#ভালোবাসার_সংসার
#পর্বঃ০৩
#ফারজানা
সময়ে’র হিসেবে পেরিয়ে গেছে পাঁচ-পাঁচটি মাস।ঋতু বদলের চ’ক্রে বদল ঘটেছে ঋতুর।প্রকৃতি সেজেছে নতুন সাজে।তবে প্রকৃতির এই নিত্য-নতুন রূপ কোনো ছাপ ফেলতে পারেনি আলভি ও তার দুই ছেলেদের জীবনে।তাদের এলোমেলো হয়ে যাওয়া জীবনটা আর সুসজ্জিত হয়ে ওঠেনি। কারো কোমল হাতের কোমল ছোঁয়ার অভাবে তাদের জীবন হয়ে উঠেছে রু’ক্ষ-শু’ষ্ক’তা’য় ভরপুর।মাত্র একটি মানুষের অনুপস্থিতি যেনো জীবনের গতিপথ থ’ম’কে দিয়েছে এই তিনটি মানুষের।তবুও সময়ের স্রোত যে সর্বদা বহমান।আর এই সময়ের স্রোতেই ভেসে চলে মানুষ।সময়ের পরিক্রমায় আলভিরাও পার করে এসেছে বিগত পাঁচটি মাস।সর্বদা হাসিখুশি,দুষ্টুমিতে ভরপুর প্রাণগুলো হয়ে উঠেছে নি’র্জী’ব।আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে ধরা যা’ন্ত্রি’ক’তা’র পে’ষ’ণে তাদের দ’ম’ব’ন্ধ হয়ে আসছে ক্রমাগত।একটুকরো শীতলতার জন্য হাসফাঁসিয়ে ম’র’ছে তারা।তবে তাদের এই শীতলতা প্রাপ্তি যে সায়রা ব্যতীত কোনোক্রমেই সম্ভব নয়।তাইতো হন্যে হয়ে সেই কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে খুঁজে বেরাচ্ছে শহরের আনাচে-কানাচে।
নিজেদের বেডরুমের সাথে লাগোয়া বারান্দা দিয়ে বাইরের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আলভি।নিকষ কালো অ’ন্ধ’কা’রে আচ্ছাদিত অন্তরীক্ষ ব্যতীত কোনো কিছুই লক্ষ্য করা না গেলেও সেই দিকেই তাকিয়ে আছে আলভি।তাদের জীবনের মতো প্রকৃতিতেও অ’ম’ব’স্যা’র গ্রহণ চলছে।তার জীবনের চাঁদটিও যেমন তার অ’প’রা’ধ- অ’ব’হে’লা’য় চাপা পড়ে হারিয়ে গেছে তেমনি অ’মা’ব’স্যা’র প্রভাবে পৃথিবীর চাঁদও ঢাকা পড়ে গেছে।..কিসব অবাস্তব ভাবনা নিজের মাথায় আসছে তা ভেবেই মাথা নিচু করে হেসে ফেললো আলভি। হ্যাঁ হেসেছে আলভি তবে সেই হাসিতে কোনো প্রাণ নেই,না আছে কোনো আনন্দ।শুধুই বি’ষা’দে ভরা মলিন হাসি।
পিছনে ঘুরে থাই গ্লাসের মধ্য দিয়ে ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখলো সাইরিফ ও আদনান বিছানায় শুয়ে আছে।ঘড়ির কাঁটায় রাত বারোটা বাজলেও আলভি জানে তাদের দুইছেলের চোখেও তার মতোই নিদ্রাপরীরা এসে ভর করেনা সহজে।ছোটো বলে সাইরিফ ও আদনান ঘুমিয়ে পড়লেও ঘুম আসেনা আলভির চোখে।বিছানার বাম পাশের অংশটি খালি দেখলেই বুকের ভেতরটা হুঁ হুঁ করে ওঠে তার।য’ন্ত্র’ণা’য় ক’লি’জা’টা ছিঁ’ড়ে আসতে চায় নিজের অ’প’রা’ধে’র কথা স্মরণ হতেই।তাইতো এখন আর বিছানাতেও খুব একটা শোয়া হয়না তার।জীবনের প্রতি তীব্র অরুচি ধরে গেছে মাত্র পাঁচটা মাসেই।অবশ্য সায়রা চলে যাওয়ার একসপ্তাহের মাথায়ই তো আলভি বুঝতে পেরেছিলো যে সায়রা তার কতখানি সেখানে পাঁচটা মাস সেই মানুষটিকে ছাড়া বেঁচে থাকাটাই অনেক।
