#পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী পর্বঃ উনিশ

0
455

#পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী পর্বঃ উনিশ
#মম_সাহা

রাতের হিমশীতল বাতাসে কেঁপে কেঁপে উঠছে সকলের শরীর। দর্শিনী অপলক তাকিয়ে আছে থানার সামনের রাস্তায় থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার দিকে। এ কী সে স্বপ্ন দেখছে? বিহঙ্গীনি এখানে, এসময়ে? অতীতের রাগ,অভিমান মানলো না দর্শিনীর ছোট্ট হৃদয়। এতদিনের প্রিয় বান্ধবীকে দেখে ভুলে গেলো সে তার অতীতের কুৎসিত গল্প। ছুটে গেলো বিহঙ্গিনীর সামনে। আবেশে জড়িয়ে ধরলো সেই নারী দেহকে। নিশ্চুপ আলিঙ্গন যেন বলে গেলো কত অব্যক্ত কথা। কত দীর্ঘশ্বাসের গল্প।

দর্শিনী বিহঙ্গীনির চুলে মোলায়েম, কোমল,আদুরে হাত বুলিয়ে বিগলিত বদনে বলে উঠলো,
“কবে এলি বিহু এখানে? আমার কাছে যাস নি কেনো?”

বিহঙ্গীনিও ততক্ষণে দর্শিনীকে জাপ্টে ধরেছে। কতদিনের তৃষ্ণাত্ব আত্মা আজ শান্তি মিললো। অবশেষে এতদিন পর সে তার প্রাণপ্রিয় সইয়ের দেখা পেলো।মেয়েটাকে ছাড়া জীবনটা কেমন বিষাক্ত হয়ে গিয়েছিলো! আজ শান্তি মিলছে। ঠান্ডা হয়েছে হৃদয় কোণ। আনন্দরা বাঁধন হারা হলো। মিশে গেলো শরীরের প্রতিটি শিরায় উপশিরায়।

বিহঙ্গিনীকে চুপ থাকতে দেখে দর্শিনী আলিঙ্গন ছাড়লো। তার দুই হাতের মধ্যিখানে বিহঙ্গীনির মুখটা আদুরে ভাবে ধরে মিষ্টি কণ্ঠে আবারও শুধালো,
“কবে এলি, পাখি? এত রাতে এখানেই বা কেনো?”

বিহঙ্গীনি এবার মুখ খুললো। সাজিয়ে রাখা বর্ণ গুচ্ছকে দর্শিনীর সামনে তুলে ধরে বললো,
“এসেছি সপ্তাহ খানেক হয়। আমাদের কলেজ থেকে ক্যাম্পিং এর জন্য এই গ্রামে এসেছে ছাত্র ছাত্রীরা। প্রথমে ভেবেছিলাম তোর সাথে কথা বলবো, দেখা করবো কিন্তু সেটা আর হয়ে উঠে নি?”

“কেনো? তোর ভাই না করে দিয়েছে বুঝি?”

দর্শিনীর ভ্রু কুঁচকানো প্রশ্ন শুনে বিষন্ন হাসলো বিহঙ্গিনী। অতঃপর উত্তর দিলো,
“ঐ বাসার কেউ জানেনা বোধহয় আমি এখানে এসেছি। আসলে আমি ঐ বাড়ি ছেড়ে একবারের মতন চলে এসেছি।”

বিহঙ্গীনির কথায় হা হয়ে গেলো দর্শিনী। যে মেয়ে কি-না বাবা-মা, ভাই ছাড়া ঘর থেকে বের হতে লজ্জা পেতো সে কিনা সপ্তাহ খানেক আগে বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে? মেয়েটার এত পরিবর্তন কী করে ঘটলো? তবে কী বিপ্রতীপের নতুন বউ টা ভালো না? কিন্তু কথা বলে তো তেমন মনে হয় নি। এসব ভাবনার মাঝেই বিহঙ্গীনি দর্শিনীর গলা জড়িয়ে ধরলো। আহ্লাদী স্বরে বললো,
“তুই এখানে কী করছিস, বৌদি? কোনো সমস্যা?”

দর্শিরী প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে বিহঙ্গীনি ভ্রু কুঁচকে ফেললো। দর্শিনীর থেকে গুনে গুনে দু পা পিছিয়ে গিয়ে দর্শিনীকে পা হতে মাথা অব্দি খেয়াল করলো। তার মিষ্টি চোখ জোড়াতে এখন বিষ্ময়। মেয়েটাকে আজ এমন লাগছে কেনো? বিশাল পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। সাধারণত এ পরিবর্তন গুলো তো প্রেগন্যান্সির সময় দেখা দেয়। তবে কী দর্শিনী…. ! বিহঙ্গীনি আর কিছু ভাবলো ন। এসব পড়েও ভাবা যাবে। আপাতত এ মুহূর্তেটা উপভোগ করার জন্য।

