ভালোবাসার সংসার পর্বঃ০৭

0
297

#ভালোবাসার_সংসার
#পর্বঃ০৭
#ফারজানা

ঘুমের মধ্যেই নিজের উপর কারোর গভীর দৃষ্টি অনুভব করতেই ঘুমটা হালকা হয়ে গেলো সায়রার।কেমন একটা অস্হির অস্হির অনুভূত হলেও চোখ খুলতে পারলোনা সায়রা।বলা ভালো খুলতে ইচ্ছেই হলোনা।কারণ গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা মানুষটি যে সায়রার চিরচেনা যে আশেপাশে থাকলেও সায়রা বুঝতে পারে, যার একটুখানি স্পর্শ সায়রার সকল য’ন্ত্র’ণা’কে এক লহমায় মুছে দিতে পারে।মুখের উপরে পড়া গরম নিঃশ্বাসটা আরো একটু কাছ থেকে অনুভব করতেই খুবই শান্তভাবে চোখ খুলে তাকায় সায়রা।চোখ খুলতেই সায়রার ভাবনাই সঠিক প্রমাণিত হয়।তার দিকে খানিকটা ঝুঁকে আলভিই বসে আছে তার সম্মুখে মুখে মিষ্টি একটা হাসি নিয়ে।আলভিকে এভাবে নিজের এতোটা কাছে দেখতে পেয়ে সায়রার যে রকম রিয়েক্ট করার কথা ছিলো তার কিছুই সায়রা করলোনা বরংচ অতিরিক্ত মাত্রায় শান্তভাব বিরাজমান তার মধ্যে। আলভির স্নিগ্ধ মুখটা এতোদিন পরে এতোকাছে থেকে দেখতে পেয়ে ঘোরে চলে গেছে সায়রা। একটা শীতল হাওয়া বয়ে চলেছে তার উত্তপ্ত হৃদয় জুড়ে।তাইতো মানুষটিকে নিজের এতোকাছে দেখেও কোনোপ্রকার খারাপ আচরণ করার কথা তার মনেই নেই।

সূর্য না উঠায় আদো আদো আলোতে ছেয়ে আছে চারপাশ।হালকা বাতাস,পাখির কিচিরমিচির, সিলেটের পাহাড়ি এলাকায় এই সময়টা যেনো অন্যরকম একটা প্রশান্তি প্রদান করে।তার চেয়েও বেশি শান্তি অনুভব করছিলো আলভি ঘুমন্ত মুখটির দিকে তাকিয়ে থাকে।কতোদিন, কতোমাস পরে এই মুখটিকে এতোটা কাছ থেকে দেখতে পাচ্ছে সে?কতোটা বি’ষা’ক্ত অপেক্ষার প্রহর অতিক্রম করার পরে এই প্রশান্তি অনুভব করছে আলভি তা শুধুমাত্র সেই জানে।খুব ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে মেয়েটিকে।কিন্তু তার ঘুম ভেঙে যাবার ভয়ে তা করতে পারছেনা।দেখে মনে হচ্ছে কতোদিন পরে আজ মেয়েটি একটু প্রশান্তির ঘুম ঘুমোচ্ছে যা তার মুখেও প্রকাশ পাচ্ছে।কতোক্ষণব্যাপী আলভি যে সায়রার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়েছিলো তা সে নিজেই জানেনা।সায়রা চোখ মেলে তাকাতেই দুজনের চোখাচোখি হয়ে যায় আর তাতেই ঘোর কাটে আলভির।তবুও সায়রার ওই শান্ত, মায়াবি চোখ থেকে কিছুতেই চোখ সরাতে পারছেনা সে।

সায়রার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকা অবস্হায়ই আরেকটু ঝুঁকে গিয়ে সায়রার কপালে গভীর একটা ভালোবাসার স্পর্শ এঁকে দেয় আলভি।আলভির ঠোঁটের স্পর্শ পেতেই আবেশে চোখ বন্ধ হয়ে যায় সায়রার।আবেগী চোখের কোণ ঘেষে গড়িয়ে পড়ে একফোঁটা পানি।আলভি উঠে বসে পরম যত্ন মুছিয়ে দেয় গড়িয়ে পড়া পানিটুকু।আদুরে হাত বুলাতে থাকে সায়রার মাথায়।

