ভালোবাসার সংসার পর্বঃ০২

0
393

#ভালোবাসার_সংসার
#পর্বঃ০২
#ফারজানা

সায়রা চলে যাওয়া’র পর পুরো একটা সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে আজ।প্রথম দু-তিনদিন আলভি’র অফিস সামলে ছেলে’দের সামলাতে খুব অসুবিধা হলেও কোনো খোঁজ করেনি সায়রার।ভেবেছে এমনিই চলে আসবে।বাপের বাড়ি ছাড়া যাওয়ার তো আর জায়গা নেই।ও এমনি এমনি ঠিকই চলে আসবে।কিন্তু পাঁচ পাঁচটা দিন পেরিয়ে গেলেও যখন সায়রা ফিরলোনা এমনকি একটা ফোন করে ছেলেদের খবর পর্যন্তও নিলোনা তখনই যেনো টনক নড়লো আলভির। তৎক্ষনাৎ শ্বশুরমশাই’কে ফোন করলো।কিছুক্ষণের কথোপকথনেই সে বুঝে গেলো সায়রা তার বাবা’র বাড়ি যায়নি।তবে কোথায় গেলো মেয়েটা?কোনো বন্ধুর বাড়ি গেলো কি?এসব ভেবেই সেদিন সারাদিন ধরে সায়রার পরিচিত সকল বন্ধুদের বাড়ি গিয়ে,ফোন করেও কোনো খোঁজ পেলোনা আলভি।এবার যেনো রীতিমত অ’স্হি’র হয়ে পড়েছে আলভি।রাগের সাথে সাথে কিছু একটা হারানোর ব্যথাটাও বুকের ভিতর তরতর করে বেড়ে চলেছে।

আলভি তো ভেবেছিলো যে সায়রা নামক মেয়েটা তার জীবন থেকে সরে গেলেই সে শান্তি পাবে।মেয়েটার সাথে থাকতে থাকতে একদম বিরক্ত হয়ে উঠেছিলো সে।দশ বছরে’র সংসার জীবনে সত্যিই সে হাঁপিয়ে উঠেছিলো।সারাদিন পর ক্লান্ত দেহে বাসায় ফিরলে সায়রার ঘর্মাক্ত মুখশ্রী,এলোমেলো বসন দেখলেই যেনো বিরক্তি’র মাত্রা আকাশ ছোঁয়া হয়ে যেতো।ধীরে ধীরে তার প্রতি সায়রার অত্যধিক যত্ন,খেয়াল রাখা এসবও যেনো অসহ্য লাগতে শুরু করলো।আর এর ফলে প্রায়ই সূত্রপাত হতো ঝ’গ’ড়া’র।যদিও তা বেশিরভাগ সময়ই হতো একপাক্ষিক।সায়রা কখনোই খুব একটা উত্তর করতোনা।তবে সেদিন সায়রা খুব ক’ড়া স্বরেই কিছুটা উত্তর দিয়েছিলো যার ফলস্বরূপ নিজের অজান্তেই আলভির মুখ থেকে তালাকের কথাটি বেরিয়ে গেছিলো।যদিও তখন সেই ঘটনার জন্য তার বিন্দুমাত্র কোনো অ’নু’শো’চ’না ছিলোনা তবে এখন আছে।তীব্র অ’নু’শো’চ’না,অ’প’রা’ধ’বোধ তাকে ঘিরে ধরেছে।