বিহঙ্গীনি একে একে সবার সাথে কুশলাদি বিনিময় করলো। অতঃপর তাদের থানায় আসার কারণ জানতে পারলো এবং সবাই একসাথে থানায় প্রবেশ করে।

রায়পুর থানার বড় অফিসার আরাম কেদারায় বসে শরীর দুলাচ্ছে আর পা চিবুচ্ছে। হাতের সামনে একটা ফোন ধরা হয়তো ভিডিও দেখছে। হুড়মুড় করে কত গুলো মানুষকে প্রবেশ করতে দেখে তিনি অবাক হন। ভ্রু জোড়া কুঁচকে যায় আপনা-আপনি। সচারাচর গ্রামের মানুষ রাতের বেলা পুলিশ স্টেশন আসে না। অথচ ওরা দলবল নিয়ে চলে এসেছে? এখানের অনেক মানুষের মুখ চেনা আবার অনেকে অপরিচিত তার। অফিসার উঠে দাঁড়ালো। মুখে থাকা পান টাকে কিছুক্ষণ চিবিয়ে ফেলে দিলো সাথের জানলা দিয়ে। অতঃপর তাদের দিকে তাকিয়ে দু হাত জোর করে বললো,
“পেন্নাম নিবেন মাস্টার, বিমল, ডাক্তার বাবুরা। তা এত রাতে এখানে?”

একে একে সবাই প্রবেশ করলো। প্রতাপ সাহা ও বিমল সাহা মানে নিধির বাবাও হাত জোর করে ভদ্রতার সহিতে বললো,
“প্রণাম নিবেন আপনিও। আসলে আমরা একটা সমস্যায় পড়ে আপনার কাছে এসেছি। আশাকরি আপনি আমাদের সাহায্য করবেন।”

“তা তো বুজেছিই যে আপনারা সাহায্য চাওয়ার জন্যই এসেছে। এমনি এমনি পুলিশের খোঁজ নিতে তো আর কেউ পুলিশ স্টেশন আসে না। বলুন তবে কী বলবেন।”

প্রতাপ সাহা তার পাঞ্জাবির পকেটটা থেকে রুমাল বের করে কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম টুকু মুছে ফেললো। আশ্চর্যজনক ভাবে তার শরীর কাঁপছে। নিজের স্বাধের বাড়ি পুড়ে যাওয়ার কথা যেন সে বলতে পারছে না। তার কণ্ঠনালী কাঁপছে।

প্রতাপের অবস্থা সবাই-ই ধরতে পারলো। বাবার এমন অবস্থা দেখে প্রদীপ এগিয়ে এলো সাথে দর্শিনীও। বাবাকে ধরে পাশের চেয়ারটায় বসালো। দর্শিনী নিজের শাড়ির আঁচলটা দিয়ে বাবার মুখ মুছিয়ে দিলো। প্রদীপ বাবার জন্য এক গ্লাস জল আনালো। মুহূর্তেই বাবার ভরসার কাঁধ হয়ে গেলো সন্তান গুলো। জীবন আমাদেরকে সব ফিরিয়ে দেয়। একসময় যে বাবা-মা থাকে সন্তানের ছায়াতল,সময়ের বিবর্তনে সে বাবা-মায়ের ছায়াতল হয়ে উঠে সন্তান। যে বাবা-মায়ের ভরসার হাত ধরে গুটি গুটি পায়ে চলতে শিখে সন্তান একটা সময় পর সে বাবা-মায়ের বৃদ্ধ বয়সের লাঠি হয়ে যায় তার সন্তান। প্রকৃতির কী দারুণ মেলবন্ধন!

প্রতাপ সাহা নিজেকে ধাতস্থ করতেই প্রদীপ মুখ খুলে। হরমোহনের সকল কৃতকর্ম গুছিয়ে উপস্থাপন করে অফিসারের সামনে। প্রদীপের কথা থামতেই অফিসার কতক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় সবার দিকে। অতঃপর কিছুটা সময় মৌন থেকে বলে উঠে,
“আপনারা হরমোহন বাবুর বিপক্ষে মা’ম’লা করতে এসেছেন! অসম্ভব সাহস দেখিয়েছেন বলা যায়। কিন্তু সেই সাহসকে আমি ভর্ৎসনা জানাই। আজ মাথার উপর ছাঁদ পুড়েছে কাল আপনারও পুড়ে যেতে পারেন। আমি সুন্দর একটা উপদেশ দেই, ঝামেলায় না জড়িয়ে মিটমাট করে ফেলুন। এতে আপনাদেরই লাভ।”

অফিসারের কথায় তেতে উঠে সবাই। সুমন তো রেগে চিৎকার দিয়ে বলে উঠে,
“আপনার কাছে কী আমরা উপদেশ চাইতে এসেছি? আপনার চেয়ে বিবেক বুদ্ধি বোধহয় আমাদেরই বেশি উন্নত। আপনার কাছে আমরা মা’ম’লা করতে এসেছি আর আপনি সেটা করতে আমাদের সাহায্য করবেন। দ্রুত কেইস ফাইল করুন। আপনার উপদেশ পকেটে রেখে দালালি বন্ধ করুন।”

