হয়ে উঠে বসলো আহান। শব্দের উৎস খুঁজতে আশেপাশে তাকালে স্পিকারের দিকে চোখ গেলো। পাখির সেফটির জন্য তার রুমে একটি ক্যামেরা আর মাইক্রোফোন লাগিয়েছে আহানের বড় ভাই। সেটার সাহায্যে আহান যেখানেই থাকুক পাখি রুমে কী করছে আর বলছে সব দেখতে আর শুনতে পারবে নিজের ফোনে বা ল্যাপটবে। আহানের রুমের স্পিকারে পাখির কথা সবসময় শোনা যাচ্ছে, আহান রুমে থাকলে। আহানের বিরক্ত লাগলেও কিছু করার নেই, বড় ভাই চব্বিশ ঘণ্টা পাখির উপর নজর রাখতে বলেছে। একটা পাগল মেয়ে তার ভাইয়ের কাছে এতটা ইম্পর্ট্যান্ট কেনো বুঝতে পারছে না আহান। গতরাতে এজন্যই পাখির চেঁচামেচি নিজের রুমেই শুনতে পেয়েছিলো। আহান চরম বিরক্তি নিয়ে পাখির রুমে গিয়ে দেখে পাখি বেডের উপর বসে শব্দ করে ছড়াটা বারবার পড়ছে।
আহান ধমক দিয়ে বললো, এই মেয়ে তুমি কী পাঁচ বছরের বাচ্চা ? এটা কী ছড়া পড়ছো হ্যাঁ ?
পাখি ভয় পেয়ে কেঁপে উঠে আহানের দিকে তাকিয়ে তোতলাতে তোতলাতে বললো, জনি জনি।
আহান পুনরায় ধমক দিয়ে বললো, কী জনি জনি ? বাচ্চাদের ছড়া তুমি বারবার পড়ছো কেনো ?
পাখি ঠোঁট উল্টে কান্নার ভাব করে বললো, এটা আমার ফেবারিট ছড়া।
আহান বিরক্ত গলায় বললো, এতবড় মেয়ের নাকি জনি জনি ছড়া ফেবারিট।
পাখি এবার ঠোঁট উল্টে কান্না করে বললো, আপনি আমাকে বকেন কেনো সবসময় ? আপুনি তো কখনো আমাকে বকে না। আমি কতকিছু ভেঙে ফেলি আপুনি কিচ্ছু বলে না আমাকে আর কিছু না করলেও বকেন আপনি। খুব পঁচা আঙ্কেল তো আপনি।
আহান চোখ বড় বড় করে বললো, হোয়াট ? আঙ্কেল, আমাকে আঙ্কেল বললো ?
আহান নিজের বিস্ময় কাটিয়ে জোরে ধমক দিয়ে বললো, এই মেয়ে আমাকে তোমার আঙ্কেল মনে হয় ?
পাখি এবার জোরে জোরে কান্না শুরু করে দিলো, পাখির কান্নার আওয়াজ শুনে দৌড়ে এলো ন্যান্সি।
আহান থতমত খেয়ে বললো, মহা জ্বালা তো।
ন্যান্সি পাখির মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, কী হয়েছে বেবি ?
পাখি আহানকে দেখিয়ে বললো, আঙ্কেলটা বকেছে।
আহান থতমত খেয়ে ধমক দিয়ে বললো, এই মেয়ে খবরদার আঙ্কেল বলবে না আমাকে। আর একবার আঙ্কেল বললে একদম বাসা থেকে বের করে দিবো।
আহান হনহনিয়ে বের হয়ে গেলো রুম থেকে। পাখি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো আহানের যাওয়ার দিকে।
ন্যান্সির দিকে তাকিয়ে বললো, পঁচা আঙ্কেল।
ন্যান্সি বাংলা বুঝতে আর বলতে পারে ভালো করেই। পাখিও ইংরেজি ভাষা রপ্ত করেছে বেশ ভালোই। তাই পাখির সাথে কথা বলতে ন্যান্সির প্রবলেম হয় না। ন্যান্সি ইংরেজিতে বললে সেও ইংরেজিতে বলে আবার ন্যান্সি বাংলা বললে সেও বাংলা বলে। তিতির পাখিকে যতটা শেখানোর যায় চেষ্টা করেছে শিখাতে।
ন্যান্সি মুচকি হেসে বললো, আঙ্কেল বলে না বেবি।
পাখি ভাবুক ভঙ্গিতে বললো, তাহলে কী বলবো ?
