তোমাকে বলার ছিল
সপ্তম পর্ব
লেখনীতে অনিমা হাসান
চা-পাতা, চিনি -খরচ করে করে উজাড় করে দিয়েছে I মনে হয় যেন বাপের পয়সায় কেনা I
ঘরের ভেতর থেকেই কথাটা কানে গেল তৃণার I বড় চাচী রান্নাঘরে থালা-বাসন আছড়ে শব্দ করছে; আর একা একাই বকে যাচ্ছে I অবশ্য বিড়বিড় করে বলছে না I ইচ্ছে করেই এমন ভাবে বলছে, যেন কথাগুলোর তৃণার কানে যায় I হঠাৎ করে প্রচন্ড কান্না পেয়ে গেল তৃণার I বাড়িতে ও খায়না বললেই চলে I সকালে না খেয়ে বেরিয়ে যায় I দুপুরে হলে গিয়ে খাবার কিনে খায় I রাতে মাঝে মাঝে খেয়ে ফেরে I কখনো চায়ের সাথে টুকটাক খেয়ে নেয় I খাবার বলতে বাড়িতে শুধু চা টাই খায় I এটা নিয়েও এত কথা শুনতে হচ্ছে ! কান্নাটা প্রায় গলার কাছে চলে এসেছিল; তখনই তৃণার মনে হল সুলতানা আন্টি বলেছিলেন যে নিজের অধিকারের জন্য নিজেকেই লড়তে হয় I বলেছিলেন তুই যত মাথা নিচু করে থাকবি, সবাই তোকে ততই দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করবে I নিজের অধিকার আদায় করে নিতে শেখ I নিজের ভালো দেখার মধ্যে দোষের কিছু নেই I
তৃণা ঘর থেকে বেরিয়ে এলো Iবড় চাচা টেবিলে বসে ভাত খাচ্ছে I টুম্পা টিভি দেখতে দেখতে আইসক্রিম খাচ্ছে I তখনো রান্নাঘর থেকে একইরকম ভাবে আওয়াজ ভেসে আসছে I তৃণা বড় চাচার সামনে দাঁড়িয়ে থমথমে গলায় বলল
– তোমার সঙ্গে কিছু কথা আছে চাচা I
সামাদ সাহেব তাকালেন না I একমনে খেয়ে যেতে লাগলেন I তৃণা বললো
-অনেকদিন থেকেই তোমাদের বলতে চাচ্ছি I আমি কাল হলে উঠে যাব I এখানে আমার পড়াশোনার খুব ক্ষতি হচ্ছে I
সামাদ সাহেব আতকে উঠলেন I সেই ফার্স্ট ইয়ার থেকে তৃণা হলে উঠে যাওয়ার কথা বলছে I কিন্তু তার মা পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে যদি তৃণা হলে থাকে, তাহলে তার খরচা বাবদ দোতালার ভাড়াটা ওকে বুঝিয়ে দিতে I দোতালার ভাড়া 12000 টাকা I এখন তৃণাকে এক পয়সা দিতে হয়না I উল্টো তৃণা মাসে মাসে এক হাজার করে টাকা দেয় I সেটাও বন্ধ হয়ে যাবে I সামাদ সাহেব হুংকার দিয়ে উঠলেন
– মেয়েটা একটু চা খায় এটা নিয়ে এত কথা বলার কি আছে I সারাদিন খালি ভ্যাজর ভ্যাজর I ভালো লাগেনা আর বাড়িতে থাকতে I
তারপর তৃণার দিকে তাকিয়ে বললেন
– যা তো মা দুইকাপ চা বানা I এক কাপ তোর আর এক কাপ আমার I তারপর গলা উঁচিয়ে বললেন,
রান্না ঘর থেকে একটু বের হলে ভালো হয় I
তৃণা বড় চাচা কে চা দিয়ে নিজের চা নিয়ে ছাদে চলে গেল I
তৃণাদের ছাদটা তেমন বড় নয় I খুব একটা যত্নও করে না কেউ I শুধু কাজের মেয়েটা এক বেলা এসে ঝাড়ু দিয়ে যায় I তৃণা কিছু গাছ লাগিয়েছিল Iঅযত্নে অযত্নে সেগুলো ও মরে গেছে I তৃণার খুব শখ ওর নিজের একটা ছাদ হবে I সেখানে অনেক গাছ লাগাবে ও I পানির ট্যাংকটার পিছনে খানিকটা ফাঁকা জায়গা I দুই দিক থেকে ঘেরা; তাই বাইরে থেকে দেখা যায় না I এই জায়গাটা তৃণার খুব প্রিয় I ও মাঝে মাঝে এখানে বসে বই পড়ে I
