তোমাকে বলার ছিল
চতুর্থ পর্ব
লেখনীতে অনিমা হাসান
বাড়ি ফিরে তৃণা দেখল সবাই বিয়ে বাড়িতে গেছে I আশ্চর্য কেউ ওকে একবার জানানোর ও প্রয়োজন বোধ করেনি I যাক, এ আর নতুন কি I তৃণা হাত মুখ ধুয়ে চেঞ্জ করে নিজের ঘরের দিকে তাকালো I ও সবসময় ঘরটাকে খুব সুন্দর আর পরিপাটি করে রাখে I যদিও এটাকে নিজের ঘর বলতে ওর খুব ঘেন্না হয় I
মনে আছে যখন প্রথম দাদা বাড়ি থেকে এখানে এসেছিল ওর জায়গা হয়েছিল বারান্দায় I পুরানো দিনের বাড়ি বলে বারান্দাটা বেশ বড় I সেখানেই একটা ছোট খাট আর পড়ার টেবিল পেতে ওকে থাকতে দেয়া হয়েছিল I একটা টেবিল ফ্যান ও ছিল I রাতের বেলা কার্নিশ দিয়ে বিড়াল হেঁটে গেলে তৃণার খুব ভয় করত I দাদা বাড়িতে সবসময় দাদির সঙ্গে থাকতো ও I কখনো এভাবে একা বারান্দার মধ্যে থাকেনি I
তৃণাকে আনতে গিয়েছিলেন ওর বড় চাচা I বড় চাচা ভীষণ ভালবাসলেন তৃণাকে I প্রতিবছর ঈদের সময় চাচা চাচি আর টুম্পা আসতো I টুম্পা তৃণার চাচাতো বোন I তৃণার দুই বছরের ছোট I বড় চাচা কত উপহার নিয়ে আসতেন I তৃণার জন্য ওর প্রিয় চকলেট নিয়ে আসতেন I টুম্পা কত খেলত তৃণার সঙ্গে I এখানে আসার পর সব হঠাৎ করে এমন বদলে যাবে তৃণা কল্পনাও করেনি I পরদিন দাদি ফোন করে জানতে চেয়েছিলেন সব ঠিক আছে কিনা I তৃণা কিছু বলতে পারেনি, ঘাড়ের উপর বড় চাচী দাঁড়িয়ে ছিলেন Iঅবশ্য না থাকলেও কিছু বলতো না I
ওকে একটা সাধারন সরকারি স্কুলে ভর্তি করা হয়েছিল I তখন টুম্পা নামিদামি প্রাইভেট স্কুলে পড়ে I তবুও তৃণা কিছু বলেনি I সব মেনে নিয়েছিল I দাদির কাছে কোনো অভিযোগ করেনি I স্কুলের প্রথম দিনের কথা তৃণা কোনদিনও ভুলবে না I তৃণা পেছনের সারির একটা বেঞ্চের কোনায় সবে বসেছে কোত্থেকে একটা মেয়ে এসে ওর সামনে দাঁড়িয়ে বলল
– এখানে বসেছিস কেন ? এটা আমার সিট জানিস না ?
তৃণা উঠতে যাবে , তার আগেই মেয়েটা ওর একটা বেনি ধরে হ্যাঁচকা টান মেরে ওকে নামিয়ে দিতে নিল I ব্যথার চাইতেও বেশি অবাক হয়েছিল তৃণা I ওর সঙ্গে আগে কেউ কখনো এরকম আচরণ করেনি I কান্নাটা প্রায় গলার কাছে চলে এসেছিল তার আগেই হঠাৎ করে মেয়েটা হুড়মুড় করে ওর গায়ের উপর এসে পড়ল I বোঝা গেল পেছন থেকে কেউ ধাক্কা মেরেছে অথবা পিঠে কিল বসিয়ে দিয়েছে I ঘটনার আকস্মিকতায় তৃণা হকচকিয়ে গেল I আর তখনই দেখল একটা মিষ্টি চেহারার মেয়ে ওদের দুজনের মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছে I মেয়েটা মিষ্টি করে হেসে বলল
– তোকে না নিষেধ করেছিলাম মারামারি করতে
অন্য মেয়েটা উঠে দাড়িয়ে তেতে উঠে বলল তাই বলে তুই আমাকে মারবি ?