ছেলেদুটোও সকলের থেকে গুটিয়ে নিয়েছে নিজেদের।সারাক্ষণ একা-একাই বাসায় বসে থাকে।যদি তাদের মা হুট করে এসে পড়ে কোনো একদিন তখন তাদের না দেখতে পেয়ে আবার যদি হারিয়ে যায় সেই ভয়েই কোথাও যেতে চায়না তারা।কোনোরকম আবদার,বায়না এখন আর নেই তাদের।শুধু একটাই তীব্র ইচ্ছা সদা জাগ্রত তাদের মনে তা হলো মায়ের আগমন।মা ছাড়া আর কোনো চিন্তাই তাদের মনে আসেনা এখন।প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরলেই আলভির কাছে যাদের বায়নার কোনো সীমা থাকতোনা এখন তারা বলে,”বাবা মাকে এনেছো?”ছেলেদের প্রশ্নের জবাবে সর্বদা নিরব থাকে আলভি।ছেলেরাও বুঝে যায় মা আসেনি।তাই তারাও মাথা নিচু করে চলে যায়।উফ!..ছেলেদের সেই মলিন মুখখানা দেখাটা যে কতোটা য’ন্ত্র’ণা’দা’য়’ক তা কাউকে বলে বোঝাতে পারবেনা আলভি।তার মনে পড়ে যায় মাত্র কিছুদিন আগে ছেলেদের আদো আদো কন্ঠে বলা কিছু কথা,,,
–“বাবা! মা আমাদের উপর অনেক রা’গ করে আছে তাইনা আমরা মাকে চলে যেতে বলেছি বলে?মায়ের কথা শুনতামনা বলে?খুব দুষ্টুমি করতাম বলে?..তাইনা বাবা?আমরা দুজন খুবই পঁ’চা ছেলে।মায়ের গুডবয় আমরা হতে পারিনি বলে মা হারিয়ে গেছে?বাবা!..ও বাবা!..মাকে খুঁজে আনোনা বাবা।আল্লাহ’র কাছে আমরা সত্যি সত্যি প্রমিস করেছি আর কোনোদিন দুষ্টুমি করবোনা।মায়ের গুডবয় হয়ে থাকবো।মায়ের সবকথা শুনে চলবো।মাকে আর কোনো কষ্ট দেবোনা আমরা।তবুও যেনো মা আমাদের কাছে ফিরে আসে সেই প্রে করেছি আল্লাহর কাছে।আল্লাহ আমাদের মাকে আবার আমাদের কাছে ফিরিয়ে দেবে তো তাইনা বাবা?..বিশ্বাস করো বাবা মাকে ছাড়া খুব ক’ষ্ট হয় থাকতে। তুমি মাকে খুঁজে নিয়ে এসোনা বাবা।তুমি কেনো মাকে খুঁজে আনতে পারোনা বাবা?বলো কেনো পারোনা?বলো?ব..”
আলভির চিৎকার করে দেওয়া ধ’ম’কে’র কথা কানে যেতেই সাইরিফ ও আদনানের কথা মাঝপথেই থেমে যায়।মুখ তুলে তাকাতেই আলভির লাল হয়ে যাওয়া মুখটা চোখে পড়ে।ভ’য় পেয়ে সেখান থেকে তৎক্ষনাৎ পালিয়ে যায় দুইভাই।সাইরিফ,আদনান চলে যেতেই ধপ করে সোফায় বসে পড়ে আলভি।দুহাত দিয়ে মাথার চুল খাঁ’ম’চে ধরে চাপা আ’র্ত’না’দ করে ওঠে।মনে মনে বলে,,,
–“কি অবস্হা করে গেলে তুমি আমাদের সায়রা?তোমাকে ছাড়া আমি,আমার ছেলেরা যে অচল তা আমরা বুঝতে না পারলেও তুমিতো জানতে।আমাদের অ’প’রা’ধ,অ’ব’হে’লা’র শা’স্তি দিচ্ছো তুমি এভাবে তাইনা?..কাছে থেকেই নাহয় শা’স্তি দিতে তুমি আমাদের।দূরে গিয়ে এভাবে য’ন্ত্র’ণা’র আ’গু’নে কেনো দ’গ্ধ করছো?প্লিজ ফিরে এসো..প্লিজ।খাওয়া-দাওয়া,রান্নাবান্না থেকে শুরু করে বাহ্যিকভাবে সব প্রয়োজনীয়তাগুলো সামলে নিলেও এই মনের ক’ষ্ট-য’ন্ত্র’ণা’গুলোর ভার যে আমি আর বইতে পারছিনা গো।না নিজের আর নাইবা তোমার ছেলেদের।..আল্লাহ সায়রা আমাদের জীবনের কি সেটা আমাদের আরও আগে বুঝতে দিলেনা কেনো?তবে তো আর এই হারানোর ব্য’থা,ভ’য় এসব আমাদের গ্রা’স করতোনা।পদ্ম পাতায় নেয়া জলের মতো করে আগলে রাখতাম আমাদের অমূল্য সম্পদটিকে।তবুও সবশেষে শুধু একটাই চাওয়া আল্লাহ মেয়েটা যেখানেই থাকুক ভালো থাকুক,সুস্হ থাকুক।”
