ভালোবাসার সংসার পর্বঃ০৪

0
337

#ভালোবাসার_সংসার
#পর্বঃ০৪
#ফারজানা

খুব কাছ থেকে কিছু ছেলে-মেয়ের আনন্দ উল্লাস কানে আসতে’ই সেদিকে পা বাড়ালো আলভি তার ছেলেদের নিয়ে।কিছুটা সামনে যেতেই দেখা মিললো স্হানীয় কিছু ছোটো-ছোটো ছেলে-মেয়ে খেলছে একজন সাদা শাড়ি পরিহিত নারীকে ঘিরে রেখে।পিছন দিকে মুখ করে থাকায় নারীটির মুখ দেখা যাচ্ছেনা একেবারে’ই।তবে সাদা শাড়ি পরিহিতা খুবই পরিচিত নারী অবয়বটিকে চিনে নিতে মোটেই অসুবিধা হলোনা আলভির।এতোগুলো দিন,এতোগুলো মাসের পরে বহুল আ’কা’ঙ্ক্ষি’ত প্রিয় মানুষটিকে নিজের থেকে মাত্র কয়েকহাত দূরেই আবিষ্কার করে বুকের র’ক্ত ছ’ল’কে উঠে আলভির।হৃৎস্পন্দনের ক’ম্প’ন মাত্রা কয়েকগুণ বেড়ে গেলো যার ফলস্বরূপ শরীরটাও হালকা কাঁ’প’ছে।দুচোখ পানিতে ভরে উঠেছে।খুব তৃ’ষ্ণা পাচ্ছে আলভির।বহুল আকাঙ্ক্ষিত প্রিয় মানুষটির মুখদর্শনের তৃ’ষ্ণা, তার কন্ঠস্বর শোনার তৃ’ষ্ণা, তার কোমল হাতের শীতল ছোঁয়া পাবার তৃ’ষ্ণা প্রবলভাবে মাথা চা’ড়া দিয়ে উঠেছে।সেই প্রবল, মাত্রাতিরিক্ত তৃ’ষ্ণা নিবারণের প্রয়াসেই একটু একটু করে এগিয়ে যেতে লাগলো আলভি নিজের প্রেয়সী,নিজের মায়াপরীর পানে।

ছেলেদুটো মায়ের উপস্থিতি বুঝতে পেরেছে কিনা বোঝা না গেলেও তারাও একভাবেই তাকিয়ে আছে সেই নারীর দিকে।তাদের ছোট্ট মনেও সৃষ্টি হয়েছে অ’স্হি’র’তা’র।তী’ব্র আকর্ষণ করছে সেই নারী দুইভাইকে।খুব খুব ইচ্ছে করছে সামনের মানুষটিকে দেখতে,তার কাছে যেতে।মনের অ’স্হি’র’তা চেপে না রাখতে পেরেই দুইভাই বাবার হাত ছাড়িয়ে ছুট লাগালো সেই নারীটিকে দেখার উদ্দেশ্যে।

__________________________________________________________________

ছোটো-ছোটো ছেলে-মেয়েগুলোর খেলার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সায়রা।চোখ সরাতেই পারছেনা ওদের থেকে।যেনো এদের মধ্যেই দেখতে পাচ্ছে নিজের দুই ক’লি’জা’র টুকরোকে।হৃদয়ের মনিকোঠায় চেপে রাখা কাউকে বলতে না পারা ক’ষ্ট’গু’লো,য’ন্ত্র’ণা’গু’লো সবসময় মানসিকভাবে বড্ড পী’ড়া দেয়।মাঝেমধ্যে মনে হয় এই বুঝি য’ন্ত্র’ণা’গু’লো আর ম’ন-ম’স্তি’ষ্ক সইতে না পেরে প্রা’ণ হারাবে সে।নিশ্বাস আ’ট’কে আসে ছেলেদুটোর কথা ভাবলেই।তাদের থেকে অনেক দূরে আছে সে যেখান থেকে চাইলেই সে তার আদরের মানিকদের দেখতে পারেনা,আদর করতে পারেনা,ভালোবাসতে পারেনা মনে আসতেই ক’লি’জা’টা ছিঁ’ড়ে আসতে চায় য’ন্ত্র’ণা’য়।খুব করে চলে যেতে ইচ্ছে করে প্রিয় মানুষগুলোর নিকট।কিন্তু..তা যে সে পারবেনা।প্রিয় মানুষগুলোর কাছে যাওয়া যে তার পক্ষে অ’স’ম্ভ’ব।