মিষ্টি চেহারার মেয়েটা খুব অবলীলায় অন্য মেয়েটার গালে ঠাস করে একটা থাপ্পর বসিয়ে দিল I তারপর আবারো মিষ্টি করে হেসে বলল
– হ্যাঁ মারলাম I তুই মারলে নিজেও মার খাবি
অন্য মেয়েটা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল তুই আমার গায়ে হাত তুললি ?
এবারে ও আরো সুন্দর করে হাসলো তারপর বলল
– ঠিক আছে এর পরেরবার আর হাত তুলবো না I বারান্দায় নিয়ে গিয়ে লাথি মেরে নিচে ফেলে দেবো
মেয়েটা ফোঁপাতে ফোঁপাতে চলে গেল I মিষ্টি চেহারার মেয়েটা তৃণার কাছে এগিয়ে এসে বলল
– আমি হিয়া I ক্লাস ক্যাপ্টেন কোন সমস্যা হলে আমাকে বোলো কেমন ?
– থ্যাংকস I আমি তৃণা I আজকেই প্রথম ক্লাস
– সমস্যা নেই, এসো আমার সঙ্গে বসবে I ওই ফাজিল মেয়ের জায়গায় তোমাকে বসতে হবে না I
এই ভাবেই ওদের বন্ধুত্বের শুরু I এরপর এতগুলো বছর ধরে সুখে দুঃখে ওরা কখনো পরস্পরের হাত ছাড়ে নি I কিন্তু এবার তৃণার মনে হচ্ছে হিয়া কাজটা ভালো করেনি I হিয়ার সঙ্গে কথা বলাটা খুব জরুরী I কিন্তু তার চেয়েও জরুরী হচ্ছে এক কাপ চা খাওয়া I তৃণা রান্নাঘরে গেল চা করতে I রান্নাঘরে গিয়ে মনে হল ভাগ্যিস খেয়ে এসেছিল তা না হলে খালি পেটে শুতে হত I ওর জন্য কোন খাবার রাখা হয়নি I তৃণা চা নিয়ে ঘরে চলে এলো I আরাম করে চায়ে চুমুক দিয়ে হিয়াকে ফোন করে মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল I কল ওয়েটিং এ দেখাচ্ছে I নিশ্চয়ই ওই বদমাইশ রাতিনটার সাথে আবার গল্প করছে I
তৃণা ঘড়ি দেখল I সাড়ে নয়টা বেজে গেছে I দশটার সময় সুজন কে ফোন করতে হবে I তৃণা উঠে গিয়ে চুল আচঁড়া নিল I অনেকখানি লম্বা চুল ওর I এই রিবন্ডিং এর যুগে ওর ঢেউ খেলানো লম্বা চুলগুলো বেশ ব্যতিক্রমী দেখায় I চুল বেঁধে মুখে ক্রিম মেখে তৃণা আবারো হিয়া কে কল করল I যথারীতি কল ওয়েটিং এ I হঠাৎ তৃণার মনে হল হিয়া বলছিল ওর মেসেঞ্জার আইডি চেঞ্জ করে ফেলেছে তারমানে তো ও সুজনের কোন ম্যাসেজই পাচ্ছে না I পুরনো আইডির পাসওয়ার্ডটা তৃণার কাছে আছে I একটা সময় বিরক্ত হয়ে হিয়া বলেছিল
– এতসব কপি পেস্ট আর ভালো লাগছেনা I তুই না হয় আমার আইডিটা তোর ওখানে ওপেন কর , তাহলে আমরা দুইজনই দেখতে পাবো I
পরের দিকে তৃণা নিজেই লিখতো I আর সেই সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলে নিতো দুজনে I হিয়া খুব হাসাহাসি করত I বলতো
-দেখ আবার না তোর সঙ্গে প্রেম হয়ে যায় !
