#বিষাক্তফুলের_আসক্তিপর্ব-১৮

0
444

#বিষাক্তফুলের_আসক্তিপর্ব-১৮
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা

ইকবাল তাকিয়ে আছে তাজের দিকে তার উত্তরের অপেক্ষায়।

তাজের চোখমুখ শক্ত হয়ে গেলো মুহুর্তে, বাবা আগে তুমি ঠিক করে নাও। ছেলেকে জীবিত দেখতে চাও নাকি মৃত। এক অপরাধবোধের বোঝা মাথায় নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরছি আমি। অনুশোচনার আগুনে পুড়ে ছাই হচ্ছি ক্ষণে ক্ষণে। আরো একটা অন্যায় করতে বললে দম বন্ধ হয়ে মারা যাবো। আর এটাও তুমি ভুলে যাচ্ছো তিতির আইনত এখনো আমার স্ত্রী।

মৌ কিছু না বুঝে বাবা আর ছেলের কথা শুনে যাচ্ছে তখনই দরজায় দাঁড়িয়ে কেউ বললো, মৌ।

মৌ সহ সবাই ফিরে তাকালো দরজার দিকে। এক সুদর্শন যুবক দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখে মৌয়ের কপালে বিরক্তির ছাপ দেখা দিলো।

তাজ বললো, আপনি কে ?

যুবক ভেতরে ঢুকে তাজের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে মুচকি হেসে বললো, আমি ডক্টর সুফিয়ান আহমেদ শান মৌয়ের হাসবেন্ড।

তাজ প্রথমে শকড হলেও পরে মুচকি হেসে হাত মিলিয়ে বললো, আমি,,,।

তাজকে কথা শেষ করতে দিলো না শান, আপনাকে দুই বাংলার কে না চেনে ? এতো ফেমাস অ্যাক্টর এন্ড সিঙ্গার।

তাজ মুচকি হেসে বললো, প্রাক্তন শব্দটা এড করতে ভুলে গেছেন মিস্টার শান।

ভুলিনি, তবে ইচ্ছে করেই এড করিনি। আপনাকে প্রাক্তন হিসাবে দেখতে চাইনি তাই।

তাজ সেদিকে কথা না বাড়িয়ে বললো, নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা। কী রে মৌ, বিয়ে করলি জানালি না ?

মৌ মাথা নিচু করে বললো, এক সপ্তাহ আগে আকদ হয়েছে। এখনো তেমন কেউ জানে না, পরে অনুষ্ঠান হলে সবাইকে জানাবে বাবা।

তাজ ঠোঁটের কোণে হাসিটা বজায় রেখে বললো, শুভকামনা।

মৌ চোখ তুলে তাকালে সবাই দেখতে পেত তার চোখের পানি। বাবা-মা বিষের বোতল হাতে নিয়ে বিয়ে করতে বাধ্য করেছে তাকে। মৌও তাদের একমাত্র সন্তান। কাল মাথার উপর থেকে বাবা-মার ছায়া সরে গেলে একা মেয়ে কীভাবে টিকে থাকবে এই পৃথিবীতে। মৌ কিছু না বলে বের হয়ে গেলো কেবিন থেকে।

শান তাজের দিকে তাকিয়ে বললো, আসছি বস, ভালো থাকবেন।

মৌ আর শান চলে যেতেই তাজ নিজের বাবার দিকে তাকালো। স্তব্ধ হয়ে বসে আছে ইকবাল। সে ঘুনাক্ষরে জানতেন না মৌয়ের বিয়ের ব্যাপারে।

ইকবাল কিছু বলবে তার আগেই তাজ বললো, ওয়েট আমার কথা আগে শুনে নাও। আজ তোমাকে একটা কথা স্পষ্ট জানিয়ে দিচ্ছি বাবা। আজকের পর যদি কখনো তুমি আমার বিয়ের ব্যাপারে কথা বলো তাহলে আর কখনো খুঁজে পাবে না আমাকে। আমাকে যদি আমার মতো থাকতে দাও তাহলে তোমাদের ছেড়ে কোথাও যাবো না। তোমার প্রবলেম ছিলো মৌ আমাকে ভালোবেসে নিজের জীবন নষ্ট করছে, এবার তো মৌ নিজের জীবন গুছিয়ে নিয়েছে। আমি আগেও মৌকে বিয়ে করতে চাইনি কারণ বন্ধু ছাড়া অন্যকিছু ভাবিনি ওকে। শুধু তোমাদের কথায় রাজি হয়েছিলাম কিন্তু আমি আর মৌ একে অপরের জন্য নই তাই আলাদা হওয়ারই ছিলো। এখন আমি শুধু তিতিরকে খুঁজে পেতে চাই আর তার কাছে ক্ষমা চাইবো। সে যদি আমার জীবনে ফিরতে চায় ফিরিয়ে নিবো আর যদি মুক্তি চায় মুক্তি দিবো। সে আমার জীবন যতটা নষ্ট করেছে, যাওয়ার আগে সেটা ঠিক করে দিয়েছে। কিন্তু আমি তার জীবন যতটা নষ্ট করেছি, আমি ঠিক করতে পারবো না। তাই তার কাছে ক্ষমা না চাওয়া পর্যন্ত আমার একটা মুহুর্ত শান্তিতে কাটবে না।

