#এটা গল্প হলেও পারতো
#পর্ব ৬
সামনের মাসে শান্তিনিকেতনের প্ল্যানটা ফাইনাল করনা প্লিজ!!
কলেজের ক্যান্টিনে বসে আড্ডা দিতে দিতে বললো শ্রেয়া, সবাই তৎক্ষণাৎ অনির্বাণের দিকে তাকালো। অনির্বাণ আজ সকাল থেকেই একটু চুপ চাপ, বন্ধুদের তাকানো দেখেই দ্রুত মাথা নাড়লো,
আমাকে জড়াস না প্লিজ!! আমি বাবার কাছে গাড়ি চাইতে পারবো না!!
তিয়াসা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো, অনির্বাণটা যা, এক্ষুনি যে হ্যাঁ বলে দেয় নি তাই রক্ষ্যে। বার দুয়েক ওর গাড়িতে গেছে ওরা, গাড়িতে যাওয়া মানেই তো ওদের ড্রাইভারটা হা করে লুকিং গ্লাসের ভেতর দিয়ে তাকিয়ে থাকবে ওদের দিকে, মাঝে মাঝে এমন বিরক্তি লাগে না!! ক্ষমতা থাকলে ও চোখটাই গেলে দিতো, বেশ কয়েকবার অনির্বাণ কে বলেছেও সে কথা। অনির্বাণ ভয় পায়,
বাবার কাছে কেস খাওয়াবি নাকি!! ওই বুড়োটা বাবার রিপোর্টার জানিস না?
অনির্বাণের সরাসরি না বলে দেওয়াতে প্ল্যানটা একটু ধাক্কা খেলো, তিয়াসা তৎক্ষণাৎ রিয়ার দিকে তাকালো,
একবার তোর গাড়ি নিয়ে চল না!! প্রতিবারই তো অনির্বাণের গাড়ি নিয়েই যাওয়া হয়!!
রিয়া মাথা নাড়লো, শুকনো মুখে বললো,
বাবা কে না জানিয়ে কি করে নিয়ে যাবো বল তো? গাড়ি নিয়ে গেলেই তো বাবা সব জানতে পেরে যাবে!! তখন মাঝখান থেকে মাও বকুনি খাবে, চল না ট্রেনেই যাই।
তিয়াসা বিরক্ত মুখে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকলো, সব সময় অনির্বাণের গাড়ি নিয়েই যাওয়া হয়। রিয়ার মুখে শুধু বড়ো বড়ো কথা!! খরচা করার সময় সবচেয়ে আগে ওই পিছিয়ে যায়!! শ্রেয়া এতক্ষন চুপ করেছিলো, প্ল্যান প্রায় ভেস্তে যাচ্ছে দেখে এবার মুখ খুললো,
চল, ট্রেনেই যাই না হয়!! তবু চল তো! আর কয়েক মাস পরেই তো পরীক্ষা, তারপর কে কোথায় যাবো কে জানে!!
কথা শেষ হবার আগেই কৌশিক ঢুকলো, সবার দৃষ্টি কৌশিকের দিকে ঘুরল, রিয়া ওর দিকে তাকিয়ে বললো,
তুই যাবি তো?
কৌশিক একটু থতমত খেলো, কি প্রসঙ্গে কথা হচ্ছে বুঝতে না পারলেও সম্মতিসূচক মাথা নাড়লো। কৌশিক কে মাথা নাড়তে দেখে তিয়াসা একটু শ্লেষের গলায় বললো,
বাবা! কিছু না জেনেই হ্যাঁ বলে দিলি, হেব্বি প্রেম ভাই!!
কৌশিকের মুখে বিরক্তির ভাব ফুটে উঠলো, নিজেকে সামলে নিয়ে সংযত গলায় বললো,
তুই এতো সব ব্যাপারেই কিছু মানে খুঁজে নিস কেনো বলতো? এটা তুই যদি বলতিস না, তাহলেও আমার উত্তর হ্যাঁ ই হতো!! অতো ভেবে চিন্তে কথা বলিনা তোর মতো!!
তিয়াসা প্রায় জ্বলে উঠলো,
আমি কি এমন ভেবে কথা বলি রে?
বলিস না ? আচ্ছা, আমারই ভুল হয়েছে তবে!! শুনতে তো পাই অনেককিছুই, কে কার সঙ্গে যাবে, কে কার গাড়িতে যাবে, কে কোথায় নামবে, সব কিছুই নাকি তুই আজকাল দায়িত্ব নিয়ে ঠিক করছিস!!