-কদিন পর ওকে বলে দিস I বেশি দেরি করিস না
– আরে একবার লাইনে তো আসুক
সুজনের প্রথম কবিতা পেয়ে হিয়া লিখেছিল
– কি সব হাবরা-যাবরা লিখেছে, কিছুই তো বুঝতে পারছি না
তৃণার ভীষণ মেজাজ খারাপ হয়েছিল I এমন সুন্দর একটা কবিতা লিখেছে আর হিয়া এই সব বলছে I তৃণা বলেছিল
– এভাবে বলছিস কেন ?
– তো কি করব ? খুশিতে নাচবো ?
– চাইলে নাচতে পারিস I এটা কিন্তু গ্রিন সিগন্যাল এর শুরু
– তাই নাকি ? হিয়া লাফিয়ে উঠেছিল I তাহলে কালকে ওর সঙ্গে দেখা করি ?
– একেবারেই না I আমি যেভাবে বলছি সেটা কর I আগামী দুইদিন তুই ক্লাসে যাবি না I মেসেঞ্জার ও অফ করে রাখবি
– এর মানে কি ? তুই না বললি গ্রিন সিগন্যাল ?
– হ্যাঁ, কিন্তু সেটা পার্মানেন্ট করতে হবে তো
হিয়া সত্যি সত্যি পরবর্তী দুই দিন ক্লাসে গেল না I সুজন ওকে অনেকবার কল দিয়েছিল I কিন্তু হিয়া অফলাইনে ছিল I তিনদিন পর সুজনের যখন পাগলপ্রায় অবস্থা তখন হিয়া অনলাইনে এসে মেসেজ পাঠালো
– কি হয়েছে এত বার কল দিচ্ছ কেন ?
জবাবে সুজন লিখেছিল
‘এক কোটি বছর হয় তোমাকে দেখি না
একবার তোমাকে দেখতে পাবো
এই নিশ্চয়তাটুকু পেলে-
বিদ্যাসাগরের মতো আমিও সাঁতরে পার
হবো ভরা দামোদর
কয়েক হাজার বার পাড়ি দেবো ইংলিশ চ্যানেল;
তোমাকে একটিবার দেখতে পাবো এটুকু ভরসা পেলে
অনায়াসে ডিঙাবো এই কারার প্রাচীর,
একবার দেখা পাবো শুধু এই আশ্বাস পেলে
এক পৃথিবীর এটুকু দূরত্ব
আমি অবলীলাক্রমে পাড়ি দেবো।
তোমাকে দেখেছি কবে, সেই কবে, কোন বৃহস্পতিবার
আর এক কোটি বছর হয় তোমাকে দেখি না।……….’
এর পরেও বেশ অনেকটা সময় লেগেছিল ওদের দুজনের কাছাকাছি আসতে I তৃণা ভেবেছিল হিয়ার অমন সুন্দর মুখশ্রী , এ মুখের মায়া সহজে কেউ এড়াতে পারবে না I কিছুদিন পর আর এসব কবিতার প্রয়োজন পড়বে না I কিন্তু সেটা আদতে হয়নি I সুজন বোধহয় আসলেই আর দশটা ছেলের মত নয় I তৃণা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘড়িটা আবার দেখলো I দশটা বেজে গেছে I একটু অস্বস্তি নিয়ে তৃনা ফোনটা হাতে নিল I কী আশ্চর্য সুজন কল করল কখন ? মনে পড়ল স্টেজে ওঠার আগে ফোনটা সাইলেন্ট করা হয়েছিল, আর ঠিক করা হয়নি I তাই বোধহয় শুনতে পাইনি I এবার তৃণা নিজেই কল করল I সুজন বলল
– তোমাকে ফোন করলাম ধরলে না যে
– সরি, ফোনটা সাইলেন্ট ছিল খেয়াল করিনি
– কি পড়তে চাও আজকে ?
– থার্মোডাইনামিক্স নিয়ে বসি ?
– পড়া যায় I তবে আমার কাছে নোটটা নেই I হাবিব নিয়ে গেছে I তোমার কাছে বই আছে ?