তুমি ভাইয়া বলতে পারো।
ঠিক আছে ভাইয়া বলবো, পঁচা ভাইয়া।
ন্যান্সি মুচকি হেসে বললো, চলো ব্রেকফাস্ট করবে।
আপুনি কখন আসবে ?
তুমি গুড গার্ল হয়ে থাকলে তাড়াতাড়ি চলে আসবে।
ঠিক আছে আমি একদম গুড গার্ল হয়ে থাকবো।
ন্যান্সি দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো পাখির দিকে তাকিয়ে। কারণ সেও জানে পাখির আপুনি বেঁচে নেই। এদিকে আহান নিজের রুমে গিয়ে পাখিকে ইচ্ছে মতো বকতে বকতে ফ্রেশ হতে চলে গেলো। মেয়েটাকে একদমই সহ্য হচ্ছে না আহানের। কিন্তু কিছু করারও নেই তার।
৮.
রাগে মাথা ফেঁটে যাচ্ছে তাজের। যতগুলো হসপিটালে প্রেগন্যান্সি টেস্ট করিয়েছে, ইমারজেন্সি রিপোর্ট বের করেছে। সবগুলো রিপোর্ট একই কথা বলছে, তিতির প্রেগনেন্ট। কিন্তু সেটা তো অসম্ভব, মাথায় কিছুই ঢুকছে না তাজের। সারাদিন একটার পর একটা হসপিটালে গিয়েছে কিন্তু ফলাফল শূন্য। তাজ যেখানে জানে তিতির প্রেগনেন্টই নয় সেখানে ডিএনএ টেস্ট করার মানেই হয় না। তাজ এটাই প্রমাণ করতে পারছে না তিতির প্রেগনেন্ট নয়, সেখানে ডিএনএ টেস্ট করে পজিটিভ কিছু আশা করাও বোকামি মনে হয়েছে তাজের কাছে। সেটাও তাজের বিরুদ্ধেই আসবে, তাজের বুঝা হয়ে গেছে। ড্রয়িংরুমে বসে আছে পুরো খান পরিবার। ইকবাল খান গম্ভীর মুখে বসে আছে। ইরিনা রহমান একবার ছেলের দিকে তাকাচ্ছে তো একবার স্বামীর দিকে তাকাচ্ছে।
ইকবাল খান গম্ভীর গলায় বললো, গতরাতে একবার মনে হয়েছিলো আমার হয়তো কোথাও ভুল হয়েছে। তুমি এমন একটা জঘন্য কাজ করতে পারো না। কিন্তু এতগুলো হসপিটালের রিপোর্ট কীভাবে ভুল হয় তাজ ?
