#বিষাক্তফুলের_আসক্তিপর্ব-১১
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
আহান দ্রুত ফোন রিসিভ করে বললো, কোনো ইনফরমেশন পেয়েছিস ?
ওপাশ থেকে উত্তর এলো, ভাই ঢাকা শহর মোটেও ছোট জায়গা নয়। প্রায় ২ কোটি ১০ লাখ মানুষ বাস করে এই ঢাকা শহরে। এখানে একটা নাম আর একটা ছবি দিয়ে কাউকে খোঁজা মানে খড়ের গাদায় সূঁচ খোঁজার মতো। তুই মেয়েটার পুরো নামও জানিস না, কীভাবে খোঁজে পাবো ?
আসলে ভাইয়া যখন পাখিকে এখানে রেখে যায় আমি ওর উপর প্রচন্ড বিরক্ত ছিলাম তাই কিছু জানার আগ্রহ দেখায়নি। এখন যদি ভাইয়াকে কিছু জিজ্ঞেস করি সন্দেহ করতে পারে।
তুই মেয়েটার পাসপোর্ট খোঁজে বার কর। সেখানে অনেক তথ্য পাবি আশা করি।
আরে ইয়ার এটা তো আমার মাথাতেই আসেনি।
তোর মাথায় তো এখন শুধু পাখি উড়ছে তাই আসেনি। এখন বাজে না বকে পাসপোর্ট খোঁজে দেখ, আরো কিছু জানতে পারিস কিনা।
ঠিক আছে।
আহান কল কেটে পাখির রুমের দিকে গেলো পাসপোর্ট খোঁজে বার করতে। পাসপোর্ট পেলে অনেক কিছুই জানা যাবে। তিতিরের সারা রুম তন্নতন্ন করে খোঁজে কিছুই পেলো না। হতাশ হয়ে বসে পড়লো আহান। একটা সূত্র পাওয়ার আশা করেছিলো সেটাও ব্যর্থ হলো।
১৩.
নিজের কেবিন এলোমেলো করে কিছু খুঁজছে রায়হান। জিনিসটা যে তার কাছে অনেক বেশি দামী। কতগুলো বছর ধরে সেটা আগলে রেখেছে সে। আজ কীভাবে হারিয়ে গেলো, ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে তার। মৌ রায়হানের কেবিনের দরজায় দাঁড়িয়ে তার অস্থিরতা দেখছে।
কিছু সময় পর শান্ত গলায় বললো, এটা খুঁজছিস রায়হান ?
মৌয়ের আওয়াজে চমকে পিছনে ফিরে তাকালো রায়হান। মৌয়ের হাতে কাংখিত জিনিস দেখে ঠোঁটের কোণে হাসি ফোটে উঠলো। দ্রুত পায়ে মৌয়ের কাছে এসে জিনিসকে নিজের হাতে নিয়ে নিলো।
হাসি মুখে বললো, এটাই তো খুজছিলাম। তুই এটা কোথায় পেলি ?
মৌ স্বাভাবিক গলায় বললো, তিতিরের বেডে পরে ছিলো।
রঙ বদলে গেলো রায়হানের চেহারার। ভীত চোখে তাকালো মৌয়ের দিকে।
মৌ চেয়ার টেনে বসে রায়হানের দিকে তাকিয়ে বললো, একই রকমের দুটো কলম কিনেছিলাম আজ থেকে তাও কয়েক বছর আগে। একটা তোকে দিয়েছিলাম আর একটা তাজকে। দেওয়ার দুদিনের মাথায় তাজের কলমটা হারিয়ে ফেললেও তোর বুক পকেটে সবসময় কলমটা আমি দেখেছি এতবছর ধরে। কিন্তু আজ সেটা তিতিরের বেডে গেলো কীভাবে বল তো ?