অনির্বাণ দীপের দিকে তাকালো, সেদিনের মেট্রোর ওদের কথোপকথন তাহলে জায়গামতোই পৌঁছে গেছে! শ্রেয়া মনে মনে একটু ভয় পাচ্ছিলো, দীপটা আবার ওর নাম নিয়ে কিছু বলে নি তো! তিয়াসার যা মুখ!! আর এগোতে না দিয়ে তাড়াতাড়ি উঠে পড়লো শ্রেয়া,
আমার একটু লাইব্রেরী যাওয়ার আছে, দীপ চল না প্লিজ!
দীপ এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলো, কৌশিক যে এরকম হাটে হাঁড়ি ভেঙে ফেলবে, এটা ও একদম ভাবতে পারে নি, তাড়াতাড়ি শ্রেয়ার পিছু ধরলো,
হ্যাঁ, চল।
পরিস্থিতি একটু জটিল হয়ে গিয়েছিলো, দীপ আর শ্রেয়া বেরিয়ে যাওয়ার পরেই কৌশিক, রিয়া কে ডেকে নিয়ে ওদের পিছু ধরলো, ওরা বেরিয়ে যাওয়ার পরে অনির্বাণ একটু রাগের গলায় বললো,
ঠিক করেছিস!
তুই তো বেশি আদিখ্যেতা দেখাস! কতোবার বলেছি তোকে, ওদের গাড়িতে চড়ানোর, বাড়িতে ডাকার কোনো দরকার নেই। তবু তুই ডাকবি!!
আর কোনো দিনও ডাকবো না!! যা করেছে না!! বাবা হেব্বি খোচে আছে ভাই!! সেদিন গিয়ে ওদের মধ্যে কেও একটা নিচে আমাদের দোকান থেকে নাকি কোনো এক ভদ্রমহিলার সঙ্গে ফোন করে ইয়ার্কি মেরেছে, যা তা কান্ড!
তুই কি করে জানলি? কে দেখেছে ফোন করতে?
একটু অবাক গলায় প্রশ্ন করলো তিয়াসা, অনির্বাণ মাথা নাড়লো,
আরে, কেও দেখেনি! ওটাই তো আসল সমস্যা! বাবা নাকি কিছুক্ষনের জন্যে দোকান থেকে ওপরে এসেছিলো, সেই সময় যে দুটো ছেলে থাকে দোকানে, ওরাও ছিলো না। বাবা যদিও ভদ্রমহিলা কে উল্টে থ্রেটনিং দিয়েছে, কিন্তু উনি নাকি বলেছেন যে উনি ইনকামিং নম্বর দেখেই রিং ব্যাক করেছেন। এবার বাই চান্স যদি পুলিশের কাছে সত্যি চলে যায়, তাহলে আমাদের দোকানের রেপুটেশন পুরো নষ্ট হয়ে যাবে।
কিন্তু ওরাই যে এটা তুই কি করে সিওর হচ্ছিস? দেখে তো নি কেউ!
অনির্বাণ ঘাড় নাড়লো,
সেখানেই তো প্রবলেম, তাই তো ডাইরেক্ট কিছু বলতে পারছি না। বাবা তো আর জানতো না যে তোরাও নিচে নেমেছিলি, বাবা তাই বোন কে সাসপেক্ট করছিলো, ও ছাড়া আর তো বাড়িতে অল্পবয়সী মেয়ে কেউ নেই। আমি তো তারপর তোদের সঙ্গেই স্যারের বাড়িতে চলে গিয়েছি, জানিই না কখন এসব হয়েছে! এসেও শুনি নি আর কিছু। কাল সকালে দেখি মা বোন কে খুব বকাবকি করছে, তখন বোনই বললো, যে বাবা যে সময়ের কথা বলেছে তখন নাকি তোরাও বাড়িতে ছিলি!! ও নাকি তোদের সবাইকেই বার দুয়েক নিচের দিকে যেতে দেখেছে,
তুই আমাকেও সন্দেহ করছিস নাকি? ইস! আমার খুব খারাপ লাগছে!! বিশ্বাস কর, আমি কিন্তু এরকম কিছু করিনি, নিচে নেমেছিলাম ঠিকই, কিন্তু সেটা জাস্ট এমনই।
অনির্বাণ তাড়াতাড়ি তিয়াসার হাতটা ধরে ফেললো,
আরে ধুর! তোকে সন্দেহ করলে আর তোকে বলতাম নাকি! তুইও পারিস! আমার তো শ্রেয়া কে সন্দেহ হয়, ওই এরকম উল্টোপাল্টা ইয়ার্কি মারে সব সময়!! ফার্স্ট ইয়ারে একবার কৌশিকের ফোন থেকে কোন একটা রান্ডম নম্বরে ফোন করে একটা মেয়ের গলা শুনে কৌশিক কে ফাঁসিয়ে ছিলো, মনে আছে?
