#এটা গল্প হলেও পারতো
#পর্ব ২
কালকের ওই ফোনটা আসার পর থেকেই অর্ক কে ফোন করতে শুরু করেছিলো অদিতি। রাত গড়িয়ে সকাল নটা বাজতে চললো একবারের জন্যেও ফোন ধরেনি ও, উল্টে অতোবার মিসড কল দেখা সত্বেও যখন রিং ব্যাক না করেই একটু বেশি রাতের দিকে ফোনটা একদম বন্ধই করে দিলো অর্ক, অদিতি মোটামুটি তখনই বুঝে গিয়েছিলো মেয়েটা একটুও ভুল বলেনি কিছু।
কিছু বুঝতে না দিয়েই যে কয়েক মাসের জন্যে ওকে নিজের বাড়িতে রেখে দিয়ে অর্ক ফিরে গেছে সেটা এই মুহূর্তে খুব ভালো করে টের পাছে দিতি। দেড় বছর ধরে এক ছাদের নিচে বাস করেও ও একটুও চিনতে পারলো না অর্ক কে, এতো টা ভালো অভিনেতা ও! খুব আফসোস হচ্ছে এখন। ও যদি একটুও বুঝতে পারতো তখন, তাহলে অন্তত বাচ্চা নেওয়ার মতো মূর্খামি কিছুতেই করতো না!
কিন্তু মেয়েটা কে ধরবে কিভাবে ও! কি করে সবটা প্রমাণ করবে সবার কাছে! নিজের ছেলে কে ছেড়ে শ্বশুর, শাশুড়ি কি ওর কথা বিশ্বাস করবেন একটুও! ও তো কিছুই জেনে উঠতে পারে নি মেয়েটার সম্পর্কে, কাল ডিরেক্টরি ঘেঁটে দেখেও কিছু পায় নি। নম্বরটা সত্যিই একটা দোকানের, নাম দেখে যদিও বোঝার উপায় নেই কিসের দোকান, তাও ওটা যে দোকান সেটা বোঝাই যায়।
মাঝে মধ্যেই এরকম ফোন ধরে না অর্ক, তার জন্যে বিভিন্ন অজুহাত সব সময়ই রেডি থাকে ওর। কখনো ক্লাস নেওয়ার, তো কখনো না শুনতে পাওয়ার, মোটামুটি এই সব অজুহাতগুলোয় অদিতি অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে এখন। কিন্তু অন্য সময় সেগুলো কে সহজ ভাবেই নিয়েছে ও, বিশ্বাস করেছে অর্কর কথায়। কিন্তু আজ বুঝতে পারছে কতো টা বোকা ও! এই দেড় বছর ধরে শুধুই অর্কর বাইরের ভালোমানুষ চেহারাটাকেই ও বিশ্বাস করেছে, ভেতরের অভিনেতা অর্ক কে বুঝে উঠতে পারেনি একটুও।
তাই আজ এতো সহজেই বোকা হয়ে গেলো দিতি! ও একটুও বুঝতে পারলো না যে অর্ক ওকে এখানে রেখে চলে গিয়েই এইরকম কিছু করতে পারে! এখান থেকে ফিরে গিয়েই বান্ধবী কে দিয়ে ওকে ফোন করিয়ে কথাটা বলে দিয়েই নিজের ফোন বন্ধ করে দিয়েছে ও। কিন্তু এই মুহূর্তে ওর কি করণীয়, সেটা কিছুতেই ঠিক করে উঠতে পারছে না দিতি। যতই সব বুঝতে পারে না কেনো মন, তবু কেনো যেনো কোথাও দাঁড়িয়ে একটু চিন্তাও হচ্ছে অর্কর জন্যে।
একা ফ্ল্যাটে কোনো বিপদ হলো না তো! সত্যিই ও ইচ্ছে করে ধরছে না নাকি কিছু হলো ওর! নিজের ওপর নিজেরই রাগ হচ্ছিলো এবার অদিতির, ও কেনো এতো উতলা হয়ে পড়ে সব সময়! ওর এই নরম হয়ে যাওয়াটা বুঝতে পারে বলেই তো অর্ক ইচ্ছাকৃত ভাবেই এগুলো করে ওর সঙ্গে! প্রতিবারই তো যখন বিভিন্ন রকমের অজুহাতে ফোন ধরে না অর্ক, প্রথমে রাগ হয়ে যায় ঠিকই, তার পরেই এই সব উল্টোপাল্টা চিন্তা মাথায় আসে ওর। আর কিছু হয়নি জানা সত্বেও অর্ক কে নিয়ে চিন্তা করে বসে ও। সেই দুর্বলতার সুযোগ নিয়েই তো প্রতিবার ওকে সরি বলে ম্যানেজ করে ফেলে অর্ক।
কিন্তু সেগুলো সাধারণ মান অভিমান ছিলো, কিন্তু এটা অনেক বড়ো বিষয়। ওর বিবাহিত জীবন খাদের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে এখন, মেয়েটার কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে কি করবে ও! বাচ্চা টারই বা কি হবে! অর্ক র বাবা , মা, ওর বাবা সবার কাছেই তো মুখ দেখাতে পারবে না ও। অর্কর মতো ছেলে যে কোনোদিনও এমন করতে পরে ও তো স্বপ্নেও ভাবে নি কখনো! ভেতরে ভেতরে টেনশন, ভয় সব এক হয়ে গিয়ে কেমন যেনো হতাশ লাগে দিতির, এতো সহজে ওর জীবন থেকে সব কিছু হারিয়ে যাবে! ও কিছুই করতে পারবে না!
