#ভালোবাসার_সংসার
#পর্বঃ১০
#ফারজানা
নীলাভ আকাশে জমেছে ঘন কা’লো মেঘ।প্রচন্ড বেগে সোঁ সোঁ করে বাতাস বইছে।ঝড় আসার পূর্বাভাস।বারান্দায় বসে বাইরের সেই দৃশ্যের দিকে একধ্যানে তাকিয়ে আছে আলভি।প্রকৃতির মতো তার মনের আকাশেও জমেছে ঘন কালো মেঘ।তার বুকেও উথাল-পাতাল ঝ’ড় বইছে।ঝড়ের তান্ডবে নুয়ে পড়েছে যেনো তার সমস্ত শরীর-মন।খুব অস্হির অস্হির লাগছে।এর কারণটা জানা নেই তার।শুধু মনে হচ্ছে হয়তো কিছু একটা হয়তো ঘটতে চলেছে।যেই ঘটনা পাল্টে দিতে পারে সবকিছু।পাল্টে দিতে পারে তাদের জীবনের গতিপথ।কিন্তু কিছুতেই এমন অনুভূতি হওয়ার কারণটা ধরতে পারছেনা সে।পাশের রুম থেকে ভেসে আসছে সায়রা, সাইরিফ, আদনান, জুলেখার হাসির কলরব।সায়রার হাসিটা কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই মনটা আরও অস্হির হয়ে পড়ছে ক্ষণে ক্ষণে। ইচ্ছে হচ্ছে মেয়েটাকে শ’ক্ত করে নিজের সাথে জড়িয়ে নিতে।নিজের বুকে মেয়েটাকে একেবারে লুকিয়ে ফেলতে।
অস্হির মন নিয়েই বারান্দা থেকে বেরিয়ে পাশের রুমের দিকে পা বাড়ায় আলভি।দরজার কাছে এসেই থেমে যায়।একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সায়রার দিকে।মেয়েটার শুভ্র মুখশ্রী অসুস্থতার প্রভাবে অত্যধিক মাত্রায় ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করেছে।শুকিয়ে গেছে অনেকটা।চোখের নিচে পড়েছে গাড়ো কা’লো দাগ।পেটটা আগের থেকে অনেকটা ফুলেছে।হাতে-পায়ে পানি এসে গেছে।আদুরে মেয়েটার ভঙ্গুর শরীরের দিকে তাকানো যাচ্ছেনা।তবুও সমস্ত শারীরিক অসুস্হতাকে ছাড়িয়ে তার মুখে লেগে আছে প্রাণখোলা মিষ্টি হাসির রেখা।সাইরিফ, আদনানকে জড়িয়ে রেখেছে নিজের সাথে।থেকে থেকেই চুমু খাচ্ছে ছেলেদুটোর মাথায়।প্রতিদিন এইরকম দৃশ্য দেখলেও আজ কেনো যেনো এই ভালোবাসা, মায়ায় ভরপুর এই দৃশ্যটি তার বুকে চিনচিনে অসহ্য য’ন্ত্র’ণা’দায়ক অনুভূতির সঞ্চার ঘটাচ্ছে।চোখ ফেটে পানি বেরিয়ে আসতে চাইছে।আদনানের কন্ঠে নিজের ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো আলভি।ঝাপসা চোখেই তাকালো ভিতরের দিকে।আদনান তখন সায়রাকে জড়িয়ে ধরে আদুরে স্বরে বলে চলেছে,,,
–“মামনি!..আই লাভ ইউ।”
আদনানের মিষ্টি কন্ঠের আদোআদো বুলিতে হৃদয়টা ভরে যায় সায়রার।আদনানের কপালে আলতো একটা চুমু খেয়ে সেও বলে ওঠে,,,
–“লাভ ইউ টু সোনা।”
আদনানকে লাভ ইউ বলাতে যেনো ফুঁ’সে ওঠে সাইরিফ।সায়রাকে অপর দিক থেকে জড়িয়ে ধরে তী’ব্র স্বরে বলে ওঠে,,,