তিয়াসা মাথা নাড়লো, একটু অন্য মনস্ক গলায় বললো, রিয়াও হতে পারে। ও ও কিন্তু প্রচুর মিথ্যে কথা বলে, আমি লক্ষ্য করেছি। দীপ সেদিন ঠিকই বলেছিলো, ও যদি সত্যিই বড়লোক হতো, তাহলে মেট্রোয় যেতো না!
ছাড়! এখন চুপ করে থাকা ছাড়া অন্য কোনো অপশন নেই! প্রমাণ ছাড়া কাউকে ব্লেম করা যায় না! সমস্যা একটাই, যদি ভদ্রমহিলা সত্যিই পুলিশে চলে যান, তাহলে কি হবে কে জানে! বাবার সম্মান নিয়ে টানাটানি হবে তখন, যেই করুক না কেনো, আফটার অল ফোনটা আমাদের দোকানের নম্বর থেকেই তো গিয়েছে!
পুলিশে যেতে পারে মহিলা? এতোটা বাড়াবাড়ি করবে! সামান্য একটু ইয়ার্কি মারার জন্যে!
শুকনো গলায় বললো তিয়াসা, অনির্বাণ মাথা নাড়লো,
যায় না কেউ সাধারণত, তবে ভদ্রমহিলা যেতে চাইছিলেন! জানি না কেনো! বলেছেন ওনাকে নাকি কিছু ব্যক্তিগত কথা বলেছে কেউ!
রান্ডম নম্বরে কল করলে কেউ ওনাকে কিভাবে চিনবে যে, ব্যক্তিগত কথা বলবে?
বিস্মিত গলায় বললো তিয়াসা,
সেটাই তো অবাক লাগছে! তারমানে কেউ চেনা নম্বরেই কল করে ইয়ার্কি মেরেছে! কি বলেছে সেটা জানতে পারলে ব্যাপারটা অনেকটা ক্লিয়ার হতো, কিন্তু সেটা উনি বলতে চান নি।
তাহলে এই মুহূর্তে তো অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই! তুই এই অবস্থায় কাকুর কাছে গাড়ি চাইতে যাস না কিন্তু কিছুতেই, সে ওরা তোকে যতোই বার খাওয়াক!
অনির্বাণ মাথা নাড়লো,
পাগল! কেউ চায় নাকি আর! আমাকেই বাড়ি ছাড়া হতে হবে তাহলে!
কি হলো? ক্লাস শেষ না তোর? বাড়ি যাবি না? নাকি বউ নেই বলে আর বাড়িতে ঢুকতে চাইছিস না,
টিচার্স রুমের চেয়ার টেনে অর্কর পাশে বসতে বসতে হেসে বললো অরিন্দম, অর্ক মাথা নাড়লো,
অদিতি চলে এসেছে রে!
অরিন্দম একটু চমকে উঠলো,
চলে এসেছে! কেনো? এই তো দুদিন আগেই তুই দিয়ে এলি। বললি যে মাস খানেক থাকবে এখন! শরীর খারাপ নাকি?
ফাঁকা টিচার্স রুমের চারপাশটা দেখে নিয়ে অর্ক মাথা নামালো, নিচু গলায় বললো,
বাড়িতে ফিরতে ইচ্ছে করছে না! অদিতি পুরো পাগল হয়ে গেছে, কি সব উল্টোপাল্টা বলেছে মা কে! আমি নাকি অন্য কাউকে বিয়ে করতে চাই! ওকে নাকি কেউ ফোন করে বলেছে! লাইফটা একদম হেল হয়ে গেছে!
অরিন্দম অবাক হয়ে তাকালো,
মাসীমা বিশ্বাস করলেন এসব কথা?
কে জানে! প্রথমে তো করেছিলো, এখন বোধহয় একটু একটু বুঝতে পারছে, তাই নিজেই এসে দিয়ে গিয়েছে কাল!
অদিতি তো এরকম ছিলো না! হটাৎ এরকম করলো কেনো? কেউ ওকে সত্যিই ফোন করে কিছু বলে নি তো?
একটু চিন্তিত গলায় বললো অরিন্দম, অর্ক প্রায় জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকালো,
তুইও! কে এসব বলবে বলতো? কার খেয়ে দেয়ে কাজ নেই? ঘটনাটা অন্য! আমি ওকে একরাত ফোন করিনি তাই! দেখিস নি আগে এটা! ফোন না ধরলেই কি রকম চিৎকার চেঁচামেচি করতো!
সে ওর টেনশন হতো তাই! তাই বলে এরকম কথা বলবে? আর তুই বা করিস নি কেনো ফোন? এতো ইরেস্পন্সিবল না তুই! অহেতুক ঝামেলা তৈরি করিস!
