#ভালোবাসার_সংসার
#পর্বঃ০৫
#ফারজানা
সায়রার ব’দ্ধ দরজার দিকে একদৃষ্টিতে চা’ত’ক পাখির মতো চেয়ে আছে তিনটে মানুষ।কি করবে কিছুই বুঝতে পারছেনা তারা।প্রিয় মানুষটিকে বহু প্র’তি’ক্ষা’র পর খুঁজে পেয়েও যেনো পাওয়া হলোনা।মানুষটি তাদের নিকট অ’ধ’রা’ই রয়ে গেলো।কি করলে ফিরে পাবে সেই মানুষটিকে?আর কতোটা অ’পে’ক্ষা’র সাগর পাড়ি দিতে হবে তাকে ফিরে পাওয়ার জন্য।জানা নেই,কারোর কিচ্ছু জানা নেই।শুধু জানে ফিরে তাদের পেতেই হবে।
————- —————
দরজার সাথে ঠেশ দিয়ে বসে আছে সায়রা।তার আ’র্ত’চি’ৎ’কা’রে’র শব্দ যেনো বাইরের মানুষগুলোর কানে কোনোমতেই না যায় তাই নিজের হাত নিজেই কাঁ’ম’ড়ে ধরে আছে।হাত কাঁ’ম’ড়ে রাখার জন্য মুখ থেকে কোনো শব্দ বের না হলেও দুচোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ে চলেছে।বুকের ভিতরটা দু’ম’ড়ে-মু’চ’ড়ে যাচ্ছে।ছেলে দুটোর ক’রু’ণ কা’ন্না,মায়ায় ভরা “মা” ডাক শুনে মনে হচ্ছে তার কানে যেনো কেউ গ’র’ম সী’সা ঢেলে দিয়েছে।ক’লি’জা’টা বের হয়ে আসতে চাইছে।নিঃ’শ্বাস আটকে আসছে।প্রাণটা বের হয়ে আসছে সায়রার।ছেলেদুটো আর নিজের প্রাণপ্রিয় মানুষটাকে আজ চোখের সামনে দেখতে পেয়ে দুনিয়া উলোটপালোট হয়ে গেছে সায়রার।ওই তিনটে মানুষের জীবনে যে সে আর ফিরতে পারবেনা।সে চাইলেও যে এই পৃথিবীতে ওই মানুষগুলোর সাথে,আগত ছোট্ট প্রাণটার সাথে সে আর বাঁ’চ’তে পারবেনা।তার জীবনের মেয়াদ যে খুবই অল্প।আর হয়তো কয়েকটা মাস।তারপরে এই পৃথিবীতে সায়রার আর কোনো অ’স্তি’ত্ব থাকবেনা।বাঁ’চা’র প্রবল ইচ্ছে থাকলেও আল্লাহ তায়ালা তার জীবনের মেয়াদ এইটুকুই রেখেছেন।
চিৎকার করে কাঁ’দ&তে চাইছে সায়রা।নিজের মধ্যে চেপে রাখা সমস্ত ক’ষ্ট, য’ন্ত্র’ণা, হ’তা’শা’গুলোকে বের করে দিয়ে ফিরে যেতে ইচ্ছে করলেও সে পারছেনা, পারবেওনা।সেই পথ যে আর তার জন্য খোলা নেই।নিজে স্বইচ্ছায় সেই পথ বন্ধ করে দিয়েছে সায়রা।প্রিয় মানুষগুলোর একটু ভালো থাকাই তার জীবনে শ্রেষ্ঠ পাওয়া।তাইতো নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে সে।তার জীবন সং’ক’টে’র কথা কাউকেই জানতে দিতে চায়না সে।তাহলে যে ওরা নিজেদের সামলাতে পারবেনা আর ওই মানুষগুলোর কষ্ট নিজের চোখে কিছুতেই দেখতে চায়না সায়রা সেটা যে সে সহ্য করতে পারবেনা।বুকভাঙা আ’র্ত’না’দ সহিত অ’স’হা’য়ে’র মতো সায়রা মনে মনেই বলে উঠলো,,,
–“আমি তো আমার ভাগ্য’কে মেনে নিয়েছি, আল্লাহ!সবটা মেনে নিয়েই তো নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি সকলের থেকে, সকল মায়া থেকে।তবে এই তিনটে মানুষকে কেনো তুমি আবার আমার সামনে এনে দাঁড় করালে?..আমি তো ঠিক থাকতে পারছিনা, আল্লাহ।এক মূহুর্তও ওই মানুষগুলোর থেকে দূরে থাকতে পারছিনা।ছুটে চলে যেতে ইচ্ছে করছে ওদের কাছে।