রায়হান কী উত্তর দিবে ভেবে পাচ্ছে না। মনে মনে সাজাতে লাগলো কী বলে এই পরিস্থিতি থেকে বের হবে।
মৌ আবার বললো, প্রথমদিন তোকে দেখে তিতিরের ভয় পাওয়া আমার সন্দেহ তৈরি করে। আমি খেয়াল করেছি তিতির তোকে প্রচন্ড ভয় পাচ্ছিলো। আজও দেখলাম ডুকরে কাঁদছে মেয়েটা আর বেডে পরে থাকতে দেখলাম তোর কলম। এবার বল তিতিরের সাথে তোর কী সম্পর্ক ?
রায়হান আমতা আমতা করে বললো, তুই ভুল বুঝছিস মৌ। তিতিরের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।
মৌ কঠিন গলায় বললো, সত্যিটা বল রায়হান। আমার সাথে মিথ্যা বললে তার ফল ভালো হবে না।
রায়হান এবার স্বাভাবিক গলায় বললো, তিতির আমার মামাতো বোন।
মৌ অবাক চোখে তাকালো রায়হানের দিকে। যদি বোনই হয় তাহলে পরিচয় দিতে এতো সংকোচ কেনো রায়হানের আর তিতির ভয় কেনো পাচ্ছে নিজের ভাইকে।
মৌ সন্দেহাতীত ভাবে বললো, তিতির যদি তোর বোন হয় তাহলে ও ভয় কেনো পাচ্ছে তোকে আর তুই পরিচয় কেনো দিতে চাইছিলি না।
রায়হান নিজের চেয়ারে বসে বললো, তিতির ছোটবেলা থেকেই ভয় পায় আমাকে। মাঝে অনেক বছর যোগাযোগ ছিলো না তাই ভয়টা বেড়েছে হয়তো।
তিতির কাঁদছিলো কেনো তুই ওর কাছে যাওয়ার পর।
সেটা আমি জানি না।
মিথ্যা বলবি না রায়হান।
আমি কোনো মিথ্যা বলছি না। জানি না কেনো কাঁদছিলো তিতির।
এদিকে থম মেরে বসে আছে তাজ। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না তার।
ভাঙা গলায় গার্ড তারেকের উদ্দেশ্যে বললো, তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে তারেক।
তারেক দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, আমার কোথাও ভুল হচ্ছে না স্যার। নাম্বারটা আমার বন্ধু রায়হান চৌধুরী ইউজ করছে জেনে বারবার চেক করেছি কিন্তু বরাবরই এক ফলাফল।
তাজ বিধস্ত গলায় বললো, রায়হান আমার সেই ছোটবেলার বন্ধু। ও কেনো আমার সাথে এমনটা করবে তারেক ?
তারেক দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, এটুকু জেনেই ভেঙে পড়েছেন স্যার ? বাকিটা কীভাবে সহ্য করবেন তাহলে ?
তাজ হতাশ দৃষ্টিতে তাকালো তারেকের দিকে, আর কী বাকি আছে তারেক ? আমার জীবনে প্রিয় বন্ধুর তালিকায় দুজন মানুষ আছে। তাদের একজন আমার এতবড় ক্ষতি করলো, বিশ্বাসঘাতকতা করলো আর কী বাকি আছে ?
স্যার, আপনার বন্ধু দিনের আলোতে একজন দয়াবান ডক্টর আর রাতের অন্ধকারে জেগে উঠে তার আরেক রুপ।
মানে কী বলতে চাইছো ?
