#_ফাগুন_প্রেমপর্বঃ ৬১+৬২
লেখনীতেঃ Bornali Suhana
💛
💛
বর্ণালীর এখন খেয়াল হয় ও তো রাত্রে ইভানের সাথে চ্যাট করতে করতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলো। কথাটা মনে হতেই মনটা খারাপ হয়ে গেছে ওর। চোখে জল টলমল করছে। ইভান সারারাত জেগে ওর অপেক্ষা করছিলো আর সে কিনা ঘুমাচ্ছিলো। কিন্তু সে তো জানতোই না ইভান তাকে আসতে বলেছে। জানলে অবশ্যই আসতো। বর্ণালী চোখের জল মুছে বললো,
-তুমি আমার মেসেজের রিপ্লে না পেয়ে কেন এখানে আসলে?
-আরেহ! এখন আমার দোষ না? কি মেয়েরে বাবা! চ্যাট করতে করতে কেউ এভাবে ঘুমায়?
-আমি কি করতাম! আমার ঘুম কখন, কীভাবে আসছে আমি নিজেই জানিনা।
-আচ্ছা ঠিকাছে বাদ দাও।
-সরি ইভান, আমার জন্য তোমাকে সারারাত অপেক্ষা করতে করতে এখানেই ঘুমাতে হলো।
ইভান দোলনা থেকে নেমে ফ্লোরে বসে পড়ে ওর সামনে। বর্ণালীর দুটো হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,
-ইট’স ওকে তো, তুমি তো আর জানতে না যে আমি তোমায় আসতে বলেছি আর তোমার জন্য এখানে অপেক্ষা করছি। জানলে তো অবশ্যই আসতে। আমার ভুল হইছে আগে তোমার রিপ্লে এর অপেক্ষা করা প্রয়োজন ছিলো।
বর্ণালী ইভানের সামনে ফ্লোরে বসে যায়। এখনও সূর্যটা দেখা যাচ্ছে না। সকালের আকাশটা খানিকটা মেঘলা থাকায় সূর্যটা ঢাকা পড়ে গেছে। বর্ণালীকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে ইভান ধীরে করে বললো,
-হেই সুইটহার্ট! এভাবে চুপ করে থাকলে তোমায় খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে হয়।
বর্ণালী হেসে দিয়ে বললো,
-তো কে না করেছে? খেয়ে ফেলো….
বর্ণালী কথাটা শেষ করার আগেই ইভান তার মুখ বন্ধ করে দেয়। ওর ঠোঁটের উপর তার ঠোঁট অবস্থান করছে। হুট করেই এমন কিছু হবে ভাবেও নি। ইভান ওর কোমড়ে হাত দিয়ে আরো কাছে টেনে নেয়। নিজের অবস্থান ঠিক রাখতে না পেরে বর্ণালী ইভানের বুকের উপর লুটিয়ে পড়ে আর ইভান ফ্লোরে গিয়ে পড়ে। পিঠে কিছু একটার আঘাত পেতেই কাৎ হয়ে বর্ণালীকে ফ্লোরে শুইয়ে দেয়। ছোট ছোট চুলগুলো বর্ণালীর মুখের উপর এসে পড়েছে। ঠোঁটের চলনের সাথে চুলগুলো বর্ণালীর মুখের একপাশ থেকে অন্যপাশে যাচ্ছে। কেমন সুড়সুড়ি লাগছে ওর কিন্তু আবেশে একহাতে জড়িয়ে ধরে তার পিঠের উপর হাত দিয়ে খামচে ধরে। আলতো করে ইভানের হাত ওর কোমড়ের পাশ দিয়ে উপরের দিকে উঠতে লাগে। এসব স্পর্শই বর্ণালীকে ভেতর থেকে কাঁপিয়ে তুলছে। ঠোঁটের চলন আরো গভীর হচ্ছে। ইভানের ঘাড়ের উপরের চুলগুলো একহাতে মুঠোয় নিয়ে নেয়। ঠোঁট ছেড়ে গলায় নিয়ে মুখ ডুবিয়ে নানারকম স্পর্শে মাতোয়ারা করে দিচ্ছে বর্ণালীকে। নিজেকে ধরে রাখতে পারছে না ও, কষ্ট হচ্ছে। খুব করে কাছে না পাওয়ার কষ্ট এটা। ওর এই মুহুর্তে ইচ্ছে করছে এই পাগলটার ঘরে সত্যি সত্যি বিয়ে করে বউ সেজে আসতে। ইভানের হাতের স্পর্শ ওর