ভালোবাসার সংসার পর্বঃ০৬

0
371

#ভালোবাসার_সংসার
#পর্বঃ০৬
#ফারজানা

অনেকটা সময় কেটে গেছে বাইরে থেকে আর কোনো শব্দ আসছেনা।পরিবেশটা একটু বাড়াবাড়ি রকমের শা’ন্ত,নি’স্ত’ব্ধ বোধ হচ্ছে সায়রার।আগের মতোই মেঝেতে নি’শ্চ’ল অবস্হায় শুয়ে আছে সায়রা।মাথার য’ন্ত্র’ণা’টা ধীরে ধীরে বেড়েই চলেছে।কমছেনা কোনোভাবেই।এই ব্য’থা যে কমবেওনা বরংচ ধীরে ধীরে মৃ’ত্যু’র দাঁড় গোড়ায় পৌঁছে দেবে তাকে তা সায়রা খুব ভালোভাবেই জানে।সায়রার হৃদয় ভে’দ করে বেড়িয়ে এলো একটি দী’র্ঘ’শ্বা’স।

ভা’রী, দু’র্ব’ল শরীরটা কোনোমতে সামলে শোয়া থেকে উঠে বসলেও দাঁড়ানোর শক্তিটুকু আর নিজের শরীরে নেই তা অনুভব করলো সায়রা।খুবই ধীম স্বরে ডেকে উঠলো জুলেখাকে।জুলেখা আসতেই অতিক’ষ্টে বললো,,,

–“আমায় একটু ধরে তোল জুলেখা।”

খুবই স’ত’র্ক’তা’র সাথে সায়রাকে আস্তে আস্তে উঠিয়ে চেয়ারে বসালো জুলেখা।উ’দ্বি’গ্ন কন্ঠে বললো,,,

–“তোমার আবার মাথা ব্য’থা করছে তাইনা আপা?খুব য’ন্ত্র’ণা হচ্ছে?”

মুখে কোনো শব্দ না করে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো সায়রা।জুলেখাও আর কোনো কথা বললোনা।এই কয়েকটা মাস মানুষটিকে কতো রাত যে এই অসহ্য য’ন্ত্র’ণা’য় ছটফট করতে দেখেছে তার কোনো হিসেব নেই।তার উপরে নিজের মনোক’ষ্টগুলো তো ছিলো উপরি পাওনা।সায়রার মুখের দিকে তাকালো জুলেখা।ইশ!শুকনো মুখটা দেখে প্রচন্ড মায়া হলো তার।আজ সারাদিন তো আর কম ধকল গেলোনা মানুষটির মনের উপর দিয়ে।প্রবল ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও প্রিয় মানুষগুলোকে ফিরিয়ে দিতে যেয়ে সায়রা যে গ’লা’কা’টা মুরগির ছ’ট’ফ’ট করেছে তা তো এতোক্ষণ সে নিজের চোখেই দেখলো।তার খুব ইচ্ছে করে এই মানুষটির সমস্ত য’ন্ত্র’ণা’গুলোকে মুছে দিতে যেভাবে সে মুছে দিয়েছিলো জুলেখার ক’ষ্ট’গুলোকে। আশ্রয়’হীন, সম্বল’হীন জুলেখাকে নিরাপদ আশ্রয় দিয়েছিলো।কিন্তু সে অপারগ।কিছুই যে করার নেই তার।এমনকি সায়রার জীবন সং’ক’ট সম্পর্কে সমস্তটা জানা সত্ত্বেও কাউকে কিছু জানাতে পারবেনা সে।কারণ সে যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।এই মানুষটির কাছে দেয়া কোনো কথার খেলাপ সে করতে পারবেনা।এটা যে তার মন মানবেনা।তবে কিছু একটা তো করতেই হবে।আপার মন নরম করার চেষ্টাটাই সে চালিয়ে যাবে।সায়রার মাথায় তেল মালিশ করতে করতেই এসব কথা ভাবছিলো জুলেখা।এই তেল মালিশে সায়রার ব্য’থা’র উপশম হবে না জেনেও এই কাজ সে প্রায় সময়ই করে থাকে।সায়রার কন্ঠ শুনে তার ভাবনার জাল ছিঁ’ড়ে বেড়িয়ে আসে সে,,,

–“জুলেখা রে!ব..বলছিলাম যে ইয়ে..মানে..ওরা কি চলে গেছে?”

