#পূর্ণিমাতিথিঅন্তিম_পর্ব
#লেখিকা-তাসনিম জাহান রিয়া
নিস্তব্ধ পরিবেশ। কারো মুখে কোনো কথা নেই। সবাই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ভাইয়া অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। আমরা সবাই এখন ৬ তলার একটা বিল্ডিংয়ের ৫ তলায় দাঁড়িয়ে আছি। তখন আমরা রাস্তার পাশে ভাইয়াকে দেখতে পেয়েছিলাম। ভাইয়াকে বাংলাদেশে দেখে আমি আর রুদ্র দুজনেই ভীষণ অবাক হয়েছিলাম। গত দুই মাস যাবৎ ভাইয়ার সাথে আমাদের কোনো যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু ভাইয়াকে যে বাংলাদেশে দেখবো সেটা কল্পনাও করতে পারিনি।
রুদ্র ভাইয়াকে ডাক দেওয়ার আগেই ভাইয়া একটা গাড়িতে ওঠে পড়ে। আমরাও ভাইয়ার গাড়ির ফলো করতে শুরু করি। বাসায় ফোন করে ভাইয়ার কথা জানিয়ে দেই। আম্মু এই দুই মাস ভাইয়ার টেনশনে প্রায় অসুস্থই হয়ে পড়েছিল। ভাইয়ার গাড়িটা দাঁড়ায় ৬ তলা বিল্ডিংয়ের সামনে। বাসার সবাই আসলে আমরা এক সাথে গিয়ে ভাইয়ার ফ্ল্যাটে হামলা করি।
আমি ভাইয়ার হাত টেনে ধরে বললাম, ভাইয়া।
একদম আমাকে ভাইয়া বলবি না। আমি কারো ভাইয়া না।
তুমি এমন করছো কেনো?
তাহলে আমার কেমন করা উচিত? তোর সাথে এতো কিছু ঘটে গেলো সেটা জানার অধিকার কী আমার ছিল না। তুই আর রুদ্র এক্সিডেন্ট করেছিস সেটা জানার অধিকার কী আমার ছিল না? তোর মিসক্যারেজ হলো, তুই ডিপ্রেশড হয়ে বার বার সুইসাইডের চেষ্টা করলি সেগুলো জানার অধিকার কী আমার ছিল না। আমার বোনের সাথে এতকিছু ঘটে গেলো যে আমি জানতেই পারলাম না। জানব কী করে? আমাকে তো জানানোই হয়নি। আমার বোনের এরকম একটা ক্রাইসিসের মাঝে দিয়ে গেলো আমি ওর পাশে দাঁড়াতে পারিনি। ওর কাধে হাত রেখে তোর ভাই আছে তো পাশে এই কথাটা বলা তো দূরে থাক ওকে দুটো সান্ত্বনার বাণীও শুনাতে পারিনি।
এখানে আমার দোষ কোথায় ভাইয়া? তুমি আমার সাথে এমন করছো কেনো? তোমাকে জানানোর মতো অবস্থায় তো আমি ছিলাম না। তখন আমি এমন একটা পরিস্থিতিতে ছিলাম যে আমার দিন দুনিয়ার কোনো খেয়ালই ছিল না আর আমি তো এটা জানতাম না কেউ তোমাকে কিছু জানায়নি।
হুট করে ভাইয়া আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়।
আমার বোন এরকম একটা সিচুয়েশনের মধ্যে দিয়ে গেছে কিন্তু আমার পরিবারের লোক আমাকে কিছু জানানোর প্রয়োজন বোধ করেনি। অন্য কারো কাছ থেকে খবরটা শোনার পর আমার কী অবস্থা হয়েছিল সেটা তোমরা কেউ বুঝতে পারবে না। নিজেকে অক্ষম মনে হচ্ছিল। ভাই হয়ে বোনের বিপদে পাশে দাঁড়াতে পারিনি। নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছিল।
আম্মু এতক্ষণ চুপ করে ছিল। আম্মু অপরাধীর ন্যায় নিচু স্বরে বললো,
তখন তোকে বলার মতো পরিস্থিতিতে আমরা ছিলাম না। তোকে জানানোর কথা মাথায় ছিল না। রিয়া অসুস্থ, তার উপর বাচ্চার জন্য পাগলামো করা, রুদ্রও অসুস্থ ছিল। ওকে যে রুদ্র সামলাবে সে অবস্থাতে ও ছিল না। সবকিছু সামলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছিলাম। সবকিছু ঠিক হলে তোকে একবার জানাতে চেয়েছিলাম। পরে ভাবলাম আর তো কয়েকটা মাসের ব্যাপার তুই দেশে আসলেই তোকে সবটা বলবো। এতো দূরে একা একা থাকিস এসব কিছু জানলে তুই টেনশন করবি।
তোমার কী মনে হয় আম্মু রিয়ার খবর শোনার পরও আমি ঐ দেশে পড়ে থাকতাম?