–“আই লাভ ইউ মা।..আদনানকে তুমি লাভ ইউ টু বলোনা।শুধু আমাকে বলবে আর বনুকে বলবে।বুঝেছো?বলো…বলো।”
সাইরিফের কথা শুনে ফিক করে হেসে দেয় সায়রা।এই দুইভাই এখন প্রায়ই সায়রা আর তাদের অনাগত বোনকে নিয়ে মিষ্টি খুনসুটিতে মেতে ওঠে।এ বলে ওরা আমার, তো ও বলে ওরা আমার।এই নিয়েই লেগে থাকে তাদের ঝগড়া।অতঃপর অনেক তর্কবির্তকের পরে শরণাপন্ন হয় সায়রার।সায়রা তখন অনেক অনেক ভালোবাসা, আদরে তুষ্ট করে দেয় তাদের।কথাগুলো ভাবনার মধ্যেই আবারও তাড়া দেয় সাইরিফ তার কথা মানার জন্য।সায়রাও হাসিমুখে তাড়াতাড়ি করে বলে,,,
–“হ্যাঁ হ্যাঁ.. লাভ ইউ টু বাবু।”
সায়রা ‘লাভ ইউ’ বলতেই গাল জুড়ে হাসি ফুটে ওঠে সাইরিফের।তার খুশি আর দেখে কে? আদনানকে ভেঙচি কেটে ওর দিকে আঙুল তুলে বলে,,,
–“দেখলি মা শুধু আমাকে আর বনুকেই লাভ ইউ বলবে।তোকে বলবেনা।”
কাঁদোকাঁদো মুখ হয়ে যায় আদনানের।সায়রাকে জড়িয়ে ধরে বলে,,,
–“তাই মামনি আমায় তুমি আর বনু ভালোবাসবেনা? আদর করবেনা? শুধু সাইরিফকেই করবে?”
–“না তো বাবা।আমি আর তোমাদের বনু তোমাদের দুজনকেই সমান ভালোবাসি।সমান আদর করি।তোমরা দুজনেই আমাদের অনেককককক প্রিয়।আর তোমরা দুইভাইও দুজনের অনেক প্রিয় তাইনা?কি সাইরিফ তাইতো?..”
সায়রার কথায় সম্মতি সূচক মাথা নাড়ে আলভি।অপর হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে আদনানকে। বলে,,,
–“আমি আদনানকেও অনেক ভালোবাসি।আর আদনানও আমাকে অনেক ভালোবাসে।”
সাইরিফের সাথে সহমত জানায় আদনান।বিছানার উপরে বসেই তিন জন তিনজনকে জড়িয়ে ধরে রাখে।আর তাদের দেখে গাল ফুলায় জুলেখা।অভিমানী স্বরে বলে ওঠে,,,
–“আর আমায় বুঝি কেউ ভালোবাসেনা?”
সাইরিফ, আদনান তখন সমস্বরে বলে ওঠে,,,
–” আমরা তোমাকেও অনেক ভালোবাসি আন্টি।কাছে এসো আমাদের।”
জুলেখাও উঠে গিয়ে জড়িয়ে ধরে তিনজনকে।রুমের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ভিতরে চলমান দৃশ্যটি মন দিয়ে দুচোখ ভরে দেখছিলো আলভি।মন গহীনে নিখুঁতভাবে এঁকে নিচ্ছে এই ভালোবাসার মায়ায় জাড়ানো চিত্রপট।ভবিষ্যতে কি হবে?এইরকম দৃশ্য আর দেখতে পাবে কিনা তার কোনো নিশ্চয়তা নেই তার কাছে।ওই মায়াবী পরীটা আর কতোদিন তাদের জীবনে যাদুকাঠি ছোঁয়াতে পারবে কোনো কিছুই জানেনা সে।বাস্তবটা এতো য’ন্ত্র’ণা’দায়ক, এতোটা নি’ষ্ঠু’র কেনো? সায়রা নামক মানবীটির আয়ুষ্কাল আর মাত্র কয়েকটাদিন হয়তো।আর কিছুদিন পরেই হয়তো হাত বাড়ালেই আর ছুঁতে পারবেনা মেয়েটাকে।ভালোবাসামাখা আদুরে স্পর্শে জড়িয়ে নিতে পারবেনা নিজের সাথে। মায়াবী মুখশ্রী দর্শন করে মেটাতে পারবেনা নিজের চক্ষুতৃ’ষ্ণা।