উন্মুক্ত পিঠের উপর পায়। এক সম্পূর্ণ শরীরের রক্ত যেন দ্রুত বইতে শুরু করে। নিশ্বাস প্রবলভাবে ঘন হয়ে এসেছে। ইভানের মাথার ছোট ছোট চুলগুলো ওর নিশ্বাসের সাথে লেগে সরে যাচ্ছে মুখের উপর থেকে আবারো সেই নিশ্বাস নেয়ার সাথে ফিরে আসছে নিজের অবস্থানে। খোঁচা খোঁচা দাড়ি বর্ণালীর গলার আশেপাশে এসে ঠিক যেন কাটার মতো লাগছে৷ ব্যথায় উহ করে আওয়াজ হতেই ইভান মাথা তুলে বর্ণালীর মুখের দিকে তাকায়। চোখ কুঁচকে বন্ধ করে আছে। ঠোঁটজোড়া মুখের ভেতর পুরে নিয়েছে। হাতটা আলতো করে তার উন্মুক্ত পিঠ থেকে বের করে আনে। গালের উপর রেখে চাপ দিতেই ঠোঁটজোড়া ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে। ইভান নিজের মুখের ভেতর ওর ঠোঁট পুরে নেয়। কিছুক্ষণের জন্য যেন দুজনের নিশ্বাস থমকে যায়। বাতাস শা শা শব্দ করে বইছে। দুজনের শরীর ছুঁয়ে দিতেই শিউরে উঠছে। আলতো করে ওর ঠোঁট ছেড়ে ফ্লোরে পিঠ ঠেকিয়ে শুয়ে পড়ে ইভান। আবারো পিঠে কিছু লাগতে দেখে একটা পাথর। পাথরটা হাতে নিয়ে শুয়ে পড়ে। বর্ণালী হাত-পা গুটিয়ে অন্যপাশে ফিরে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকে। ইভান ওকে টান দিয়ে নিজের বুকের উপর এনে শুইয়ে দেয়। তুমি এখানে ঘুমাবে সবসময় অন্য কোথাও না।
ও কোন কথা না বলেই মাথা তুলে ইভানের গলায় চুমু এঁকে দেয়। বুকের উপর মাথা রাখতে যাবে তখনই ছাঁদের সিঁড়ির দরজায় চোখ পড়ে ওর কারো ছায়া যেন দেখতে পায়। মনে হচ্ছে এখানে কেউ দাঁড়িয়ে ছিলো। সন্দেহ সত্যি হলে কি হবে! যদি আসলেই কেউ দেখে থাকে ওদের এই অবস্থায়! তাহলে কী হবে!
বর্ণালী ইভানের হাত ছাড়িয়ে ওর বুকের উপর থেকে উঠে সোজা হয়ে বসে চুল, জামা, ওড়না ঠিক করতে লাগে। ইভানও উঠে বসে বললো,
-কী হলো?
-কিছুনা, আমি নিচে যাচ্ছি তুমি কিছুক্ষণ পর নিচে নেমে সোজা তোমার রুমে চলে যেও।
-আচ্ছা! কেন?
বর্ণালী ইভানের গাল টেনে দিয়ে বললো,
-আমি বলেছি তাই।
উঠতে যাবে তখনই ইভান ওর হাত ধরে ফেলে। বর্ণালী ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-কী হলো?
-কিছুনা।
-তাহলে?
ইভান আলতো অরে বর্ণালীর বুকে চুমু দেয়। সাথে সাথে ও চোখ বন্ধ করে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে দ্রুত সিঁড়ির পানে হাঁটতে শুরু করে। ইভান আবারো পেছন ডেকে বললো,
-ভালোবাসি বাসন্তী।
বর্ণালী হেসে হেসে দ্রুত পায়ে নিচে নামছে। সিঁড়ি পাড় করে নিচে নামতেই ঠাস করে ওর গালে একটা থাপ্পড় পড়ে। হুট করে গালে এতো জোরে চড় পড়তেই বর্ণালী নিজের অবস্থান ঠিক রাখতে পারেনা। সিঁড়ির উপর গিয়ে চিৎ হয়ে পড়ে। চোখে ঝাপসা দেখছে ও। মাথা তুলে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। কোনদিকে তাকাবে বুঝতে পারছে না। কয়েকবার চোখ খুলে আবার বন্ধ করে গালে হাত দিয়ে মাথা সোজা করে উপরের দিকে তাকায়।
-মা……হ!
