#পূর্ণিমাতিথিপর্ব-৯
#লেখিকা-তাসনিম জাহান রিয়া
হাঁটতে হাঁটতে কলেজের পিছনের দিকে চলে এলাম। এদিকটায় বেশি মানুষজন আসে না। টিফিন টাইমেই একটু আধটু মানুষের আনাগোনা হয়। হঠাৎই উড়নায় টান পড়ে। পিছন ফিরে দেখি এনাম ভাইয়া আমার উড়না টেনে ধরেছে। এই ছেলেটা যেদিন থেকে কলেজে ভর্তি হয়েছি সেদিন থেকে বিরক্ত করে যাচ্ছে। কিন্তু আজকে তো উড়না টেনে ধরেছে। হঠাৎই জুড়ে উড়না টান দেয়। রাগে শরীর থরথর করে কাঁপছে।
কিছু বলার জন্য পিছনে ঘুরতেই একটা ছেলে এসে এনাম ভাইয়ার নাক বরাবর ঘুষি মারে। সাথে সাথে এনাম ভাইয়া ছিটকে পড়ে যায়। আমার ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে আছে সুঠাম দেহি এক পুরুষ। ছেলেটা গিয়ে এনাম ভাইয়াকে এলোপাতাড়ি মারতে শুরু করে। ইতিমধ্যে অনেকেই এখানে এসে বিড় করেছে। ছেলেটা এনাম ভাইয়াকে টেনে তুলে কানে কানে যেনো কী বললো। তারপর বেশ গম্ভীর গলায় বলল,
তোকে যেনো আমি আর এই কলেজের আশেপাশে না দেখি।
এনাম ভাইয়ার ছাড়া থেকে পাওয়া মাত্রই দৌড়ে চলে যায়। আমি দ্বিধায় ভুগছি। উনাকে ধন্যবাদ দিব নাকি চলে যাব। চলে গেলে এটা অভদ্রতা হবে। আমি ভদ্রতার খাতিরেই এগিয়ে গেলাম।
ধন্যবাদ ভাইয়া।
ছেলেটা পিছন ফিরে তাকাল। এতক্ষণে আমি ছেলেটার মুখ দেখতে পেলাম। এতো ফর্সা না তবে মোটামুটি ফর্সা। সবাই তো আর উনার মতো সাদা বিলাই হবে না। তবে উনার সাথে এই ভাইয়াটার একটা মিল আছে দুজনেরই কপালের কাছে কাটা।
ইট’স ওকে। তুমি…..
উনি আর কিছু বলতে পারলেন নাহ তার আগেই উনাকে কেউ পিছন থেকে ডেকে ওঠলো। উনি সেদিকে চলে গেলেন। তখনি আমার দিকে এগিয়ে আসলো আমার মোস্ট ফেবারিট স্যার। স্যারকে দেখেই ঠোঁটের কোণে এক টুকরো হাসি ফুটে ওঠলো। এই কলেজের সবার প্রিয় স্যার উনি। উনার প্রতি কোনো দিন কোনো স্টুডেন্টের অভিযোগ ছিল না। কারণ উনি কখনো অভিযোগ করার সুযোগই রাখেন না। সব স্টুডেন্টের সাথে বন্ধুর মতো মিশেন।
স্টুডেন্টরাও স্যারের সাথে সবকিছু শেয়ার করতো। আমার মতে উনি একজন চমৎকার ব্যক্তি। উনার মতো স্যার পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। স্যার বেশ অভিমানী গলায় বললেন,
আমি তোমার ওপর ভীষণ রাগ করে আছি। একা একা বিয়ে করে ফেললা। আমাকে দাওয়াত দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলে না। আমি কী বা বেশি খেতাম। এক প্লেট পোলাও আর একটা রোস্টই নাহয় খেতাম।
স্যারের কথা শুনে আমার ঠোঁটের কোণের হাসিটা প্রসস্থ হলো। আমি বেশ শব্দ করে হেসে ফেললাম।
উফ এই হাসিটায় এতোদিন মিস করছিলাম। কতোদিন পর তোর এই হাসিটা দেখলাম। তোর ওপর কেউ বেশিক্ষণ রেগে থাকতে পারবে না। কারো রাগ ভাঙানোর মহাঔষধ হচ্ছে তোর এই হাসি। ধর তোর ওপর কেউ ভয়ঙ্কর রেগে আছে। তুই শুধু ঐ ব্যক্তির সামনে দাঁড়িয়ে হেসে দিবি। দেখবি রাগ গলে জল হয়ে গেছে।
প্লিজ স্যার রাগ করবেন নাহ। আমি নিজেও জানতাম নাহ ঐ দিন আমার বিয়ে ছিল। অন্য কাউকে না বললেও আপনাকে নিশ্চিত বলতাম। পরে নিশ্চয়ই আব্বু আপনাকে বলেছে।
তোর আব্বুই বলেছে। তোদের ম্যাডাম বলেছে তুই তোর হাজবেন্ডকে নিয়ে আমাদের বাসায় যেতে। আমি রেগে নেই। তোর এই হাসি দেখার পর কী আর রেগে থাকা যায়।
একদম ঠিক বলেছেন স্যার। এই মাইয়া হাসি দিয়া মাইনষের রাগ ভাঙায় ফেলে। বিয়ের পর যদি জামাই রাগ করে। জামাইয়ের সামনে দাঁড়ায়া শুধু ৩২ দাঁত বের করে ভেটকাইবো। তাহলেই রাগ গলে জল হয়ে যাবে।
কথাগুলো কর্ণগোচর হতেই দ্রুত পিছন ফিরে তাকাই। আমার ঠিক পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে আমার পুরো ফ্রেন্ড সার্কেল। স্যারের সাথে আর কিছুক্ষণ কথা বলে কলেজ থেকে বের হয়ে যায়। আমাদের প্লেন আজকে সারাদিন ঘুরাঘুরি করা।
________________
বাসায় আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। আজকে সারাদিনটা অন্য রকম কেটেছে। ওরা কেউ জানে না বিয়ের ব্যাপারটা। আমিও আর বলি নাই। যে বিয়েটার কোনো মূল্য নেই সেই বিয়েটা জনে জনে বলে বেড়ানোর তো কোনো মানে হয় না। কলিংবেল বাজাতেই মামুনি এসে দরজা খুলে দিলো। মামুনি আমাকে দেখে বলে ওঠল,
কেমন কাটল আজকে সারাদিন বন্ধুদের সাথে?