বাচ্চাগুলোর থেকে চোখ সরিয়ে খোলা আকাশের দিকে দৃষ্টি স্হাপন করে সায়রা।গোধূলীর লা’ল আলোয় রাঙা হয়ে আছে আকাশ।তার জীবনটাও তো এমন রঙিনই ছিলো তবে কেনো এতোটা বেরঙিন হয়ে গেলো সবকিছু?..আজ খুব করে মনে পড়ছে সেই মানুষটাকে।যার হাত ধরেই সে পাড়ি জমিয়েছিলো জীবনের নতুন এক অধ্যায়ে।একটু একটু করে যে তার জীবনটাকে ভালোবাসার রঙে রাঙিয়ে দিয়েছিলো।বাবার পরে সবচেয়ে নিরাপদ ভরসাযোগ্য মানুষ হয়ে উঠেছিলো।সেই আলভির কথা আজ খুব মনে পড়ছে যার মুখের নিঃসৃত সামান্যতম প্রশংসাও সায়রার কাছে অমূল্য ছিলো।যার কাছে এসেই মিটতো সায়রার ছোটো ছোটো আবদারগুলো।তবে ধীরে ধীরে সবটাই বদলে গেলো একসময়।ব্য’স্ত’তা ঘিরে ধরলো দুটো মানুষকেই।ছোটো ছোটো অ’ভি’মা’ন থেকে জমে উঠলো অভিমানের পাহাড় যার তলায় চাপা পড়ে গেলো ভালোবাসা।বেড়ে গেলো দূ’র’ত্ব।ফলশ্রুতিতে প্রাণপ্রিয় সায়রাকেই আলভি ঠেলে দিলো দূরে,অনেকটা দূরে।..তবুও যে মনটা শুধু তাকেই চায়।মস্তিষ্কের বারণ না শুনে অবচেতন মন সর্বদা সেই মানুষটার সান্নিধ্যই প্রার্থনা করে চলে।তবে তা কি আদেও কোনোদিন সম্ভব?

নিজের ভাবনায় বিভর সায়রার চোখ থেকে কখন যে পানি পড়া শুরু হয়েছে তা সে নিজেও জানেনা।শরীরে কারোর হাতের উপস্থিতি অনুভব করতেই স’ম্বি’ত ফিরে পায় সায়রা।পাশে তাকাতেই দেখতে পায় জুলেখা দাঁড়িয়ে আছে তার পাশে।এই মেয়েটিই এখানে তার দেখাশোনা করে।সেই রাতে ঝোকের মাথায় বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়লেও কোথায় যাবে তা মাথায় আসছিলোনা সায়রার।বাবার বাসায় সে যেতে চায়না।কারণ সে গেলে বাবাকে স’ৎ মায়ের কাছে অনেক কথা শুনতে হবে যা সায়রা একদমই চায়না।ভাবতে ভাবতেই মাথায় আসে এক পুরনো বান্ধবীর কথা যার বাসস্থান বর্তমানে সিলেটে।তার সাথে যোগাযোগ করেই এখানে আসা সায়রার।বান্ধবী সহায়তায় সিলেটে এলেও তার সাথে থাকেনি সায়রা।স্হানীয় বাসিন্দাদের এই কলনিতেই ছোট্ট একটা ঘরের মধ্যেই সাজিয়ে নিয়েছে এ’কা’কী’ত্বে ঘেরা নিজের জগৎ।এরপর থেকে এই সিলেটেই থাকছে সায়রা আর তার সর্বক্ষণের দেখাশোনার দায়িত্বে রয়েছে জুলেখা।

