#ফাগুন_প্রেমপর্বঃ ৬৩+৬৪

0
361

#ফাগুন_প্রেমপর্বঃ ৬৩+৬৪

লেখনীতেঃ Bornali Suhana
💛
💛
উনার এই হাড় জোড়া দেয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিলো না৷ তাই বাধ্য হয়েই আমাদের উনার পায়ের পাতা কেটে ফেলে দিতে হয়েছে। ডাক্তারের কথা শুনে শারমিন বেগম মাথায় হাত দিয়ে ফ্লোরে বসে পড়েন। বর্ণালীর মায়ের চিৎকারে আশেপাশের রুমের যত রোগী ছিলো, তাদের পরিবারের যতজন সদস্য ছিলো সবাই বেরিয়ে আসে। মায়ের এমন আহাজারিতে হাসপাতাল কাঁপছে।
“বর্ণরে আমি বেঁচে থাকতে কেন তোর এমন অবস্থা দেখতে হলো! আল্লাহ আমায় নিয়ে তোকে কেন সুস্থ করে দিলো না! আল্লাহ তুমি আমার নিষ্পাপ মেয়েটার সাথে কেন এমন করলে? আমার ইবাদতে কি কম রয়ে গিয়েছিলো আল্লাহ! আমার ফুলের টুকরো মেয়েটার কেন এমন ক্ষতি হলো! আল্লাহ!!!”
কারো চোখের জল বাঁধ মানছে না। মানবেই বা কীভাবে এমন একটা পরিস্থিতিতে পড়তে হবে কেউ ভাবেও নি। যারা কোন আত্মীয়ও না তাদের চোখেও জল। কিন্তু এই জল বেশিক্ষণের জন্য না। সবাই কিছুক্ষণ পর যার যার কেবিনে চলে যায়। শারমিন বেগমের কান্নার শব্দটা ধীরে ধীরে কমে আসে। ঈশার বুকে মাথাটা ছেড়ে দেন তিনি। সম্পূর্ণ শরীরের ভার ছেড়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। ইভান পিছ পা হতে লাগে, পিঠ দেয়ালের সাথে গিয়ে ঠেকে। ধীরে ধীরে ফ্লোরে বসে পড়ে। পা জোড়া ভাঁজ করে বুকের সাথে লাগিয়ে দু’হাতের ভেতর আটকে মুখ হাঁটুর উপর রাখে। জেনি ইভানের পাশে গিয়ে বসে কাঁধে হাত রাখে। ইভান মাথা তুলে তাকায় না। জেনি বুঝতে পারে ওর সম্পূর্ণ শরীর কাঁপছে। গরম হয়ে গেছে, মনে হচ্ছে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসছে। জেনি কয়েকবার তাকে ডাকে কিন্তু কোন সাড়া পায় না। নিরাশ হয়ে সেও চুপ করে পাশে বসে থাকে। সজিব শক্ত হয়ে বসেছিলো অনেকক্ষণ, মা জ্ঞান হারাতেই ছুটে এসে মাকে নিয়ে কোলে করে কেবিনে নিয়ে যায়। ডাক্তার তাঁকে স্যালাইন দিয়ে দেয়। হাবিব হাসানের সিগারেট নিভে ছাই ফ্লোরে পড়ছে। ওয়ার্ড বয় তাঁর কাছে গিয়ে বললো,
-স্যার হাসপাতালের ভেতর ধুমপান নিষেধ।