আবার তাদের মায়া, ভালোবাসা, স্নেহে জড়িয়ে যাওয়ার প্রবল ইচ্ছায় হৃদয় তো’ল’পা’ড় হচ্ছে।বুকে দূ’র’ত্বে’র বি’ষা’ক্ত য’ন্ত্র’ণা’র তী’র ক্রমাগত ফুটে চলেছে।তাদের কাছে যাবার এই ইচ্ছে আমি কিভাবে দমাবো, আল্লাহ?ওই মানুষগুলোর কাছে ফিরে গেলে আমাকে আবার চিরদিনের মতো হারিয়ে ওরা যে একেবারে নিঃ’শে’ষ হয়ে যাবে, আল্লাহ।আমি পারবোনা সেটা করতে।..আমি তো জানি শত অ’ভি’মা’ন- অ’ভি’যো’গ থাকলেও ওই মানুষগুলো যে আমায় ঠিক কতোটা ভালোবাসে,কতোটা পা’গ’ল আমার জন্য।..এতোদিনে নিশ্চয়ই ওরা আমাকে ছাড়া বাঁচতে শিখে গেছে আবার ওদের আমার মিথ্যে মায়ায় জড়াতে আমি পারবোনা।আমার প্রতি ঘৃ’ণা, অ’ভি’মা’ন নিয়েই নাহয় ওরা ভালো থাকুক আমায় ছাড়া সেটাই আমি চাই।ওদের কাছে ফিরে গিয়ে ওদের আবার ভে’ঙে গু’ড়ি’য়ে দিতে আমি পারবোনা।আবার চোখের সামনে ওদের এমন ক’ষ্ট’ও স’হ্য করতে পারছিনা।..তুমি আমাকে পথ দেখাও, আল্লাহ।আর সহ্য করতে পারছিনা আমি এই য’ন্ত্র’ণা।আমায় তুমি নিয়ে যাও, আল্লাহ। নিয়ে যখন যাবেই এক্ষুনি আমায় তোমার কাছে নিয়ে নেও তাহলে অন্তত ওদের এই আ’র্ত’না’দ আমায় শুনতে হবেনা।..নাহয় ওদের তুমি ফিরিয়ে দেও, আল্লাহ।প্লিজ আল্লাহ..প্লিজ।আ..আমি আর পারছিনা..প্লিজ।”
মনে মনে ভাবনার জাল বুনে সেখানেই মাটিতে শুয়ে পড়লো সায়রা।মাথাটা ভা’র হয়ে আসছে।অ’স’হ্য ব্য’থা’য় র’গ’গুলোও যেনো ছিঁ’ড়ে আসতে চাইছে।পাগল পাগল লাগছে নিজেকে।এই য’ন্ত্র’ণা বোধহয় ছোট্ট অনাগত প্রাণটাও সইতে পারছেনা তাই বুঝি পেটের মধ্যে এতোটা য’ন্ত্র’ণা দিয়ে মাকে বুঝাতে চাইছে যে তারও ক’ষ্ট হচ্ছে।..নিজের হৃ’দ’য়ে’র আকুতি, বাইরের প্রাণপ্রিয় মানুষগুলোর আকুতি মিলেমিশে একাকার হয়ে সায়রার প্রা’ণ’পাখিটা বেরিয়ে আসতে চাইছে দেহ নামক খাঁচা ছেড়ে।তবে সে সস্তিটুকুও বুঝি নেই তার কপালে।
————- —————
আলভি হাঁটু মুড়ে বসে আছে দরজার বাইরে দরজার দিকে তাকিয়ে।ছেলেদুটোও বসে আছে তার পাশে।কিছুক্ষণ পর পরই দরজা ধাক্কাচ্ছে আর আকুল স্বরে ডেকে চলেছে তাদের মাকে।মাকে একঝলক চোখের সামনে দেখতে পেয়েই তাদের ধৈ’র্য্যে’র বাঁ’ধ ভে’ঙে গেছে।মাকে ছাড়া আর থাকতে পারছেনা।খুব করে মাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে।একটু আগের মতো আবারও মায়ের আদর খেতে ইচ্ছে করছে।
এতো সবকিছুর মধ্যেও আলভি সেই আগের মতোই নির্বাক রয়ে গেছে। আজ অপ্রত্যাশিতভাবে সায়রাকে নিজের চোখের সামনে দেখতে পেয়ে একেবারেই স্ত’ব্ধ হয়ে গেছে সে।এতোদিনে হৃদয় ছা’ড়’খা’ড় দেয়া আগুন যেনো এক পশলা বৃষ্টির স্পর্শ পেয়ে নিভে গেছে।প্রাণ ফিরে পেয়েছে আলভি।সায়রার মায়াবী মুখটা দেখে তার সকল য’ন্ত্র’ণা নিমেষে উধাও হয়ে গেছে।সায়রার এই আকস্মিক দর্শনে যে কতোটা আনন্দ ঘিরে ধরেছে আলভিকে তা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব।সায়রাকে পাওয়ার আনন্দের সাথে আরও একটি প্রাপ্তি নতুন করে যোগ হয়েছে তার জীবনে, তাদের জীবনে।সায়রার ভিতরে আরও একটি প্রাণ বেড়ে উঠছে ধীরে ধীরে যে কিনা তার সন্তান।
