এটা_গল্প_হলেও_পারতো ১ পর্ব

0
537

#এটা_গল্প_হলেও_পারতো
১ পর্ব

ইমন, এই ইমন !
ইমন! ওঠ না মা ! এই ইমন!
মা ছুটির দিনেও কি দুপুরে একটু শান্তিতে ঘুমাতে পারবো না?
ইমন প্লিজ ওঠ মা! এই ইমন!
কি হয়েছে মা? কার ঘরে আগুন লেগেছে যে আমি না উঠলে সর্বনাশ হয়ে যাবে? বলে কাঁথার ভেতর থেকে মুখ বের করে তেঁতে উঠল ইমন!
নার্গিস খানম একটু থমকে গিয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, আগুন তো লেগেছে মা তোর ভাগ্যে !
মা প্লিজ এসব ফালতু ভাগ্য নিয়ে কথা বলার অন্য অনেক সময় পাবে । এখন আমাকে দয়া করে ঘুমাতে দাও!
হ্যাঁ তোরা সবাই নাকে তেল দিয়ে ঘুমা , আমি শুধু মাতম করে যাব যত সমস্যা আছে সেসব নিয়ে!
মা, দয়া করে বলবে কি সমস্যা?
নার্গিস খানম মুখ অন্য দিকে ফিরিয়ে চোখের পানি মুছলেন!
মা বলো এখন কি হয়েছে?
থাক তোর আর শোনার কি দরকার? তুই কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমা !
মা এরকম এপাশ ওপাশ কথা ভালো লাগছে না , ঘুম ভাঙ্গিয়ে যখন ফেলেছো এখন তোমার কথা না শুনে তো ছাড়ব না! কোন ভনিতা না করে পরিস্কার করে বল কি হয়েছে?
ইমন ছেলে পক্ষ তোর বাবার কাছে ফোন দিয়েছিল!
এবার ইমন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ও এই কথা!
সামান্য কথা না ইমন!
বলো আমি শুনেছি মা!
ওরা বিভিন্ন হাবিজাবি কথা বলে বিয়েটা ভেঙ্গে দিয়েছে তোর !
দিয়েছে তো দিয়েছে! এটা নিয়ে এত হাপিত্যেশ করার কি আছে বুঝলাম না!
ইমন!
প্লিজ মা এটা নিয়ে সীন ক্রিয়েট করো না আর !
কি বললি আমি সীন ক্রিয়েট করব না ! এটা নিয়ে তোর কয়টা বিয়ে ভাঙ্গলো খেয়াল আছে?
বিয়ে ভাঙ্গেনি মা , বিয়ের সম্বন্ধ ভেঙ্গেছে!
তোর কাছে বিয়ের সম্বন্ধ ভাঙ্গা সামান্য ব্যাপার হতে পারে আমার কাছে না !
আমার মেয়ে তো রূপে,গুনে, বংশ মর্যাদায় হেলাফেলা নয় যে ঠিক ঠাক হয়ে যাওয়া বিয়ে এভাবে একের পর এক ভেঙ্গে যাবে !
তো কি করবে তুমি মা এখন? ছেলে পক্ষ কে এর জন্য ফাঁসি দিয়ে দিবে ? মামলা করবে ?
প্রয়োজনে করব ইমন !
মা ছেলেমানুষের মত কথা তোমার মত উচ্চ শিক্ষিত মানুষের মুখে মানায় না !
আমাকে জ্ঞান দিবি না ইমন !
আমি তোমাকে কোন জ্ঞান দিচ্ছি না মা , শুধু বাস্তব কথা টা বললাম!
কি বাস্তব কথা ! ছেলে পক্ষ আসলো , তোকে দেখে খুব পছন্দ করলো । ছেলের মা আংটি পড়িয়ে দিল । ছেলে তোর সঙ্গে কথা বলল, দুজনের দুজনকে পছন্দ হলো ! তাদের আগ্রহ এত বেশি তাড়াতাড়ি আকদ করবে দিন ঠিক করতে কি তাড়াহুড়া দিচ্ছিল । আর আজ ফোন দিয়ে বলছে তাদের কি সমস্যা এখন বিয়েটা নিয়ে তারা ভাবছে না । আর আমরাও যেন অপেক্ষা করে না থাকি !
হ্যাঁ বুঝলাম মা , তো কি হয়েছে?
এসব কি ছেলে খেলা নাকি ইমন?
মা তুমি দয়া করে শান্ত হ‌ও , ওদের তখন আমাকে পছন্দ হয়েছে এখন হচ্ছে না ! তারা আগাতে চাইছে না !