-মুখ দিয়ে যে শব্দ বের করেছো তা মুখের ভেতরই রেখে দাও।
-আন্টি আপনি!
-কি খুব অবাক হচ্ছো আমাকে এখানে দেখে? আমার ঘরে আমি যেখানে সেখানে যাবো কিন্তু তুমি! তুমি এখানে কী করছো? এটা তো তোমার ঘর না যে তুমি যেখানে সেখানে যাবে।
বর্ণালীর হাত পা কাঁপছে। ওর সামনে ইভানের মা মিসেস সাহারা ইসলাম দাঁড়িয়ে আছেন। তার মানে ও ভুল দেখেনি। যার ছায়া দেখেছিলো সে আর কেউ না ইভানের মা ছিলেন। বর্ণালী সিঁড়ি থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
-আসলে আন্টি,
-চুপ, একদম চুপ। লজ্জা করেনা নিজের চাইতে ছোট ছেলের সাথে এভাবে মেলামেশা করতে? ছিঃ ছিঃ আমার বাচ্চা ছেলেটাকে নষ্ট করে দিচ্ছো। এসবই শিখেছো? এই তুমি না টিচার? এসব বাচ্চা ছেলেদের কি ক্লাসে এসবই শিখাও? আরে না তোমাকে তো স্কুল থেকে বের করে দিয়েছে শুনেছিলাম। তাহলে লোকেদের কথাই সত্যি আমি আরো বিশ্বাস করিনি।সাহারা বেগম কপালে হাত দিয়ে চোখ বড় বড় করে লম্বা নিশ্বাস নিয়ে আবারো বলতে লাগলেন,
-আল্লাহ! কি ভুলটাই না করেছি। তোমার নামের যতটা খারাপ কথা শুনেছি তাহলে সব সঠিক। তোমাকে কলেজের কোন একটা বাচ্চা ছেলের সাথে একদিন আপত্তিকর অবস্থায় দেখে স্কুল থেকে বের করে দিয়েছে এটাও সঠিক তাই না? এখন এসেছো আমার ছেলেকে ফাঁসাতে? আরে পৃথিবীতে আর ছেলে পেলে না? আমার অবুঝ বাচ্চাটাকেই কেন? তোমার জন্য কি নিজের থেকে বড় নাহলে তোমার সমবয়সী ছেলের অভাব পড়েছে? পড়লে বলো আমরা তোমার জন্য ছেলে খুঁজে বিয়ে করিয়ে দিবো তাও ভালো, স্ট্যান্ডার্ড পরিবারে।
বর্ণালীর চোখ থেকে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে। নীচের দিকে অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে আছে সে। চোখের জলের গতি একনাগাড়ে পড়ে যাচ্ছে। যা ভয় করছিলো তাই সত্যি হতে চলেছে। আজকে সেই বয়সের ব্যবধানটা এসেই গেলো তাদের সম্পর্কের মাঝে। চোখের পানি নীরবে ফেলে ভাঙা ভাঙা গলায় বললো,
-আন্টি আপনি,
-শোন মেয়ে, পরিষ্কারভাবে শুনে রাখো কথাটা মাথায় গেঁথে নিও, আমি আমার মুখের ভাষা তোমার জন্য কটু বা খারাপ করতে চাচ্ছি না। তবে হ্যাঁ আজকের পর আমি তোমাকে আমার মেয়ের ননদ হিসেবেই যেন দেখি আমার ছেলের বউ হিসেবে নয়।
কথাটা বলেই সাহারা বেগম হনহন করে সেখান থেকে চলে যান। বিরবির করে হাজারো গালি দিচ্ছেন বর্ণালীকে। যে গালিগুলো সাহারা ইসলাম চোখের আড়াল হওয়ার আগপর্যন্ত বর্ণালী শুনতে পারছিলো।
💛
💛
#______চলবে……….