মামুনি সেই। মনে হচ্ছিল সবাই মিলে আবার স্কুল লাইফে ফিরে গেছি।
আগে ফ্রেশ হয়ে আয়। তারপর তোর কাছ থেকে সব গল্প শুনবো।
আমি মাথা দুলিয়ে রুমে চলে এলাম। রুমে আসতেই কেউ আমার হাত টেনে ধরে। পাশ ফিরে তাকাতেই দেখি রুদ্র। ফুরফুরে মোডটাই নষ্ট করে দিলো। কেউ উড়না টেনে ধরছে তো কেউ হাত টেনে ধরছে। আমি কী টানাটানি করার জিনিস নাকি? উনার কর্কশ গলা কর্ণগোচর হলো।
সারাদিন কোথায় ছিলে? আমাকে না বলে ঐ বাসা থেকে তোমার আসার সাহস হলো কী করে?
হাতটা ছাড়ুন।
উনি আরো শক্ত করে আমার হাতটা চেপে ধরলেন। উনার সব রাগ যেনো আমার হাতের ওপর ঝাড়ছেন।
আমি কী বলছি তুমি শুনতে পাচ্ছো না? আমার বলা কথা তোমার কানে ঢুকছে না।
একদমি না। আপনাার মতো রোবটিক মানুষের কথা শুনতে আমি একদমি ইচ্ছুক নই। কী বলুনতো আপনার সাথে কথা বলতেও আমার বিরক্ত লাগে।
আমি হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই উনি আমাকে কাবাডের সাথে চেপে ধরলেন।
আমার সাথে কথা বলতে বিরক্ত লাগে। তো কার সাথে কথা বলতে ভালো লাগে? আজকে সারাদিন কার সাথে ছিলা?
আপনিও বলুন আপনার সাথে কথা বলা যায়। নরম সুরে কখনো কারো সাথে কথা বলছেন? সব সময় গম্ভীর। এই জন্যই আপনার সাথে কেউ এতো বেশি ঘেষতে চায় না। সারাদিন কার সাথে ছিলাম সেটা আপনাকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করছি না।
আমাকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করছো না তো কাকে জানাবা? বলো।
এবার আর নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারলাম না। ধাক্কা দিয়ে উনাকে দূরে সরিয়ে দিলাম। চিৎকার করে বলে ওঠলাম,
কীসের এতো অধিকার দেখাচ্ছেন আপনি আমার ওপর? আপনার কোনো অধিকার নেই আমার ওপর। আমি সারাদিন কোথায় ছিলাম সেটা জিঙ্গেস করার অধিকার আপনার নেই। আপনি আমাকে নিজের স্ত্রী হিসেবে মানেন না আবার আমার ওপর অধিকার দেখাবেন। আমাকে কী খেলনা পুতুল মনে হয়? সেটা ভেবে থাকলে আপনি ভুল করবেন। যেদিন আমাকে নিজের স্ত্রী হিসেবে মানতে মারবেন সেদিনই আমার ওপর নিজের অধিকার দেখাতে আসবেন এর আগে না।
আর এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে না থেকে সোজা ওয়াশরুমে চলে এলাম। উনি যে হা করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন তা ভালো করেই বুঝতে পারছি। উনার সাথে আগে কখনো চিৎকার তো দূরে থাক উচ্চ স্বরে কথা বলিনি। তাই তো উনি এতো অবাক হয়েছেন।
______________
সন্ধ্যা হতে রাত ১০টা পর্যন্ত উনাকে আমি এড়িয়ে চলেছি। খুব কড়াকড়ি ভাবে উনাকে ইগনোর করে চলেছি। এটা হয়তো উনি খেয়াল করেছেন হয়তো না। রুমে আসতেই ওনি বলে ওঠলেন,
পড়াশোনা কী একেবারে ছেড়ে টেড়ে দিবা নাকি?
আমি উনার দিকে ভ্রু কুচকে তাকাই। উনি একটু নড়েচড়ে বসেন। উনি বিছানার ওপর বসে ছিলেন আর কোলের ওপর ছিল ল্যাপটপ। উনি পা দুটো আরেকটু গুটিয়ে বিছানার ওপর বসেন।
তোমার তো ডক্টর হওয়ার ইচ্ছা। তো এডমিশন কোচিংয়ে কী ভর্তি হবা না?
কে বললো ভর্তি হবো না? অবশ্যই হব। আগামীকাল আব্বু আসবে। আব্বুর সাথে যাব ভর্তি হতে।
আমিই তো ভর্তি করিয়ে দিতাম।
তার কোনো দরকার নেই। আমার জন্য আপনার অতি মুল্যবান সময় নষ্ট করতে হবে না।
চলবে……..