আমতাআমতা করে জিজ্ঞেস করলো সায়রা।সায়রার কথা শুনে হালকা একটা হাসির রেখা ফুটে ওঠে জুলেখার ঠোঁটে।মুখে দূরে চলে যেতে বললেও মনে মনে যে সেও চায় মানুষগুলোর সান্নিধ্য তা আর বুঝতে বাকি নেই জুলেখার।জুলেখা চুপ করে থাকায় অ’ধৈ’র্য্য হয়ে সায়রা আবারও একই প্রশ্ন করলে জুলেখা বললো,,,

–“আমি তো জানিনা আপা।তবে তুমি বললে দেখে আসবো গিয়ে।”

জুলেখার জবাবে অসন্তুষ্ট হলো সায়রা।রু’ক্ষ স্বরে বললো,,,

–“জানিসনা মানেটা কি?যাহ্ গিয়ে দেখে আয়।..শোন চুপিচুপি দেখবি যেনো বুঝতে না পারে।”

শেষের কথাটা বেশ আস্তেই বললো সায়রা।সায়রার কথামতোই ঘরের দরজার কাছে থাকা জানালার পাল্লা খুলে বাইরে মুখ বাড়ালো জুলেখা।দেখলো ঘরের সাথে লাগোয়া বরইগাছটার সাথে হেলান দিয়ে দুইছেলেকে জড়িয়ে ধরে ঠাঁই বসে আছে আলভি।সেই দৃশ্য দেখতে পেয়েই তৎক্ষনাৎ সায়রাকে এসে জানালো জুলেখা।জুলেখার কথা শুনেই অ’স্হি’র হয়ে সায়রা বললো,,,

–“কি বলছিস এখনো যায়নি?রাত বাড়ছে আস্তে আস্তে।বাইরে এখন ঠান্ডা’ও পড়ছে।এই ঠান্ডা’র মধ্যে ছেলেদুটোকে নিয়ে বসে আছে কেনো এখনো?”

জুলেখা কিছুই বললোনা।সায়রা নিজেই আবার বলে উঠলো,,,

–“কি করি এখন বলতো?..শোন একটা কাজ কর দরজাটা খুলে তুই গিয়ে বল এখান থেকে যেনো এক্ষুণি চলে যায়।রাত বাড়লে আর পথ চিনে ফিরতে পারবেনা।..কি রে যা তাড়াতাড়ি?”

সায়রা অ’স্হি’র কন্ঠে তাড়া দিতেই জুলেখাও বেড়িয়ে গেলো দরজা খুলে।দরজা খুলার শব্দ কানে আসতেই হুড়মুড় করে উঠে দাঁড়ালো তিনজন।তবে তাদের আশা নিরাশায় পরিণত হলো জুলেখাকে দেখে।মুখ চুন করে আবারও বসে পড়লো বাবা-ছেলেরা। জুলেখা তাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েই গড়গড় করে বলতে লাগলো,,,

–“রাত বাড়ছে, ঠান্ডাও পড়ছে আপা বলেছে বসে না থেকে এক্ষুণি চলে যেতে।”

জুলেখার কথায় কোনো পাত্তাই দিলোনা আলভি।খোলা দরজার দিকে মুখ করে ভিতরে থাকা মানুষটির উদ্দেশ্যে জোড়ে জোড়ে চি’ৎ’কা’র করে বললো,,,

–“ঠা’ন্ডা তো পড়ছেই কিন্তু কারো কি আর দ’য়া-মা’য়া হয় নাকি আমাদের উপর?কেউ তো একটু দেখতেও এলোনা?একটু ঘরে ঢুকতে দিলেও তো হয়।বুঝলি রে বাপেরা আমার তোদের মায়ের একটুও মায়া নেই রে।আমাদের মাছুম চেহারাগুলো যেনো চোখেই পড়লোনা।”

আলভির কাছে পাত্তা না পেয়ে গোল গোল চোখে তাকিয়ে থেকে আলভির কথাগুলো শোনার পরে গুটিগুটি পায়ে ভিতরে চলে এলো জুলেখা।আলভির কথাগুলো শুনে রা’গে গ’জ’গ’জ করতে থাকা সায়রা জুলেখাকে দেখতে পেয়েই বললো,,,

–“লাগিয়ে দেতো দরজাটা।থাকুক বসে বাইরে।দেখি কতোক্ষণ থাকতে পারে।”

