#বড়গল্প
#অবেলার_পুষ্প
#পর্ব_৪
তৃতীয় পর্বের পরে…
কিছুটা সময় কারও মুখেই আর কথা নেই।
এই দীর্ঘ সময় পর্যন্ত আমার মনে নানারকম জল্পনা কল্পনা চলছিল। এমন তো হতেই পারে যে, রায়হানকে তার বাসায় হয়ত শাকিল নামে ডাকা হয়। রায়হান হয়ত আমার বন্ধুর পোশাকি নাম যা কাজিনদের কাছে তেমন একটা পরিচিত নয়। যদিও এই ভাবনা খুব বেশি ধোপে টেকে না, কিন্তু মনে মনে এমনটা ভেবে আশার আলো জাগছিল। এখন এই ছেলেকে দেখে এক মুহূর্তে বুঝে গেলাম, আমি ভুল জায়গায় এসেছি। অথচ আমাকে যে ঠিকানা দেওয়া হয়েছে সেটা এই বাড়িরই ঠিকানা!
একসময় নীরবতা ভাঙতে হলো। ছেলেটি সহ অন্যান্যরা অবাক হয়ে আমাকে দেখছে। আমি একটু অপ্রস্তুতভাবে বললাম, ‘ইয়ে… একটা ঝামেলা হয়েছে মনে হচ্ছে। আমাকে যারা এখানে নিয়ে এসেছে তাদেরকে আমি বোঝাতে চেষ্টা করছি। কিন্তু কেউ আমার কথা শুনল না। আমি ঢাকা থেকে আসছি। আমার নাম মাহমুদ…’
সংক্ষেপে নিজের পুরো বক্তব্য পেশ করলাম। ছেলেটা যথেষ্ট ধৈর্যশীল বলতে হবে। এই পুরো সময়ে সে কোনও কথা না বলে চুপচাপ আমার কথা শুনে গেল। আমার কথা শেষ হতেই বলল, ‘খুবই অদ্ভুত তো! আপনি আসছেন এই ঠিকানাতেই অথচ… আচ্ছা আপনি যে রায়হানের কথা বলছেন উনি কি আপনার সাথে ঢাকায় থাকে? মানে তার ব্যাপারে একটু বিস্তারিত জানা গেলে ভালো হতো। এমন টাইপের মজা কে করল বুঝতে তো পারছি না…’
শাকিল নামের ছেলেটি থেমে গেল একজনের কথা শুনে। পেছন থেকে একজন ভদ্রমহিলা কথা বলতে বলতে এদিকেই এগিয়ে আসছেন। ‘কার সাথে কথা বলছিস রে শাকিল? এভাবে দৌড়ে এলি যে!’
‘মা উনি এসেছেন ঢাকা থেকে…’ বলেই কী মনে হতেই আমাকে উদ্দেশ্য করে শাকিল বলল, ‘আরে! আমি আপনাকে বাইরেই দাড় করিয়ে রেখেছি। আপনি ভেতরে আসুন। ভেতরে বসে কথা বলি।’
আমি তখন চূড়ান্ত অস্বস্তিতে হাঁসফাঁস করছি।
সবকিছু ছাপিয়ে মাথা খারাপের মতো রাগ লাগছে রায়হানের ওপরে। ও কীভাবে পারল আমার সাথে এমন একটা ধাপ্পাবাজি করতে? অজানা অচেনা একটা জায়গায় কিছু সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা মানুষের সামনে নিজেকে পাক্কা আসামী বলে মনে হতে লাগল আমার। মনে মনে ফিরতি বাস ধরার কথা ভাবছি। নতুন জায়গায় কীভাবে চট করে বাসের টিকিট করব… এসবের একটা ভাবনাচিন্তা শুরু হয়ে গেছে ততক্ষণে। এরা আমাকে চেনে না জানে না। শুধু শুধু এদেরকে আর বিব্রত করতে ইচ্ছে করছে না।
আমি বিনয়ের সাথেই শাকিলের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতে দিতে বললাম, ‘না না… থাক। আমি আসলে ওদের সাথে আসতে চাইছিলাম না। ওরা অনেকটা জোর করেই… যাকগে যা হওয়ার হয়েছে। ঢাকায় ফেরার বাস কখন পাওয়া যাবে, জানালে ভালো হতো। আর বাস কাউন্টারের ঠিকানাটা যদি দিতেন…’
‘না না তা কীভাবে হয়? আপনি ভুল করে এলেও এভাবে আপনাকে…’ শাকিল আন্তরিকভাবেই কথাগুলো বলল। তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে পেছনে দাঁড়ানো ভদ্রমহিলা এবারে কথা বলে উঠলেন।
‘আরে কে কোথায় যাচ্ছে? বাবা তুমি ঢাকা থেকে আমাদের এই বাড়িতে এসেছ। বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠান চলছে। কত অতিথি অভ্যাগত এসেছেন। তোমাকে আমরা বাড়ির দরজা থেকে বিদায় করে দিব… এটা কীভাবে ভাবলে? তুমি এসো। ঘরে এসে বসো… একটু চা পানি খাও। এত দূর থেকে এসেছ নিশ্চয়ই ক্ষুধাও লেগেছে। এ্যাই শাকিল তুমি দরজা থেকে সরে দাঁড়ালে তো ও ভেতরে আসবে! আর এ্যাই…তোমরা সব ভেতরে যাও। ওদিকে গিয়ে দেখো কী করতে হবে! এখানে সব ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছ কেন?’