আজ আকাশ খুব পরিষ্কার I তৃণা উপরের দিকে তাকিয়ে দেখল, অজস্র তারা-ভরা রাতের আকাশ Iতৃণার খুব ইচ্ছা করে ছাদের মধ্যে শুয়ে থাকতে I চায়ের কাপ পাশে রেখে হেলান দিয়ে বসলো তৃণাI রাত বোধ হয় ভালোই হয়েছে I পাশ থেকে মোবাইলটা নিল সময় দেখার জন্য I একটা মেসেজ এসেছে I খেয়াল করা হয়নি I তৃণা দেখল সুজন মেসেজ পাঠিয়েছে I
– সরি তোমার ফোন ধরতে পারিনি I তুমি কি ঘুমিয়ে পড়েছ I ফোন করা যাবে ?
তৃণা নিজেই ফোন করলো
– তোমার শরীর এখন কেমন সুজন ?
-ভালো
– তাহলে আজকে ক্লাসে আসলে না যে ?
– সকালে একটু খারাপ ছিল I সারাদিন ঘুমিয়েছি I এখন খুব ঝরঝরে লাগছে I তোমাকে কি ফোন করে বিরক্ত করলাম I
– একেবারেই না I
– তোমার কি মন খারাপ তৃণা ?
তৃণা একটু চমকালো;
– না তো
– তোমার গলা শুনে মনে হচ্ছে I একটু ভিডিওটা অন করবে ?
তৃণা হেসে ফেললো I বলল
– আমি এখন ছাদে I ভিডিও অন করলে তুমি কিছু দেখতে পাবে না I
– এত রাতে তুমি ছাদে কি করো ?
– আকাশ দেখি I আজকে আকাশ খুব পরিষ্কার I অনেক তারা দেখা যাচ্ছে I
-তাই ? তোমার কথা শুনে তো আমারও দেখতে ইচ্ছে করছে I কতদিন ছাদে যাওয়া হয় না I দাঁড়াও আমিও যাচ্ছি I
– না তুমি যেওনা I একটু ঠান্ডা আছে I তোমার আবার শরীর খারাপ করবে I
-আচ্ছা I
– তোমাকে একটা জরুরী কথা বলার জন্য ফোন করেছিলাম I
-কি ?
– কালকে স্টেরিও কেমিস্ট্রির একটা পরীক্ষা আছে I ম্যাডাম নোটিশ বোর্ডে দিয়েছে
– হঠাৎ ? ম্যাডাম তো ছুটিতে ছিল !
– হ্যাঁ কাল থেকে ক্লাস শুরু হবে I তোমাকে কেউ বলেছে নিশ্চয়ই ?
– না কেউ বলেনি I কেউ ফোনও করেনি;
– ও
– তৃণা একটা কথা তোমাকে অনেকদিন ধরে বলব ভাবছি I বলা হচ্ছে না…
– কি বলো..
– থ্যাঙ্ক ইউ I তুমি আমার জন্য যা করেছ, সেটা অনেক কাছের বন্ধু না হলে কেউ করেনা I
– আমি আবার কি করলাম ?
সুজন একটু হাসলো তারপর বলল;
– আমাকে দেখতে যতটা বোকা মনে হয়, আমি আসলে ততটা বোকা নই I এই যে তুমি রাতের বেলা আমাকে ফোন করো পড়ার কথা বল, এটা তুমি কেন করছ আমি জানি I যেন আমার পড়াশোনার ক্ষতি না হয় I তুমি জানো এই সময়টাতে হিয়া আমাকে কবিতা পাঠাতো I কি জানো তৃণা, ছোটবেলা থেকে আমার কোনো বন্ধু নেই I সবাই সব সময় প্রয়োজনে আমার কাছে এসেছে I কিন্তু আমি যখন তাদের মাঝে গেছি, ওদের আড্ডা থেমে গেছে I কেউ আমার সামনে সহজ হতে পারেনি I আমি সবার কাছে দূরেরই থেকে গেছি I
কিছুক্ষণ দুজনই চুপ করে রইলো I একসময় তৃণা নীরবতা ভেঙে বলল
– তুমি কি আমার কাছে হিয়ার ব্যাপারে কিছু জানতে চাও ?