কথাগুলো ভাবলেই হৃদস্পন্দন থমকে যেতে চায়।বুকের চিনচিনে ব্য’থা’টা সর্বস্ব গ্রাস করে নেয়।মস্তিষ্ক অকেজো হয়ে পড়ে।নিঃশ্বাসটাও বন্ধ হয়ে আসতে চায়।উফ!..কি করে বাঁচবে আলভি? ম’রে যাবেনা সে?..হ্যাঁ ম’রেই তো যাবে সে।শরীরটা বেঁচে থাকলেও মনটাতো তার নিঃ’শ্বে’ষ হয়ে যাবে।আর ওই ছোটো ছোটো বাচ্চাদুটো ওদের কি হবে?মাকে চিরতরে হারানোর য’ন্ত্র’ণা সহ্য করতে পারবেনা ওরা।একদম পারবেনা।মা’ই যে ওদের কাছে সবকিছু।মা ছাড়া যে ছেলেদুটো কিছুই বোঝেনা।একমূহুর্তও কাছ ছাড়া করেনা মাকে।সেই মাকে ছাড়া থাকতে পারবে তারা?সায়রাকে ছাড়া যে এই পৃথিবীটা জাহান্নাম হয়ে উঠবে মানুষ তিনটির কাছে।
সায়রা,জুলেখাকে নিয়ে আলভিরা সিলেট থেকে ফিরে এসেছে প্রায় দুমাস হলো।সেইদিন রাতে সায়রার লুকিয়ে রাখা এতো বড়ো সত্যিটা, তার অসুখের কথা জানতে পেরে একদম ভেঙে পড়েছিলো আলভি।হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছিলো।সায়রাও সেদিন নিজের সবথেকে নিরাপদ, ভরসাযোগ্য, শান্তির স্হান আলভির বুকে মাথা রেখে নিজের মনে জমে থাকা সমস্ত ক’ষ্ট, য’ন্ত্র’ণা, ভ’য়, আ’শ’ঙ্কা বিসর্জন দিয়েছিলো। জানিয়েছিলো প্রিয় মানুষগুলোর সাথে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা।জানিয়েছিলো অনাগত সন্তানটির জীবন নিয়ে তার মনে থাকা শ’ঙ্কা’র কথা।কিছুই বলতে পারেনি সেদিন আলভি।স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো।মেয়েটার এতোটা কষ্ট সহ্য হচ্ছিলোনা তার।একা একা এতোটা মাস এতোটা য’ন্ত্র’ণা’ম’য় প্রহর পার করেছিলো মেয়েটা ভাবতেই নিজেকে নিজের শেষ করে দিতে হচ্ছিলো।আলভিও অঝোরে কেঁদে ছিলো সেদিন সায়রাকে বুকে নিয়ে।দুই মানব-মানবীর করুণ কান্নায়, একসাথে বেঁচে থাকার আকুতিতেই বুঝি ভারি হয়ে উঠেছিলো আকাশ-বাতাস।
পরেরদিন সকালবেলাই সায়রার শত নিষেধ অবজ্ঞা করে জোর করে তাকে নিয়ে ঢাকায় ফিরে এসেছিলো আলভি। তারপর থেকেই শুরু হয় এই ডাক্তার, ওই ডাক্তারের কাছে সায়রাকে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি। গত দুমাসে কম ডাক্তারের সাথে কথা হয়নি আলভির।কিন্তু কেউই তাকে কোনো আশা দিতে পারেনি সায়রা আর তাদের সন্তানের জীবনের নিশ্চয়তা নিয়ে।বাচ্চাটির আশা আলভি ছেড়েই দিয়েছে কারণ যেখানে সায়রার জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নেই সেখানে অনাগত প্রাণটি কি করে বাঁচবে?মেজর অপারেশনের ধকল হয়তো সামলাতে পারবেনা ছোট্ট প্রাণটি। নিজের সন্তানের এমন করুণ পরিণতির কথা ভাবলেই কলিজাটা ফে’টে যায় আলভির।কিন্তু করার যে কিছুই নেই।সমস্তটা শুধুমাত্র ওই মহান আল্লাহ’ই ঠিক করে দিতে পারেন।তাই তার কাছেই নিজের সমস্ত আকুতি, অনুরোধ, কা’ন্না মেলে ধরে আলভি।