ছয়মাসের ভা’রী পেটটা সামলে দু’র্ব’ল শরীরটা নিয়ে জুলেখার সহায়তায় উঠে দাঁড়ালো সায়রা।তার আর ভালোলাগছেনা এখানে।দিনের বেশিরভাগ সময়টা এই বাচ্চাদের পড়িয়ে কাটিয়ে দিলেও এখন তার বি’ষা’ক্ত লাগছে সবকিছু।শরীরটাও বড্ড খা’রা’প লাগছে।মনটা কেমন যেনো করছে।হঠাৎই অজানা কারণে হৃদস্পন্দন বে’ড়ে গেছে।এখনই নিজের জায়গায় একান্ত ছোট্ট জগতে ফিরে যেতে চায় সে।সবকিছু থেকে সরিয়ে নিতে চায় নিজেকে।সবকিছুর মায়া ত্যা’গ করতে চায় সে ভাবতে ভাবতেই পিছনে ফিরলো সায়রা।..পিছনে ফিরতেই আকস্মিক কোনোকিছুর প্রচন্ড ধা’ক্কা’য় তার দু’র্ব’ল শরীরটা পিছন দিকে হেলে যেতেই পাশে দাঁড়ানো মেয়েটা সামলে নিলো তাকে।বুকটা ধ’ড়’ফ’ড় করছে সায়রার।এক্ষুনি কতবড়ো অ’ঘ’ট’ন ঘটতে যাচ্ছিলো ভাবতেই ভয় বেড়ে গেলো।নিজের কাছে থাকা একমাত্র সম্বলটিকে কোনোক্রমেই হারাতে চায়না সায়রা।

ছোটো ছোটো কিছু হাত তাকে জড়িয়ে আছে বুঝতে পেরেই চোখ খুলে তাকায় সায়রা।তবে চোখ খুলতেই অবিশ্বাস্য ঘটনা চোখে পড়ে।এ কাদের দেখছে সে?কাদের অনুভব করতে পারছে নিজের শ’রী’র জুড়ে?কাদের হাতগুলো জড়িয়ে আছে তাকে?..এটা কি স্বপ্ন নাকি সত্যি? বুঝতে পারছেনা সায়রা।অপ্রত্যাশিত কোনোকিছু হুট করে চোখের সামনে চলে এলে মানুষের যেমন অনুভব হয় ঠিক তেমনি অনুভব হচ্ছে সায়রার।আপনা আপনিই চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে।তবে এই চোখের পানি কি বি’ষা’দে’র নাকি অ’প্র’ত্যা’শি’ত কিছু প্রাপ্তির?..সায়রার দুচোখের তৃ’ষ্ণা যেনো মিটছেইনা।কা’ঙা’লি’নী’র মতো প্রাণ ভরে দেখে চলেছে মায়াময় মুখ দুটিকে।হাত দুটি নিজের অজান্তেই জড়িয়ে ধরেছে তার দুই ক’লি’জা’র টুকরোকে।

সাইরিফ, আদনানও একাধারে কেঁ’দে চলেছে মাকে দেখে। কতোদিন পরে মায়ের দেখা পেলো তারা।অবশেষে তাদের দোয়া আল্লাহ কবুল করেছেন।তাদের মাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন তাদের কাছে ভাবতেই খুশিতে আ’ত্ম’হা’রা হয়ে উঠেছে দুইভাই।আর কোথ্থাও মাকে যেতে দেবেনা তারা।তাইতো শ’ক্ত করে জড়িয়ে নিয়েছে নিজেদের সাথে।প্রবল উৎফুল্লতার সহিত সেই একজায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা আলভি’কে উদ্দেশ্য করে সাইরিফ বললো,,,

–“বাবা!..বাবা দেখো মা’কে আমরা পেয়েছি বাবা।আল্লাহ আমাদের কথা শুনেছেন।আমরা গুডবয় হয় আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলাম তো তাই আল্লাহ আমাদের ইচ্ছে পূরণ করেছেন।আমরা মা’কে আর কখনো হা’রি’য়ে যেতে দেবোইনা।শ’ক্ত করে ধরে রাখবো নিজেদের কাছে আর মায়ের গুডবয় হয়ে মায়ের সবকথা শুনবো।কোনো দুষ্টুমি করবোনা।মা’কে কোনো ক’ষ্ট দেবোনা।তাইনা?”