একই শহরে বাড়ি হলেও কোনোদিনই বিয়ের আগে অর্ক কে দেখেনি ও। অর্ক আর ওর পিসতুতো দাদা ছোটবেলার বন্ধু ছিলো, সম্বন্ধ টা পিসিই এনেছিলো। মা মারা যাবার পর থেকেই বাবার পরে পিসিই দিতির সব কিছু। কিছুদিন আগেই পিসেমশাই চলে গেছেন, এখন ছেলে অফিসের কাজে বাইরে গেলেই পিসি ওদের বাড়ি চলে আসেন।
প্রথম যেদিন ওদের বাড়িতে এলো অর্ক, কথা বলে বেশ ভালই লেগেছিলো ওর। ভদ্র, সভ্য হ্যান্ডসাম অর্কর প্রেমে সেদিনই পড়ে গিয়েছিলো দিতি। তাই অর্ক যখন ওর কাছে ফোন নম্বর চেয়েছিলো, ওকে নম্বর টা দিতে একবারের বেশি ভাবে নি ও। দেখতে আসার পর থেকে বিয়ের দিন পর্যন্ত কিন্তু দিনে দুবার করে অদিতি কে ফোন করতে বা অদিতির ফোন ধরতে কোনোদিনই ভোলেনি ও।
বিয়ের পরেই আস্তে আস্তে ফোন ধরতে আর করতে দুটোই ভুলতে লাগলো ও, এই নিয়ে মাঝে মাঝেই রাগ করতো দিতি, কিন্তু অর্কর যুক্তিও অকাট্য ছিলো, যখন ওরা একসঙ্গেই থাকে তাই আগের মতো ফোনের আর দরকার কি! যুক্তি টা যে খুব বেশি ভুল নয়, সেটা মুখে না হলেও মনে মনে তো স্বীকার করেই অদিতি, তাই এই ঝগড়া গুলোর স্থায়ীত্ব খুব বেশিক্ষন হতো না। কিন্তু এবার তো তা নয়, এবার অর্ক ওকে রেখে একাই ফিরে গিয়েছে তাই ফোন তো ওর অবশ্যই ধরা উচিত ছিলো। এখন ওর কি শাশুড়ি কে ডেকে বলা উচিত, কাল থেকে ওকে ফোন করেনি অর্ক! নাকি এটা শুনলে উনি আরও টেনশন করবেন, মনস্থির করতে পারছিলো না দিতি।
হটাৎ করেই ওর চিন্তার মধ্যেই ফোন টা বেজে উঠলো, স্ক্রিনে ভেসে ওঠা অর্কর নাম টা দেখেই আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলো না দিতি। কালকের থেকে জমা হওয়া রাগ, দুশ্চিন্তা, কষ্ট, মেয়েটার বলা কথা গুলো সব মিলে মিশে একাকার হয়ে প্রবল চিৎকারে পরিণত হলো,
আমি আর কোনোদিনও তোমার মুখ দেখতে চাইনা, আমার কোনো উপায় নেই তাই তোমার সঙ্গে থাকবো, কিন্তু কোনোদিনও আর তুমি আমার সামনে আসবে না, আর জেনে রেখো কিছুতেই ডিভোর্স আমি দেবো না তোমাকে।
আরে! আমার ফোন টা কাল থেকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না…..
কথা গুলো অর্ক কে শেষ করতে না দিয়েই ফোনটা কেটে দিয়ে বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে দিলো দিতি, হাউ হাউ করে মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগলো, আজই যদি সম্ভব হতো ও অর্ক কে ডিভোর্স দিয়ে চলে যেতো! কিন্তু অসুস্থ বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে ওকে শক্ত থাকতে হবে, বাবা যদি একটুও বুঝতে পারে ওর মনের অবস্থা, তাহলে আরও বেশি করে খারাপের দিকে যাবে শরীর। এখন কোনো মতেই ও বাবা কে আরো অসুস্থ করে দিতে পারবে না ওর ভালো থাকার জন্যে!