একমাস আগে সকলকে নিয়ে ইন্ডিয়া এসেছে আলভি।ডাক্তারের পরামর্শেই এই ব্যবস্হা।ডাক্তারের ভাষ্যমতে আবহাওয়া পরিবর্তন হলে, প্রিয় মানুষগুলোর সাথে সুন্দর কিছু মুহূর্ত কাটালে মনের জোর বাড়বে সায়রার কঠিন পরিস্হিতি মোকাবেলা করার জন্য।আর এখানেই ব্রেইন টিউমার অপারেশন করা হবে সায়রার। ****** হসপিটালে সায়রার অপারেশনের সমস্ত ব্যবস্হা করা থাকলেও সায়রা কিছুতেই রাজি নয় কোনো অপারেশন করতে।তার গর্ভের সন্তানের জীবনের ঝুঁ’কি নিয়ে, সেই প্রাণটাকে বিপদে ফেলে কোনোক্রমেই সে অপারেশনে রাজি না।তাতে সে না বাঁচলেও চলবে।তবে বাচ্চাটির কোনো ক্ষতি সে হতে দিতে পারবেনা।জোর করেও কোনো লাভ হচ্ছেনা।সায়রা কিছুতেই রাজি হচ্ছেনন।উল্টে সে সকলকে হুমকি দিচ্ছে তাকে জোর করলে অপারেশন টেবিলে সে কোনো একটা অঘটন ঘটিয়ে দেবে।কোনোকিছুতেই সে নিজে থেকে রেন্সপন্স করার চেষ্টাটাও করবেনা।কেউ তাকে এটা বুঝাতেই পারছেনা যে এভাবে থাকলে তার সাথে সাথে বাচ্চাটিরও ক’ষ্ট হবে।তার থেকে একবার শেষ চেষ্টা করাটাই উত্তম।সায়রা তা কোনোমতেই মানতে নারাজ।যার ফলে টিউমারটা ধীরে ধীরে আরও মা’রা’ত্ম’ক হয়ে উঠছে।
এই দুইমাস সায়রার অসহনীয় য’ন্ত্র’ণা নিজের চোখে দেখেছে আলভি।মাথার ব্যথাটা বাড়লেই পাগল পাগল হয়ে যায় মেয়েটা।মাথার চুল খাঁ’ম’চে, চিৎকার করে কেঁ’দে য’ন্ত্র’ণা কমাতে চায়।সেই সময়টাতে নিজেকে সবথেকে বড়ো অপদার্থ, অসহায় বলে মনে হয় আলভির।মনে হয় আল্লাহ তো মেয়েটার জায়গায় তাকেও দিতে পারতো এই অসুখটা।তবুও তো মেয়েটা, তার সন্তানেরা ভালো থাকতো।কিন্তু সায়রার কিছু হয়ে গেলে তারা তিনটে মানুষ বেঁচে থেকেও ম’রে যাবে।আর এমন জীবন আলভি চায়না যে জীবনে সায়রার ভালোবাসা, মায়া থাকবেনা।
দরজা থেকে সরে আসে আলভি।ড্রয়িংরুমের সোফায় মাথা নিচু করে বসে পড়ে।হয়তো নিজের অস্হিরতা, ক’ষ্ট, য’ন্ত্র’ণা’র ছাপ, চোখের পানি লুকনোর প্রচেষ্টা।হঠাৎই মাথায় আলতো হাতের ছোঁয়া পেয়ে মাথা তুলে তাকায় আলভি।সায়রা দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। সায়রার হাত ধরে তাকে সোফায় বসিয়ে দেয় আলভি।নিজে সোফা থেকে নেমে সায়রার পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে আলতো করে নিজের মাথাটা রাখে সায়রার কোলে।
