#পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী পর্বঃ আট
#মম_সাহা
বাড়ির উঠনো নিস্তব্ধ পরিবেশ। কিছুক্ষণ আগে ধৃষ্টের বলা কথা যেন বিশ্বের সবচেয়ে বড় বো’মার মতন ফেটেছে। নিপা ছিঃ ছিঃ করে উঠে বললো,
“দেখেছেন তো মা,পরের ছেলের দোষ দিয়েছেন সংসার ভাঙার জন্য। আসল দোষী কে দেখুন। গ্রামে আসতে না আসতে আপনার মেয়ের বেলেল্লাপনা শুরু। ছিহ্।”
“তুমি এসব কী বলছো,বৌদি? ধৃষ্টের কথা শুনেই এসব বলছো। আমাকে তো আগে সবটা পরিষ্কার করে বলতে দিবে তাই না?”
দর্শিনীর কথা থামতেই তার মা বিরাট এক চড় বসালো মেয়ের গালে। টলমলে দৃষ্টি নিয়ে বললো,
“নিজের সংসার তো খেয়েছিস। এখন আমার সংসারেও কী ফাটল ধরাতে চাচ্ছিস, মুখপুরী?”
মা, বৌদির আচরণে ঘৃণায় দর্শিনীর শরীর রি রি করে উঠলো। বিষাদে ভরে উঠলো হৃদয়। বৌদি নাহয় বলেছে, কারণ সে পরের মেয়ে। কিন্তু মা? মা তো নিজের মানুষ। মা কীভাবে পারলো এটা বলতে?
“আপনারা ছোট্ট একটা বাচ্চার কথায় এতকিছু বলছেন। অথচ যে মানুষটা বিশ্লেষণ করতে চাইছে, তার কথাটাও শোনার চেষ্টা করছেন? অদ্ভুত!”
মৃত্যুঞ্জয়ের কথায় দর্শিনীর চোখের জল আহ্লাদ পেলো যেন। দর্শিনী তাচ্ছিল্য হেসে মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
“বুঝলেন,মেয়ে হলো সংসারের সবচেয়ে বড় বোঝা। আর সে মেয়ে যদি হয় সংসার ভাঙা তাহলে তো কথাই নেই। নিজের মা-ই যেখানে জ্বালা জ্বালা ভাবে সেখানে অন্য কারো কথা বাদ-ই দেন।”
মেয়ের কথা সরলার অন্তর আত্মা কাঁপালো। নেতিয়ে গেলো তার উত্তপ্ত রাগ। প্রতাপ সাহা এগিয়ে আসলেন। মেয়ের মাথায় আদুরে স্পর্শ করলেন। মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে বললেন,
“কষ্ট নিও না মনে, মা। এ বাড়ি তোমার। এখানে কারো সাধ্য নেই তোমাকে পর করার। তোমার যেখানে ইচ্ছে তুমি যাবে। তোমার কাউকে জবাবদিহিতাও করার দরকার নেই। আমি বিশ্বাস করি তোমায়। আর কেউ কী ভাবলো না ভাবলো সেটা তোমার দেখতে হবে না।”
প্রিয়দর্শিনী জড়িয়ে ধরলো বাবাকে। চোখের কোণ ঘেষে গড়িয়ে পড়লো অশ্রুকণা। কণ্ঠ ক্ষাণিকটা কেঁপে উঠলো। অপরাধী কণ্ঠে সে বলে উঠলো,
“বাবা,আমি দৃষ্টান্ত দা এর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তুমি তো জানো দাদার সাথে ছোট বেলা থেকেই আমার কত ভালো সম্পর্ক। আমার মনে কোনো পাপ নেই, বাবা।”
ধৃষ্টের বলা কথা টা এবার পরিষ্কার হলো সবার কাছে। নিপার এতক্ষণের ঝলমলে মুখখানা চুপসে গেলো। মৃত্যুঞ্জয় অবাক কণ্ঠে বললো,
“দৃষ্টান্তের কাছে গিয়েছিলেন? এটা প্রথমেই বলে দিতেন। আপনার মা, বৌদি তাহলে আর খারাপ কিছু ভাবার সুযোগই পেতো না।”
“ভাগ্যিস তখন বলি নি,নাহয় নিজের লোকদের মনের খবর জানতে পারতাম?”