– লাইব্রেরী থেকে তুলেছিলাম I দাঁড়াও নিয়ে আসছি
-আচ্ছা আমরা আজকে ফার্স্ট এন্ড সেকেন্ড ‘ল পড়বো
– ঠিক আছে
সুজন বোঝাতে আরম্ভ করলো I পড়াতে পড়াতে কেমন একরকম নেশা ধরে গেল ওর I তৃণা মাঝে মাঝে টুকটাক প্রশ্ন করলেও মোটামুটি সুজনকে বলতে দিল বেশি I সুজন অসম্ভব ভালো পড়ায় I সব ভালো ছাত্রের মধ্যে এই গুনটা থাকেনা I ওর মধ্যে আছে I ও নিঃসন্দেহে একজন ভালো টিচার হতে পারবে I তৃণা একসময় হাই তুলে বলল
– আজ এ পর্যন্তই থাক I সাড়ে এগারোটা বেজে গেছে I
সুজন চমকে উঠলো I কি অদ্ভুত I থার্মোডাইনামিক্স এর সূত্রে ও এমন ভাবে আটকে ছিল যে সময়ের খেয়ালই ছিল না I অন্যদিন হলে এই সময়টা ওর কাটতেই চায় না I শুধু ঘড়ির দিকে তাকায় আর কবিতার জন্য অপেক্ষা করে I
– আচ্ছা ঠিক আছে আজকে এই পর্যন্তই থাক I কালকে শেষ করে দেব I যতটুকু পড়েছি তুমি পুরোটা মুখস্ত করে রেখো I
– আচ্ছা ঠিক আছে তাহলে কাল কথা হবে I
ঘুমাতে যাওয়ার আগে তৃণা ভাবলো একবার হিয়ার আইডিটা চেক করে দেখা যেতেই পারে I কেন জানি একটা ক্ষীণ আশা মনের মধ্যে দেখা দিচ্ছে , যদি সব ঠিক হয়ে যায় I আইডি ওপেন করে তৃণা হতভম্ব হয়ে গেল I এইমাত্র সুজন একটা কবিতা পাঠিয়েছে
তোমার কাছে আর যাব না
নদীর কাছে যাবো
সকাল বেলার ভাঙ্গন দেখে
তোমার ছায়াই পাব
তোমার কাছে আর যাব না
যাবো মেঘের কাছে
তোমার চেয়ে দৃশ্য বদল
তারই জানা আছে
তোমার কাছে আর যাব না
যাব সমুদ্দুরে
তোমার চেয়ে চতুর ঢেউয়ে
ভাসবো অনেক দূরে
তোমার কাছে আর যাব না
থাকবো নিজের কাছে
তোমায় ছেড়ে ভালো থাকার
অনেক কিছুই আছে
কবিতাটা পড়ে তৃণার মনটাই খারাপ হয়ে গেল I তৃণা খুব করে চেয়েছিল যেন ওদের ভালোবাসাটা সফল হয় I অন্তত একবারের জন্য হলেও ওর ভালবাসার প্রতি বিশ্বাস টা ফিরে আসত I মনে হতো এই পৃথিবীতে সবাই ওর বাবা মায়ের মত নয় I এখনও এই পৃথিবীতে ভালোবাসা বেঁচে আছে I কিন্তু হিয়া সবটাই মিথ্যা প্রমাণ করে দিল I
কবিতাটা পাঠানোর পর সুজন অনেকক্ষণ বারান্দায় বসে রইল I আজও বোধহয় ঘুম আসবে না I আজ তৃণা কে পড়াতে যেয়ে একটা ব্যাপার বুঝতে পেরেছে সুজন I পড়ানো টা শুধু ওর ভালো লাগা নয়; একটা প্যাশন ও বটে I আবেগের বশে ও আর এটাকে নষ্ট করবে না I
কিন্তু যেই কথাটা সুজন কিংবা তৃণা কেউ জানলো না; তা হল পুরনো আইডি খুলে কবিতাটা দেখে হিয়া একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ঘুমাতে চলে গেল I
চলবে……..