#পূর্ণিমাতিথিপর্ব-৩৬
#লেখিকা-তাসনিম জাহান রিয়া
আব্বু আমি তোমার কাছ থেকে কিছু জানতে চাই। আমার কিছু প্রশ্ন ছিল। যেগুলোর উত্তর আজকে আমার চাই। আজকে আমার সব প্রশ্নের উত্তর তুমি দিবে বল।
তোমাকে আমি আগেই বলতে পারছি না প্রশ্নের উত্তর দিব কী না। আগে তোমার প্রশ্নগুলো শুনি তারপর ভেবে দেখবো উত্তর দেওয়ার কথা।
আব্বু প্লিজ না করো না। এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানা আমার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। আব্বু আমি ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি তুমি ভাইয়া এবং আমার থেকেও বেশি প্রীলিয়া আপুকে প্রায়োরিটি দিয়ে এসেছ। কিন্তু কেনো? এমনটা নয় যে আমরা জানি না যে তুমি আমাদের ভালোবাসো। আমরা জানি তুমি আমাদের ভীষণ ভালোবাসো। নিজের থেকেও বেশি আমাদের ভালোবাসো। আমাদের জন্য হাসতে হাসতেও নিজের জীবনটা দিয়ে দিতে পারো। কিন্তু তুমি কেনো প্রীলিয়া আপুর সামনে দেখাতে তুমি আমাদের ভালোবাসো না? আমার এবং ভাইয়ার প্রিয় জিনিসগুলো যদি প্রীলিয়া আপুর ভালো লাগতো তাহলে তুমি সেগুলো প্রীলিয়া আপুকে দিয়ে দিতে। আমার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছিল যে ছেলের ঐ ছেলে আমার সাথে বিয়ে ভেঙ্গে দিয়ে প্রীলিয়া আপুকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিল। তবুও তুমি কিছু বললে না। চুপচাপ সবকিছু মেনে নিলে। বিনা বাধায় ওদের এ্যাংগেইজমেন্ট হয়ে যেতে দিলে। ভাইয়া রিয়েক্ট করেছিল বলে তুমি ভাইয়াকেও থামিয়ে দিলে। এই নয় যে আমি রুদ্রর সাথে অসুখী। রুদ্রর মতো মানুষ হয় না। উনাকে পেয়ে আমার জীবন পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। আমি অনেক ভাগ্যবতী উনার মতো একজন লাইফ পার্টনার পেয়েছি। কিন্তু আব্বু আমার প্রশ্নের উত্তরগুলো জানা খুব প্রয়োজন। প্লিজ আব্বু আজকে সব বলো।
তুমি এখন বড় হয়েছ। সবকিছু জানার অধিকার তোমার আছে। তোমার মামাকে দেখে যা মনে হয় তোমার মামা আসলে তেমন