আরে! ইচ্ছা করে করিনি নাকি! ফোনটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না ভাই! তারমধ্যে কখন আবার সাইলেন্ট করে দিয়েছিলাম কে জানে!
অর্কর উত্তরে বিরক্ত হলো অরিন্দম,
তো সেটা কে কি বলে? ইরেস্পনসিবলই তো? নিজের বাড়িতে ফোন হারিয়ে ফেললি? আর এই সাইলেন্ট মোডে রাখা নিয়ে তো তোদের আগেও ঝামেলা হয়েছে, তাও রাখিস কেনো? ক্লাস শেষ হলে ঠিক করে নিতে পারিস না!
অর্ক চুপ করে থাকলো, খানিকক্ষন পরে মনমরা গলায় বললো,
বিশ্বাস কর, শুধু বাচ্চাটার জন্যে! না হলে আমার সত্যি আর অদিতির সঙ্গে থাকতে ইচ্ছে করছে না!! ভুল করেছি এটা মেনে নিয়েও বলছি, একটা ফোন না ধরার শাস্তি কখনই এতো বড়ো অপবাদ হতে পারে না! বাবা, মা সবার সামনে এমন সিন ক্রিয়েট করলো না! একদম ছোটো লাগছে নিজেকে!
শোন! ভুল তো দুজনেই করেছিস! আর এটা নিয়ে টানিস না! বাচ্চাটার কথা ভেবেও তো তোদের গন্ডগোল মিটিয়ে নেওয়া উচিত! আমার একজন খুব ক্লোজ বন্ধু আছে, খুব ভালো কাউন্সিলিং করে! একবার কথা বলে দেখতে পারিস, ফোন করি?
কাউন্সিলর! কাউন্সিলর কি করবে? অদিতি এসব ইচ্ছা করে করছে!
বিরক্ত গলায় বললো অর্ক, অরিন্দম ওর দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে একটু চিন্তিত হয়ে বললো,
কিন্তু কেনো করছে সেটাও তো জানা দরকার, তাই না? এতদিন তো এরকম কিছু করে নি! একবার কথা বলে দেখতে ক্ষতি কি!
অর্ক কে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়েই নম্বরটা ডায়াল করে ফেললো অরিন্দম। উল্টোদিকের কথা শুনতে না পেলেও অরিন্দমের বিস্তারিত বিবরণ শুনলো অর্ক, প্রায় মিনিট পনেরো কথার পরে ফোনটা নামিয়ে রেখে অর্কর দিকে তাকালো অরিন্দম,
শোন! সাথী মানে আমার বন্ধু বললো, দুটো ব্যাপার হতে পারে! হয় সত্যিই কেও ওকে ফোন করেছিলো, অথবা ওর মানসিক সমস্যা হচ্ছে, প্রেগন্যান্সি তে নাকি কারো কারো হয় এগুলো। আমি কথা বলে নিয়েছি, দু একদিনের মধ্যেই অদিতি কে নিয়ে চলে যা! যদি সত্যি মানসিক সমস্যা হয়ে থাকে প্রেগন্যান্সির জন্যে, তাহলে কিন্তু অবশ্যই কাউন্সিলরের সঙ্গে কথা বলা উচিত। না হলে পরে আরো বাড়তে পারে!
প্রেগন্যান্সির জন্যে মানসিক সমস্যা হতে পারে! অর্কর হটাৎ করেই খুব খারাপ লাগলো অদিতির জন্যে, ও কিছু না ভেবেই সত্যি খুব খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছে! তাড়াতাড়ি চেয়ারটা ঠেলে সরিয়ে উঠে দাঁড়ালো অর্ক, ওকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে!
অরিন্দমও উঠে দাঁড়ালো, ওর ক্লাসও শেষ হয়ে গিয়েছিলো, দুজনে একসঙ্গে মেট্রোর দিকে এগোলো। মেট্রো থেকে নামার আগে অর্কর দিকে তাকিয়ে বলে গেলো অরিন্দম,
কি হলো জানাস কিন্তু, একটু বুঝিয়ে বলিস অদিতি কে। ও রাজি হলে কালই চলে যাস সাথীর কাছে।
অর্ক মাথা হেলাল,
হ্যাঁ, জানাচ্ছি তোকে!
ক্রমশ
(কেমন লাগছে গল্পটা? খুব পরিচিত একজনের গল্পই আমার ভাষায় লিখতে চেষ্টা করেছি আমি। সে যেভাবে জেনেছে সবটা, গল্প সেভাবেই এগোবে, সঙ্গে থাকবেন সবাই 🙏)