তোমাকে বলার ছিল
ত্রয়োদশ পর্ব
লেখনীতে অনিমা হাসান
– বাহ ! আমি জানতাম না তুমি এত মজার রান্না করো I
খেতে খেতে কথাগুলো বলল সুজন I রান্না-বান্না শেষে ছাদের মধ্যে চাদর বিছিয়ে বসা হয়েছে I আয়োজন খুবই সামান্য I খিচুড়ি, ডিম-ভাজা; তার সঙ্গে লেবু আর শশা I কিন্তু দুজনেই ভীষণ ক্ষুধার্ত থাকায় খেতে অসাধারণ লাগছে I তৃণা হেসে ফেললো I বলল
– তুমি কাল রাতে কি খেয়েছ ?
-কিছু খাইনি I
– দুপুরে ?
– মনে নেই I
– এজন্যই এত মজা লাগছে I
– না সেজন্য না I আসলেই ভালো হয়েছে I
– কিন্তু তুমি না খেয়ে ছিলে কেন ?
– আসলে খুবই এক্সাইটেড ছিলাম I তোমাকে নিয়ে আসব বলে I সব গোছগাছ করছিলাম I তাই খাওয়ার কথা মনে ছিল না I
– এখানে গোছগাছ করার কি আছে ? কিছুই তো নেই I
– আমি ইচ্ছা করেই কিছু কিনিনি I তুমি পছন্দ করে কিনবে তাই I
তৃণা খাওয়া থামিয়ে তাকিয়ে রইল I সুজন বলেই যাচ্ছে I
– গাছ ও লাগাই নি I আমি জানিনা তোমার কি গাছ পছন্দ I তুমি তোমার ইচ্ছা মতন এনে নিও I
তৃণার রাগ হওয়া উচিত I কিন্তু কেন যেন রাগ হচ্ছে না I খুব ভাবতে ইচ্ছা করছে আসলেই কদিন পর ও এখানে আসবে I এই জায়গাটাকে ওর মনের মতো করে সাজাবে I অনেক গাছ লাগাবে I তারপর রাত হলে দুজনে দোলনাতে বসে আকাশের তারা দেখবে I তৃণা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে গেল I এঁটো প্লেটগুলো ধুয়ে রাখল I অবশিষ্ট খিচুড়ি, ডিম ভাজি বক্সে তুলে রেখে বলল
– তুমি রাতের বেলা খেয়ে নিও I
– আচ্ছা I চা বানাই ?
– চা করতে পারো ?
– হ্যা পারি I
সুজন তৃণার জন্য চা করল I নিজের জন্য কফি I তারপর দুজনে এসে দোলনাতে বসলো I দুপুর হলেও রোদ নেই I আকাশে মেঘ জমে আছে I চারপাশটা ভীষণ নিরব I অনেকক্ষণ দুজনে চুপ করে বসে রইল I সুজনের অনেক কিছু বলতে ইচ্ছা করছে I খুব ইচ্ছা করছে তৃনাকে আর যেতে না দিতে I ওর জন্য খুব শখ করে একটা উপহার কিনেছে I কি জানি ও নিবে কিনা I
তৃণা চা শেষ করতে পারলো না I তার আগেই বাড়ি থেকে ফোন এলো I ল্যান্ড ফোন থেকে ফোন এসেছে বোঝার উপায় নেই কে করেছে I তৃণা ভুরু কুঁচকে ফোনটা ধরল
– হ্যালো I
– তুমি কোথায় তৃণা ? বড় চাচীর গলা পাওয়া গেল I
– আমার বন্ধুর বাসায় I কেন ?
– লাইব্রেরীর কথা বলে বন্ধুর বাসায় চলে গেলে ?
তৃণার প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হয়ে গেল I প্রতিদিন সকালে ও বেরোয় I রাত করে বাড়ি ফেরে I কেউ কখনো কিছু জানতে চায়নি I আজ হঠাৎ করে এত খোঁজখবর বিরক্ত লাগছে I
– তিনটার সময় টিউশনিতে যেতে হবে I এতক্ষণ তো লাইব্রেরীতে থাকতে পারবো না I তাই বন্ধুর বাসায় এসেছি I সব সময় এরকমই হয়ে এসেছে I আজ হঠাৎ করে কি হয়ে গেল ?
রেহানা একটু থমকালেন I বললেন
– দেশ থেকে তোমার দাদি এসেছেন I তোমার খোঁজ করছিলেন I তাই ফোন করলাম I
তৃণা ভীষণ অবাক হয়ে গেল I একটু চিন্তাও হলো I
– দাদির শরীর ঠিক আছে ? এভাবে হঠাৎ কিছু না জানিয়ে এলেন যে ?