আলভির দিকেই তাকিয়ে আছে সায়রা।খুব মনে পড়ছে পুরনো সেই সোনালী দিনগুলোর কথা যখন এই ঘটনাটিই ছিলো তাদের নিত্যদিনকার ভালোবাসাময় প্রহরের স্বাভাবিক দৃশ্য।আগেতো এভাবেই প্রতিদিন সকালে আলভি সায়রার কপালে এঁকে দিতো নিজের পবিত্র ভালোবাসার গভীর স্পর্শ।আর এতেই সমস্ত শরীর-মন জুড়িয়ে যেতো সায়রার।ভালোবাসা বহিঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে আলভির কোনো কমতি ছিলোনা।চার দেয়ালের বদ্ধ ইট-পাথরের ঘরটিও তাদের ভালোবাসায় হয়ে উঠেছিলো #ভালোবাসার_সংসার।কিন্তু হঠাৎই সবটা বদলে গেলো।ভালোবাসা না কমলেও বেড়ে গেলো অভিমান আর তাতেই ছন্নছাড়া হয়ে গেলো নিজেদের সাজানো গোছানা জীবনটা।আর যাতে খানিকটা দোষ হয়তো সায়রারও ছিলো।আলভির গলা পেতেই নিজের ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো সায়রা।মিহি কন্ঠে তার মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরেভাবে আলভি জিজ্ঞেস করলো,,,

–“কেমন আছো তুমি?”

কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করে আলভির চোখ চোখ রেখেই কিছুটা রু’ক্ষভাবে সায়রা জবাব দিলো,,,

–“গতকাল পর্যন্ত ভালোই ছিলাম।আপনাদের দেখেই খারাপ থাকা শুরু হয়ে গেছে।”

সায়রার কথায় কোনো পাল্টা জবাব করেনা আলভি।কথাটির মধ্যে যে কতোটুকু সত্যতা আছে তা সে ভালোভাবেই জানে।তাই মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে সায়রার স্ফিত উদরে আলতোভাবে হাত বুলিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলো,,,

–“আর আমার বাবুটা কেমন আছে মায়ের কাছে?..বাবা, ভাইয়াদের দেখে অনেক খুশি হয়ে গেছে নিশ্চয়ই?”

–“একদমই না।একদমই খুশি হয়নি আপনাদের দেখে বরংচ এতোদিন খুশি ছিলো, ভালো ছিলো।”

একটুও দেরি না করে তৎক্ষনাৎ উত্তর দেয় সায়রা।তবে সায়রার কথা শেষ হতে না হতেই মুখ কুঁচকে যায় সায়রার।কারণ পেটের মধ্যে অবস্হান করা ব্যক্তিটি তার কথায় যে মোটেও সম্মত নয় তা বুঝাতেই সে তৎপর হয়ে উঠেছিলো।সায়রার পেটের উপরে হাত রাখা ছিলো বলে আলভিও তা টের পেয়েছে।তাইতো সায়রার পাতলা কাপড়ের উপর দিয়ে ছোটো পায়ের লাথি অনুভব করতেই ফিক করে হেসে দেয় আলভি।বড্ড অ’লৌ’কি’ক ঘটনা বটে।তবে সে ভীষণ খুশি হয়েছে তা তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে।হাসিমুখেই সায়রাকে পিন্ঞ্চ করে বললো,,,

–“থাক তোমায় আর ক’ষ্ট করে মিথ্যে বলতে হবেনা। ছোটো হলে কি হবে সে নিজেই নিজের মতামত জানাতে পারে তার বাবাকে।”

–“এই সরুন তো সরুন।আমি উঠবো।আপনার ফালতু কথা শুনে আমার মেজাজ খারাপ হচ্ছে।”