সাতদিনের এই দূরত্ব যেনো আলভির চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে সায়রা আসলে তার জীবনের কতখানি?তার হৃদয়ের কতটা জুড়ে সায়রার অবস্হান।সায়রার প্রস্হানের ফলেই সে বুঝতে পেরেছে আসলে তার বিরক্তিটা সায়রার উপরে নয় বরংচ তাদের মধ্যে তৈরি হওয়া দূরত্বের উপরে ছিলো।সায়রার থেকে দূরত্বটুকুই সে সহ্য করতে পারছিলোনা যার ফলস্বরূপ তার মনে সৃষ্টি হয়েছিলো সায়রার প্রতি তীব্র অভিমান,অনুরাগ।এই অভিমানেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এভাবে।তা নাহলে আলভি শতবিরক্তি থাকা সত্ত্বেও কেনোইবা কখনো তার বিছানার পাশের অংশটি খালি রাখতে দেয়নি?সায়রার একটুখানি অ’সু’স্থ’তা’ও কেনো তাকে এতোটা বি’চ’লি’ত করে তুলতো?শুধু কি নিজে অসুবিধা থেকে বাঁচার কারণ হিসেবেই আসতো এই বি’চ’ল’তা?

আলভির আজ খুব মনে পড়ছে তাদের বিয়ের প্রথম দিককার সময়ের কথা।বাইরের কর্মব্যস্ততা সামলেও দুজনার একে-অপরের জন্য ছিলো অফুরন্ত সময়।সায়রার মায়াবি মুখটা দর্শন করলেই তার ভিতরকার সমস্ত ক্লা’ন্তি,অ’ব’সা’দ যেনো এক নিমিষে দূর হয়ে যেতো।যেকোনো সমস্যায় পড়লেই সে জানতো কারোর কোমল হাতযুগল সর্বক্ষণ তার হাত আঁকড়ে আছে ভ’র’সা যোগাবার জন্য।জীবনের সকল পরিস্থিতিতে কেউ একজন আছে যে তার পাশে থাকবে।বিশ্বাস, ভরসা, স্নেহ,আদর, আল্হাদ, খুনশুটিতে গড়ে উঠেছিলো তাদের ভালোবাসার সংসার।সেই সংসারে ভালোবাসার ঝুলি উপচে দিতে এসেছিলো তাদের দুই যময সন্তান।তখন নিজেকে দুনিয়ার সবথেকে বেশি সুখী মানুষ বলে মনে হতো আলভির।কিন্তু একটু একটু করেই যেনো সবটা কেমন খাঁ’প’ছা’ড়া হয়ে গেলো।তাদের ভালোবাসার সংসার থেকে আবেগগুলো সরে গিয়ে যান্ত্রিকতা এসে ভর করছিলো।সারাদিনের অফিসের কর্মব্যস্ততা শেষে বাসায় ফিরেও শা’ন্তি পেতোনা আলভি কারণ সায়রা যে তখনও ব্যস্ত তার ছেলেদের নিয়ে,তার সংসার নিয়ে।বারংবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতেই রা’গ হতো আলভির।মনে হতো সায়রা সারাদিন বাসায় বসে বসে কি এমন করে যে সে ফিরলেও সায়রার এতো ব্যস্ততা?একটুও সময় নেই তাকে দেবার মতো?তাই নিজেও সায়রার জন্য অ’পে’ক্ষা করা বন্ধ করা দেয়।সায়রার যত্নগুলোও আর ভালো লাগতোনা।এভাবেই ধীরে ধীরে দুজনার মাঝে এসে গেলো যো’জ’ন মাইল দূরত্ব।