তাজ অসহায় গলায় বললো, প্লিজ বাবা বিলিভ মি।
কীভাবে বিশ্বাস করবো বলো তো ? একটা হসপিটালের রিপোর্টও যদি ভিন্ন হতো তাহলে তুমি এই কথা বলতে পারতে।
তাজ অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বাবার দিকে। কীভাবে তাকে বুঝাবে সে মিথ্যা নয় বরং এই মেয়েটা মিথ্যা, সবগুলো রিপোর্ট মিথ্যা। ইরিনা বরাবরই শান্ত মেজাজের মানুষ, তাই সে নিরব ভূমিকা পালন করছে। ইরিনা ঘুরে তাকালো একটু দূরে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার দিকে।চোখমুখ বলে দিচ্ছে সে প্রচন্ড ক্লান্ত, দাঁড়িয়ে থাকতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে তার। মেয়েটার মুখ দেখে বুঝার উপায় নেই কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যা। কেমন অনুভূতিহীন পুতুলের মতো নিষ্প্রাণ চোখে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে আছে। ইরিনা দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিজের ছেলের দিকে তাকালো। রাগ, হতাশা আর অসহায়ত্ব চোখে মুখে স্পষ্ট। নিজের বাবার দিকে তাকালো অসহায় দৃষ্টি যেনো বলে দিচ্ছে সে মিথ্যা বলছে না। ইরিনা রহমানের নিজেকে কেমন পাগল পাগল মনে হতে লাগলো। কেমন গোলকধাঁধা মনে হচ্ছে সবকিছু। ধুপ করে কিছু পড়ে যাওয়ার আওয়াজে সবাই ঘুরে তাকালো। তিতির লুটিয়ে পড়েছে ফ্লোরে। ইরিনা দ্রুত এগিয়ে গেলো তিতিরের দিকে।
ব্যস্ত গলায় বললো, কেউ এক গ্লাস পানি নিয়ে এসো।
একজন সার্ভেন্ট দ্রুত এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলো ইরিনার দিকে। চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে দিয়েও কোনো লাভ হলো না।
তাজের দিকে তাকিয়ে বললো, ওকে রুমে নিয়ে চল।
তাজ অবাক হয়ে বললো, আমি ?
এতকিছু ভাবার সময় নেই তাজ। মেয়েটা যেমনই হোক একজন মানুষ সে। এই অবস্থায় তো ফেলে রাখা মানুষের মতো কাজ হবে না। রাজিব ভাইকে একটা কল করুন তো, ইকবালের উদ্দেশ্যে বললো।
তাজ বাঁধ্য হয়ে তিতিরকে কোলে তুলে নিচের গেস্ট রুমের দিকে এগিয়ে গেলো। কিছুক্ষণের মধ্যে তাজদের ফ্যামিলি ডক্টর রাজিব হোসেন হাজির হলো।
তিতিরকে পরীক্ষা করে বললো, দেখে মনে হচ্ছে প্রচন্ড মানসিক চাপের মধ্যে আছে। বেশ কয়েকদিন ঠিকমতো খাওয়াদাওয়াও করেনি, শরীর একদমই দূর্বল। এভাবে চলতে থাকলে আরো অবণতি হবে, খারাপ কিছু হতে সময় লাগবে না। এই সময়ে তো আরো দিগুণ দেখাশোনার প্রয়োজন। নাহলে দুজনেরই ক্ষতি হবে।
তাজ তাকিয়ে আছে রাজিবের দিকে। একটা অন্তত আশা ছিলো, রাজিব হোসেন বুঝতে পারবে তিতির প্রেগনেন্ট নয়। সেই আশায় পানি ঢেলে দিলো। রাজিব কিছু মেডিসিন দিয়ে, তিতিরের খেয়াল রাখতে বলে চলে গেলো।
ইরিনা বললো, তাজ মেডিসিনগুলো আনানোর ব্যবস্থা কর।
তাজ বিরক্ত হয়ে বলো, সব নাটক।
ইরিনা শান্ত গলায় বললো, রাজিব ভাই আমাদের ফ্যামিলি ডক্টর। সে নিশ্চয়ই মিথ্যা কথা বলবে না।
তাজ অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো মায়ের দিকে। নিজের বাবা-মাই তাকে বিশ্বাস করতে পারছে না, এটা তাকে আরো বেশি কষ্ট দিচ্ছে। তিতিরের দিকে রক্তচক্ষু করে বের হয়ে গেলো রুম থেকে। মেয়েটার প্রতি ঘৃণা যেনো তাজের ধাপে ধাপে বেড়ে চলেছে।
চলবে,,,,