আমি চিন্তিত মুখে একবার ঘড়ি দেখলাম।
বাস থেকে নেমেছি দেড়টার সময়। এখন বাজছে আড়াইটা। পেটে ছুঁচো দৌড়াচ্ছে সেটা এই এতক্ষণের ডামাডোলে ভুলতেই বসেছিলাম। ভদ্রমহিলার আন্তরিকতা মাখানো কথায় সেটার কথা মনে পড়ে গেল। কিন্তু এখন যদি বাস ধরতে রওয়ানা না দিই, তাহলে নির্ঘাত রাত হয়ে যাবে। অচেনা জায়গায় শুধু শুধু দেরী করে লাভ কী? এসব সাতপাঁচ ভেবে নিয়ে পেটের চিন্তাকে একপাশে সরিয়ে রেখেই বললাম, ‘আপনাদের অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু আমি যখন ভুল ঠিকানাতেই এসে পড়েছি, তখন আর শুধু শুধু দেরী করতে চাইছি না। এখনও রওয়ানা দিলে হয়ত তাড়াতাড়ি ঢাকায় গিয়ে পৌঁছাতে পারব!’
‘আরে! তুমি বয়স্ক মানুষের কথাকে গুরুত্ব দাও না! এত করে বুড়ো মানুষটা বলছি থাকতে! একদিন দেরী করে গেলে কি অন্য কোনও অসুবিধা হবে তোমার? এসেছ…আমাদের বাড়িতে না হয় একদিন মেহমান হয়েই থাকলে!’
ভদ্রমহিলা এবারে বেশ স্নেহমাখানো শাসনের সুরেই কথাগুলো বললেন। আমি কেমন যেন সম্মোহিত হয়ে গেলাম। এভাবে স্নেহভরা কণ্ঠে কেউ কখনো আমাকে শাসন করেছে কী না ভালোমত মনেও করতে পারি না আর! আবেগতাড়িত হয়ে যাচ্ছি খুব দ্রুত। স্নেহ মায়া বিবর্জিত এই জীবনে এমন স্নেহের বারিধারা কেমন একটা শীতল আবেশ ছড়িয়ে দিলো আমার মনে। আমি আর কোনও প্রতিবাদ করার ভাষা খুঁজে পেলাম না। কৃতজ্ঞ চোখে চেয়ে রইলাম ভদ্রমহিলার মুখের দিকে।
আমার চাহনি দেখেই সেটাকে সম্মতি হিসেবে বুঝে নিতে দেরী হলো না কারও। ভদ্রমহিলা কাকে যেন হাঁক দিয়ে বললেন, ‘এ্যাই… কেউ এসে এই ব্যাগটা ওপরের রুমে রেখে আয় দেখি!’