তাজ চলে গেলো কেবিন থেকে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো ইকবাল। সে চেনে নিজের ছেলেকে। একবার যেটা না বলে দিয়েছে সেটা তাকে দিয়ে আর করানো সম্ভব নয়।

ইকবাল বিড়বিড় করে বললো, তিতির মেয়েটা আমার ছেলের জীবনে একটা বিষাক্তফুল। যে চলে গিয়েও তার বিষের রেশ রেখে গেছে।

তাজ প্রচন্ড স্প্রিডে ড্রাইভ করছে। মনের অস্থিরতা কমানোর জন্য এমন করছে। বুকের ভেতরটা কেমন অস্থির অস্থির লাগছে তার। হঠাৎ তাজের দৃষ্টি ঝাপসা হলে সে চোখে হাত দিলো। তার চোখে নোনাজল কিন্তু কেনো ? তাজ অস্থির হয়ে এই নোনাজলের কারণ খুঁজতে লাগলো কিন্তু পেলো না। বারবার ফোন বেজে বিরক্ত করছে তাই গাড়ি এক সাইডে নিয়ে ফোন রিসিভ করলো।

স্যার রায়হান চৌধুরী আপনার সাথে দেখা করতে চাইছেন।

২২.
আহান বাইরে আসতেই দেখতে পেলো বিধস্ত দুটো মানুষ বসে আছে চেয়ারে৷ কী উত্তর দিবে আহান তাদের ?

পাখি দৌড়ে এসে আহানের সামনে দাঁড়ালো, আপুনি কোথায় আহান ? আমি আপুনির কাছে যাবো।

আহান অসহায় চোখে তাকালো পাখির দিকে, তোমার আপুনি তো ঘুমিয়ে পড়েছে পুতুল। তার ঘুম আর কখনো ভাঙবে না।

পাখি কিছু না বলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে আহানের দিকে। আহান কোলে থাকা ছোট্ট ধ্রুবকে পাখি দিকে এগিয়ে দিলো।

পুতুল তোমার আপুনি তোমাকে একটা জীবন্ত পুতুল দিয়ে গেছে তুমি নিবে ?

পাখি তাকালো ধ্রুবর দিকে মুহুর্তে হাসি ফোটে উঠলো পাখির মুখে। এক আঙ্গুল দিয়ে ধ্রুবকে ছুঁয়ে দেখে খিলখিল করে হেসে উঠলো সে। আহান টলমলে চোখে তাকিয়ে আছে পাখির দিকে। মেয়েটা যখন জানতে পারবে তার আপুনি আর কখনো ফিরে আসবে না তখন কীভাবে তাকে সামলাবে আহান ?

তুমি ওকে নিবে পুতুল ?

পাখি হাত বাড়িয়ে দিলো। আহান সাবধানে ধ্রুবকে পাখির কোলে দিলো। ধ্রুব এখন শান্ত হয়ে ঘুমাচ্ছে।

আহান বললো, ব্যাথা পাবে কিন্তু সাবধানে রাখবে।

পাখি ধ্রুবকে কোলে তুলে চেয়ারে চুপটি করে বসলো। সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ধ্রুবর মুখের দিকে। এবার ন্যান্সি এগিয়ে এলো আহানের দিকে। আহানের কাঁধে হাত রাখতেই বাচ্চাদের মতো কেঁদে দিলো আহান।

আমার তুতুলটা চলে গেলো মাম। ওকে ছাড়া আমি কীভাবে থাকবো এখন ? পুরনো ক্ষত কেবল শুকাতে শুরু করেছিলো কিন্তু এবার যে ক্ষত দিয়ে গেলো সেটা তো আর সারাজীবনেও শুকাবে না মাম।