হাবিব হাসান সিগারেটের দিকে একবার তাকান তারপর ডাস্টবিনে ফেলে দিলেন। আবারো আগের জায়গায় বসে পা ঝাঁকাতে লাগলেন। সাহারা ইসলাম আইসিইউ এর দরজার কাছে গেলেন। দরজার ছোট গ্লাস দিয়ে বর্ণালীকে দেখার চেষ্টা করতেই ইভান চট করে উঠে পথ আগলে দাঁড়ায়। মাথা দু’দিকে নেড়ে বললো,
-না মা, তোমার ওকে দেখার অধিকার নেই। কি দেখছো ও বেঁচে আছে কিনা? ও বেঁচে আছে মা আর বেঁচে থাকবে কিন্তু জীবিত লাশ হয়ে বেঁচে থাকবে। তুমি যে ওর শরীরের একটা অংশ কেড়ে নিলে মা। আমার বাসন্তী উঠে প্রশ্ন করলে আমি কি জবাব দেবো মা? কি জবাব দেবো? ও কি এমন ক্ষতি করেছিলো মা? ভালোবাসা কি কোন পাপ মা? নাকি ও আমার বড় হয়ে জন্ম নিয়েছে এটা পাপ? আমরা তো কোন পাপ করিনি মা। কিসের ভিত্তিতে তুমি বললে সে আমাদের বাড়ির বউ হতে পারবে না? কোন সমাজ আছে যেখানে বলে ছোট-বড় বিয়ে করা যায় না? কোন ধর্মে কি বলা হয়েছে যে, বড়-ছোট বিয়ে করা যাবে না? তাহলে কেন মা? কেন? কেন এমন করলে? আজ তোমার ভুলের জন্য মা শুধু তোমার ভুলের জন্য ওকে সারাজীবন এভাবে থাকতে হবে। ইভান কাঁদতে কাঁদতে দরজার কাছেই নীচে বসে পড়ে। সাহারা ইসলামের চোখ দিয়ে জল টপটপ করে ঝরে পড়ছে। পা পেছনে নিয়ে নেন। ফারহান আহমেদের দিকে তাকিয়ে উনার দিকে এগিয়ে যান৷ ফারহান আহমেদ চোখ ফিরিয়ে নেন অন্যদিকে।
👇
একেকজন একেক জায়গায় বসে আছেন। কারো মুখেই কোন কথা নেই। ঈশা সবাইকে খাওয়াতে চায় কিন্তু কেউ খায় না। সজিবের ফোনের টোন বেজে উঠে, স্ক্রিনে তাকাতেই দেখে অপরিচিত একটা নাম্বার। ঈশা ওর মোবাইলের টাইম দেখে রাত ২টা বাজে। এতো রাতে কে কল দিলো! অবাক না হয়ে পারেনা ও।অজান্তেই মনের মাঝে প্রশ্ন আসে। কে কল দিলো?
সাহারা ইসলামকে শারমিন বেগমের পাশে রেখে সজিবের পেছনে যায়। ব্যালকনিতে গিয়ে ফোন রিসিভ করতেই সজিবের কানে যে কণ্ঠ আসে তা ওর ভেতরটাকে নাড়িয়ে দেয়।
-তুই?
– হ্যাঁ আমি।
-কোথায় তুই? কোন খবর নেই কেন তোর?
-বর্ণের কি হয়েছে সজিব?
সজিব কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। অনেকক্ষণ নিজেকে শক্ত করে রেখেছিলো আর পারলো না। রুমুর কাছে সে বরাবরই কোন কিছুই লোকাতে পারেনা। সে না বললেও রুমু বুঝে নেয়। একমাত্র ওর সাথেই কষ্টটা শেয়ার করতে পারে৷ রুমু বুঝে গেছে কোন একটা খারাপ খবর আছে।
-সজিব বল বলছি আমার জানের কিছু হলে আমি কাউকে ছাড়বো না। কি হয়েছে ওর? ও ঠিক আছে তো?