শাকিল নামের ছেলেটাও বেশ আন্তরিকভাবেই স্বাগত জানালো আমাকে। আমি ওদের সাথে সাথে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলাম।
বাড়িটাতে ঢোকার পর থেকেই সেই পুরনো অনুভূতিটা ফিরে ফিরে আসতে লাগল… বাড়ির নামফলকটা দেখে যেমন অনুভূতি হচ্ছিল। কী এক অদ্ভুত মায়া আর আপনত্বের ইন্দ্রজাল যেন বিছানো আছে পুরো বাড়ি জুড়ে। ছড়ানো ছিটানো ঘর আর বারান্দাগুলো দেখে মনে হচ্ছিল, যিনি বাড়িটা বানিয়েছেন তিনি প্রচণ্ড সৌখীন আর বেহিসাবি মানুষ ছিলেন। যেখানে যতটুকু প্রয়োজন সবকিছুই যেন তার চেয়ে বেশি বেশি করে বরাদ্দ করা হয়েছে। ঘরগুলোর পাশ দিয়ে যেতে যেতে এক ঝলক নজর চলে যাচ্ছিল ভেতরে। ঘর তো নয়, যেন একেকটা ময়দান। বারান্দাগুলোর এমাথা থেকে ওমাথা দেখা যাচ্ছিল না।
প্রতিটা ঘরে বেশ অনেক লোকজন দেখতে পাচ্ছিলাম। উৎসবের আমেজ এখানে ভালোমতোই মিশে আছে। রানু মেয়েটার কথাই ঠিক। বাড়িটার সামনে থেকে এই শোরগোল টের পাওয়া যায়নি। এই পাশটাতে বেশ অন্যরকম চিত্র। পুরো বাড়ি সেজেছে নানারকম ফুল লতাপাতা দিয়ে। রঙ্গিন কাগজ দিয়ে বানানো ফুল পাখি এসবও দেখতে পেলাম। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখছি সবকিছু। খুব অন্যরকম লাগছে। ঢাকাতে যে কটি বিয়ে খেয়েছি, কমিউনিটি সেন্টারে গিয়ে শুধু খেয়েদেয়ে আর বর কনের সাথে ছবি তুলে চলে এসেছি। এখানে বিয়েতে আত্মীয় পরিজন আর বন্ধুবান্ধব মিলে এত চমৎকার একটা উৎসবের আবহ ফুটে উঠেছে যে আমার মুগ্ধতা কিছুতেই ফুরোতে চাইছে না যেন।
শাকিল আমাকে নিয়ে ড্রইংরুমে বসালো। তারপর নিজের দিকে তাকিয়ে বিব্রতমুখে বলল, ‘ইয়ে কিছু মনে করবেন না। আমি একটু চেঞ্জ করে আসছি। আজকে গায়ে হলুদ ছিল। তাই… আপনি একটু বসুন প্লিজ। আমি এক্ষুনি আসছি।’
আমি হাসিমুখে বললাম, ‘আপনি টেনশন নিবেন না। ঢুকেই যখন পড়েছি, তখন জমিয়েই বসে গেলাম। আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন।’
শাকিল চলে যাওয়ার পরে আমি গৃহসজ্জায় মন দিলাম। এতক্ষণ লক্ষই করিনি যে, আমাকে মোটামুটি একটা স্টেডিয়ামে এনে বসানো হয়েছে। চারপাশ দেখে ভড়কেই গেলাম রীতিমত। বাপরে বাপ! এরা কি জমিদারের বংশধর নাকি? এত বিশাল বাড়ি কে মেইনটেইন করে? বাড়িতে তো শুনলাম মাত্র কয়েকজন মানুষ থাকে। এদের জন্য এত বড় বাড়ি!
ঘরের চারপাশে নানারকম এণ্টিক জিনিসপাতি ছড়ানো ছিটানো। একপাশের দেওয়ালে কিছু ছবি ঝুলে থাকতে দেখলাম। ছবির প্যাটার্ন দেখে মনে হলো, হয়ত পূর্বপুরুষদের ছবি সারি ধরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এই বৈশিষ্ট্যটিও জমিদারদের সাথেই মিলে যায়।
একটি ছবির দিকে তাকিয়ে আমার খুব অদ্ভুত লাগল। এটি সম্ভবত নিকটতম পূর্বপুরুষের ছবি হবে। ছবিটা দেখে কেন আমার অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে সেটা চট করে ধরতে পারছি না। কিন্তু ছবির ব্যক্তির চোখ চুল নাক তাকানোর ভঙ্গি এসব যেন আমাকে কিছু একটা মনে করিয়ে দিতে চাইছে। কঠোর মুখভাব, লম্বা নাক আর চোখের দৃষ্টিতে কেমন জানি একটা অস্পষ্ট ছায়া। আমি মনে করতে পারছি না, এই ছায়া আমি আগে কোথায় দেখেছি!