সোফা ছেড়ে ছেলেদের কাছে যেতেই দেখতে পায় কাঁদছে তারা।এগিয়ে গিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরতেই বাবার স্নেহের পরশে তারাও নিজেদের কান্নাগুলো বি’স’র্জ’ন দিচ্ছিলো।এই চিত্র শুধু একদিনের নয় গত পাঁচমাসের প্রায়দিনেরই চিত্র এটা ভেবেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে আলভির।
আগামীকালের সিলেট যাওয়ার কথা মনে পড়তেই বারান্দা থেকে বেরিয়ে ভিতরে চলে যায় সে।গত কয়েকমাসে কোনো প্রজেক্টের কাজেই ঢাকার বাইরে পা রাখেনি আলভি।তবে এবারের প্রজেক্টের দায়িত্বটা না নিলে চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে তাই ছেলেদের নিয়েই আগামীকাল সে পাড়ি জমাবে সিলেটের পথে।কেনো যেনো সিলেটের কথা শুনতেই মনটা আ’ন’চা’ন করছে আলভির।তবে কি সিলেটে কিছু অপেক্ষা করে আছে তাদের জন্য?…
——————————————————————————————————–
গত চারদিন যাবত সিলেটে আছে আলভি ও তার দুই ছেলে।তাদের ব্রাঞ্চ অফিসের কাছাকাছি একটা কটেজে উটেছে তারা।অফিসের কাজে থাকাকালীন সময়ের জন্য একজন কেয়ারকেটার নিয়োগ করা সাইরিফ, আদনানের দেখাশোনা করতে।তিনদিনে কোথাওই বের হওয়া হয়নি তাই আজ জুম্মার নামায পড়ে ছেলেদের নিয়ে একটু ঘুরতে বেরিয়েছে আলভি।এতে যদি ওদের মন একটু হলেও হালকা হয়।আজ তিন বাবা-ছেলে পড়নে রয়েছে ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি আর টুপি।অতুলনীয় লাগছে দেখতে। তাইতো পথিমধ্যে বেশিরভাগ মানুষেরই তাদের দিকে চোখ চলে যাচ্ছে।এই সাদা পাঞ্জাবি তিনটি সায়রার খুব পছন্দের। পাঞ্জাবিগুলো খুব জে’দ করে কিনেছিলো সায়রা সঙ্গে নিজের জন্য একটা সাদা শাড়ি।আজ তারা সাদা পাঞ্জাবি পরিধান করলেও সাদা পরিহিতা নারীটি অনুপস্হিত।
হাঁটতে হাঁটতে বেশ অনেকটা পথই চলে এসেছে আলভিরা।স্হানীয়দের একটি কলোনির মতো জায়গায় পৌঁছে গেছে।চা বাগানের বেশ কিছুটা পাশের জায়গাটি কিঞ্চিত উঁ’চু’তে অবস্হিত।চারিদিকে শুধু সবুজের সমারোহ।একধ্যানে সেইদিকেই তাকিয়ে ছিলো আলভিরা।হঠাৎই খুব কাছ থেকে কিছু ছেলে-মেয়ের আনন্দ উল্লাস কানে আসতেই সেদিকে পা বাড়ালো আলভি তার ছেলেদের নিয়ে।কিছুটা সামনে যেতেই দেখা মিললো স্হানীয় কিছু ছোটো-ছোটো ছেলে-মেয়ে খেলছে একজন সাদা শাড়ি পরিহিত নারীকে ঘিরে রেখে…
চলবে…
_____________________________________________________________________