সায়রা তাকিয়ে আছে আলভির মুখের দিকে।আলভিকে দরজা থেকে সরে আসতে দেখেই উঠে চলে আসে তার কাছে।ছেলেটা অাজকাল অত্যধিক চিন্তায় মগ্ন থাকে সারাটাক্ষন, ঘুমায়ওনা ঠিকভাবে।আর এই চিন্তাটা যে তাকে নিয়েই তাও ভালোভাবেই জানে সায়রা।কিন্তু তার যে কিছুই করার নেই।নিজের জীবন বাঁচাতে গিয়ে কি করে এতোদিন তার গর্ভে লালন করা সন্তানটির জীবন বিপদে ফেলবে সে? কিছুতেই পারবেনা সে।তাইতো কিছুতেই সে রাজি হচ্ছেনা অপারেশনের জন্য।আল্লাহ তার কপালে যা লিখে রেখেছেন তাইই হবে তার সাথে।কিন্তু অনাগত প্রাণটিকে সে ঝুঁকিতে ফেলবেনা।জানে তার এই সিদ্ধান্তে এই মানুষগুলো ক’ষ্ট পাচ্ছে, পাবে।তবে সময়ের সাথে সাথে হয়তো সেই য’ন্ত্র’ণা ফিঁকেও হয়ে যাবে।আল্লাহই ঠিক করে দেবেন সব ইনশাআল্লাহ।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আলভির মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে নরম কন্ঠে সায়রা বলে,,,
–“এতো চিন্তা কেনো করছো?এরকম করলে তো তোমার শরীরটাও খারাপ হয়ে যাবে।কতোটা শুকিয়ে গেছো দেখেছো একবারো?তুমি এরকম করলে বাচ্চাদুটো কি করবে বলোতো?”
কোনো উত্তর দেয়না আলভি। চুপচাপ বসে থাকে।তা দেখে চোখে পানি চলে আসে সায়রার।আলভির মাথাটা নিজের কোল থেকে উঠিয়ে হাত দিয়ে কাছে টেনে আনে।গভীরভাবে ভালোবাসার পরশ এঁকে দেয় আলভির কপালে।আবেশে আলভি চোখ বন্ধ করতেই গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে চোখের কোণে জমে থাকা পানি।খুব যত্ন করে সেই পানি মুছে দেয় সায়রা।আরেকটু কাছে টেনে নেয় আলভিকে।কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলে,,,
–“তোমার এতো ক’ষ্ট আমি আর সহ্য করতে পারছিনা আলভি।এতো ক’ষ্ট পেয়োনা তুমি প্লিজ।”
বন্ধ চোখের পাতা খুলে সায়রার মুখটা দুহাতে স্পর্শ করে আলভি।ধরা গলায় বলে ওঠে,,,
–“আর আমার?আমার বুঝি খুব সহ্য হচ্ছে?তোমার এতো য’ন্ত্র’ণা, এতো ক’ষ্ট আমাকে কি পরিমাণ আঘাত করছে তা কি তুমি জানোনা মায়াপরী?তবে কেনো এতোটা নি’ষ্ঠু’র হচ্ছো?..যে এখনো পৃথিবীতে আসেইনি তার জন্য তোমার এতো মায়া আর আমরা যারা তোমার মুখ চেয়ে বেঁচে আছি তাদের প্রতি তোমার কোনো মায়া হয়না, না?”
একটু থেমে আবার অনুরোধের স্বরে আলভি বলে,,,
–“এতোটা নি’ষ্ঠু’র কেনো হচ্ছো জান?তুমি তো জানো তোমাকে ছাড়া আমরা একেবারে নিঃস্ব হয়ে যাবো।বেঁচে থাকার রশদটাই যদি হারিয়ে যায় তবে বাঁচবো কি করে গো আমরা?..প্লিজ পরী জেদ করোনা।আমাদের বাঁচাও।রাজি হয়ে যাও অপারেশনের জন্য।প্লিজ..”