সায়রার কথামতো দরজা লাগিয়ে তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো জুলেখা।দুই মিনিট সময় অতিক্রান্ত হতে না হতেই জুলেখার উপর আদেশ পড়লো জানালা দিয়ে বাইরের মানুষগুলোর অবস্হা দেখার।জানালার বাইরের দৃশ্য অবলোকন করে সে কথা সায়রাকে জানানোর একমিনিটের মাথায় পুনরায় একই আদেশ পেলো জুলেখা।বারবার একই ঘটনা ঘটায় পাঁচ মিনিটেই অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো জুলেখা।জানালার সামনেই দাঁড়িয়ে পড়লো সে যেনো সুপারগ্লু লাগিয়ে দিয়েছে কেউ তার পায়ে।এবং মুখটিও সমানতালে চলতে থাকলো তার সায়রার উদ্দেশ্যে।জানালার বাইরে থেকে জুলেখার মুখটা দেখতে পেতেই এদিক থেকে বসে থাকা মানুষ তিনটিও মুখ ভে’ঙ’চে দিলো তাকে।মুখ কুঁচকে গেলো জুলেখার।এই বউ, জামাই, বাচ্চাদের মাঝে পড়ে চেপ্টা হয়ে যাচ্ছে জুলেখা।সায়রার কন্ঠ পেতেই জানালা থেকে মুখ সরালো জুলেখা এবং তার আপডেট জানানোও বন্ধ হলো।

–“এই চাদর গিয়ে দিয়ে আয় তাদের আর বল ছেলেমানুষি না করে এখান থেকে চলে যেতে।বাইরে অনেক ঠান্ডা।ছেলেদুটোকে আর ক’ষ্ট না দিয়ে এখান থেকে যেতে বল।যাহ্।”

প্রথম দিকে গম্ভীর কন্ঠে বললেও শেষের কথাগুলো বলার সময় কন্ঠস্বর কেঁ’পে উঠলো সায়রার।জুলেখার মনটাও আবার বি’ষা’দে ভরে গেলো।এতোক্ষণের চলমান দৃশ্যটাই তার ভালো লাগছিলো।কিন্তু আবার সেই আগের মতোই হয়ে যাচ্ছে সবটা।একটা দী’র্ঘ’শ্বা’স ফেলে সায়রার হাতে ধরে থাকা চাদর তিনটে নিয়ে বাইরে বেরোলো জুলেখা।

জুলেখাকে বাইরে দেখেই মুখ বাঁ’কা’লো আলভি আর তার ছেলেরা।ভ্রুঁ নাঁচিয়ে আলভি জিজ্ঞেস করলো,,,

–“কি আবার কি নির্দেশ?”

জুলেখা হাতে ধরে থাকা চাদরগুলো এগিয়ে দিলো আলভির দিকে।বললো,,,

–“পড়ে নিতে বলেছে আর বলেছে বাচ্চাগুলোকে ঠান্ডায় ক’ষ্ট না দিয়ে এখান থেকে চলে যেতে।”

আলভি প্রতিউত্তরে কিছু বলার পূর্বেই দুইভাই মিলে চেঁ’চি’য়ে বললো,,,

–“আমরা এখান থেকে যেতে চাইনা।তোমার কাছে থাকতে চাই আম্মু।”

ছেলেদের বুকে জড়িয়ে নিয়ে মৃদুহাসি দিয়ে জুলেখাকে আলভি বললো,,,

–“শুনেছো তো ওদের কথা।তোমার আপাও শুনেছে।যাও তুমি এবার।…এখান থেকে আমরা যাচ্ছিনা।কারো যদি দ’য়া হয় তবে যেনো আমাদের তার কাছে যেতে দেয়।”

ছেলেদের আর আলভির কথা শুনতে পেতেই দুচোখে পানি ভরে আসলো সায়রার।ফুঁ’পি’য়ে ফুঁ’পি’য়ে কাঁদতেও লাগলো।জুলেখা ভিতরে ঢুকলেও কিছু বললোনা সায়রা।জুলেখাও ভিতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিয়ে সেখানেই বসে পড়লো।মিনিট তিনেক পড়ে চোখের পানি মুছে উঠে দাঁড়ালো সায়রা।ক্লা’ন্ত স্বরে জুলেখাকে বললো,,,

