#বিষাক্তফুলের_আসক্তি পর্ব-২১
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
ঝুম বৃষ্টিতে অন্ধকার রাত আরো নিকষকালো অন্ধকারে রুপ নিয়েছে। শীতকালের বৃষ্টি কারোই পছন্দ হওয়ার কথা নয়, তবে মৌয়ের ভালোই লাগছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি উপভোগ করছে সে, বাতাসের ঝাঁপটায় বৃষ্টির ছিটেফোঁটা গায়ে এসে লাগছে। পাতলা ফিনফিনে শাড়ি ভেদ করে ঢোকা ঠান্ডা বাতাসে শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। এতেও মন্দ লাগছে না। মৌ ঘুরে তাকালো রুমের দিকে। দুই বছরের ছোট্ট মেয়ে শায়িনীকে বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে শান। মৌ ভালো আছে, তার সংসার আজ পরিপূর্ণ তবু কোথাও রয়ে গেছে চাপা দীর্ঘ শ্বাস। সবার সামনের সুখী দাম্পত্য জীবনের আড়ালের এই দীর্ঘ শ্বাস কেউ দেখে না, শানও নয়। শান নিসন্দেহে একজন ভালো মানুষ, ভালো স্বামী আর ভালো বাবাও। মৌকে কখনো তার অতীত মনে করিয়ে দেয়নি বরং চেষ্টা করেছে তার ভালোবাসায় সব ভুলিয়ে দিতে। দিন শেষে মৌ মানিয়ে নিয়েছে নিয়তির সাথে। তার জীবনে তাজ নয় শানই ছিলো। তবে মাঝে তাজের আসাটা কী খুব জরুরি ছিলো ? ভাগ্য যখন শানের সাথেই জুড়ে ছিলো তাহলে তাজের জন্য মায়া কেনো তৈরি হলো মনে ? তাজের প্রতি তার ভালোবাসা কোনো আবেগ ছিলো না, সেটার প্রমাণ আজও একান্তে মৌয়ের মনে তাজের বিচরণ। মৌ জানে এটা পাপ, অন্যায় কিন্তু মন ? সেটা যে অবুঝ পাখি, খাঁচায় বন্দী রাখলেও ডানা ঝাঁপটে যন্ত্রণা দেয় আর মুক্ত করে দিলে উড়ে গিয়ে বসে নিষিদ্ধ গাছের ডালে। একান্ত সময়গুলো বড্ড যন্ত্রণায় কাটে মৌয়ের, জীবনের পূর্ণতার খাতায় একটা শূন্য অংশ সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে তাকে।
মৌ কালো মেঘে ঢাকা অন্ধকার আকাশের দিকে তাকালো, হে খোদা যার জন্য যাকে বানাও নাই তার জন্য মায়া কেনো দাও ? কেনো নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের এতো আকর্ষণ। আমি তো চাই আমার স্বামীকে মন প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতে। কিন্তু কোথায় যেনো তবু ফাঁকা থেকে যায়।
মৌ অনুভব করলো তার চোখ ভিজে উঠেছে। আজকের চোখের জল তাজকে না পাওয়ার নয়, তাজকে ভুলে শানকে পুরোপুরি ভালোবাসতে না পারার ব্যর্থতার। যে ব্যর্থতা কিছুতেই চায় না মৌ। এখন সে চায় তার মনে কেবল শানের রাজত্ব চলুক, শুধুমাত্র শানের। গায়ে কিছু মেলে দেওয়ায় শীত অনুভব না হলে মৌ নিজের দিকে তাকালো। একটা শাল জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তার গায়ে। মুহূর্তে একজোড়া হাত পেছন থেকে জড়িয়ে নিলো তাকে।
এই শীতের মধ্যে এখানে দাঁড়িয়ে কী করছো ?
বৃষ্টি বিলাশ করছিলাম।
চমকে উঠলো শান, তোমার গলা এমন শুনাচ্ছে কেনো মৌ ?