#_ফাগুন_প্রেম
পর্বঃ ৬২
লেখনীতেঃ Bornali Suhana
💛
💛
বিরবির করে হাজারো গালি দিচ্ছেন বর্ণালীকে। যে গালিগুলো সাহারা ইসলাম চোখের আড়াল হওয়ার আগপর্যন্ত বর্ণালী শুনতে পারছিলো। ওর পা সামনে এগোচ্ছে না। কানে এখনও কথাগুলো বাজছে। ইভান দ্রুত পায়ে ওর সামনে দিয়ে বাতাসের বেগে চলে গেলো। বর্ণালী মুহুর্তের মধ্যে কি হয়ে গেলো বুঝতেই পারছে না। তাহলে কি ইভান সব শুনে ফেলেছে? নিজের সন্দেহ দূর করতে ইভানের পিছু যায়। ইভান তার মায়ের রুমের সামনে গিয়ে সাহারা ইসলামকে ডাকতে লাগলো,
-মা, মা বাইরে এসো।
বর্ণালী দূরে দাঁড়িয়ে আছে যা সন্দেহ করছিলো তাই হচ্ছে, ইভান সব শুনেছে। সাহারা ইসলাম রুমের বাইরে এসে ছেলেকে দেখে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন,
-কি হয়েছে আমার বাবুর?
-বর্ণালীকে আমি ভালোবাসি।
-আচ্ছা তো?
-তুমি ওর সম্পর্কে না জেনে কীভাবে ওই কথাগুলো বলতে পারলে? একবারও কি খোঁজ নিয়েছো ওর সম্পর্কে? কীভাবে এতো বাজে কথা বলতে পারলে মা?
সাহারা বেগম পেছনে তাকিয়ে দেখলেন বর্ণালী চুপচাপ খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে। মৃদু হেসে বললেন,
-বাহ! আমার ছেলের মাথা এতোটাই খেয়েছো যে সে এখন আমার সামনে এভাবে দাঁড়িয়ে কথা বলছে!
-মা!!!! চুপ করো বলছি। বর্ণালী সম্পর্কে একটা বাজে কথাও বলবে না।
ইভানের চিৎকার শুনে সবাই এসে যায়। বর্ণালী দৌড়ে গিয়ে ইভানকে আটকাতে চেষ্টা করে। ওর রাগ উঠলে উল্টাপাল্টা কাজ করবে। ইভানের একটা হাত ধরে বললো,
-ইভান, চুপ করো। মায়ের সাথে এভাবে কথা বলো না। উনি মা যা ইচ্ছে বলতে পারেন। আমাদের কাজ চুপচাপ শুনে যাওয়া।
-তুমি চুপ করে শুনতে পারো আমি না।
-প্লিজ ইভান, এই কথাটা অন্তত শুনো।
ইভান রাগে দাঁত খিঁচিয়ে কিছু বলতে চেয়েও বলেনা। ইভানের মা তখনই বললেন,
-ইভানকে কন্ট্রোল করা তাহলে ভালোই শিখে গেছো?
-আন্টি!
-মা! প্লিজ আমাকে ভুল কিছু বলতে বা করতে বাধ্য করো না।
বর্ণালী চোখ দিয়ে অনবরত জল গড়িয়ে পড়ছে। ঈশা বর্ণালীর কাঁধে হাত রেখে বললো,
-মা কার সম্পর্কে কি বলছো ভেবে বলছো তো?
-ও যদি তোর ননদ হয়েই এখানে থাকতো তাহলে আমার ভালোবাসা ও আদর দুটোই পেতো কিন্তু ও এ বাড়ির বউ হতে চাচ্ছে তাহলে কি আমার ভুলাটা স্বাভাবিক না?
-মা তুমি কি চাও আমি আর এ বাড়িতে না আসি?