তোর আর ব্যাখ্যা দিতে হবে না বলে নার্গিস খানম উঠে দাঁড়ালেন!
তুই ঘুমা তোর বাপ , ভাই ও ঘুমাক ! এবার আমি এর একটা বিহিত করে ছাড়ব । ঘটকালি তোর মিনু খালার বিয়াইন করেছিল না ! খবর দিয়েছি তোর মিনু খালা আর তার ছেলের শ্বাশুড়ি কে ! আমি এর কৈফিয়ত ওদের কাছ থেকে আদায় করছি দেখ তুই বলে ইমনের মা নার্গিস খানম রুম থেকে বের হয়ে গেলেন!
পিছন থেকে ইমন ডেকে উঠল মা প্লিজ এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না !
নার্গিস খানম ইমনের কোন কথা শুনলেন না ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন !
ইমন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাহিরে তাকিয়ে দেখে , আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি হচ্ছে !
ইমন বেড সাইড ড্রয়ার খুলে আবীরের ছবিটা বের করলো তারপর ছবির দিকে তাকিয়ে বলল,
: আমি তো জানতাম এরকমই হবে ! বিবাহিত কারো কখনো আবার বিয়ে হয় নাকি বলো !
দেখেছো আবীর কি বৃষ্টি বাহিরে ! এরকম আকাশ ভেঙ্গে পড়া বৃষ্টি দেখলে আমার সেই দিনটার কথা মনে পড়ে যায় ! যেদিন তোমার মা আর ছোট চাচী আমাদের বাসায় এসেছিল !
আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে সেই দিনটার কথা ভার্সিটিতে শ্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন চলছে ক্লাস হয়নি তনু আর আমি ভয়ে ভয়ে কিছুটা হেঁটে তারপর রিক্সায় কত কষ্ট করে কলাবাগানে ফিরেছিলাম ! মে মাসের কি তপ্ত রোদ আর পুলিশের কাদানো গ্যাসে শাহবাগ, কাঁটাবন এলাকা রণক্ষেত্র তখন !
বাসায় এসে দেখি বাসায় কারো আসার তোরজোর চলছে ,কিছুক্ষণ পর বুঝলাম আমাকে দেখতে কেউ আসবে !
দুপুরের পর হঠাৎ আকাশ অন্ধকার হয়ে গেল এত বাতাস আমি দৌড়ে ছাদে চলে গিয়েছিলাম। তিনতলা আমাদের এই বাসার ছাদটা আমার বরাবরই খুব প্রিয়। আর মায়ের করা ছাদ বাগান এ বসেই নিচে তাকিয়ে দেখি আমার মেঝফুপু চলে আসছে।
তাঁর আসা মানেই আমাকে তৈরি হতে হবে ফুপুর ইচ্ছা মত!
ফুপু সেদিন নীল রঙের একটা সুতি শাড়ি পড়িয়ে নিজেই সাজিয়ে দিয়েছিল আমাকে। আমার এই মেঝফুপু নাজনীন অসম্ভব সুন্দরী এবং স্টাইলিশ এয়ার ফোর্স অফিসারের স্ত্রী ! ফুপুদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আদর ইমন এই ফুপুর কাছ থেকেই পায়!
আমি কেন একটুও সাজগোজ করি না কেন ফ্যাশন সচেতন না এই নিয়ে কত জ্ঞান দিলেন।
তার ভাস্তি এমন সাদামাটা তিনি কল্পনাও করতে পারেননি।
সেদিন তোমার মা আর ছোট চাচী যখন বাসায় এসে ঢুকেছে ততক্ষণে আজকের মত উজাড় করা বৃষ্টি হচ্ছিল।
সবাই তো ভেবেছিল উনারা আসতেই পারবে না !
তোমার মা আমাকে প্রথম দেখেই বলে উঠেছিল,
আমি তোমাকে দেখার জন্য এত এক্সাইটেড ছিলাম ইমন এই বৃষ্টি আমাকে আটকাতে পারেনি !
কেন জানো ?
আমি আমার ছেলেকে এবার বাইশটা মেয়ের ছবি পাঠিয়েছি সেখান থেকে তোমাকে দেখে আমার ছেলে পছন্দ করেছে গত তিন বছরে বিভিন্ন সময়ে আমি না হলেও একশ’ ছবি পাঠিয়েছি তাকে সে কোন দিন একটা নিয়েও দুই লাইন কথা বলেননি গতকাল তোমার ছবি দেখে আবির বলেছে তোমাকে যেন আমি দেখে আসি !