আমি যখন একদৃষ্টে ছবির দিকে তাকিয়ে আছি, তখন রানু মেয়েটি ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল। তার চোখেমুখে একটু যেন অপ্রস্তুত ভাব। ঘরে ঢুকেই আমার দিকে তাকিয়ে একটু কুণ্ঠিত ভঙ্গিতে বলল, ‘কিছু মনে করবেন না। আমি মনে করেছিলাম আপনি হয়ত সত্যিই ভাইয়ার বন্ধু। কিছু একটা ভুল হচ্ছে হয়ত! কিন্তু ভাইয়া তো বলল, আপনি নাকি ওর বন্ধু না… আমরা আপনাকে ভুল করে নিয়ে এসেছি। কিন্তু আপনি তো এখানকার ঠিকানাই দিয়েছিলেন বাইক ওয়ালাকে! তাহলে ভুলটা কোথায় হলো বুঝতে পারলাম না তো!’
রানুর ভাবভঙ্গি দেখে মনে হলো, সে ভুল কোথায় হলো এটা খুঁজে না পেয়ে হয়রান হয়ে আছে!
আমি হাসতে হাসতে বললাম, ‘খুকি দেখলে তো! আমার কথা তো শুনতেই চাইছিলে না! একরকম ধরে বেধে নিয়ে এলে সবাই মিলে!’
রানুর মুখ নিমেষেই আবার গম্ভীর হয়ে গেল। খুব কঠোর একটা ভাব ফুটিয়ে তুলতে তুলতে সে বলল, ‘আপনি আমাকে খুকি খুকি করছেন কেন? এটা আবার কী? আমাকে দেখে কি আপনার খুকি বলে মনে হচ্ছে?’
‘এ্যাই রানু তোকে এখানে কী কাজে পাঠিয়েছি আর তুই এসে কী করছিস শুনি? তোকে না বললাম, মেহমানকে খাবার টেবিলে আসতে বল! এত ফাঁকিবাজ একটা মেয়ে! একটা কাজ যদি ঠিকমত হয় একে দিয়ে!’
বলতে বলতে নীচের সেই বয়স্কা ভদ্রমহিলা ঘরে ঢুকলেন। ভদ্রমহিলার বয়স ষাটের কাছাকাছি। মুখের আদলে এখনও লাবণ্যের ছিটেফোঁটা বেশ ভালভাবেই মিশে আছে। রানুর মুখের আদলের সাথে অনেক মিল। বুঝতে পারলাম, ইনি সম্ভবত রানু আর শাকিলের মা।
ভদ্রমহিলা আমাকে বললেন, ‘বাবা সব কথা পরে শুনব। তুমি দূর থেকে এসেছ। দুপুর পড়তে চললো। উঠে আগে হাতমুখ ধুয়ে কিছু খেয়ে নাও। তোমার জিনিসপত্র সব ওপরের ঘরে রাখা হয়েছে। এ্যাই রানু উনাকে ঐ ঘরে নিয়ে যা। যাও বাবা… রানু তোমাকে ঘর দেখিয়ে দিবে। ঘরের সাথে এ্যাটাচড বাথ আছে। ফ্রেশ হয়ে এসে খাওয়াদাওয়া করে নাও আগে। তারপর শুনব সব কথা। আর যদি ভুলও কিছু হয়ে থাকে, না হয় হয়েছেই! আমাদের এই বিয়েবাড়িতে তোমার রিজিক লেখা ছিল বলেই এসেছ। মেহমান তো শুভ কিছু বয়ে আনে। তুমি হয়ত আমার শাকিলের বিয়ের জন্য শুভ কিছুই সাথে করে এনেছ।’
আমি এই কথা শুনে কেমন যেন বিমোহিত হয়ে পড়লাম। ভদ্রমহিলার আচার আচরণ কথাবার্তা সবকিছুতেই একটা রুচিশীল ব্যক্তিত্বের ছাপ সুস্পষ্ট। মাতৃময়ী ভদ্রমহিলাকে দেখে বহুদিন আগে হারিয়ে যাওয়া মায়ের মুখটি মেঘে ঢাকা চাঁদের মতো উঁকি দিয়ে গেল আমার মনে। আমার মা বেঁচে থাকলেও বুঝি এভাবেই স্নেহভরে আমাকে খেতে ডাকত।
চোখের সীমানায় অনাহুতের মতো ছুটে আসতে চাওয়া কিছু নোনাজলকে প্রাণপনে ঠেকাতে ঠেকাতে আমি নিঃশব্দে বিনা প্রতিবাদে রানুর পিছে পিছে রওয়ানা দিলাম।(ক্রমশ)
আগের পর্বের লিংক- https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=401657888630241&id=100063580982892
#ফাহ্মিদা_বারী