বর্ণালী ঈশার হাত ধরে থামিয়ে বললো,
-ঈশা প্লিজ তুই চুপ কর। আন্টি আমি চলে যাচ্ছি। আপনার ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই। আমি আর কখনোই এ বাড়িতে আসবো না। ঈশার ননদ হিসেবেও না আর আপনার পুত্রবধূ হিসেবেও না।
কথাটা বলেই বর্ণালী দরজার দিকে দৌড় দেয়। দরজার কাছে যেতেই সজিব ও ইভানের বাবা ফারহান আহমেদের সাথে দেখা হয়। সজিব ওর এমন অবস্থা দেখে ঘাবড়ে যায়। দু’বাহু ধরে জিজ্ঞেস করলো,
-বর্ণ কি হয়েছে তোর? এই বর্ণ এভাবে কাঁদছিস কেন?
সজিবের কথার কোন উত্তর না দিয়ে চোখের জল মুছে নেয় ও। নীচের দিকে তাকিয়ে আছে। ফারহান আহমেদ বর্ণালীর মুখ তুলে জিজ্ঞেস করলেন,
-কি হয়েছে প্রিন্সেস? কাঁদছো কেন?
-কিছু হয়নি ভাইয়া, কিছুই না আংকেল। ভাইয়া আমি বাসায় যাচ্ছি।
-বাসায় যাচ্ছি মানে কি? কি হয়েছে তোর? -কি হয়েছে আমি বলছি।
ঈশা পেছন থেকে কথাটা বলে একবার মায়ের দিকে তাকিয়ে সজিবের কাছে আসে। সজিব ঈশার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-কি হয়েছে ঈশা?
-ঈশা তুই কিচ্ছু বলবি না। ভাইয়া আমি গেলাম।
বর্ণালী আর এক মুহুর্তের জন্যও দাঁড়ায় না, দৌড় দিয়ে বেরিয়ে যায়। ইভান পেছন থেকে ওকে ডাকে কিন্তু কোন সাড়া দেয় না। ইভানও ওর পিছু পিছু বেরিয়ে যায়। ঈশা সজিবকে আর ফারহান আহমেদকে সব খুলে বলে।
সজিবের চোখে জল জমে গেছে। তার অনুপস্থিতিতে তার কলিজার টুকরো বোনের এতো বড় অপমান করা হয়েছে এ বাড়িতে। আর এখানে এক মুহুর্তও থাকা সম্ভব না। সজিব ঈশার একটা হাত ধরে বললো,
-যেখানে আমার বোনের অপমান করা হয়েছে আমি সেখানে থাকবো না। তুমি কি আমার সাথে যাবে নাকি এখানেই থাকবে? মনে রেখো এখানে আজকেই শেষ দিন আর আসা হবে না। ভেবে উত্তর দিও।
ঈশা সজিবের চোখের দিকেই তাকিয়ে বললো,
-মেয়েদের বিয়ের পর তাদের আসল ঠিকানা স্বামীর ঘর, বাবার ঘর না।
ফারহান আহমেদ সজিবের কাঁধে হাত রেখে বললেন,
-দেখো বাবা, আমি বিষয়টা বুঝেছি তোমরা এভাবে নিও না। এটাকে আমরা বসে সমাধান করতে পারি। আমি বেঁচে থাকতে আমার কোন সন্তানের খুশির বাইরে কিছুই হতে দিবো না।
এতোক্ষণে সাহারা ইসলাম এগিয়ে এসে বললেন,
-যা জানোনা তা নিয়ে কথা বলো না। আমার ছেলেকে এনে দাও, সে বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছে।
-সাহারা চুপ করো, আমার ছেলের কিছু হলে এই বাড়িতে কিচ্ছু থাকবে না। আমি ওর খুশি যেভাবে সেভাবেই কাজ করবো। বাবা সজিব তুমি প্লিজ শান্ত হও।
আনমনে বাড়ির ভেতরের রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছে বর্ণালী। কানে ইভানের মায়ের কথাগুলো বারবার বাজছে। চোখের জল থামার কোন নাম গন্ধ নেই। পায়ের গতি হুট করেই যেন বেড়ে গেছে ওর। ইভান পিছু পিছু দৌড়ে আসছে। আর কিছুক্ষণ গেলেই বর্ণালী ওদের বাসা ছেড়ে মেইন রাস্তায় উঠে যাবে। ইভান ওকে এসে যেইনা আটকাবে তখনই কোথাও থেকে একটা গাড়ি এসে বর্ণালীকে ধাক্কা দিয়ে দেয়। ছিটকে গিয়ে রাস্তার মাঝে পড়ে যায় সে। অন্যদিক থেকে আরেকটা গাড়ি এসে বর্ণালীর পায়ের উপর দিয়ে চলে যায়।
-বাসন্তী……………
ইভানের চিৎকার যেন সম্পূর্ণ জায়গাটা কাঁপিয়ে দেয়। বাসার ভেতর থেকে সবাই দৌড়ে আসে। আশেপাশের মানুষ জড় হয়ে যায়। বর্ণালী পিটপিট করে ইভানের দিকে তাকিয়ে হাত বাড়ায়। ও দৌড়ে গিয়ে বর্ণালীর মাথাটা কোলের উপর নেয়।
-বাসন্তী, এই বাসন্তী কি হয়েছে তোমার? দেখো চোখ বন্ধ করবে না একদম কেমন? এই যে আমি আছি তোমার পাশে। ইস কত রক্ত বের হচ্ছে! কেন এভাবে রাস্তাতে এলে?