ছোটো থেকেই মা হারা অদিতির বড়ো হয়ে ওঠা বাবা কে ঘিরে, গত বছর ওর বিয়ের পর থেকেই বাবার শরীর টা খারাপ যাচ্ছিলো, ঠিক করে কিছুই বোঝা যাচ্ছিলো না। এখন তো সব সময়ই খারাপ থাকে, ছোটো খাটো একটা অ্যাটাক হয়ে যাবার পর থেকেই। ওর প্রেগন্যান্সির খবরে এখন বাবার মন বেশ ভালো, অর্কর বাবা মাও খুব খুশি, এই সময় কোনো হঠকারি সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে চারবার ভাবা দরকার।
এই মুহূর্তে ওর একটুও আর শ্বশুর বাড়িতে থাকতে ইচ্ছে করছে না, বাবার কাছে ছুটে চলে যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু বাবার কাছে যাওয়া মানে, বাবাকেই বিপদে ফেলে দেওয়া, কিন্তু ওই বা কি করে শাশুড়ির সামনে স্বাভাবিক থাকবে সব সময়!
ফোন টা রেখে দিয়ে অবাক হয়ে বসে রইলো অর্ক, অদিতির রাগের কোনো কারণ ও খুঁজে পাচ্ছে না। হ্যাঁ, ওর একটা ভুল হয়েছে, ও কাল রাত থেকে ফোন টা খুঁজে পাচ্ছিলো না, অথচ ওর স্পষ্ট মনে ছিলো ও ওটা সোফার ওপরেই রেখেছিলো। তারপর আর মনে ছিলো না, রাতে অদিতি কে ফোন করতে গিয়ে আর ফোন টা খুঁজে পায় নি ও। ও জানতো অদিতি চিন্তা করবে, ও অপেক্ষা করে থাকবে ফোনের জন্যে, কিন্তু কোথাও খুঁজে পেলো না সেটা।
বাধ্য হয়েই শুয়ে পড়লো শেষে, কান খাড়া করে রেখেছিলো যদি বাজে ফোন টা কোথাও, কিন্তু সেটাও বাজেনি। তার মানে অদিতিও ওকে ফোন করেনি একবারও, তাহলেও তো ফোনটা খুঁজে পেতো ও, কাল থেকেই মনে হচ্ছিলো বারবার। অবশেষে সকালে উঠে চা করতে গিয়ে রান্নাঘরে খুঁজে পেয়েছিলো ওটা, সাইলেন্ট মোডে করা ছিলো। বোধহয় কলেজে ক্লাস করার সময় করেছিলো আর ঠিক করা হয়নি। ফোন টা খুলতে গিয়ে দেখলো চার্জ শেষ হয়ে ওটা বন্ধ হয়ে গিয়েছে কখন কে জানে। চার্জ দিয়ে ফোন টা কে অন্ করার পর অদিতির অনেকগুলো মিসড কল দেখেই সঙ্গে সঙ্গেই ওকে ফোন করলো অর্ক।
কিন্তু ওকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই চিৎকার করতে লাগলো দিতি। ও তো জানে ওর ভুল হয়েছে, কিন্তু সেটা যে ইচ্ছাকৃত নয় এটা কোনোদিন বোঝেনা দিতি। ওর সব সময় ধারণা ইচ্ছে করেই ফোন ধরেনা অর্ক। কিন্তু সত্যি যে কাল থেকে ও ফোন টা খুঁজে পায়নি সেটা দিতি কে বোঝাবে কে! সব সময় রাগ দেখায় ওর ওপর। ওরও রাগ হচ্ছে এবার, কোনো কথাই বলতে দিলো না, জানতে চাইতেও তো পারতো কি হয়েছিলো, তা না করেই আগেই চিৎকার করতে লাগলো।
সামান্য ফোন করেনি বলে আর মুখ দেখতে চায় না, পাগল নাকি অদিতি, সন্দেহ হচ্ছে ওর এখন! কোনো সুস্থ লোক শুধু এই কারণে ডিভোর্সের কথা বলে, বিরক্ত হচ্ছিলো অর্ক। এতো জোরে চিৎকার করছিলো ও, যে মাও শুনতে পেতে পারে, এতো বোধের অভাব, যথেষ্ট বড়, বাচ্চা তো নয়, এবার নিজেরও রাগ হয়ে যাচ্ছে, রেগে গিয়ে ফোন টাই বন্ধ করে দিলো অর্ক।
ক্রমশ