নয়। উনি ভীষণ অহংকারী একজন মানুষ। প্রীলিয়ার মতোই স্বার্থপর। বাবা-মায়ের গুণগুলোই তো সন্তান পায়। প্রীলিয়াও তোমার মামার মতোই জেদী আর একরোখা। নিজের জেদ বজায়া রাখার জন্য সবকিছু করতে পারে। কাউকে খুন করতেও পিছপা হবে না। যেমনটা প্রীলিয়া নিজের জেদ বজায়া রাখার জন্য তোমাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছিল। তোমার বয়স যখন তিন বছর তোমার একটা খেলনা প্রীলিয়া কেঁড়ে নিয়েছিল। সেটার জন্য তুমি চিৎকার করে কাঁদছিলে। প্রীলিয়া বদ মেজাজি আর অহংকারী থাকাই রুদ্র ওকে সহ্য করতে পারতো না। রুদ্রর পিছন পিছন সব সময় তুমি থাকতে। রুদ্রকে ছাড়া তুমি কিছুই বুঝতে না। তুমি ছোটবেলায় দেখতে অনেকটা পুতুলের মতো ছিলে। তুমিই ছিলে রুদ্রর খেলার পুতুল। তোমাকে খাইয়ে দেওয়া ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া সব রুদ্র করতো। প্রীলিয়াকে সহ্য করতে পারতো না আর প্রীলিয়া তোমাকে কাঁদাচ্ছে এটা দেখে রুদ্র ভীষণ রেগে যায়। প্রীলিয়ার হাত থেকে খেলনাটা কেড়ে নিয়ে প্রীলিয়াকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। এটা নিয়ে তোমার মামা ভীষণ রাগারাগি করে। রীতিমত তেড়ে আসে রুদ্রকে মারার জন্য। তোমার আংকেল তোমার মামার অসভ্যতামো দেখে রেগে চলে যান রুদ্রকে নিয়ে। তোমার মামার সাথে সব সম্পর্ক নষ্ট করে দেন। কিন্তু আমি চাইলেও সেটা করতে পারতাম না। আমার মাথায় ছিল তখন ঋণের বোঝা। তোমার মামার কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা আমি ধার নিয়েছিলাম। তাই তো তোমার মামার সব অন্যায় আবদার আমার মেনে নিতে হতো। তোমার মামার আবদার মেনে না নিলে আমাকে তোমাদের নিয়ে গাছ তলায় গিয়ে দাঁড়াতে হতো। তখন তোমাদের জীবনটা এতো সুন্দর হতো না।
এ্যাংগেইজমেন্টের দিন চুপ থাকার কারণই কী এটাই ছিল?
না। অনেক আগেই আমি তোমার মামার সব টাকা ফেরত দিয়ে দিয়েছি। তোমার মামা আমাকে বলেছিল, আমি যদি কোনো রকম সিনক্রিয়েট করার চেষ্টা করি তাহলে তোমাকে আর তোমার ভাইকে মেরে ফেলবে। আমি জানতাম তোমার মামার জন্য এসব কিছু অসম্ভব নয়। প্রীলিয়ার অন্যায় আবদার পুরণ করার জন্য তোমার মামা সবকিছু করতে পারে। সেই ভয়েই আমি চুপ ছিলাম আর শাওনকেও কোনো রকম সিনক্রিয়েট করতে দেইনি।
রুদ্র এসব কিছু জানে?
হ্যাঁ আমি বলেছি কিছুদিন আগে।
প্রীলিয়া আপুর এক্সিডেন্টটা কী রুদ্রই করিয়েছে?
না। কিন্তু আমার মনে হয় প্রীলিয়ার মৃত্যু পিছনের রহস্য রুদ্র জানে। কিন্তু সবার সামনে সেই রহস্য ফাস করতে নারাজ।
আচ্ছা আব্বু আমি আসি।
এখনি চলে যাবি?