রুমু কেঁদে কেঁদে চিৎকার করে করে কথা বলছে। সজিব কিছু একটা ভাঙার শব্দ পায়। রুমু কিছু একটা ছুঁড়ে ফেলেছে।
-কি হলো? বলবি তুই? সজিব।
-রুমু, আ…..আমাদের বর্ণের ডান পায়ের পাতা কেটে ফেলে দিতে হয়েছে।
কথাটা বলতে সজিবের গলা ধরে এসেছিলো। রুমু কথাটা শোনা মাত্র ফোনটা কান থেকে পড়ে যায়। সজিব অনেকক্ষণ হ্যালো হ্যালো করে কিন্তু কোন উত্তর পায় না। কল কেটে চোখের জল মুছে পেছনে মুড়তেই ঈশাকে দেখে। ও কাছে যেতেই সজিব তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়। কেউ একজনের কাঁধে মাথা রেখে কান্না করাটা ওর খুব বেশি প্রয়োজন ছিলো ঈশা সেই মানুষ যার কাঁধে মাথা রেখে কান্নাটা আর ধরে রাখতে পারলো না। সজিবের চোখের জল ঈশার কাঁধ বেয়ে পড়ছে। চোখ খিঁচে বন্ধ করে ঈশা কান্না করছে। সজিবের কান্নার শব্দের কাছে ওর কান্নার শব্দ চেপে গেছে। হাত বুলিয়ে দিচ্ছে সজিবের পিঠে। সজিবের কান্না থেমে গেছে। ঈশা ওকে ছাড়িয়ে সোজা করে দাঁড় করায়। ওড়না দিয়ে সজিবের চোখ-মুখ মুছে দেয়।
-রুমু কল দিয়েছিলো।
-রুমু! ওকে বলেছো? ও কীভাবে জানলো?
-রুমুর ভাইকে আমি বলেছিলাম হয়তো সেখান থেকেই জেনেছে।
– ও কি আসছে?
-জানিনা, ফোনে আওয়াজ আসছিলো না।
-রুমু ওখানে একা নিজেকে কীভাবে সামলাচ্ছে আল্লাহ জানে!
ঈশা চোখ থেকে জল পড়ার আগেই মুছে ফেলে। সজিব ওকে শক্ত করে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে। সজিবের বুকে মাথা রেখে টি-শার্ট খামচে ধরে ঠোঁট কামড়ে কেঁদে দেয় ঈশা, সজিবও কাঁদছে। ঈশা ওর বুক থেকে মাথা তুলে সজিবের কপালে, দু’চোখের উপর, দু’গালে ঠোঁট দিয়ে ছুঁয়ে দেয়। সজিব চোখ বন্ধ করে ঈশার স্পর্শ অনুভব করছে। দু’গালে হাত রেখে কপালে কপাল ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ঈশা। সজিবের হাত ঈশার কোমড়ে রাখা। সজিব ওকে ছেড়ে দিতে গেলে ঈশা ওর টি-শার্ট ধরে আবারো কাছে টেনে নেয়। আলতো করে সজিবের ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়। নিশ্বাস থমকে গেছে দুজনের। সজিবের হাত ঈশার কোমড় আরো শক্ত করে চেপে ধরে। ঈশা ব্যথা পাচ্ছে কিন্তু সজিবকে এই মুহুর্তে শান্ত করতে হবে। কোন শব্দ না করে তার বুকে মাথাটা এলিয়ে দেয়।
👇
ইভান বর্ণালীর একটা হাত বুকের সাথে চেপে ধরে বসে আছে। ওকে কেবিনে পাঠানো হয়েছে। এখনও ঘুমে বর্ণালী, একবারের জন্যও চোখ খুলে নি। ইভান ওর হাতে বারবার চুমু খাচ্ছে। চোখের জল ওর হাত বেয়ে পড়ছে। সাহস হচ্ছে না একটাবার বর্ণালীর পায়ের উপর থেকে কাঁথাটা সরিয়ে দেখতে। অনেকক্ষণ ধরে এভাবেই চুপচাপ বসে আছে। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। হাত কাঁপছে ইভানের, প্রচন্ড ঘামছে। হাত দিয়ে মুখ মুছে কোন শব্দ না করে বর্ণালীর পায়ের পাশে চেয়ার টেনে বসে। কাঁথায় একবার হাত দিচ্ছে তো আবার সরিয়ে নিচ্ছে। চোখ বন্ধ করে লম্বা একটা নিশ্বাস নিয়ে সাহস সঞ্চয় করে পায়ের উপর থেকে কাঁথাটা সরায়। ব্যান্ডেজ করা কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ব্যান্ডেজের উপর আলতো করে চুমু খায় ইভান। ওর পা জড়িয়ে ধরে মাথা রাখে পায়ের পাশে।
-তোমার বসন্তপথিক তোমায় অনেক বেশি ভালোবাসে বাসন্তী। তোমায় সৌন্দর্য দেখে ভালোবাসেনি সে। তুমি যেমনই আমার তোমায় তেমনই চাই। আমার তুমিটা থাকলেই হলো বাসন্তী আমার আর কিচ্ছু চাই না, কিচ্ছু না। আমি তোমায় হারাতে দেবো না কখনোই।