আমি সত্যিই খুব এক্সাইটেড ইমন!
বাসার সবাই খুব খুশি হয়েছিল তোমার মায়ের কথা শুনে।
হবে নাই বা কেন , আমেরিকায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া ছেলে, আমার ইন্জিনিয়ার বাবার কাছে সে সোনার টুকরো ছেলে এরকম ছেলের তাদের মেয়েকে পছন্দ হয়েছে তাঁরা তো আনন্দে দিশেহারা।
তোমার মা বললেন তবে আমার ছেলে ইমনের সঙ্গে ফোনে কথা বলতে চায় যদি আপনারা কিছু মনে না করেন?
সেদিন আমাদের ফ্যামিলির কারো কিছু মনে করার কোন চান্স ছিল না!
সন্ধ্যার পর আমাদের বাসার ল্যান্ড ফোনে সুদূর মার্কিন মুল্লুক থেকে যে ফোনটি আসে সেটি প্রথমে তোমার মা কথা বলেন তারপর আমাকে দেয়া হয়েছিল! বিশ্বাস করবে আমি কতটা অস্বস্তি ফীল করছিলাম কথা বলতে! জানা নেই শোনা নেই একজন মানুষের সঙ্গে এভাবে ফোনে কোন দিন কথা বলিনি!
তোমার কি মনে আছে আমাদের কি কথা হয়েছিল আবির?
আমার আজ‌ও মনে আছে ! প্রথমেই তুমি যে প্রশ্ন করেছিলে একেবারে ভাইভা রুমে স্যারদের মত প্রশ্ন!
: আপনার নামের অর্থ কি জানেন?
: সঙ্গীতের একটা রাগের নাম ইমন !
: আপনি কি জানেন ইয়েমেনের জনপ্রিয় একটা সুর হলো ইমন ?
: ইয়েমেনের খবর জানি না তবে দক্ষিণ ভারতের উচ্চাঙ্গসংগীতের কল্যাণরাগ হলো ইমন রাগ !
: ইমন আমি গান খুব পছন্দ করি আপনি কি গান গাইতে পারেন?
: জ্বি না আমার গলায় সুর নেই !
: কিন্তু আপনার গলার স্বর খুব মিষ্টি , আমি কথা বলতে চেয়েছি শুধু মাত্র জানার জন্য, যে মেয়ে ছবিতে এত মিষ্টি দেখতে তার ভয়েস টা কেমন ? আপনি আমার ছবি দেখেছেন ?
: দেখেছি !
: আমার সিদ্ধান্ত আমি নিয়ে নিয়েছি আপনি আপনার সিদ্ধান্ত নির্দ্বিধায় আমার মা কে জানিয়ে দিতে পারেন ! আপনার কোন প্রশ্ন আছে আমার কাছে ?
: না !
: আপনি যে কোন প্রশ্ন করতে পারেন ইমন প্লিজ ?
: আমি আপনার মত ভালো স্টুডেন্ট ন‌ই কিন্তু !
ইমনের কথা শুনেই আবির অন্যপ্রান্তে হাসতে শুরু করলো !
: ইমন আমি যে আপনার মত সুন্দর ন‌ই ,একদিক দিয়ে আপনি পূর্ণ অন্য দিকে আমি পূর্ণ হবে না আমাদের পথ চলাটা এক সঙ্গে?
: হবে !
আবির‌ তারপর তার মায়ের সঙ্গে কথা বলল‌! তিনি খুশিতে সেদিন ই আমাকে নিজের গলার সোনার চেইন পড়িয়ে দিয়ে গেলেন!
ঠিক হলো আবির ছয় মাস পর ছুটিতে আসবে তখন হবে বিয়ে !
এই ছয় মাসে প্রতি রবিবার আবির ফোন দিত ইমনদের বাসায়! কিছুক্ষণ কথা বলতো দুজন ! সেই সময়টা ইমনের জন্য সবচেয়ে মধুর এক সময় মনে হতো ! পুরো সপ্তাহ জুড়ে ইমন অপেক্ষা করতো আবির কখন ফোন দিবে !
: ইমন আমি তোমার ছবিটা আমার রুমে টাঙ্গিয়ে রেখেছি !
: তাই ! আমি আমার পড়ার টেবিলের ড্রয়ারে রেখেছি ! পড়ার সময় একটু পর পর বের করে দেখি!
:ইমন ইকোনমিক্স বাদ দিয়ে ছবি দেখা হয় বুঝি?