–“যা জুলেখা ভিতরে নিয়ে আয় ওদের।খেতে দে।আমার ছেলেদুটোর নিশ্চিত খিদে পেয়েছে।যাহ্ নিয়ে আয়।”

সায়রার কথা শুনে আনন্দে নেচে উঠলো জুলেখার মন।একমূহুর্তও সময় নষ্ট না করে ছুটে গেলো বাইরে।সে দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে ভিতরের রুমে ঢুকে পড়লো সায়রা।

জুলেখা এসে সায়রার কথা বলতেই উঠে দাঁড়ালো তিনজন।তাদের মনেও অসীম আনন্দ এসে ভর করলো।তাড়াতাড়ি করে খুশিমনে তারাও ঢুকে পড়লো সায়রার ঘরে।ঘরে রুম শুধুমাত্র দুটোই।এক রুমে এখন তারা দাঁড়িয়ে আছে আরেক রুমে সায়রা দরজা বন্ধ করে বসে আছে।এই মেয়েটার কথায় কথায় এমন দরজা বন্ধ করে দেওয়ার অভ্যাসটা কোথা থেকে যে এলো ভেবে পেলোনা আলভি।তবে তা নিয়ে খুব একটা মাথাও ঘামালোনা সে।কতক্ষণ আর আটকে রাখবে দরজা রুমে তো তাদের ঢুকতে দিতেই হবে।সায়রার কাছে যেতে তাদের দেবার জন্য সায়রা নিজেই বাধ্য।

কিছুক্ষণ বাদেই তিনজনের সামনে খাবার দিলো জুলেখা।এটাও সায়রারই নির্দেশ।বাবা-ছেলেরাও বিনাবাক্যে খেয়ে নিলো সেই খাবার।কারণ না খেয়ে থাকলে তারা যু’দ্ধ করবে কি করে?এবার থেকেই তো শুরু হবে তাদের আসল যু’দ্ধ। সায়রার অ’ভি’মা’নে’র পাহাড় ভে’ঙে দেবার যু’দ্ধ।

খাওয়া শেষ হয়েছে অনেকক্ষণ। আলভি, সাইরিফ, আদনান বসে আছে সায়রার দরজা খোলার আশায়।জুলেখা বসে আছে তাদের থেকে কিছুটা দূরে একটা টুলের উপরে।তার মনেও একই আশা।সকলের আশাকে পূর্ণ করে দিয়ে সায়রা দরজা খুলে দিলো।ভিতর থেকে উচ্চস্বরেই ডেকে উঠলো জুলেখাকে। দরজা থেকে চোখ সরিয়ে সামনে বসে থাকা মানুষগুলোর দিকে তাকালো জুলেখা।দেখলো তার দিকেই তিনজন তাকিয়ে আছে কপাল কুঁচকে।কিছুক্ষণ চোখে চোখে নিরব যু’দ্ধে’র পরে জুলেখা উঠে দাঁড়াতেই তিন বাবা-ছেলে মিলে দিকবিদিক না দেখেই হুড়মুড় করে দিলো দৌড় সায়রার রুমের দিকে।রুমে ঢুকেই ঠা’শ করে দরজা লাগিয়ে দিলো জুলেখাকে জানান দিলো যে তারা জিতে গিয়েছে।সে দিকে তাকিয়েই হেসে ফেললো জুলেখা।

দরজার শব্দ কানে আসতেই সেদিকে তাকিয়ে তিনজনকে দেখেই ভ্রঁ কুঁচকে তী’ক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সায়রা।তবে তার তী’ক্ষ্ণ দৃষ্টিকে কোনো পাত্তা না দিয়েই সায়রার বিছানার পাশে থাকা জুলেখার চৌকিটাতে গিয়ে গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়লো তিনজন।সায়রা তা দেখে কিছু বলতে নিতেই মিষ্টি একটা হাসি তিনজনই ছুঁড়ে দিলো তার দিকে।তা দেখতে পেতেই কথা না বাড়িয়ে দীর্ঘ’শ্বাস সায়রাও শুয়ে পড়লো নতুন ভোরের আশায়।

চলবে…

_____________________________________________________________________
ভুল-ত্রুটি ক্ষ’মা’সু’ন্দ’র দৃষ্টিতে দেখবেন এবং গল্পটি সম্পর্কে আপনাদের মতামত জানাবেন।
হেপি রিডিং!!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here