সাইরিফের কথা শেষ হতেই নিজের আদো আদো কন্ঠে অসীম মায়া ঝড়িয়ে আদনান বললো,,,

–“তুমি থাকবে তো মা আ..আমাদে’র কাছে?..বলোনা মা?থাকবে তো?”

সাইরিফের মুখ থেকে বাবা ডাক শুনতেই মাথা তুলে সামনে তাকায় সায়রা।ওইতো মাত্র কিছুটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে তার প্রাণাধিক প্রি’য় মানুষটা।যাকে দেখার আকুল তৃ’ষ্ণা এতোদিন হৃদমাঝারে সযত্নে লুকিয়ে রেখেছিলো সে।সাদা পাঞ্জাবিটাতে মানুষটিকে প্র’চ’ন্ড রকম স্নিগ্ধ লাগছে।ওই শান্ত-স্নিগ্ধ মুখটি দেখতেই হৃদয় তো’ল’পা’ড় করা সমস্ত ঝ’ড় থেমে গেছে।ক’ঠো’র-রু’ক্ষ মানুষটির চোখ দিয়েও পানি গড়িয়ে পড়ছে।অসম্ভব মায়াবি চোখগুলোতে পানি দেখতে পেতেই বুকটা অসম্ভব য’ন্ত্র’ণা’য় ভরে উঠছে সায়রার।একছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হচ্ছে মানুষটিকে।

আদনানের কন্ঠ শুনে ঘোর থেকে বেরিয়ে এলো সায়রা।এতোক্ষণ সে যেনো একটা ঘোরের মধ্যে ছিলো।স’ম্বি’ত ফিরে পেতেই সাইরিফ,আদনানের থেকে ছি’ট’কে সরে এলো সায়রা।এটা কি করছিলো সে?যে মায়া থেকে সে সকলকে মু’ক্তি দিতে চায় সেই মায়াই কেনো তবে গ্রা’স করছে তাকে,তার প্রিয় মানুষগুলোকে?..প্রবল ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও যে সে আর ফিরে যেতে পারবেনা এই তিনটে মানুষের জীবনে।পারবেনা সকলকে আবারও তার ভালোবাসা-মায়ায় জড়িয়ে নিতে।সে যে অপারগ।ফিরে যাওয়া,ফিরিয়ে নেয়া এসব যে আর তার জীবনে সম্ভব নয় সেটা সে কি করে ভুলে গেলোস?না না এসব থেকে দূরে যেতে হবে তাকে ভেবেই পাশে দাঁড়ানো জুলেখাকে ক’ঠো’র স্বরে বললো,,,

–“জুলেখা আমাকে এক্ষুণি নিয়ে চলো এখান থেকে।এক্ষুণি মানে এক্ষুণি। ”

সায়রার আদেশমতো কোনো প্রশ্ন না করেই সায়রাকে নিয়ে তার ঘরের উদ্দেশ্যে নিয়ে যেতে লাগলো।মা’কে চলে যেতে দেখতেই তার পিছু পিছু ছুটলো সাইরিফ ও আদনান।আটকাতে চেষ্টা করলো সায়রাকে।চেষ্টায় অসফল হয়ে দুইভাই পিরে এলো বাবার কাছে।যাতে বাবা ফিরিয়ে এনে দেয় তাদের মাকে।এতোক্ষণ স্ত’ব্ধ হয়ে সবটা দেখলেও সাইরিফ,আদনানের কা’ন্না’য় ঘোর থেকে বেরিয়েই ছুট লাগায় সায়রার পিছনে।তবে সে যে এরইমধ্যে বন্ধ করে দিয়েছে তার দরজা।তবে কি এতোটা কাছে এসেও আলভি,সাইরিফ, আদনান ফিরে পাবেনা নিজেদের অতি প্রিয় মানুষটিকে?..

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here