: সব সময় ইকোনমিক্স নিয়ে কে বসে থাকে ? একটা কথা বলব আপনার চোখ এত সুন্দর কেন ?
: জানি না তো । এই প্রশ্ন আমার প্রফেসরের স্ত্রী ও আমাকে করেছিলেন। আমি যে প্রফেসর এর আন্ডারে আমার পিএইচডি করছি তার রুমে একদিন কাজ করছি উনার স্ত্রী রুমে ঢুকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আমাকে প্রশ্ন করেছিল আমার চোখ এত সুন্দর কেন ! এই কথা তোমরা দুজন ছাড়া আর কেউ বলেনি কখনো!
: আমি মুগ্ধ হয়ে আপনার চোখ দেখি তাই একটু পর পর ড্রয়ার খুলে ছবি টা বের করি !
আবির ইমনের কথা শুনে হাসছে ! তুমি অনেক সুন্দর করে কথা বলো ইমন! আমার তোমার কথা শুনতে খুব ভালো লাগে ।
পাঁচ ছয় মিনিটের বেশি কথা হতো না ইমন আর আবিরের!
আবিরের আসার দিন যত কাছে এগিয়ে এসেছে তারা আরো ঘন ঘন কথা বলতো। হঠাৎ হঠাৎ আবির ফোন দিয়ে অবাক করে দিত ইমন কে !
ততদিনে ইমন আবিরকে আপনি থেকে তুমিতে চলে এসেছে!
একদিন আবির ফোন দিয়ে বলল,
: আমি গতকাল রাতে স্বপ্ন দেখেছি তোমাকে ইমন !.
: কি স্বপ্ন দেখলে ?
: দেখলাম তোমার আমার বিয়ে হয়ে গেছে তুমি এখানে চলে এসেছো আমরা ম্যাসাচুসেটস এর চার্লস নদীর পাড়ে ঘুরতে গেছি ! আমার খুব পছন্দের একটা জায়গা এই নদীর পাড় । প্রথম প্রথম যখন এসেছিলাম তখন বাসার জন্য মন খারাপ হলে নদীর পাড়ে গিয়ে বসে থাকতাম!
: আমি গেলে নিয়ে যাবে না নদীর পাড়ে?
: অবশ্যই নিয়ে যাব ! আমরা কয়েকমাস শুধু ঘুরে বেড়াবো এই দেশে !
: ঠিক আছে!
: ইমন আমার ইদানিং তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে !
: আর তো দুটো মাস তারপর তো চলে আসবে তুমি !
: কিন্তু অপেক্ষা করতে ভালো লাগছে না !
আবির আর ইমনের অপেক্ষা ছিল একটা সুন্দর দিনের!
ইমন যখন এসব ভাবছে ছোটবোন প্রিয়ম এসে ঘরে ঢুকলো !
ইমন বালিশের নিচে আবিরের ছবি টা ঢুকিয়ে ফেলল ,
: কিছু বলবি ?
: মিনু খালাম্মা আর সানি ভাইয়ার শ্বাশুড়ি আসছে ! মা আর বাবার সঙ্গে কথা বলছে !
: ও আচ্ছা !
: আপি তোমার কি খুব কষ্ট হচ্ছে বিয়ে ভেঙে গেল দেখে ?
: আরে না যে বিয়ে হয়নি তার জন্য কষ্ট পাওয়ার কি আছে !
: একটা কথা বলব ?
: বল কি বলতে এসেছিস ?
: কিছু মনে করোনা আমার কথায় তুমি কি আবির ভাইয়া কে ভুলতে পারো নি এখনো ?
ইমন চুপ করে অন্য দিকে তাকিয়ে রইল ! তারপর প্রিয়ম এর দিকে তাকিয়ে বলল ,
: তোর পরীক্ষা তো শেষ ইন্টার্নশিপ কোথায় করবি কিছু ঠিক করিস?
: এখনও কিছু ঠিক করিনি !
: আমার ব্যাঙ্ক এ করতে চাইলে বলিস আমি এইচ‌আর এ বলে দিব !
: আপি তুমি প্রসঙ্গ টা নিয়ে কথা বলতে চাইছো না তাই না ?
: বুঝতে যখন পারছিস তাহলে এত কথা কেন বলছিস ?
প্রিয়ম রুম থেকে বের হয়ে যাচ্ছে , সরি আপি কিন্তু তুমি চিন্তা করে দেখো প্রায় বার বছর হয়ে গেছে আবির ভাইয়ার ঘটনার !

( চলবে )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here