তিন বছর কম্পলিট হওয়ার আগে তুমি দেশে ফিরে আসলে তো তোমার চাকরিটা চলে যেতো। ভাইয়া এই চাকরিটা তো তোমার স্বপ্ন ছিল।
চাকরি কী চলে যাবে? আমি নিজেই চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছি। আমার বোনের থেকে আমার স্বপ্ন বড় না। যে চাকরির জন্য আমি আমার বোনের পাশে থাকতে পারিনি সেই চাকরির দরকার নেই আমার।
দুই মাস ধরে তুমি দেশে আছো তাই না?
ভাইয়া মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।
তাহলে তুমি আমাদের সাথে দেখা করোনি কেনো? এই দুই মাস তুমি আমাদের সাথে যোগাযোগ করনি। তোমার ব্যাপারে কোনো রকম ইনফরমেশন আমাদের কাছে ছিল না। তোমাকে নিয়ে কতোটা টেনশনে আমরা দিন পার করেছি সেটা তুমি বুঝতে পারছ?
পেটে হুট করেই হালকা ব্যথা করছে। আমি ভাইয়াকে ছেড়ে দিয়ে সোফায় গিয়ে বসলাম।
তোদের ওপর ভীষণ অভিমান হয়েছিল। তাই তোদের সাথে দেখা করিনি। কিন্তু আড়াল থেকে সবার খোঁজ খবর আমি রেখেছি।
পেটে ব্যাথা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। আমি ঠোঁট দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে বসে আছি। রুদ্র আমার দিকে তাকাতেই চমকে ওঠলেন। অস্থির হয়ে এসে আমার পাশে বসলেন।
রিয়া তুমি এভাবে বসে আছো কেনো? তোমার খারাপ লাগছে? কোনো অসুবিধা হচ্ছে?
ব্যাথাটা দ্বিগুণ হারে বেড়ে গেলো। আমার সহ্য ক্ষমতার বাইরে চলে গেলো। আমি রুদ্রর বাহুর কাছে শার্টটা খামছে ধরে চিৎকার করে ওঠলাম। আমার চিৎকার শুনে রুদ্র আরো অস্থির হয়ে পড়লেন। ভাইয়া এগিয়ে এসে বলে,
রিয়াকে এখনি হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে। রুদ্র তুমি রিয়াকে নিয়ে এসো আমি গাড়ি বের করছি।
_________________
ডেলিভারি ডেইট আরো দশ দিন পর ছিল। কিন্তু আজকেই লিভার পেইন শুরু হয়ে যাওয়ায় আজকেই ডেলিভারি হবে। এটা নিয়ে রুদ্র ডক্টরদের প্রশ্ন করতে করতে পাগল করে দিচ্ছেন। কেনো দশদিন আগে হবে? এরকমটা কেনো হচ্ছে? দশদিন আগে হওয়ায় কোনো সমস্যা হবে না তো? আমি এবং বেবি দুজনেই সুস্থ থাকবো তো? ব্লা ব্লা। ডক্টররা রুদ্রর প্রশ্নে রীতিমত বিরক্ত হয়ে গেছেন। উনিও যে একজন ডক্টর সেটা ভুলে গিয়ে রুদ্র বাচ্চাদের মতো বিহেইভ করছেন।
কিছুক্ষণের মাঝেই আমাকে ওটিতে ঢুকানো হবে। রুদ্র আমার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি যন্ত্রণায় ছটফট করছি। রুদ্র আমাকে কী সান্ত্বনা দিবে রুদ্র নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারছেন না। রুদ্রর কপাল থেকে দর দর করে ঘাম ঝরছে। আমি একটু জুরে চিৎকার দিলেই উনার মুখের অবস্থা ভয়ানক হয়ে যায়। যেনো আমি না উনি ব্যথা পাচ্ছেন।
রুদ্র পড়ে যেতে নিলে ভাইয়া এসে ধরে ফেলে। আমাকে ওটিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আর রুদ্রকে একটা ডক্টর দেখছেন।
বেশি টেনশন করার ফলে আপনার প্রেসার হাই হয়ে গেছে। স্যার মেম একদম ঠিক আছেন। আপনি এতো বেশি টেনশন করলে তো আপনি স্টোক করবেন।
_____________________
আমার মেয়ে হয়েছে। রুদ্র মেয়েকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি উনার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। কয়েক ঘন্টায় চেহেরার কী হাল করেছেন। রুদ্রর পাগলামো দেখে সবাই হাসাহাসি করছে। কিন্তু এতে উনার কোনো হেলদুল নেই। উনি আমাকে কাছে এসে আমার কপালে একটা চুমু এঁকে দিলেন। মেয়ের কপালে একটা চুমু দিয়ে বললেন,
আমাদের মেয়ের নাম রুদ্রিতা জাহান আর্শিয়া।
রুদ্রিতা আয়মান আর্শিয়া হলে কেমন হবে?