শান মৌকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে মুখটা উঁচু করে ধরলো। মৌয়ের চোখ ভেজা দেখে বুক ধক করে উঠলো শানের। এই চোখের পানি সহ্য হয় না তার।
ব্যস্ত গলায় বললো, কী হয়েছে বউ তুমি কাঁদছো কেনো ?
মৌ কিছু না বলে শানকে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো, আমি অনেক খারাপ তাই না ?
শান মুচকি হেসে নিজের বুকে জড়িয়ে নিলো মৌকে, কে বলেছে আমার বউ খারাপ কার এতবড় সাহস ?
মজা করবেন না শান।
আচ্ছা বাবা মজা করবো না। এখন বলো কী হয়েছে কাঁদছো কেনো ?
আপনি আমাকে এতো কেনো ভালোবাসেন ? আমি তো কত অপমান করেছি আপনাকে, কত অবহেলা করেছি, কষ্ট দিয়েছি।
নিজের প্রাণকে ভালো না বেছে থাকা যায় বলো ? আমি জীবনে কোনোদিন প্রেম করিনি, আমার সব ভালোবাসা আমার বউয়ের জন্য জমিয়ে রেখেছিলাম। এতো বছর ধরে যার জন্য ভালোবাসা জমিয়ে রেখেছি, তাকে ভালো না বাসলে কাকে ভালোবাসবো ?
কান্নার বেগ বাড়লো মৌয়ের, আমি যে আমার অতীত ভুলতে পারি না তবু।
দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো শান, অতীত ভুলা যায় না মৌ। প্রথম ভালোবাসা তো আরো ভুলা যায় না। কিন্তু অতীত আঁকড়ে কষ্ট পাওয়া বোকামি। আমাদের উচিত অতীতটাকে মনের এক কোণে সযত্নে লুকিয়ে রেখে বর্তমানটা উপভোগ করা। অতীত তুমি যত ভুলতে চাইবে তত বেশি মনে পড়বে। তাই সেটা ভুলতে চেষ্টা না করে বরং বর্তমানকে ভালোবাসার চেষ্টা করো মৌ।
মৌ শানকে শক্ত করে জড়িয়ে কাঁদতে লাগলো শান সেভাবে কিছু সময় থেকে বললো, রুমে চলো এখানে থাকলে ঠান্ডা লেগে যাবে শেষে মেয়েও কষ্ট করবে।
আর একটু থাকি না।
শান আর কিছু বললো না। মৌকে ভালো করে জড়িয়ে নিলো শাল দিয়ে। সেভাবেই বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলো দু’জন।
২৬.
প্রতি বছর এই দিনে সবাইকে নিয়ে বাংলাদেশে আসে আহান। সাতদিন এখানে থেকে ফিরে যায় নিজেদের ব্যস্ততম জীবনে। বাংলাদেশের মাটিতে পা রেখে একটা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো আহান। এই দেশের মাটিতে মিশে আছে তার আপনজন। ধ্রুব আর পাখি খুশীতে লাফাচ্ছে। ন্যান্সি তাদের দিকে তাকিয়ে আছে মলিন মুখে। দু’টোই যে অবুঝ তারা কী জানে এখানে এসেছে আনন্দ করতে নয়। হায় কপাল যদি বুঝতে পারতো।
সবাইকে নিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলো আহান। এখানে আসলে তার কষ্ট হয়, পুরানো ক্ষত তাজা হয়ে উঠে।
ধ্রুব আহানের দিকে তাকিয়ে বললো, পাপা আমরা কোথায় যাচ্ছি ?