– না সব ঠিক আছে I তুমি এসো টিউশন শেষ করে I কোন সমস্যা নেই I
তৃণা উঠে গেল I বলল
– আমাকে যেতে হবে I
-এখনি চলে যাবে ? আরেকটু থাকো I
– বাড়ি থেকে দাদি এসেছেন I আমার খোঁজ করছেন I
– ও আচ্ছা I চলো আমি নামিয়ে দিয়ে আসি I
– না, ঠিক আছে আমি চলে যাব I তোমাকে আর কষ্ট করতে হবে না I
– সমস্যা নেই গাড়ি নিয়ে যাব I আজকে ড্রাইভার নেই; আমি তোমাকে ড্রপ করেই চলে আসব I
– আচ্ছা I
– তৃণা একটা কথা ছিল I
– বল I
– তোমার জন্য একটা উপহার কিনেছিলাম I
– হঠাৎ! কি উপলক্ষে ?
– তুমি আজকে প্রথম এখানে এলে তাই I একটু দাঁড়াও আমি নিয়ে আসছি I
সুজন একটা বই আর একটা প্যাকেটে তৃণার হাতে দিলো I খুব অবাক হয়ে প্যাকেটগুলো হাতে নিল তৃণা I একটা কবিতার বই মহাদেব সাহার I তৃণা অবাক চোখে তাকিয়ে বলল
– আর এর মধ্যে কি ?
– একটা শাড়ি I তোমাকে শাড়ি পরলে খুব সুন্দর দেখায় I আমি কখনো তোমাকে নীল রঙের শাড়িতে দেখিনি I তাই কিনলাম I তুমি পরলে আমার খুব ভালো লাগবে I
সুজন ভেবেছিল তৃণা হয়তো উপহার গুলো নেবেনা; কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে তৃণা শাড়িটা ব্যাগের মধ্যে রেখে দিল I বইটা হাতেই ধরে রাখল I তারপর বলল
– চলো যাই, দেরী হয়ে যাচ্ছে I
****************
-কই যাও তৃণা ?
– ছাদে যাচ্ছি দাদি I
– এত রাতে ছাদে কি করতে যাও ?
– এমনি I আমি রোজই যাই I
– তুমি কি আমার উপর রাগ করছো ?
– না রাগ করিনি I
– বস I শুনো তোমার ভালোর জন্যই বলি I বিয়াটা কইরা ফালাও I আমি আজ আছি কাল নাই I তোমারে নিয়া সবসময় চিন্তায় থাকি I মন টিকে না I তোমার বিয়েটা হইলে নিশ্চিন্ত হইতে পারি I
– আমি এখন বিয়ে করতে চাই না দাদি I পড়াশোনা শেষ করতে চাই আগে I
-পড়াশোনা তো বিয়ের পরেও শেষ করা যায় I
-বললাম তো এখন বিয়ে করতে চাচ্ছি না I তোমরা সবাই হঠাৎ এরকম উঠে পড়ে লাগলে কেন ?
-আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে I তুমি যেমন চাইবা তেমনই হবে I
তৃণার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল I ও বই আর ফোন নিয়ে ছাদে চলে গেল I আসার পর থেকে এই জবাবদিহিতা শুরু হয়েছে I অসহ্য লাগছে এইসব I বাসায় কথা বলতে হবে I আর একটা বছর আছে I এবছরটা হলে থাকতে চায় ও I এত ঝামেলর মধ্যে পড়াশোনা সম্ভব না I
আজ আকাশে মেঘ জমে আছে I তারাদের দেখা মিলছে না I তৃণা ছাদের এক কোনায় বসে সুজনের দেয়া বইটা খুলল I শাড়িটা এখন পর্যন্ত দেখারও সুযোগ পায়নি I বইয়ের প্রথম পাতায় একটা কবিতা লিখে দিয়েছে ও I
তুমি চলে যাবে বলতেই বুকের মধ্যে
পাড় ভাঙার শব্দ শুনি-
উঠে দাঁড়াতেই দুপুরের খুব গরম হাওয়া বয়,
শার্সির কাঁচ ভাঙতে শুরু করে;
দরোজা থেকে যখন এক পা বাড়াও
আমি দুই চোখে কিছুই দেখি না-
এর নাম তোমার বিদায়, আচ্ছা আসি, শুভরাত্রি,
খোদা হাফেজ।
তোমাকে আরেকটু বসতে বললেই তুমি যখন
মাথা নেড়ে না, না বলো
সঙ্গে সঙ্গে সব মাধবীলতার ঝোপ ভেঙে পড়ে;
তুমি চলে যাওয়ার জন্যে যখন সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকো
তৎক্ষণাৎ পৃথিবীর আরো কিছু বনাঞ্চল উজাড়
হয়ে যায়,
তুমি উঠোন পেরুলে আমি কেবল শূন্যতা শূন্যতা
ছাড়া আর কিছুই দেখি না II
তৃণার ভেতরটা হটাৎ খুব এলোমেলো লাগল I বুকের মধ্যে প্রচন্ড একটা কষ্ট টের পেল I হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে ডুকরে কেঁদে উঠল তৃণা I ফোন বাজছে; ধরতে ইচ্ছা করছে না I ফোনটা বেজে বেজে থেমে গেল I যাক ভালই হয়েছে I টুং করে একটা মেসেজ এলো I দেখতে ইচ্ছা করছে না I আবারো বাজছে ফোনটা I বাধ্য হয়ে তৃণা ফোনটা ধরল I
– হ্যালো I
– কি হয়েছে তৃণা ? তুমি কাদছো কেন ?