তবে তার অনাগত সন্তানের আগমনের খবরটাও তাকে জানালোনা সায়রা?এতোটা অ’ভি’মা’ন, এতোটা অভিযোগ এখনো তবে জমে আছে সায়রার মনে তার প্রতি, তাদের সন্তানদের প্রতি যে চোখের সামনে তাদের দেখতে পেয়েও বিন্দুমাত্র মা’য়া হলোনা সায়রার?..মনের ভিতরে নানান প্রশ্নের ঝ’ড় উঠলেও তাতে খুব একটা পাত্তা দিলোনা আলভি।সায়রার মনের মনিকোঠায় জমে থাকা সকল অভিমান এবার সে আর তার ছেলেরা মিলে ভেঙে দেবে।আর কোনো দূরত্বকে নিজেদের মধ্যে জায়গা করে নিতে দেবেনা সে।একদমই দেবেনা।তাদের জীবনের অমূল্য সম্পদটিকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেই। আল্লাহ একবার তাদের সুযোগ করে দিয়েছে এই সুযোগটা কিছুতেই হারাবেনা সে।তাতে যতোটা ক’ষ্ট, য’ন্ত্র’ণা’ই সহ্য করতো হোক না কেনো সবটা সে মাথা পেতে নেবে।তবুও সায়রাকে, তার মায়াপরীকে, তার সন্তানদের মাকে ফিরিয়ে সে নিয়ে যাবেই যাবে যে করেই হোক না কেনো।
নিজের মনের ভাবনাগুলোকে প্রাধান্য দিয়েই কান্নারত ছেলেদের নিজের কাছে টেনে নিলো আলভি।চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে শ’ক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরলো।ছেলেদের কিছুটা শান্ত করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,,,
–“কাঁ’দে না সোনা বাবারা আমার।মা তো আমাদের উপর অ’ভি’মা’ন করে আছে তাইনা?মায়ের এই অ’ভি’মা’ন আমাদের ভাঙাতেই হবে।মাকে অনেক অনেক খুশি করে দিতে হবে আমাদের।অনেক আদর দিতে হবে মাকে।তবেই না মায়ের অভিমান ভাঙবে আর মা ফিরে যাবে আমাদের সাথে।..আর আরেকটা মজার খবর শুনবে?খুব তাড়াতাড়ি তোমাদের মা তোমাদের একটা বোনু উপহার দিবে।তাই যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদের মায়ের অভিমান ভা’ঙা’তে হবে।..তো আমার সাহসী, গুডবয় ছেলেরা তৈরি তো নিজেদের মায়ের অভিমান ভা’ঙা’তে?”
আলভির কথা শুনে দুইভাইই আলভির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।আলভি মাথা নাড়তেই প্রবল উৎসাহে দুইভাই বাবার বাড়িয়ে দেয়া হাতের উপর হাত রেখে সম্মতি জানালো যে তারা তৈরি।তিনজন, তিনজনকে জড়িয়ে ধরেই হাসিমুখে তাকিয়ে রইলো সায়রার বন্ধ দরজার দিকে।
————- —————
আলভি নিজের মনের মতো ভেবে নিলো সায়রার মনে তাদের প্রতি এখনো অভিমান জমে আছে।তাই সেই অভিমান ভাঙাতে এবার সে দৃ’ঢ় প্র’তি’জ্ঞ।তবে সে তো জানেনা যে সায়রার মনে আসলে কি চলছে?..একদিকে একজনের দূরে থাকার চেষ্টা আর অপরদিকে তিনজনের তাকে নিজেদের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে আগলে রাখার চেষ্টা।কোন পক্ষের ঝুলিতে সফলতা জায়গা করে নেয় সেটাই এবার দেখার বিষয়।
চলবে…