এ নিয়ে একই প্রশ্ন অনেকবার করেছে ধ্রুব কিন্তু নিরব ভূমিকা পালন করেছে আহান। আজ তার কারো সাথেই কথা বলতে ভালো লাগছে না। আহান ধ্রুবকে নিয়ে ড্রাইভারের পাশের সীটে বসেছে আর পাখি, ন্যান্সি পিছনে।
আহান ধ্রুবকে বুকে জড়িয়ে বললো, তোমার মায়ের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি।
ধ্রুব গোল গোল চোখে তাকালো আহানের দিকে। তার কথার মানে বুঝতে পারেনি যে।
বেশ অনেকটা জার্নি করার পর কাংখিত জায়গায় পৌঁছে গেলো সবাই। ধ্রুব ঘুমিয়ে পড়েছে আহানের বুকে। তাকে কোলে নিয়ে গাড়ি থেকে নামলো আহান। পাখিও নেমে গেছে, আশপাশটা দেখছে সে। আহানকে দেখে দৌড়ে এগিয়ে এলো এক ভদ্রলোক।
স্যার আসতে কোন অসুবিধা হয়নি তো ?
আহান শান্ত গলায় বললো, নাহ। এদিকে সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে ?
জী স্যার সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে।
আহান তাকালো বাড়ির দিকে। এখন আর বাড়িটাকে কেউ ভূতের বাড়ি বলতে পারবে না। রঙচটা বাড়ি চকচক করছে নতুন রঙে, বাড়ির আঙিনা জঙ্গলের পরিবর্তে নানা প্রজাতির ফুলে রঙিন হয়ে উঠেছে। আহান তো আর তার তুতুলকে যেখানে রেখেছে সেখানকার প্রতি উদাসীন থাকতে পারে না। আহান কোনদিকে না তাকিয়ে সোজা কবরের দিকে পা বাড়ালো।
ন্যান্সির উদ্দেশ্যে বললো, পুতুলকে নিয়ে ভেতরে যাও মাম আমরা আসছি।
ন্যান্সি পাখিকে নিয়ে ভেতরে চলে গেলো। এতটা জার্নি করে পাখিও ক্লান্ত তাই সে আর কোনদিকে না তাকিয়ে ন্যান্সির সাথে চলে গেলো। আহান দিয়ে দাঁড়ালো কবরের সামনে, তার কোলে ঘুমন্ত ধ্রুব। বুকল ফুল পড়ে বিছিয়ে আছে কবরের উপর, বকুল ফুলের মিষ্টি সুবাস নাকে লাগছে।
কেমন আছিস তুতুল ? হয়তো ভালোই আছিস, ভালো থাকার জন্যই তো এভাবে চলে গেলি। আমি কিন্তু ভালো আছি, নিজের কথা রেখেছি। এই দেখ তোর ছেলে, কত বড় হয়ে গেছে। দু-হাতে আগলে বড় করছি, কখনো বাবা-মায়ের অভার বুঝতে দেয়নি আর কোনদিন দেবো না। আমি কিন্তু ধ্রুবর জীবন থেকে তোর পরিচয় মুছে দেয়নি। সবার সামনে ধ্রুব আমার ছেলে হলেও খাতা কলমে তোর ছেলে হয়েই আছে। মাম্মাম-পাপা হিসাবে আমাকে আর পাখিকে জানলেও বাবা-মা হিসাবে তোকে আর মিস্টার খানকে জানে। আহান চৌধুরীর ছেলে নয় বরং তাজওয়ার খান তাজ আর মুসকান মাহমুদ তিতিরের ছেলে তাহিয়ান খান ধ্রুব। আমি তোদের পরিচয়েই বড় করছি ওকে। কিন্তু একটা ভুল করে ফেলেছি রে। ভুলতে বসেছি ধ্রুব আমার কাছে আমানত, ওকে ফিরিয়ে দিতে হবে। ফিরিয়ে দিতে খুব কষ্ট হবে রে তিতির কিন্তু তুই চিন্তা করিস না। আমি আমার এই কথাও রাখবো যত কষ্টই হোক মিস্টার খান চাইলে দিয়ে দিবো তাকে তার ছেলে।
আহানের চোখের পানি ধ্রুবর ঘাড়ে পড়লে ঘুম ভাঙলো ধ্রুবর।
মুখ তুলে আহানের দিকে তাকিয়ে ছোট ছোট হাতে তার চোখ মুছে দেওয়ার চেষ্টা করে বললো, তোমার কী হয়েছে পাপা, তুমি কাঁদছো কেনো ?