সায়রা রাগ করে উঠে যেতে নিতেই আলভি তাড়াতাড়ি আগলে নেয় তাকে।সায়রার বারণ সত্ত্বেও নিজেই বিছানা থেকে নামিয়ে দাঁড় করায়।সায়রার সামনে দাড়িয়ে বলে ওঠে,,,

–“পালিয়ে গেলে আর কিইবা হবে?যা জানার তা তো জেনেই গেছি আমি।”

কথাটি বলে মিটিমিটি হাসতে হাসতে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।আর তা দেখতে পেয়েই দাঁত কিড়মিড় করে রাগ প্রকাশ করে সায়রা।বাম পাশে তাকাতেই চোখ পড়ে চৌকিতে ঘুমন্ত দুইছেলের উপরে।ধীরে ধীরে সেদিকে এগিয়ে যায় সায়রা।খাটের মধ্যে দুইভাই দুইজনকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে।সায়রা থাকাকালীন এই দৃশ্য কখনোই দেখা যেতোনা।অথচ সায়রার অবর্তমানে সবকিছু অনেকটা পাল্টে গেছে।এটাই তো চায় সায়রা।তবুও অবুঝ মন যে মানেনা।খুব যত্ন করে নিজের দুই কলিজার টুকরোর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় সায়রা।দীর্ঘক্ষণ ব্যপী তার আদরের পরশ বুলিয়ে দেয় দুইছেলের কপালে,গালে।দুইছেলেকে নিজের বুকের মাঝে শক্ত করে জড়িয়ে ধরার প্রবল ইচ্ছেটা পূরণ করতে না পারায় সায়রার প্রাণটাই কখনো কখনো বেরিয়ে আসতে চায়।তবুও সে যে অপারগ এটিই এখন তার জীবনের অমোঘ বাস্তব সত্যি।

দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে মা, ছেলেদের এই ভালোবাসাময় দৃশ্য অবলোকন করতেই বুকটা ভরে ওঠে আলভির।এই দৃশ্যটি চোখের সামনে দেখার জন্য কতোইনা অস্হির ছিলো সে। অবশেষে আজ আবারও এতো সুন্দর একটা মুহূর্তের সাক্ষী হতে পারলো সে।আলভি জানে সায়রা তাদের সাথে যেতে রাজি হবেই।তাদের ক্ষমা করবেই।এটা আলভির মন বলছে।আর নিজের উপর, নিজের ভালোবাসার উপর, ভালোবাসার মানুষটির উপরে পূর্ণ বিশ্বাস তার আছে।

————- —————

রান্নাঘরের থেকে কিছুটা দূরে ছোটো টুলে বসে আছে সায়রা।তার রা’গী দৃষ্টি রান্নাঘরের দিকেই নিবদ্ধ। আর রান্নাঘরে বর্তমানে অবস্হানরত আছে তিন বাপ-ছেলে।সায়রাদের রান্নাঘরটা বাইরেই আলাদাভাবে তৈরি করা খড়কুটো দিয়ে।আর তাতে রান্নার কাজে ব্যবহৃত হয় লাকড়ি।এই লাকড়ি দিয়ে শহরের মানুষের পক্ষে রান্না করা সম্ভব নয় অন্তত যারা আগে কখনো এভাবে রান্না করেনি তাদের ক্ষেত্রে। এবং এই দলের তালিকা করতে গেলে সর্বপ্রথম নাম আসবে বোধহয় আলভির।যে কিনা গ্যাসস্টোভেই রান্না করতে পারেনা সে যদি লাকড়ি দিয়ে রান্না করতে যায় তাহলে কি অবস্হা হতে পারে সেই কথা চিন্তা করেই সায়রার এই রাগ।তবে তার রাগকে বিন্দুমাত্রও পাত্তা দিচ্ছেনা ওই তিনটি মানুষ।এমনকি জুলেখাকেও যেতে দিচ্ছেনা সাহায্যের জন্য।তাদের নাকি আজ খুব ইচ্ছে হয়েছে সায়রার জন্য রান্না করার তাই সেই ইচ্ছে পূ্রণের জন্যই এহেন কাজ তাদের।