ন্যান্সি ভেজা গলায় বললো, তিতির কথায় কথায় বলতো ওর যদি কিছু হয়ে যায় ওকে যেনো বাংলাদেশে ওর বাবা-মার কাছে কবর দেওয়া হয়। এই কথা শুনে আমি কত বকতাম আহান। আর আজ দেখো সত্যি চলে গেলো মেয়েটা।

তিতিরের লাশ হসপিটালের মর্গে রাখা হলো। বাংলাদেশে নেওয়ার সব ব্যবস্থা না করা পর্যন্ত এখানেই রাখা হবে। পাখিকে একবার দেখানো হয়েছে তার আপুনিকে। পাখি তিতিরকে ডাকতে গেলে আহান বলে তিতির ঘুমিয়ে আছে, ঘুম ভেঙে গেলে তার কষ্ট হবে। অবুঝ পাখি সেটাই বিশ্বাস করে নিয়েছে। সে নতুন একটা পুতুল পেয়েছে সেটা নিয়ে মেতে আছে। পুতুলটা নড়াচড়া করে, কাঁদে সব ভালো লাগে পাখির।

ধ্রুব আর পাখি ন্যান্সির কাছে আছে। ধ্রুব তিতিরের বানানো কাঁথায় ঘুমাচ্ছে আরামে। বাজারে পাওয়া পাউডার দুধ হয়েছে তার খাবার। সাদা বরফে ঢাকা লন্ডন শহর ঘুমিয়ে গেছে, ঘুম নেই আহানের চোখে। তিতিরের রুমে বসে আছে সে। এখনো সে চাইলেই দেখতে পারবে তার তুতুলের মুখটা কিন্তু দুদিন পর ? তিতিরের রুমের ছোট ছোট জিনিস ছুঁয়ে দেখছে আহান। টেবিলের উপর ডায়েরি দেখে থমকে গেলো কিছুটা সময়।

হাতে নিয়ে দেখলো উপরে জ্বলজ্বল করছে আমার ধ্রুবতারা লেখাটা। আহান হাত বুলালো লেখাটার উপর। ডায়েরির ভেতরে একটা কাগজ ভাজ করে রাখা, সেটা বের করলো আহান। ডায়েরিটা রেখে কাগজের ভাজ খুললো,

প্রিয় আহু
ডায়েরিটা লিখে প্রতিদিন এটা এখানেই রাখি সাথে এই চিঠি। যাতে হুট করে আমার কিছু হয়ে গেলে সহজে পেয়ে যাস। আজ এটা পড়ছিস মানে আমি তোদের থেকে অনেক অনেক দূরে চলে এসেছি। জানি তুই ভালো নেই তবুও বলবো কষ্ট পাস না প্লিজ। আহু রে মেয়েদের একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। সামনে থাকা ছেলেটা তাকে কোনো নজরে দেখে সেটা বুঝার অদ্ভুত ক্ষমতা। তুই আমাকে ভালোবাসিস সেটা আমি বুঝতে পেরেছি প্রথম দিকেই কিন্তু তুই যখন আমার জীবনে ফিরে এলি তখন এক ঝড়ে আমার জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেছে। মনে জায়গা দিয়ে ফেলেছি অন্য কাউকে, তুই আরো আগে কেনো ফিরে এলি না ? তোর জীবনেও আমি একটা স্বার্থপর প্রমাণিত হলাম। বিশ্বাস কর আমি বুঝেও না বুঝার ভান করতাম যাতে তুই কষ্ট কম পাস। তুই যদি এই কষ্টটা বুকে আগলে জীবনটা থমকে দিস তাহলে মরেও শান্তি পাবো না, নিজেকে দায়ী মনে করে। আমার বোনুটা যদি সুস্থ থাকতো তাহলে আমি বেঁচে থাকতেই ওর সাথে তোর বিয়ে দিতাম। কিন্তু ওকে তোর জীবনে চাপিয়ে দিয়ে তোর জীবনটা নষ্ট করার অধিকার আমার নেই। জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না আহু, তুইও এগিয়ে যা এতেই আমি খুশি হবো। শুধু এতটুকু অনুরোধ আমার দুটো প্রাণকে আগলে রাখিস। ধ্রুব তোর কাছে আমানত, যদি কোনোদিন ওর বাবা ওর কথা জেনে ফিরিয়ে নিতে আসে তবে তাকে আমার রেখে আসা উপহারটা দিস। যেটা আলমারিতে রাখা আছে একটা নীল রঙের ডায়েরি আর তোর সামনে রাখা ডায়েরিটা আমার জীবনের ধ্রুবতারা, আমার সন্তানের। তার ১৮তম জন্মদিনে এটা আমার তরফ থেকে তার উপহার। সেদিন সে সিদ্ধান্ত নিবে তার বাবার কাছে ফিরে যাবে, নাকি যাবে না। তবে তুই তাকে নিজের কাছে আমানত হিসাবেই রাখিস, যাতে ফিরিয়ে দিতে হলে আবার কষ্ট না হয়। জীবনটা এগিয়ে নিয়ে যাস আহু। একটা কথা মনে রাখিস,
“তোদের হাসিতেই আমার বাস।”