যে হসপিটালে রায়হান চৌধুরী আছে, গরীব অসহায় মানুষদের অল্প ব্যয়ে চিকিৎসা দিয়ে সবার সামনে মহৎ সাজে তারা। রাতের অন্ধকারে জেগে উঠে সেই হসপিটালের আরেকটা রুপ। সেটা সবার চোখের আড়ালে।
তুমি কী বলতে চাইছো, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না তারেক।
ঐ হসপিটালের রাতের অন্ধকারে একটা নোংরা রহস্য লুকিয়ে আছে স্যার। আমাদের কাছে প্রমাণ নেই, তবে এসব সত্যি। আপনি চাইলেই রায়হানের সাথে পেরে উঠবেন না। সে অন্ধকারে নিজের একটা রাজত্ব তৈরি করেছে। সেখানে কেবল তারই রাজ চলে। স্যার আমাদের যা করতে হবে ঠান্ডা মাথায় করতে হবে। তাড়াহুড়ো করলে কেবল বিপদ বাড়বে।
তাজ কিছু ভাবতে পারছে না। সে এতবড় ধাক্কা সামলাতে পারছে না। বন্ধু যদি শত্রু হয়ে তাহলে সেটা অনেক ভয়ংকর হয়ে দাঁড়ায়। কারণ তার জানা থাকে আপনার প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্য সকল বিষয়ে।
তাজ টলমল পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, আমি কিছু ভাবতে পারছি না তারেক।
তারেক আশ্বস্ত করে বললো, স্যার ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করুন। রায়হান চৌধুরী কেনো আপনাকে নিজের শত্রু মনে করে একটু চিন্তা করলেই আপনি বুঝতে পারবেন। একটু চেষ্টা করুন, বুঝার।
তাজ এলোমেলো পায়ে নিজের গাড়ির দিকে গেলো। কোনরকমে বাড়ি পৌছে সোজা ওয়াশরুমে চলে গেলো। শাওয়ার ছেড়ে নিচে দাঁড়িয়ে পড়লো। চোখের সামনে ভেসে উঠলো তাদের এত বছরের বন্ধুত্ব।
রাজ তুই কেনো কম্পিটিশন থেকে নাম কেটে দিয়েছিস ?
আমাকে রাজ বলবি না। আমার নাম রাজ নয়, রায়হান।
তাজ বিরক্ত হয়ে বললো, এতবড় নাম বলতে ভালো লাগে না আমার। তাই তো কত সুন্দর করে আমার নামের সাথে মিলিয়ে তোর নাম রেখেছি রাজ। তাজ আর রাজ কত সুন্দর মিলে গেছে।
রাজ আর কিছু না বলে চুপ করে রইলো। আজ তাদের স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। তাজ আর রাজ দুজনেই কম্পিটিশনে নাম দিয়েছিলো। দুজনের গানের গলায় অনেক ভালো আবার অভিনয়ও করবে একটা নাটকে। তারা সহপাঠীরা মিলে একটা নাটক করবে আজ। কিন্তু শেষ মুহূর্তে রাজ নিজের নাম কেটে দিয়েছে।
তাজ বললো, এখন বল নাম কেটে দিয়েছিস কেনো ?
আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই।
তুই কত কষ্ট করে রিয়ার্সেল করেছিলি। এখন এসে এমন বলছিস কেনো ?
তোর কাজ তুই কর গিয়ে, আমাকে নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না।
রাজ হনহনিয়ে চলে গেলো তাজের সামনে থেকে। তাজ হা করে তাকিয়ে আছে রাজের যাওয়ার পানে। রাজ এখন সবসময় তার সাথে এমন রেগে থাকে কেনো বুঝে উঠে না তাজ। যেদিন থেকে মৌ তাজকে প্রপোজ করেছে সেদিন থেকে অদ্ভুত আচরণ করছে তাজ। তাজ আর বেশি না ভেবে নিজের কাজে চলে গেলো। একটু পরেই অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যাবে।
রাজ স্কুলের পেছন দিকে পুকুরপাড়ে গিয়ে বসলো। কিছুক্ষণ পর সেখানে উপস্থিত হলো স্কুল ড্রেস পরা কিউট একটা মেয়ে।
রাজের পাশে বসে বললো, তুই রাগ করেছিস রাজ ?