এখন আলভি বুঝতে পারে কেনো ছিলো সায়রার এতো ব্যস্ততা।সে যে মা, সন্তানদের একমাত্র পরম ভ’র’সা’স্থ’ল।তাদের এই সংসারে’র প্রাণ।তাইতো সায়রা চলে যেতেই তাদের সংসারটা আর সংসার নেই চার দেয়ালের ব’দ্ধ কু’ঠু’রি হয়ে গেছে।আজ আলভির মনে হয় যে কেনো তখন সায়রার জন্য আর একটু অপেক্ষা সে করতোনা?অ’ভি’মা’ন-অ’ভি’যো’গ না করে কেনো নিজে কখনো দুজনের জন্য একটু সময় সে বের করলোনা?সায়রার সারাদিনের ক্লান্তিটুকু কেনো নিজের স্নেহ,ভালোবাসার পরশে সে মুছিয়ে দিলোনা?তবেই তো এতোটা দূরত্ব কখনোই আসতোনা তাদের মাঝে।আসলে প্রত্যেকটা সম্পর্ক একটা চারাগাছের মতো।চারাগাছকে যেমন পানি দিয়ে, সার দিয়ে পরিচর্যার মাধ্যমে বাঁচিয়ে রাখতে হয় যাতে যেকোনো দু’র্গ’ম পরিস্থিতিতেও গাছটির অস্তিত্ব বিনষ্ট না হয় ঠিক তেমনি প্রত্যেকটি সম্পর্কে’র পানি হলো একে অপরকে দেওয়া সময় আর সার হলো ভালোবাসা।সময়,ভালোবাসা আর যত্ন দিয়ে কোনো সম্পর্ককে আগলে রাখলে যতো ঝ’ড়-ঝা’প’টা’ই আসুক না কেনো চিরদিন সেই সম্পর্কের বন্ধন অটুট থাকে।

গ’র’ম পাতিলে ছেঁ’কা লাগতেই নিজের ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে আলভি।তাড়াতাড়ি করে চুলাটা বন্ধ করে পাতিল নামিয়ে নেয়।ছেঁ’কা খাওয়া হাতটা চোখের সামনে ধরতেই দেখতে পায় অনেকটা অংশ লাল হয়ে আছে।হাতটা দেখেই একটা ঘটনা মনে পড়ে চোখে পানি চলে আসে আলভির।..একবার আলভি অনেক জেদ করে সায়রার জন্য রান্না করতে চেয়েছিলো।সায়রার বারণ না শুনেই সে রান্না করা শুরু করে।অসাবধানতা’বশত সেদিনও তার হাতে এভাবেই ছেঁকা লেগে যায়।তারপর থেকে আর কোনোদিন সায়রা তাকে রান্নাঘরে ঢুকতে দেয়নি।সকলকে পরম য’ত্নে,ম’ম’তা’য় আগলে রাখা মেয়েটি আজ কোথায় যেনো হারিয়ে গেছে তা মনে পড়তেই বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে আলভির।ক’ষ্ট’গুলো যেনো অধিক য’ন্ত্র’ণা দেবার নিমিত্তে গলার কাছে দলা পাকিয়ে আছে।তবে একটা বিষয় খটকা লাগছে আলভির।শুধুমাত্র তার কথায় ছেলেদের ছেড়ে যাবার মতো সায়রা নয়।তবে কি তার অজান্তেই আরও কিছু হয়েছিলো?কথাটা মাথায় আসতেই নিজেদের বেডরুমের দিকে পা বাড়ায় আলভি।

বেডরুমে এসে বেডের দিকে তাকাতেই সায়রার ছবি বুকে আঁকড়ে ঘুমিয়ে থাকা ছেলেদের মুখটা দেখতেই বুকের ব্যথাটা যেনো হাজারগুণ বেড়ে গেলো আলভির।মায়ের যত্ন,ভালোবাসা না পেয়ে মাত্র একসপ্তাহেই ছেলেদুটো যেনো অনেকটা মিইয়ে গেছে।যাদের দুষ্টুমিতে সকলে অ’তি’ষ্ঠ হয়ে উঠতো তারাই এখন চুপচাপ মায়ের ছবি আঁকড়ে বসে থাকে।অপেক্ষার প্রহর গুনে চলে মায়ের ফিরে আসার।একটা দী’র্ঘ’শ্বা’স বেরিয়ে আসে আলভির বুক চিঁড়ে।