হ্যাঁ। এখান থেকে কলেজে যেতে হবে। আজকে তো কলেজে যাওয়া হলো না তাই ত্রয়ীর কাছ থেকে সব নোট নিব দেন বাসায় যাব।
একা যাবি? আমিও তোর সাথে যাই চল।
না তোমাকে আর কষ্ট করে যেতে হবে না। আমি একাই যেতে পারবো। আব্বু তোমার পিচ্চিটা আর পিচ্চি নেই সে এখন বড় হয়ে গেছে। একা পথ চলতে পারে।
বাবা মার কাছে সন্তান কখনো বড় হয় না। তুই তো আমার পিচ্চি রাজকন্যা। সাবধানে যাবি আর পৌছে আমাকে একটা ফোন দিবি।
আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম। আম্মুর সাথে দেখা করে বাসা থেকে বের হয়ে এলাম। রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে ভাইয়াকে মেসেজ করে দিলাম। এবার ভাইয়ার মনের প্রশ্নগুলোর উত্তর মিলবে।
________________
বাসায় আসতে আসতে বিকাল হয়ে গেলো। বাসায় এসেই আগে শাওয়ার নিয়ে নিলাম। ঘামে ভিজে একাকার হয়ে গিয়েছিলাম। পাক্কা এক ঘন্টা জ্যামের জন্য আটকে ছিলাম। বিরক্তির চরম মাত্রাই পৌছে গিয়েছিল।
টাওয়াল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বের হতেই বার কয়েক বার কেউ দরজায় নক করলো। হাতের টাওয়ালটা চেয়ারে রেখে দরজার দিকে অগ্রসর হলাম। দরজা খুলে দিতেই মামুনি আমার দিকে নিজের ফোনটা বাড়িয়ে দিল। আমি জিঙ্গাসু দৃষ্টিতে মামুনির দিকে তাকাই।
রুদ্র ফোন করেছে। নে কথা বল।
মামুনির সামনে রুদ্রর সাথে কথা বলবো ভাবতে জানি কেমন লজ্জা লাগছে। আমি নিজেকে ধাতস্থ করে ফোনটা হাতে নিলাম। ফোনটা কানের কাছে নিতেই নিশ্বাসের আওয়াজ ছাড়া আর কিছু শুনতে পেলাম না। আমি হ্যালো বলতেই রুদ্র ফোন কেটে দিল। কি থেকে কি হলো কিছুই আমার বোধগম্য হলো না। আমি মামুনির দিকে ফোনটা বাড়িয়ে দিলাম।
কী হলো?
রুদ্র ফোন কেটে দিয়েছে।
রুদ্র তোর ওপর ভীষণ রেগে গেছে। তুই তো রুদ্রকে বলেই ঐ বাসায় যেতে পারতি। কলেজের নাম করে কেনো গেলি? রুদ্র তোকে ফোন করতে করতে অস্থির হয়ে ওঠেছিল। কিন্তু তোরে ফোনে কিছুতেই কল ঢুকেছিল না। পরে ত্রয়ীকে কল করে জানতে পারে তুই তোদের গিয়েছিস। এটা জানার পরই তোদের বাসায় যেতে চেয়েছিল। কিন্তু হসপিটাল থেকে কল আসায় হসপিটাল চলে যেতে হয়েছে। আবার নিশ্চয়ই ঝগড়া করেছিস। তোদের দুজনকে নিয়ে আর পারি না। এক সাথে থাকলে সারাদিন ঝগড়া করবি। আর দূরে গেলে দুজন দুজনকে চোখে হারাস।
মামুনি বকবক করতে করতে চলে গেলো। আমি একটা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লাম।
_________________
আংকেল কিছুদিনের জন্য চট্টগ্রাম গিয়েছে। মামুনির শরীর খারাপ লাগছিল তাই তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছে। আমি রুদ্রর জন্য অপেক্ষা করছি। রুদ্র এখনো বাসায় ফিরেনি। ড্রয়িংরুমে বসে পড়ছিলাম। হঠাৎ করে কলিংবেল বেজে ওঠায় তাড়াতাড়ি করে ওঠতে গিয়ে সোফা থেকে ঠাস করে পড়ে গেলাম। তেমন একটা ব্যথা পাইনি। তাড়াতাড়ি করে ওঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। দরজা খুলতেই রুদ্র হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে হাতে থাকা ব্যাগটা ছুড়ে ফেলে দেয়। আমার বাহু দুটো খুব শক্ত করে চেপে ধরে। রাগে হিশহিশিয়ে বলে,
তোমার আমাকে মানুষ মনে হয় না। আমার সাথে যা ইচ্ছে তাই করা যায় তাই না? তুমি কেনো বুঝতে পারো না তোমার জন্য কারো চিন্তা হয়। তোমার চিন্তায় কেউ অস্থির হয়ে ওঠে। তোমাকে এক মুহূর্ত দেখতে না পারলে আমার বক্ষঃস্থল চিন চিন ব্যথা হয়। চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসে। সারা পৃথিবী এলোমেলো হয়ে যায়।
চলবে………