দর্শিনীর কণ্ঠে তাচ্ছিল্য ভাব। নিধি এবার এগিয়ে এলো। নিজের ছেলের কান টেনে ধরে শাসনের স্বরে বললো,
“এই ছেলের কথায়, নিপা তুই নাচছিস? জানিস না ও অর্ধেক কথা বলে আর অর্ধেক পেটে রাখে? আর মা, আপনিও? নিজের মেয়ের উপর একটু ভরসা রাখুন। আমার যখন বিয়ে হলো তখন প্রিয়ো ছিলো বারো তেরো বছরের ছোট্ট পাখি। তাকে নিজের হাতে বড় করলাম। এখন আমাকে কেউ গলা কেটেও যদি প্রিয়োর নামে কিছু বলে তবুও আমি বিশ্বাস করবো না। কারণ আমার নিজের লালন পালনের উপর ভরসা আছে। আর আপনি তো ওর মা, আপনি কীভাবে বার বার নিপার কথা শুনে ওকে অবিশ্বাস করেন? বলি হারি যাই,পারেনও বটে। মেয়েটা আসছে আজকে। এ অব্দি দুইটা চড় খেয়েও ফেলেছে। শ্বশুর বাড়ি ছেড়ে একটু ভালো ভাবে বাঁচার জন্য বাবার বাড়ি এসেছে। আর সেই বাবার বাড়ি কিনা ওর কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে? মা না বুঝলে কে বুঝবে?”
নিপা এবার আমতা-আমতা করা শুরু করলো। আমতা-আমতা করেই বললো,
“ধৃষ্ট যেভাবে বলেছিলো,যে কেউই তো খারাপ ভাববে, বড়দি। তাই আমিও ভেবেছি।”
“থাক,তুই আর কথাই বলিস না, ছোটজা। তোরও তো বিয়ে হয়েছে সাত আট বছর হলো। এত বছর যাবত প্রিয়োকে দেখছিস। এখনো চিনতে পারলি না? খালি উসকানি দেওয়ার তালে থাকিস।”
নিধির কথায় চুপ হলো নিপা। সরলাও আর কিছু বললো না। নিধি এবার ধীর পায়ে দর্শিনীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। আদুরে কণ্ঠে বললো,
“অনেক হয়েছে কান্নাকাটি। এবার ঘরে চল। তোর জন্য যে হাত পুড়িয়ে রান্না করলাম একটু খেয়ে দেখলি না। খালি টো টো করে ঘুরার তালে থাকিস। এখন মাছের মাথাটা যে তোর আশায় বসে আছে, জানিস? চল খেতে। খাবার খেয়ে ঘুম দিবি। তোর জন্য তোর এই বড়বৌদিই যথেষ্ট। আমার মেয়ে আমার কাছে থাকবে। আর কেউ কিছু বলুক একদম শুনিয়ে দিবো।”
দর্শিনী জড়িয়ে ধরলো তার বৌদিকে। বড় বৌদি যত্নের হাত বুলিয়ে দিলো সারা অঙ্গে। মৃত্যুঞ্জয় অপলক চেয়ে রইলো দর্শিনীর দিকে। এই নারীতে সে যেভাবে আটকে গিয়েছে আর ফেরত যাওয়ার উপায় নেই। এখন কেবল দেখতে হবে তার ভাগ্যে কী আছে।
_
“তোমার সাথে তো আমার প্রণয়ের বিয়ে। তবে এত অশান্তি কেনো করছো সংসারে?”
নিজের হাতে বরফ ডলতে ডলতে বিপ্রতীপ মায়াকে প্রশ্ন করলো। মায়া চুল আঁচড়ানোতে মনোনিবেশ করে মুচকি হেসে বললো,
“তোমার সাথেও তো আমার প্রণয়ের বিয়ে, স্বামী। তবে,কেনো বলো নি ঘরে সতীন আছে?”
মায়ার প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেলো বিপ্রতীপ। তার হাত ফসকে বরফের টুকরো টা নিচে পড়ে গেলো। আমতা-আমতা করে বললো,
“আসলে, আমি ভয় পেয়েছিলাম। তুমি যদি এটা জেনে আমাকে ছেড়ে দেও।”
বিপ্রতীপের কথায় মায়া মুচকি হাসলো। বাঁকা হাসি ঝুলিয়েই বললো,
“আর আমি কষ্ট পেয়েছি। তুমি ঘরে স্ত্রী থাকা স্বত্তেও আমাকে প্রেমের জালে ফাঁসিয়েছো। তুমি তোমার সেই স্ত্রীর প্রতিও তো অবিচার করেছো।”
মায়ার কথায় টনক নড়লো বিপ্রতীপের। হঠাৎ করেই দর্শিনীর শূণ্যতা গ্রাস করলো তার অন্তরে। তার মস্তিষ্ক জানান দিলো অবিচারের কথা। সত্যিই তো,সে তো ঠকিয়েছে দর্শিনীকে। মায়ার রূপে মুগ্ধ হয়ে সে তো অন্যায়ই করেছিলো।
মায়া বিপ্রতীপকে চুপ থাকতে দেখে বাঁকা হাসলো। বিপ্রতীপের সামনে এগিয়ে এসে ফিসফিসিয়ে বললো,
“তুমি আর তোমার মা যে অন্যায় করেছো,তার ক্ষমা নেই স্বামী।”
–
“খাবার খাওয়ার সময় কেউ কান্না করে? কী রে বাবা! এমন কাজ কেউ করে? তোমার কান্না কিসের এত?”