আমার নাম রাজ নয় রায়হান।
এতদিন তো রাজ বলেই ডাকতাম আমরা।
এখন থেকে রায়হান বলে ডাকবি। রাজ রাজ বলে মাথা নষ্ট করবি না।
মৌ কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, তুই রাগ করেছিস আমার উপর। ঠিক আছে যা তুই কম্পিটিশনে পার্টিসিপেট কর, আমি কিছু বলবো না।
মৌ উঠে চলে আসতে গেলে রাজ হাত টেনে ধরলো তার, তোর মুখের হাসি দেখার জন্য এতো কষ্ট করার পরও কম্পিটিশন থেকে সরে এলাম তাও এমন করে কাঁদবি ?
তুই তো রেগে আছিস, কাঁদবো না কী করবো, নাচবো ?
রাজ মুচকি হেসে বললো, তুই তো নাচতেই পারিস না।
মৌ নাক ফুলিয়ে তাকালো রাজের দিকে। রাজ নাক টেনে দিলো মৌয়ের। এই মেয়েটাকে খুশি করতেই রাজ নিজের নাম সরিয়ে নিয়েছে।
মৌ রাজের পাশে বসে বললো, আসলে তাজ অনেক কষ্ট করেছে এই কম্পিটিশনে জেতার জন্য। এই কম্পিটিশনে জিতে গেলে আন্টি একটা গিটার কিনে দিবে বলেছে। তাজের সবচেয়ে বড় কম্পিটিটর তুই, কারণ স্কুলে তোরা দু’জনই সবচেয়ে ভালো গান গাইতে পারিস আর অভিনয় করতে পারিস। তাই তোকে বলেছি নাম কেটে দিতে। প্লিজ রাগ করসি না তুই। তুই তো আমার বন্ধু না ?
রাজ মনে মনে বললো, তাজের কষ্টটা তুই দেখলি আর আমারটা দেখলি না। আমিও কী কম কষ্ট করেছি এই কম্পিটিশন জেতার জন্য ? আজ শুধুমাত্র তোর হাসিমুখ দেখার জন্য সরে এলাম। তোর জন্য আমি সব করতে পারি মৌমাছি আর তুই তাজের জন্য।
শেষের কথাটা মনে মনে আওড়ে তাচ্ছিল্যে হাসলো রায়হান।
রুমে ফোনটা তখন থেকে বেজে চলেছে। ফোনের আওয়াজে বর্তমানে ফিরে এলো তাজ। মৌয়ের কথায় রাজ সরে গিয়েছিলো, সেটা অনেক পরে জানতে পারে তাজ। সেই কম্পিটিশন অনেকটা বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় জিতে যায় তাজ। কিন্তু সব জানার পর সেই জিতে কোন আনন্দ খোঁজে পায়নি সে৷ মৌকে অনেক বকেছিস এর জন্য। মৌ তাজের জন্য সব করতে রাজি ছিলো তো, রাজ মৌয়ের জন্য সব করতে রাজি। দশম শ্রেণিতেই মৌ প্রথম তাজকে প্রপোজ করেছিলো কিন্তু তাজ মজা ভেবে উড়িয়ে দেয় আর রাজের ব্যবহার পরিবর্তন হতে থাকে তখন থেকে। তাজের সাথে দুরত্ব বাড়তে থাকে। এভাবে চলতে থাকে তাদের জীবন। মৌ অনেকবার গোপনে তাজের পথ থেকে সরিয়ে এনেছে রাজকে। তাজ সেটা কোনো না কোনোভাবে পরে জেনেও গেছে।
তাজ বিড়বিড় করে বললো, সেসবের প্রতিশোধ নিতেই কী রায়হানের এই পদক্ষেপ। সেসব তো ছোটবেলার বাচ্চামি ভেবে কবেই ভুলে গেছি আমি। রায়হান কী সে সবই পোষে রেখেছে নিজের মনে ? কিন্তু পরে তো রায়হান নিজের ইচ্ছায় মৌয়ের সাথে মেডিক্যালে পড়েছে আর আমি বিজনেস। এই সবকিছুর উত্তর কেবল রায়হানের কাছেই আছে।
চলবে,,,