বেডের কাছে গিয়ে ছেলেদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই সাইরিফ ও আদনান একসাথে “মা এসেছে,মা এসেছে” বলতে বলতে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে।হাসিমুখে পিছনে তাকিয়ে সায়রার পরিবর্তে আলভিকে দেখে দুই ভাইয়ের চোখই পানিতে ভরে ওঠে।চোখের পানি গাল বেয়ে নেমে আসতেই ছেলেদের নিজের বুকে টেনে নেয় আলভি।কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে যায় সাইরিফ,আদনানের।সেই ভাবেই ভাঙা স্বরে সাইরিফ বলে ওঠে,,,

–“ও বাবা মা কে খুঁজে আনোনা প্লিজ।মা কে ছাড়া আর থাকতে পারছিনা।আম্মুকে ছাড়া ঘুম আসেনা,খেতেও ইচ্ছে করেনা।মা না আসলে কিন্তু আমরা না খেয়ে খেয়েই ম’রে যাবো বাবা দেখে নিও।”

সাইরিফের মুখে মু’ত্যু’র কথা শুনে তাকে আরও শ’ক্ত করে নিজের সাথে জড়িয়ে নেয় আলভি।মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।ছেলেরা কিছুটা শান্ত হতেই আলভি বললো,,,

–“এরকম কথা বলতে নেই বাবা।মা আসবে।নিশ্চয়ই আসবে।মা তো আমাদের ছাড়া থাকতেই পারেনা তাইনা?মা খুব তাড়াতাড়ি চলে আসবে আমাদের কাছে।তবে তোমরা একটা কথা আমায় বলোতো বাবা তোমরা কি মা কে কোনো বা’জে কথা বলেছো?যাতে তোমাদের উপর তোমাদের মা রা’গ করে ফেলে এমন কোনো কথা?”

আলভির প্রশ্ন শুনে কিছুক্ষণ চুপ থেকে আদনান বলে ওঠে,,,

–“হ্যাঁ বাবা বলেছিলাম।রা’গ করে আম্মুকে আমরা চলে যেতে বলেছিলাম আমাদের ছেড়ে।”

এবার সবটা পরিষ্কার হলো আলভির কাছে।এই কারণেই তবে সব ছেড়ে কোথাও হারিয়ে গেছে সায়রা।স্বামী,সন্তান সকলের কাছ থেকে অ’ব’হে’লা,তি’র’স্কা’র পেয়ে ভাঙা মন নিয়ে এই বাড়ি,এই সংসার ছেড়েছে সায়রা।কখন যে মেয়েটা বেরিয়ে গেছে তাও কাউকে টের পেতে দেয়নি।রাতেই বেরিয়ে গেছিলো নাকি সকালে?কোথায় গেছে?কিচ্ছুটি জানেনা আলভি।কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই এক ফোঁটা চোখের পানি আলভির গাল বেয়ে নেমে আসে।মনে মনে বলে ওঠে,,,

–“কোথায় হারিয়ে গেলে তুমি মায়াপরি?কোথায় গেলে খুঁজে পাবো তোমায়?আমাদের খুশির চেরাগটাই যে তুমি সেটা আমি বুঝে গেছি।তাইতো তুমি চলে যেতেই আমাদের খুশি,সুখ সবটা তোমার সাথে সাথেই হারিয়ে গেছে।তুমি কি জানো আমি,তোমার সন্তানেরা তোমায় ছাড়া কতোটা ক’ষ্ট, কতোটা য’ন্ত্র’ণা পাচ্ছে?প্লিজ ফিরে এসো মায়াপরি।তুমি দেখো এবার আর আমি আমাদের মাঝে কোনো দূ’র’ত্ব আসতে দেবোনা।কোনো ক’ষ্ট পেতে দেবোনা তোমায়।তবুও একটাবার ফিরে এসো প্লিজ।একটাবার..”

চলবে…

_____________________________________________________________________
ভুল-ত্রুটি ক্ষ’মা’সু’ন্দ’র দৃষ্টিতে দেখবেন এবং গল্পটি সম্পর্কে মতামত জানাবেন।
হেপি রিডিং!!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here