চুলোর ভেতরে লাকড়িটা প্রায় শেষ হয়ে আসলেও সেদিকে কোনো খেয়াল নেই আলভির।সে ব্যস্ত পাতিলের ভিতরে উঁকি দিতে আর খাবারের টেস্ট পরোখ করে দেখতে।আর এদিকে যে লাকড়িটা জ্ব’ল’তে জ্ব’ল’তে চুলোর আ’গু’ন সেই লাকড়ির একদম শেষ প্রান্তে উপস্হিত হয়েছে তা সে বুঝতেও পারেনি।যার ফলস্বরূপ চুলোর আ’গু’ন আরো জ্বলে উঠার জন্য লাকড়ির দিকে হাত বাড়াতেই সেই আগুনে বেশ ভালোভাবেই ছেঁ’কা লেগে যায় আলভির।অজান্তেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে আ’র্ত’না’দ।

আলভির আ’র্ত’না’দ কানে আসতেই পড়িমড়ি করে রান্নাঘরের দিকে ছুট লাগায় সায়রা।তার পিছনে পিছনে জুলেখাও যায়।রান্নাঘরে আসতেই আলভিকে ডান হাতটা ধরে চোখ-মুখ কুঁচকে থাকা অবস্হায় দেখতে পায়।তৎক্ষনাৎ আলভির হাতটা টেনে নিজের হাতে নিতেই দেখতে পায় ফর্সা হাতের তালু অনেকটা লাল হয়ে আছে।বিচলিত হয়ে পড়ে সায়রা।কারণ সে জানে আলভি এইসব যন্ত্রণা সহ্য করতে পারেনা।অস্হির হয়েই আলভির উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,,,

–“কেনো আসলেন এখানে? আপনি কি রান্না করতে পারেন? গেলো তো এখন হাতটা পুড়ে।ইশ!”

সায়রার বিচলিত হয়ে ওঠা মুখের দিকে তাকিয়েই আলভি শান্তস্বরে জবাব দেয়,,,

–“নাহ্ পারিনা তো।একদমই পারিনা।তুমি ছাড়া কিচ্ছু পারিনা।জানোতো তুমি।প্লিজ ফিরে চলো আমাদের সাথে তাহলে আর কখনোই এরকমটা হবেনা তো।প্লিজ…”

কোনো জবাবই আসেনা সায়রার দিক থেকে।সে একভাবে তাকিয়ে আছে আলভির ফর্সা হাতের দিকে।হাতের দুই-তিন জায়গায় পোড়া দাগগুলোই দেখছে সায়রা।যা জানান দিচ্ছে আলভির এই কয়েক মাসের ক’ষ্ট সম্পর্কে। আলগোছে আলভির হাতটা ছেড়ে দিয়ে জুলেখার দিকে তাকিয়ে অত্যধিক শীতল কন্ঠে সায়রা বললো,,,

–“পানি দিয়ে দে ওনার হাতে আর বার্ন মলমটাও দিস।”

নিজের কথা শেষ করেই রান্নাঘর থেকে প্রস্হান করে সায়রা।খুব ধীরস্হির তার চলার গতি।আর সায়রার যাওয়ার পথের দিকেই একদৃষ্টিতে করুণভাবে চেয়ে আছে আলভি।চোখে তার ফিরে পাওয়ার স্পষ্ট আকুতি বিরাজমান।

চলবে…

_____________________________________________________________________
ভুল-ত্রুটি ক্ষ’মা’সু’ন্দ’র দৃষ্টিতে দেখবেন এবং গল্পটি সম্পর্কে আপনাদের মতামত জানাবেন।
বিঃদ্রঃ “গল্পটি সম্পূর্ণ কল্পনাপ্রসূত।”
হেপি রিডিং!!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here