ভাইয়া কেবিনে ঢুকতে ঢুকতে বললো, রুদ্রিতা জাহান আর্শিয়াই বেস্ট।
_________________
কেটে গেছে চারটা বছর। চারটা বছর কেটেছে হাসি-আনন্দ আর মান অভিমানের মাঝে দিয়ে। রুদ্রর সাথে ঝগড়া হয়েছে অনেকবার। অভিমানে গাল ফুলিয়ে রেখেছি। উনি আহ্লাদের সাথে আমার অভিমান ভাঙিয়েছেন। রুমে ঢুকতেই একটা মনো মুগ্ধকর দৃশ্য নজরে এলো। আর্শিয়া রুদ্রকে চেইন্জ করতে সাহায্য করছে। নিজের ছোট ছোট হাত দ্বারা যতটুকু পারছে ততটুকু করছে। রুদ্রর হাত থেকে ঘড়ি খুলে দিচ্ছে।
আমি দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্যটা উপভোগ করছি। আর্শিয়ার বয়স এখন চার বছর। আর্শিয়া একদম রুদ্রর মতো হয়েছে। আমার আর ওর মাঝে অল্প কিছু মিল আছে। আমার ঠোঁটের নিচে তিল আছে ওর ঠোঁটের নিচেও তিল আছে। ওর চোখ দুটোও আমার চোখের মতোই।
রুদ্রিতা।
নিভ্রর ডাক শুনে আর্শিয়া দরজার দিকে তাকায়। সবাই আর্শিয়া ডাকলেও নিভ্র রুদ্রিতা ডাকে। নিভ্রর বয়স ৮। নিভ্রকে দেখেই আর্শিয়া ছুটে আসে। এভাবে ছুটে আসায় পড়ে যেতে নিলেই নিভ্র এসে ধরে ফেলে। আর্শিয়া শুধু বাপের চেহেরা আর সাদা চামড়াটাই পেয়েছে আর সবকিছুই আমার মতো। আমার মতো ছটফটে আর চঞ্চল। কিন্তু প্রচণ্ড জেদি। নিভ্র আর্শিয়াকে ধমক দিয়ে বলে ওঠে,
দেখে চলতে পারিস না? আমি না ধরলে তো এখনি পড়ে যেতি।
নিভ্র আর্শিয়াকে বকতে বকতে রুম থেকে নিয়ে চলে যায়। রুদ্র আমাকে এসে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে। আমাকে জড়িয়ে ধরেই বেলকনিতে নিয়ে আসে। আজকে আকাশে থালার মতো চাঁদ ওঠেছে। উনি আকাশের দিকে ইশারা করে বললেন,
চাঁদের পরিপূর্ণ রূপ হওয়ার সময়কে কী বলে জানো?
নাহ।
পূর্ণিমাতিথি। আমার জীবনেও তোমার আগমনটাও পুর্ণিমাতিথির মতো। তুমি আমার জীবনে এসে আমার জীবনটা পরিপূর্ণ করে দিয়েছ। তোমার হাতে হাত রেখে হাজারটা পুর্ণিমাতিথি পার করতে চাই। থাকবে তো আমার পাশে?
হাজারটা পুর্ণিমাতিথি পার করতে পারবো কী না জানি না। কিন্তু জীবনের শেষ পূর্ণিমাতিথি পর্যন্ত আপনার পাশে থাকব।
…….সমাপ্ত…….
[এতদিনের অপেক্ষার অবসান ঘটলো। আমার পাঠক ভাগ্য বরাবরই ভালো। আপনারা আমার সিচুয়েশন বুঝে প্রত্যেকটা পর্বের জন্য ভীষণ অপেক্ষা করেছেন। এতোটা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে প্রতিটা পর্ব পড়ার জন্য ধন্যবাদ। আর অন্তরের অন্তস্তল থেকে আপনাদের জন্য ভালোবাসা রইল। সবাই কিন্তু অবশ্যই জানাবেন আপনাদের কাছে উপন্যাসটা কেমন লেগেছে ]