কিছুই বলেনা সায়রা।আলভিকে জড়িয়ে তার ঘাড়ে মুখ গুঁজে দেয়।আলভির ইচ্ছেটা কোনোভাবেই তার পক্ষে মানা সম্ভব নয়।নিজের কাঁধে ভেজা অনুভব করতেই বুঝতে পারে আলভিও কাঁদছে।আরও একটু শ’ক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরে সায়রা।
কিছুটা সময় যেতেই মাথার য’ন্ত্র’ণা অত্যধিক বেড়ে যায় সায়রার।কিছুতেই আর সেই ব্যথা সহ্য করা সম্ভব হচ্ছেনা তার পক্ষে। অনেকক্ষণ আগে থেকে ব্য’থাটা শুরু হলেও কাউকেই বুঝতে দিচ্ছিলোনা সে।কিন্তু এখন ব্য’থা তার সহ্যের মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।আলভির ঘাড়ে মুখ রেখেই দুহাত দিয়ে তার দুকাঁধ খাঁ’ম’চে ধরে।কা’ম’ড়ে ধরে আলভির ঘাড়।
সায়রার কা’ম’ড়, খাঁ’ম’চি’তে প্রচন্ড ব্য’থা পাচ্ছে আলভি।সাথে এটাও বুঝতে পারছে সায়রার শরীর প্রচন্ড পরিমাণে কাঁপছে।নিজের থেকে সায়রাকে ছাড়াতে চেষ্টা করলেও কিছুতেই তাকে ছাড়ছেনা সায়রা।আলভি ক্রমাগত অস্হির কন্ঠে সায়রাকে জিজ্ঞেস করে চলেছে তার কোথায় ক’ষ্ট হচ্ছে।কিন্তু সায়রা যে কোনো উত্তর দেবার অবস্হাতেই নেই।হঠাৎই মুখ ভরে আলভির গায়ে বমি করে দেয় সায়রা।বমি করেই আস্তে আস্তে নেতিয়ে পড়তে থাকে।ছেড়ে দেয় আলভিকে।এদিকে সায়রাকে বমি করতে দেখে ভ’য় পেয়ে যায় আলভি।চিৎকার করে ওঠে।আলভির চিৎকার শুনেই তড়িঘড়ি করে ড্রয়িংরুমে এসে উপস্হিত হয় দুইভাই আর জুলেখা।সায়রার চোখ-মুখ কেমন উল্টে আসছে।দুচোখ বেয়ে পানি পড়ে চলেছে।জোড়ে জোড়ে নিঃশ্বাস নিচ্ছে।দুইভাই সায়রার এই অবস্হা দেখে তাড়স্বরে কা’ন্না শুরু করে দিয়েছে।আর সায়রার দেহ দুহাতে আঁকড়ে ধরে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে আলভি।
নিজের দুর্বল কাঁপা হাতটা আলভির গালে রেখে বহু কষ্টে জোড়ে জোড়ে নিঃশ্বাস নিতে নিতেই সায়রা বলে,,,
–“বাচ্চাদের দে.. দেখে রেখো আলভি।ভা..ভালো থেকো।খু..খুব ভালো থেকো।..আমার বাচ্চাটাকে বাঁ..বাঁচাও আলভি। বাঁচাও।”
আলভি এখনো হতভম্ব। তার কানে আদেও কিছু ঢুকছে কিনা তার কোনো ঠিক নেই।সে শুদু নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে সায়রার য’ন্ত্র’ণামা’খা চেহারার দিকে।জুলেখা সায়রার অবস্হা খারাপ দেখেই অ্যাম্বুলেন্সের জন্য ফোন করে দিয়েছে।বাইরে প্রচন্ড ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়েছে।ডালপালা ভেঙে পড়ছে।প্রকৃতির সাথে সাথে এই মানুষগুলোর জীবনেও শুরু হয়েছে ঝড়ের তা’ন্ড’ব।কে জানে কি হবে তাদের পরিণতি?..
চলবে…