ইতি
তোর স্বার্থপর তুতুল

আহান নিজের ঝাপসা চোখ মুছে নিলো। চিঠিটা বুকে জড়িয়ে চুপ করে বসে রইলো কিছুটা সময়। টেবিলের উপর থেকে ধ্রুবতারা ডায়েরিটা হাতে নিলো। এগিয়ে গেলো আলমারির দিকে। খোলে সামনেই পেলো নীল রঙের ডায়েরিটা। এমন জায়গায় রেখেছে যাতে সহজেই পাওয়া যায়। নীল রঙের ডায়েরিটা হাতে তুলে নিতেই চোখে পড়লো উপরের জ্বলজ্বল করতে থাকা লেখাটা, “বিষাক্তফুলের আসক্তি”। ডায়েরি দু’টো বোধ হয় নিজে ডিজাইন করে অর্ডার দিয়ে বানিয়ে এনেছে তিতির। দেখে তেমনই মনে হলো আহানের। কত যত্নে আগলে রেখেছিলো তিতির। আহান দু’টো ডায়েরি নিয়ে নিজের রুমে ফিরে এলো। যত্ন করে তুলে রাখলো সেগুলো আর তার জন্য রেখে যাওয়া চিঠিটাও আলাদা করে তুলে রাখলো।

২৩.
বাবার অফিসে জয়েন করেছে তাজ। ইকবাল খান এখনো হসপিটালে তাই অফিসের জরুরি কাজে তাজকেই সিলেট আসতে হয়েছে। কাজ শেষ করে ফিরে যাচ্ছে আজই। এই সরু রাস্তায় দুটো গাড়ি পাশাপাশি একসাথে যেতে পারে না। তাজের গাড়ি আর একটা লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স মুখোমুখি দাঁড়ালো। অ্যাম্বুলেন্স দেখে তাজ নিজের গাড়ি একটু পিছিয়ে নিয়ে সাইড করলো। ধীর গতিতে পাশ কাটিয়ে চলতে লাগলো অ্যাম্বুলেন্সটা, পাশাপাশি হতেই তাজের বুকটা কেমন কেঁপে উঠলো। কেমন দম বন্ধ হয়ে আসছে, চিনচিনে ব্যাথা অনুভব হচ্ছে বুকের বা পাশটায়। তাজ তাকালো অ্যাম্বুলেন্সটার দিকে, কষ্টটা যেনো বাড়লো, কে জানে ভেতরে কার আপনজন শুয়ে আছে চিরনিদ্রায়। ভেতরে তিতিরের লাশের কফিনটা সামনে নিয়ে বসে আহান। সিলেট তিতিরের নিজের শহর, এখানেই আছে তার বাবা-মায়ের কবর। সেখানেই তাকে চিরশায়িত করতে যাচ্ছে আহান। তাজ যাকে পাগলের মতো খোঁজে ফিরছে মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরে শুয়ে আছে সে কিন্তু তাজ জানতেও পারলো না। অ্যাম্বুলেন্সটা চলে যেতেই তাজ হাসফাস করে নিজের গাড়ি ছুটালো।

চলবে,,,,

(দিতে চাইছিলাম না তবু দিলাম তাই দেরি হয়ে গেল। গতপর্বে সবার অনেক খারাপ লেগেছে হয়তো আজকের পর্বেও লাগবে। তবে এখন তিতিরকে বাঁচিয়ে দিলে বেখাপ্পা লাগবে। তাই আমি দুঃখিত, আমার পরপর দুটো গল্প স্যাড হয়ে গেলো। তবে আগামী গল্প অনেক রোমান্টিক আর হ্যাপি দিবো ইনশাআল্লাহ, সবাইকে কথা দিলাম। এটা যেভাবে ভেবেছি সেভাবে লিখি প্লিজ। আজ আর হ্যাপি রিডিং বললাম না, আল্লাহ হাফেজ।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here