ইভানের চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে অনবরত। বর্ণালীর পা জড়িয়ে ধরে চুপটি মেরে শুয়ে আছে। তার বাসন্তীকে সে কখনোই ছাড়বে না, কোন কিছুর মূল্যেই না। ভালোবাসার জন্য যা করতে হয় তাই করবে সে। প্রয়োজনে সে সারাজীবন তার বাসন্তীকে কোলে করে নিয়ে বেড়াবে তবুও ছাড়বে না।
#______চলবে…………

#ফাগুন_প্রেম
পর্বঃ ৬৪
লেখনীতেঃ Bornali Suhana
💛
💛
ইভানের চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে অনবরত। বর্ণালীর পা জড়িয়ে ধরে চুপটি মেরে শুয়ে আছে। তার বাসন্তীকে সে কখনোই ছাড়বে না, কোন কিছুর মূল্যেই না। ভালোবাসার জন্য যা করতে হয় তাই করবে সে। প্রয়োজনে সে সারাজীবন তার বাসন্তীকে কোলে করে নিয়ে বেড়াবে তবুও ছাড়বে না। সাহারা ইসলাম বাইরে থেকে ছেলেকে দেখছেন। বর্ণালীর মলিন মুখের উপর চোখ পড়তেই তার ভেতর কেঁপে ওঠে। আজকে এই ফুটফুটে মেয়ের এমন অবস্থা শুধুমাত্র তার জন্যই। মাথায় ব্যান্ডেজ, হাতে ব্যান্ডেজ, পায়ে ব্যান্ডেজ, পেটে ব্যান্ডেজ না জানি আর কত জায়গা কেটে গেছে ওর! চোখ দিয়ে জল পড়ছে।
-এমন না করলেও পারতে মা। আর করেই যখন দিয়েছো তো এখন কাঁদছো?
মেয়ের এমন প্রশ্নের জবাব কোন জবাব নেই সাহারা ইসলামের কাছে। ফারহান আহমেদ উঠে এসে বললেন,
-তোর মা কি আর ইচ্ছে করে এমন করেছে রে?
-বাবাই তুমিও এমনটা বলছো?
-তুমি চুপ করো ফারহান। হ্যাঁ আমারই সব দোষ। আজ আমার জন্যই আমার ছেলে-মেয়ে কষ্টে। আর এই ফুটফুটে সম্পূর্ণা মেয়েটা আজ আমার জন্যই অসম্পূর্ণা। আমি পাপী ফারহান আল্লাহ আমার পাপের শাস্তি আমার ছেলে -মেয়েকে দিচ্ছেন। তাদের এই কষ্ট দেখে আমার ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে শাস্তি আমিও পাচ্ছি।
ঈশা আর মায়ের সামনে দাঁড়ায় না, চলে যায় শারমিন বেগমের কাছে। এখনও তাঁর স্যালাইন চলছে। পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগে। সজিব অন্যপাশে মায়ের পায়ের কাছে বসে আছে।
অনেকটা সময় চলে গেছে। সবার মাঝে একটা নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে।
বর্ণালী পিটপিট করে তাকায়। মাথাটা অনেক ধরেছে৷ অনেকটা অংশ ফেটে গিয়েছিলো মাথার। মাথায় হাত দিতেই বর্ণালী বুঝতে পারে ব্যান্ডেজ করা। গতদিনের কথা মনে করতে চেষ্টা করে। আমি এখানে কেন? কি হয়েছিলো আমার সাথে? নাহ মনে পড়ছে না কেন আমার? জোর দিয়ে ভাবতে লাগে বর্ণালী। অনেকক্ষণ চোখ বন্ধ করার পর মনে পড়ে গতদিনের কথা। এক্সিডেন্টের কথা মনে হতেই শোয়া থেকে উঠে বসে। কলিজাটা যেন ছিড়েই যাচ্ছিলো। এক্সিডেন্টের সেই মুহুর্তে বর্ণালীর মনে হচ্ছিলো ও এই পৃথিবীর বুক থেকে পাড়ি জমাবে। ইচ্ছে করছিলো শেষবারের মতো ইভানকে একটাবার ছুঁয়ে দিতে, মায়ের কোলে মাথা রাখতে, ভাইয়ার বাইকে চড়তে, বাবার চশমাটা মুছে দিতে, রুমুকে একটাবার দেখতে, ঈশার সাথে কথা বলতে। মনে হচ্ছিলো সব ইচ্ছেই অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। কিন্তু না আল্লাহ সহায় থাকলে সবকিছুই সম্ভব। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছেন তাকে৷ সামনে চোখ যেতেই দেখে ওর পা জড়িয়ে ধরে ইভান শুয়ে আছে। ইভানের দিকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ৷ হঠাৎ করে চোখ পড়ে নিজের পায়ের দিকে। নিজের মনে প্রশ্ন আসে, “আমার পায়ে ব্যান্ডেজ কেন?”