ইভান আজেবাজে কথা বলেই যাচ্ছে। সজিব এসে বর্ণালীর রক্তমাখা শরীর দেখে রাস্তায় ওর পায়ের পাশে বসে পড়ে। ঈশা সজিবের দু’বাহুতে হাত রেখে ধাক্কা দেয়।
-সজিব এই সজিব কথা বলো, দেখো বর্ণালীকে।
-হুঁ! বর্ণ! কি হয়েছে ওর!
সজিব বর্ণালীর দু’গালে হাত রাখে।
-বর্ণ এই বর্ণ কথা বল পাখির ছানা। ভাইয়ার সাথে কথা বল না। চোখ বন্ধ করবি না একদম। দেখ, আমি আর তোকে কখনোই স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ বলে ডাকবো না সোনাপাখি।
সজিব পাগলের মতো আচরণ করতে শুরু করেছে। জেনি চট করে হসপিটালে কল দিয়ে এম্বুল্যান্স ডাকে। ইভানের বাবা এম্বুল্যান্সের অপেক্ষা না করে নিজের গাড়ি বের করেন। ইভান পাগলের মতো তখনও প্রলাপ করতেই আছে। সাহারা বেগম সেই তখন থেকেই চুপ। কোন কথা বলছেন না তিনি। বুকের ভেতরে যেন কেমন একটা কষ্ট চাপ দিয়ে বসেছে। উনার হাত-পা কাঁপছে। ফারহান আহমেদ ইভানের কাঁধে হাত রেখে বললেন,
-ইভু উঠ বাবু, প্রিন্সেসকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
ইভান ডান হাতের শার্টের হাতের উল্টোপাশ দিয়ে চোখের জল মুছে বর্ণালীকে কোলে তুলে নিতে যাবে তখনই সজিব কোলে তুলে নেয়। ফারহান আহমেদ গাড়ির দরজা খুলে দিতেই ঈশা জেনি আর নিধি পেছনে উঠে সজিব ওদের কোলে বর্ণালীকে রাখে। সজিব সামনে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসে ফারহান আহমেদ ইভানকে সামনে সজিবের পাশে তুলে বসান। দীপুকে বলে অন্য গাড়ি বের করান।
-তুমি কি হাসপাতালে যাবে?
ফারহান সাহেবের কথা যেনো তাঁর কানে লাগছেই না। ধ্যান ধরে তিনি এখনও রাস্তায় ছড়িয়ে থাকা লাল তাজা রক্তের দিকে তাকিয়ে আছেন। এই লাল রক্তটা কিছুক্ষণ পরই কালো রঙ ধারণ করবে। ফারহান আহমেদ এখন খানিকটা ধমকের স্বরে বললেন,
-কী হলো? তুমি যাবে হাসপাতালে? নাকি এখানেই ভূতের মতো দাঁড়িয়ে থাকবে?
-হুঁ!
সাহারা ইসলাম চমকে উঠেন! গড়িয়ে যাওয়া রক্তের দিকে আরেকবার তাকান তারপর ফারহান আহমেদের দিকে তাকিয়ে ধীর পায়ে গাড়িতে গিয়ে উঠেন। তার শরীর ঠান্ডা হয়ে এসেছে৷
👇
ইভান, সজিবের শার্টে আর ঈশা, জেনি ও নিধির ড্রেসে রক্তের ছাপ বসে গেছে। প্রচুর পরিমাণে রক্ত ঝড়ে গেছে। বর্ণালীকে আইসিইউতে চিকিৎসায় রাখা হয়েছে। কিছুক্ষণ পর পর নার্স ওয়ার্ডবয় আসা যাওয়া করছে। প্রায় ২৫মিনিটের মতো হয়ে গেছে বর্ণালীকে ডাক্তাররা দেখছে। নার্স যতবার বের হচ্ছে ততবারই ইভান গিয়ে জিজ্ঞেস করছে “ওর কিছু হয় নি তো? ও ঠিকাছে?” নার্স বারবার একই উত্তর দিচ্ছে, “চিন্তা করবেন না আল্লাহর কাছে দোয়া করুন। উনার অবস্থা ক্রিটিক্যাল, প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়ে গেছে। কিন্তু আল্লাহ চাইলে সব পারেন।”
আইসিইউ এর বাইরে সবাই চেয়ারে বসে আছে। ইভান দরজার পাশে ফ্লোরে বসে আছে। সাহারা ইসলাম শারমিন বেগমের পাশে বসে আছেন। শান্তনা দেয়ার মতো তার কোন ভাষা জানা নেই। আজকে বর্ণালীর এমন অবস্থার জন্য কোন না কোনভাবে তিনি নিজেই দায়ী। তার মাঝে অপরাধবোধটা কাজ করছে।
ডাক্তার নার্সের সাথে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে আসে। ইভান ফ্লোর থেকে উঠে দাঁড়ায়। শুধুমাত্র বর্ণালীর বাবা হাবিব হাসান ছাড়া সবাই বসা থেকে উঠে দাঁড়ান। শারমিন বেগম শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছে ডাক্তারের কাছে আসেন।
-ও….. কেমন আছে ডাক্তার সাহেব?
-আলহামদুলিল্লাহ সে সুস্থ আছে আর বাকিটা তো জানেনই। আল্লাহর হুকুম আমাদের কিছুই করার ছিলো না।
সজিবের কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়লো। বাকিটা মানে কি বুঝালেন ডাক্তার! প্রশ্নটা মনের ভেতর না রেখে সজিব ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলো,
-বাকিটা জানেনই মানে কী?
-কেন আপনার বাবা আপনাদের বলেন নি?
হাবিব হাসান তখনও চুপচাপ বসে আছেন। মাঝেমধ্যে বাম হাতের দু’আঙুলের ভেতর রাখা সিগারেট বারবার টানছেন। শারমিন বেগম স্বামীর দিকে তাকিয়ে দেখেন হাবিব হাসান পা ঝাঁকিয়ে বারবার সিগারেট টানছেন। খুব বেশি টেনশনে থাকলেই উনি এমন করেন। আজকে তিনি টেনশনে থাকাটা স্বাভাবিক। কিন্তু উনি কি এমন জানেন যা তাদেরকে বলেন নি এই মুহুর্তে এটার গভীর ভাবনায় শারমিন বেগম।
-বাবা কি জানেন যা আমাদেরকে বলেন নি?
-আসলে আমরা অপারেশনের আগে পেপারে আপনার বাবার সাইন নিয়েছি।
ইভান উষ্কখুষ্ক চুল নিয়ে ডাক্তারের সামনে এসে জিজ্ঞেস করলো,
-পেপারটা কিসের ছিলো?
-আসলে আপনাদের রোগীর পায়ের উপর দিয়ে গাড়ির চাকা চলে গেছে যার কারণে উনার ডান পায়ের গোড়ালির হাড় ভেঙ্গে গুড়িয়ে গেছে। আর আপনারা হয়তো খেয়াল করেন নি গোড়ালি থেকে পায়ের পাতা দু’ভাগ হয়ে গেছে উনার। একটুতে আটকে ছিলো তার উপর অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়ে জমাট বেঁধে ইনফেকশনও হয়ে গিয়েছিলো। উনার এই হাড় জোড়া দেয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিলো না৷ তাই বাধ্য হয়েই আমাদের উনার পায়ের পাতা কেটে ফেলে দিতে হয়েছে।
#_____চলবে………..