নিধির কথায় দর্শিনী চোখের জলটা মুছে নিলো। ভাতের থালায় হাত দিতেই আবারও ডুকরে কেঁদে উঠলো সে। প্রতাপ সাহা এবার মোড়া থেকে উঠে এলেন। মেয়ের পাশে বসে আদুরে কণ্ঠে বললেন,
“কাঁদছো কেনো, মা? তোমার বৌদি তোমার জন্য কত শখ করে রান্না করেছে। খাবার কী পছন্দ হয় নি, মা?”
দর্শিনী বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। ক্রন্দনরত কণ্ঠে বললো,
“জানো বাবা,কতদিন পর আমি এভাবে খেতে বসলাম? এতদিন কেবল বেঁচে থাকার জন্য খেয়েছি। প্রতিদিন খেতে বসতাম আর মনে হতো বিষ ভক্ষণ করছি। কেউ আমায় আদর করে খাওয়ায় নি, বাবা। কতদিন এমন সাজিয়ে কেউ খাবার দেয় না আমায়। আমাকে ওরা তিলে তিলে মেরে ফেলেছে,বাবা। একবারে নিঃশেষ করে দিয়েছে। ওরা আমায় বাঁচতে দিচ্ছিলো না, বাবা। বাবা গো, কী ভীষণ যন্ত্রণা ভালোবাসায়। আগে জানলে এই ভুলে পা বাড়াতাম না। বেঁচে থেকে মরে যাওয়াটা কত যে কষ্টের,বাবা। জানো বাবা,একটা গানের লাইন বোধহয় আমার জন্যই সৃষ্টি হয়েছে। ‘এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না,, শুধু সুখ চলে যায়’ – আমার জীবনে এ লাইনটা প্রতি অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। মা আমায় এখন চড় থাপ্পড় দিলেও আমার খারাপ লাগে না। এই মা আমায় কত নিষেধ করেছিলো, সে ঘরে পাঠাবে না। জোড় করেই নিজের কপাল পুড়িয়ে ছিলাম গো, বাবা। কী ভীষণ যন্ত্রণা! ভালোবাসার মানুষ গুলো এমন বিশ্বাসঘাতক কেনো হয়, বাবা? তারা জানেনা,তাদের বিশ্বাসঘাতকতা মেরে দেয় কাউকে। বাবা গো,মানুষ এত পাষাণ কেমন করে হয়!”
দর্শিনীর কণ্ঠে নিরব অভিযোগ শুনে কেঁদে উঠে বাবার প্রাণ। নিধি ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে ননদকে। মুছিয়ে দেয় অশ্রুকণা। ধমকে বলে উঠে,
“একটা চড় দিবো। খাবারের সময় এত কথা কেনো বলিস? চুপ করে খা। তুই বাঁচবি। ভালো ভাবেই বাঁচবি। আর ঐ নরকে তোরে পাঠাবো না আমরা।”
প্রিয়দর্শিনীর কান্না বন্ধ হয় না। কতদিন পর অভিযোগ করার সুযোগ পেলো সে! এতদিন তো মরার মতন বেঁচে ছিলো। এটাকে কী আর বেঁচে থাকা বলে?
তাদের কথপোকথনের মাঝে মাংসের বাটি টা নিয়ে ঘরে হাজির হয় নিপা। দর্শিনীর থালায় কয়েক টুকরো মাংস দিয়ে গদোগদো কণ্ঠে বলে,
“তুমি কেঁদো না। ভালো মতন খাও। ও ঘর জাতের ছিলো না তাই কষ্ট পেয়েছো। এবার আমরা দেখেশুনে তোমার বিয়ে দিবো।”
#চলবে
[আগামীকাল কিছু কারণবশত গল্প দিতে পারবো না। কেউ অপেক্ষা করো না প্লীজ।]