বর্ণালী আলতো করে ইভানের হাত সরিয়ে বিছানায় রাখে। পায়ের মাঝে কেন যেন ও পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছে। ধীরে ধীরে কাঁথার নীচ থেকে বাম পা বের করে। পার্থক্য অবলোকন করে দু’টো পায়ের মাঝে। ভয়ে ওর আত্মা কেঁপে উঠে। গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না, আটকে গেছে কোথাও। বারবার গুঙিয়ে গুঙিয়ে কাঁদছে আর বলছে, “নাহ, নাহ, নাহ।”
হঠাৎ করে মুখ দিয়ে চিৎকার বের হয়ে আসে, “নাআ……..”।
ইভান ধরফরিয়ে উঠে বসে৷ বর্ণালীর পায়ের উপর কাঁথাটা টেনে দিয়ে ওর দু’গালে আলতো করে হাত রাখে৷
-হুস! শান্ত হও বাসন্তী।
বাইরে থেকে সবাই বর্ণালীর চিৎকার শুনে কেবিনের ভেতর আসেন।
-আ…..আমার পা, আমার পা কি হয়েছে? কি হয়েছে আমার পায়ের? সরো ইভান আমায় দেখতে দেও। আমার পায়ে কি হয়েছে?
একদিকে ইভান বর্ণালীকে আটকানোর চেষ্টা করছে অন্যদিকে ঈশা, সজিব, ফারহান আহমেদ, সাহারা ইসলাম হাবিব হাসান, সবাই মিলে ওকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। ও কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না। ডাক্তার এসে শান্ত করার জন্য ইঞ্জেকশন দিয়ে দেয়। বর্ণালী নাহ, নাহ বলে চোখ বন্ধ করে নেয়। ঈশা ওর মাথাটা আলতো করে বালিশে রাখে। ওড়না দিয়ে চোখের কোণের জল মুছে দেয়। ঈশা ও ইভান ছাড়া সবাই ভেজা চোখে কেবিন থেকে বের হয়ে যায়। ডাক্তার তাদেরকেও যেতে বলে কিন্তু কেউ যেতে চায় না। ইভান আবারো বর্ণালীর পা জড়িয়ে মাথাটা এলিয়ে দেয় ওর পাশেই। ঈশা ওর মাথার পাশে বসে আছে।
👇
গভীর ঘুমে আছন্ন পুরো হাসপাতাল। পাখির কিচিরমিচির শব্দ এসে বর্ণালীর কানে লাগছে। আধবোজা চোখ দুটো জানালার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। মাত্র আধো আধো মিষ্টি আলো ছড়িয়েছে চারদিকে। সকাল যতটা মিষ্টি এই দিন ততোটাই তেতো। আজকের দিনটা বর্ণালীর কাছে অনেক দীর্ঘ হবে। একটু নড়তেই মাথা, পা ও শরীরের বিভিন্ন অংশে ব্যথা অনুভব করে। কেবিনের উপর চোখ বুলাতেই দেখে ওর মাথার একপাশে ঈশা অন্যপাশে সজিব আর ইভান ওর একটা পা জড়িয়ে শুয়ে আছে। ইভান ওকে ছাড়বে না কোনদিনও আর সেটা আজকে তার কাছে পানির মতো পরিষ্কার। পায়ের উপর থেকে ইভানের হাত সরিয়ে আলতো করে বিছানা থেকে পা নামায়। দু’টো পায়ের মাঝে বিশাল পার্থক্য আজ। একটা পা সম্পূর্ণ আর আরেকটা পা অসম্পূর্ণ। যে বর্ণালীর কোন খুঁত ছিলো না, আজ তার অঙ্গহানি সবচেয়ে বড় খুঁত হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইভানের দিকে নিষ্পলক চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে আলতো করে চুলের উপর চুমু এঁকে দেয়। “অনেকটা পথ চলার ছিলো একসাথে কিন্তু খোদা হয়তো তা আমাদের কপালে লিখেন নি। তোমার ভাগ্য হয়তো অন্য কারো সাথে আমার সাথে না।”
এসব কথা ভেবে ওর কান্না পাচ্ছে না, পাবার কোন কারণও নেই। কেননা তার ভালোবাসা আজ সার্থক। ভালোবাসার সুখের জন্য অনেক সময় ভালোবাসাটা ত্যাগ করতে হয়। আর আজ বর্ণালী তাই করবে। আজকে রুমুর কথা ভীষণ মনে পড়ছে। রুমুর আর ওর ভাগ্য কি আল্লাহ এক কলমেই লিখেছেন নাকি! হ্যাঁ হয়তো। সজিবের চুলে হাত বুলিয়ে কয়েক ফোটা চোখেরজল ফেলে। “ভাইয়া আর কাকে ডাকবি স্বরবর্ণ! ব্যঞ্জনবর্ণ! আমিও যে আর তোকে ভাইয়া বলে ডেকে মনটা শান্ত করতে পারবো না।”
হাতের উল্টো পাশ দিয়ে চোখের জল মুছে নেয়। পা ফ্লোরে ফেলতে ভয় পাচ্ছে বর্ণালী। ও কি হাঁটতে পারবে! ভয়ে ভয়ে ফ্লোরে বাম পা রাখে। ডান পা ফ্লোরে ঠেকায়। পা প্রচন্ড কাঁপছে। পায়ের উপর শরীরের ভর ছাড়তে ভয় পাচ্ছে। চোখ বন্ধ করে দীর্ঘ একটা নিশ্বাস নিয়ে শরীরের ভর ছেড়ে দেয়। হ্যাঁ ও দাঁড়াতে পেরেছে। চোখের কোণে জল আর ঠোঁটের কোণে আলতো হাসি ফোটে ওঠে। এবার ওর হাঁটার পালা। প্রথম পা এগুতেই ব্যথায় কুঁকড়ে যায়। এক হাত দিয়ে মুখ চেপে অন্য হাতে বিছানায় ভর দেয়। ঘা এখনো তাজা তাই ব্যথাটাও বেশি। টপটপ করে চোখ দিয়ে জল পড়ছে। কিন্তু তাকে ভেঙে পড়লে চলবে না। সামনে এগুতেই হবে। এ কদম থামালে চলবে না তার। এক পা দু’পা করে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে বর্ণালী। ভ্রু কুঁচকে ঠোঁটজোড়া চেপে কষ্টটাকে কম করার চেষ্টা করছে। ঈশার পাশে এসে কপালের কোণে চুমু এঁকে দেয়। “আর তোদের সুখের সংসার দেখা হবে না, হবেনা তোদের সাথে খুনসুটি, আর হবেনা তোর ভাবী ডাক শোনা।”
একটা শব্দও মুখ দিয়ে বের করে না। কথাগুলো মনের ভেতরই দাফন দিয়ে দিলো। কথা বললেই ওরা জেগে যাবে আর জেগে গেলে হয়তো বর্ণালী তার সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারবে না। পেছন ঘুরে গুটি গুটি পায়ে কেবিন থেকে বের হয় বর্ণালী। বাইরে মা ছাড়া সম্পূর্ণ পরিবারকে দেখতে পায়। বাবার পা ধরে সালাম করে। “বাবা অনেক ভালোবাসি, কখনো বলা হয়নি আর না বলাই থেকে গেলো। তোমার এই মেয়ে তোমার থেকে ভালোবাসাটা আর পেলোই না। মেয়ে হয়ে জন্ম নেয়া কি আমার পাপ ছিলো বাবা? প্রশ্নটা আর করা হবে না তোমায়। ইনশাআল্লাহ ভাইয়া তোমাদের খেয়াল রাখবে।”