ধ্রুবর কাজে চমকে উঠলো আহান। দ্রুত নিজের চোখ মুছে নিলো।
ধ্রুবর গালে কিস করে বললো, আমার কিছু হয়নি বাবাই। তোমার ঘুম ভেঙে গেছে পাপা সরি।
ধ্রুব আশেপাশে তাকালো, আমরা এখানে কী করছি পাপা ?
আহান ধ্রুবকে তিতিরের কবর দেখিয়ে বললো, তোমার মায়ের সাথে কথা বলতে এসেছি।
ধ্রুব কবরের দিকে একবার তাকিয়ে আহানের দিকে তাকালো, এখানে তো কেউ নেই পাপা।
আছে তো বাবাই, এখানে ঘুমিয়ে আছে তোমার মা। ঐ যে তোমাকে ছবিতে মা দেখালাম।
ধ্রুব কবরের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট গলায় বললো, মা।
বুক কেঁপে উঠলো আহানের। ধ্রুব কোন বাংলা স্পষ্ট বলতে পারে না। কিন্তু মা শব্দটা এতোটাই স্পষ্ট উচ্চারণ করলো আহানের বুক কেঁপে উঠলো শুনে।
আহান কাঁপা গলায় বললো, আবার বলো তো বাবাই, মা।
ধ্রুব আবারও বললো, মা উঠে না কেনো ? মায়ের ঘুম কখন ভাঙবে পাপা।
ধ্রুবকে বুকে জড়িয়ে চোখের পানি ছেড়ে দিলো আহান, মায়ের ঘুম আর কোনদিন ভাঙবে না বাবাই। নিজের জীবনের বিনিময়ে তোমার জীবন পেয়েছে তোমার মা, কখনো এই জীবন নষ্ট করো না বাবাই।
আহানের বড় বড় কথার মানে ধ্রুব বুঝতে পারলো না। তবে আহানের বুকের সাথে মিশে তাকিয়ে রইলো কবরের দিকে।
আহান মনে মনে বললো, ছেলের ডাকও কী শুনতে পাস না তুতুল ?
সিলেট বাংলাদেশের অন্যতম এক পর্যটন এলাকা। এখানেই একটা রিসোর্ট বানানোর পরিকল্পনা নিয়ে এসেছে তাজ। জায়গা দেখে তার মালিকের সাথে কথা বলে সব ঠিকঠাক করার জন্যই সিলেট আসা। তাছাড়া যান্ত্রিক জীবনের বাইরেও একটু সময় কাটানো হয়ে যাবে। মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে উঠে তাজ। মনে হয় ঘড়ির মতো একই নিয়মে চক্রাকারে ঘুরে চলেছে সে। এজন্যই বিজনেসটা সে প্রফেশন হিসাবে নিতে চায়নি প্রথম থেকে। দেশ বিদেশ ঘুরে শুটিং করে নতুন নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করার জন্যই সব ফেলে সেটাকে প্রফেশন হিসাবে নিয়েছিল। কিন্তু সেটাই জীবনের কাল হয়ে দাঁড়ালো তাজের।
দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে প্রকৃতি দেখায় মনোযোগ দিলো তাজ। ঢাকা শহরের দালানকোঠা আর ব্যস্ততম মানুষের ছুটে চলা দেখে দেখে চোখ দু’টোও ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।
চলবে,,,
[নোটঃ মাথা ব্যাথায় তাকাতেও কষ্ট হচ্ছে, আগে একটু লিখেছিলাম আর এখন একটু লিখলাম। আজ আর কেউ ছোট ছোট বইলেন না, দিতেই চাইছিলাম না তবু দিলাম]