– নাহ I আমার এখন ওর মুখটা ও ঠিক মত মনে পড়ে না I
– এসব কী বলছো?
– সত্যিই বলছি I ওর সঙ্গে আমার কখনো সেই রকম কোন কানেকশন তৈরি হয়নি I তবে হ্যাঁ , যখন রাত হয় আমার ভীষণ কষ্ট হয় I প্রতি রাতেই ও আমাকে তিনটা করে কবিতা পাঠাতো I ওই সময়টা আসলে আমার খুব অস্থির লাগে I কোন কিছুতেই মন বসাতে পারি না I
– ঠিক হয়ে যাবে আস্তে আস্তেI
– হু I
-কবিতা তোমার খুব প্রিয় তাই না…
– হ্যাঁ
তৃণার হঠাৎ মনটাই খারাপ হয়ে গেল I এভাবে ছেলেটার ইমোশন নিয়ে খেলা উচিত হয়নি I তৃণা জানত সুজনের কবিতা খুব প্রিয় I লাইব্রেরীতে দেখেছে ও I সুজন যখন পড়তে বসে, তখন ওর ব্যাগ থেকে সব বই বের করে টেবিলের উপর রাখে I তৃণা লক্ষ্য করেছে, ওখানে অনেক কবিতার বই থাকে I
সুজন খুব বিষন্ন গলায় বলল
– আচ্ছা তৃণা , তুমি তো আবৃত্তি কর I আজকে আমাকে একটা কবিতা শোনাবে ?
-তৃণা সচরাচর কাউকে কবিতা পড়ে শোনায় না I কিন্তু আজকে ওর মনটা খুব অন্যরকম হয়ে আছে I ও বলল, আচ্ছা I
হয়তো এই পাহাড় সমান উঁচু হতে চায় কেউ
আমি মাটিতে মেশা ঘাস হতে ভালোবাসি,
যার মাড়িয়ে যাওয়ার সে মাড়িয়ে যাক ঘাস
তবু ঘাসের বুকেই জমে শিশিরবিন্দু ;
হয়তো কেউ পার হতে চায় দীর্ঘ দূরের পথ
আমি বাড়ির উঠোনে লুটিয়ে থাকি,
উঠানের কোণে হয়ে থাকি চারাগাছ
সেইখানে ঐ দূর আকাশকে ডাকি ;
হয়তো কেউ পাখিদের মতো চায় দুইখানি ডানা
আমি ভালোবাসি শিশুদের টলমলে হাঁটা, উড়তে চাইনা,
চাই এইখানে নিরিবিলি শুয়ে থাকি
যার হওয়ার সে হোক জোয়ার,
আমি হতে চাই ভাটা ;
হয়তো কেউ হতে চায় ঐ পাহাড়ের মতো
আমি হাত-পা গুটিয়ে মাটিতেই শুয়ে থাকি,
লেগে থাক এই শরীরে শুধুও কাদামাটির ঘ্রাণ
যে কাছে আছে তাকেই আমি আরো কাছাকাছি ডাকি II
অনেকক্ষণ পর্যন্ত সুজন চুপ করে রইলো I তৃণা একটু হেসে বলল,
– কি হল, আমার অডিয়েন্স এরকম নীরব হয়ে গেল কেন ?
– আচ্ছা তৃণা একটা কথা জিজ্ঞেস করব, সত্যি করে বলবে ?
– হ্যাঁ বল
– এইযে হিয়া আমাকে এত কবিতা পাঠাতো এগুলো কি সব আসলে ওই পাঠাতো ?
তৃণা চমকে উঠলো I কোন জবাব খুঁজে পেল না I
চলবে