সাহারা বেগম ও ফারহান আহমেদকে সালাম করে ঠোঁট ভেঙে কেঁদে দেয়।
“ক্ষমা করে দিবেন, আপনাদের সুখের সংসারে আমি দুঃখের একটা স্মৃতি হয়ে থেকে যাবো। আসবো না কখনো বাঁধা হয়ে আপনাদের সামনে।”
শারমিন বেগমকে খুঁজতে লেগে গেলো বর্ণালী। কয়েকটা কেবিনে উঁকি দিতেই পেয়ে যায়। কেবিনে ঢুকে মায়ের বালিশে মাথা রাখে। এক হাতে জড়িয়ে ধরে। “জানি আমার জন্যই তোমার এমন অবস্থা মা। তোমার আঁচল যে মেয়ে ছাড়েনি আজ সে মেয়ে তোমার থেকে অনেক দূরে যাচ্ছে মা। দোয়া রেখো আর নিজের খেয়াল রেখো।”
আলতো করে মায়ের গালে চুমু এঁকে দেয়। নাহ আর দেরি করা যাবেনা। আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে চারিদিকে। ধীরে ধীরে পা বাড়ায় বর্ণালী অজানার পথে। ও জানেনা এই পথের গন্তব্য কোথায়। পা থেকে রক্ত ঝরছে সেদিকে ভ্রুক্ষেপহীন হয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে যাচ্ছে। রাস্তায় নামতেই দেখতে পায় রক্তিম সূর্য উঁকি দিয়েছে। সবকিছু ঠিকই আছে শুধু বদলে গেছে ওর জীবন। মৃদু হেসে এগিয়ে গিয়ে সিএনজি ধরে ড্রাইভারকে একটা ঠিকানা বলে। ড্রাইভার সেদিকেই যাচ্ছে। কিন্তু ওর কাছে গাড়িভাড়া নেই কি করবে তাও ভাবেনি। একটা বিল্ডিংয়ের সামনে এসে গাড়ি থেকে নেমে ড্রাইভারকে বলে দাঁড়াতে। প্রায় ২০মিনিট পর ফিরে এসে আবারো সিএনজিতে উঠে বলে স্টেশন যেতে।
হাতের মুঠোয় রাখা মোবাইল আর টাকার দিকে কিছুক্ষণ তাকায়। ব্যবস্থা হয়ে গেছে ওর। আর কোন সমস্যা নেই। স্টেশনে এসে গাড়ি ভাড়া মিটিয়ে ট্রেনের টিকেট কাটতে যায়। জীবনের প্রথম খালি পায় হাঁটছে। বাম পায়ের তলায় ব্যথা পাচ্ছে কিন্তু থামবে না সে। ৫মিনিটের রাস্তা ১০মিনিটে যাচ্ছে। টিকেট কেটে পেছনে তাকাতেই ভেজা চোখে আবারো অশ্রুপাত হয় বর্ণালীর। চোখের সামনে যাকে দেখছে সে শুধু একজন মানুষ নয় নিজের ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছে তার মাঝে। ও এগিয়ে যাওয়ার আগেই সেই মানুষটা তাকে জড়িয়ে ধরে। না কোন প্রশ্ন করে না কেউ কোন উত্তর দেয় চুপচাপ ট্রেনে চেপে বসে দুজন। ট্রেন চলছে তার গতিবেগে আর তাদের গন্তব্য সিলেট।
#______চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here