– কিছু হয়নি I
-তুমি কি ছাদে ?
– হ্যাঁ I
– বাসায় কিছু হয়েছে ?
-না I
– আমাকে বলবেনা ?
– না I
অনেকক্ষণ দুজনেই চুপ করে রইলো I পরস্পরের নীরবতাটাই যেন অনুভব করল I অনেকক্ষণ পর সুজন বলল
– তৃণা..
– হু.
– তোমাকে খুব মিস করছি I
তৃণার খুব বলতে ইচ্ছা করল আমিও; কিন্তু বলতে পারল না I
***************
এই নিয়ে দুইবার ফোন করেছে হিয়া তৃণাকে I প্রতিবারেই কল ওয়েটিং এ দেখাচ্ছে I হিয়া মনে মনে একটু হাসলো I সুজনের সঙ্গে কথা বলছে নিশ্চয়ইI কিযে দারুন হবে এরকম হলে I রাতিনের সঙ্গে ওর বিয়ের ডেট ফিক্স হয়েছে ঈদের পরে I রোজা শুরু হতে আর কয়েকদিন বাকি I ওরা দুজনে মিলেই কেনাকাটা করছে I বিয়ের, সেইসঙ্গে আবার ঈদের ও I তৃণার পাত্রী দেখানোর ব্যাপারটা হিয়া মায়ের সঙ্গে শেয়ার করেছে I সুলতানা বেশ চিন্তায় পড়ে গেছেন I
হিয়া যতটা মারকুটে স্বভাবের, তার মা সুলতানা ঠিক ততটাই অমায়িক I চোখের পলকে বন্ধুত্ব করে ফেলতে পারেন; তা হোক সে তরকারিওয়ালা কিংবা কোন শিল্পপতির স্ত্রী I হিয়ার কাছ থেকে তৃণার ছেলে দেখানোর কথাটা সুলতানা শুনেছেন I এই মেয়েটাকে তিনি অসম্ভব স্নেহ করেন I তার যদি নিজের কোন ছেলে থাকতো, তাহলে ওকেই বিয়ে করিয়ে আনতেন I মেয়েটা যেমন সাহসী, দৃঢ়চেতা, তেমনি তার আত্মসম্মানবোধ I নিজের মেয়ের চাইতে কোন অংশে কম স্নেহ করেন না তিনি তৃণাকে I ছেলে তৃণার বড় চাচির আত্মীয় শুনে চিন্তায় পড়ে গেছেন সুলতানা I তৃণার বড় চাচী রেহানাকে দুই চোখে দেখতে পারেননা সুলতানা I মহিলা এক নাম্বারের একচোখা I অসম্ভব স্বার্থপর I তার আত্মীয়র সঙ্গে বিয়ের ব্যবস্থা করেছে; নিশ্চয়ই এর মধ্যে কোন একটা ঘাপলা আছে I সুলতানা তাই ছেলের নাম পরিচয় বের করে সব খোঁজখবর করে ফেলেছেন I এটা করতে অবশ্য তাকে তেমন বেগ পেতে হয়নি I তার বান্ধবীর খালাতো বোন রেহানার পরিচিত I তার মাধ্যমেই ছেলের ঠিকুজি বের করে নিয়েছেন I তারপর পাড়ায় ,মসজিদে, অফিসে বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ নিয়ে যে খবর পেয়েছেন, তাতে তার মাথা ঠিক নেই I এই ছেলের সঙ্গে কোনোভাবেই তৃণার বিয়ে দেওয়া যাবে না I কোনোভাবেই না I
চলবে