সুমনের কথায় ক্ষ্যাপে গেলো পুলিশ অফিসারও। এতক্ষণের বাঁকা হাসিটা তার মুখে আর নেই। বরং তার অগ্নিশর্মা রূপ। সুমনের দিকে আঙ্গুল তাক করে বললেন,
“পুলিশ স্টেশনে বয়ে এসে পুলিশকে হ্যারেস করার অপরাধে আমি আপনাকে জেলে নিতে পারি জানেন সেটা?”

এবার দর্শিনীর তীক্ষ্ণ কণ্ঠ শোনা গেলো,
“ক্ষমতার অপব্যবহার করতে তো সবাই ই জানে। আপনার ক্ষমতা আছে তাই আপনি সেটা করতেই পারেন। তবে মনে রাখবেন সাধারণ জনগনেরও শক্তি অতটাও কম না।”

পুলিশ অফিসার ক্রুর হাসলেন। আরাম করে নিজের চেয়ারটায় বসে পা নাড়াতে নাড়াতে বললেন,
“আচ্ছা? সাধারণ মানুষের এত শক্তি! তবে আমি আগে আপনাদের ক্ষমতা দেখবো তারপর কেইস ফাইল করবো।”

দর্শিনীরা একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো। এটা স্পষ্ট বুঝায় যাচ্ছে হরমোহনের পক্ষের লোক উনি। আইনি কোনো সাহায্য যে সহজে পাওয়া যাবে না সেটাও তাদের বোধগম্য হয়ে গেলো কয়েক মিনিটে। হতাশার শ্বাস ফেললো দর্শিনী। এ জগতে টাকার কাছে বিকিয়ে যায় সব। ক্ষমতা,প্রেম এমনকি ভালোবাসাও টাকার কাছে হার মানে। তবে কী তারা বিচার পাবে না?

তন্মধ্যেই মৃত্যুঞ্জয় কাকে যেন ফোন লাগায়। দরজার কাছে গিয়ে কার সাথে যেন কথা বলে অতঃপর সে ফোন অফিসারের দিকে এগিয়ে দিয়ে বাঁকা হেসে বলে,
“ধরেন অফিসার,সাধারণ মানুষের ক্ষমতা দেখুন এবার।”

অফিসার ভ্রু কুঁচকে ফোনটা নিয়ে নেয়। বিপরীত পাশ থেকে কিছু একটা বলতেই সে তড়িৎ গতিতে লাফিয়ে উঠে। মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে কথা বলেই ফোনটা এগিয়ে দেয় মৃত্যুঞ্জয়ের কাছে। মৃত্যুঞ্জয় আরও কিছু কথা বলে ফোনটা রেখে দেয়। পকেটে দু হাত গুজে হাসি হাসি মুখে বলে,
“কী অফিসার? আরও কিছু দেখবেন?”

অফিসার তার সামনে থাকা জলটা তাড়াতাড়ি এক নিমিষেই শেষ করে স্বস্তির শ্বাস ফেলে। এর একটা বাক্য ব্যয় না করেই কেইস ফাইল করেন। তার মুখে যেন রা নেই। মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে সবাই কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকায়। অসময়ে দূরের মানুষ গুলোই যেন বেশি আপন হয়ে যায়।

_

রাত প্রায় দেড়টা কিংবা দুটো বাজে। দর্শিনী তার রুমের পিছিনের দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে। তারা ন’টার দিকেই বাড়ি ফিরেছে। বিহঙ্গিনী অবশ্য আসে নি অনেক জোড়াজুড়ি স্বত্বেও। বলেছে কাল দেখা করবে। মৃত্যুঞ্জয় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ফোন দিয়ে ছিলো যার ফলস্বরূপ দর্শিনীদের কাজ সহজ হয়ে গেছে। দর্শিনী তপ্ত শ্বাস ফেলে। হঠাৎ উঠোনে কারো প্রতিচ্ছবি দেখতে পেয়ে সে অবাক হয়। পরক্ষণেই মনে হয় এটাই মোক্ষম সময় তার অজানা প্রশ্নের উত্তর টা জানার।

যেমন ভাবনা তেমন কাজ। দর্শিনী ধীর পায়ে উঠোনে গিয়ে দাঁড়ায়। আকাশে আজও ভরা জোৎস্না। রাত হলেও সব কিছু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। দর্শিনী মানুষটার দিকে তাকিয়ে আহত কণ্ঠে বলে উঠে,
“বিপ্রতীপকে কল দেওয়ার কারণ জানতে পারি?”

#চলবে

[রাতে দিবো বলেও দিতে পারি নি ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। দুঃখীত।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here