#এটা গল্প হলেও পারতো
#পর্ব ৯
স্টেশনে খুব ভিড়, প্রচুর মানুষ এখানে বেড়াতে এসেছিলো বোঝাই যাচ্ছে, দিতি ভিড় বাঁচিয়ে সাবধানে একটা ধার ঘেঁসে দাঁড়ালো। ওদের নিজেদেরও প্রচুর লোকজন, গত কালের বৌভাত শেষে একসঙ্গে সবাই ফিরছে নিজেদের বাড়িতে, সব মিলিয়ে বেশ একটা হট্টগোলের সৃষ্টি হয়েছে। ট্রেনটা লেট করছে কিন্তু বসার কোনো জায়গা নেই স্টেশনে, দিতি চারদিকে তাকিয়ে বসার জন্যে একটু জায়গা খুঁজছিলো, কয়েকদিনের ধকলে শরীরটা একটু খারাপ লাগছে।
ওর ঠিক পাশেই একটা বেঞ্চ যেখানে একটা কলেজ পড়ুয়াদের গ্রুপ বসে এবং ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বসে থাকা মেয়ে তিনটের দিকে তাকিয়ে ওদের একটু বসতে দেবার অনুরোধ করা যায় কিনা ভাবতে ভাবতেই অর্ক এসে দাঁড়ালো। ও এতক্ষন বাপ্পার সঙ্গে হাত মিলিয়ে সবার জিনিসপত্র একজায়গায় গুছিয়ে রাখছিলো। অর্ক কে দেখেই গ্রুপের সবাই ওর দিকে ফিরে তাকালো, একটা ছেলে বললো,
স্যার কতো নম্বর কোচ?
অর্ক উত্তর দিলো সাত,
অদিতি কথোপকথন শুনেই ওদের অর্কর স্টুডেন্ট বলে বুঝতে পারলো। নিজের মনেই ও একটু অবাক হলো, হটাৎ দেখা হওয়ার মধ্যে যে ব্যাপারটা থাকে, সেই ব্যাপারটা ওদের কথার মধ্যে নেই। এটা যেনো জানাই ছিলো যে ওদের এখানে দেখা হবে! অর্ক কে ওর পাশে দাঁড়াতে দেখেই সম্ভবত অদিতির পরিচয় ওদের কাছে স্পষ্ট হলো, বসে থাকা মেয়েগুলোর মধ্যে একজন উঠে দাঁড়ালো,
ম্যাম, বসুন না!
অদিতি আর বেশি কিছু না ভেবে বসেই পড়লো, এতক্ষন দাঁড়িয়ে থাকা ওর পক্ষে সম্ভব ছিলো না। অর্ক ততোক্ষনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেগুলোর সঙ্গে গল্প করতে শুরু করেছিলো, অদিতি কে জায়গা ছেড়ে দেওয়া মেয়েটিও তাদের পাশেই দাঁড়িয়েছিলো। বেঞ্চটা বেশ ছোটো, তারমধ্যে প্রত্যেকের কাছেই যথেষ্ট জিনিসপত্র রয়েছে, অদিতি নিজের হাত ব্যাগ টা কোলে নিয়েই বসলো। পাশে বসে থাকা মেয়েটি সম্ভবত অদিতি কে ঠিক ভাবে বসতে দেওয়ার জন্যে নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে পাশে দাঁড়িয়ে মোবাইলে মনোনিবেশ করলো। দিতি খুব অস্বস্তিতে পড়লো, ও আসায় যে ওদের কে জায়গা ছেড়ে দিতে হচ্ছে এটা বুঝেই ও মেয়েটার দিকে তাকালো,
আরে! তুমি উঠলে কেনো! আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না!
মেয়েটি মিষ্টি হাসলো,
ঠিক আছে ম্যাম! আপনি বসুন না! আমরা অনেকক্ষণ ধরেই বসে আছি, একটু দাঁড়াতে ভালোই লাগবে!
এরপরে আর কিছু বলার ছিলো না, থ্যাংক ইউ বলে, অদিতি নিজেও নিজের মোবাইলের দিকে তাকালো। গ্যালারি খুলে বিয়ের ফটো গুলো দেখছিলো, হটাৎ করেই পাশ থেকে একটা গলা খুব আস্তে করে বললো,
এই সেটটা ভালো হয়েছে না ম্যাম? আমি চয়েস করে দিয়েছিলাম।
চমকে উঠে পাশের মেয়েটার দিকে তাকালো অদিতি, মেয়েটা তখন ওর গ্যালারির দিকে ইশারা করছে। মেয়েটার ইশারা লক্ষ্য করে ফটোর দিকে তাকিয়েই অবাক হয়ে গেলো দিতি, এটা তো সেই গয়নাগুলোর একটা যেটা অর্ক হাট থেকে কিনে এনেছিলো! এতো ভালো লেগেছিলো, তখনই পরে ফটো তুলেছিলো ও! কিন্তু এই মেয়েটা সেটা পছন্দ করলো কিভাবে! অর্ক কি তাহলে ওকে মিথ্যে কথা বললো!
আর কিছু ভাবার আগেই ট্রেন চলে এলো, কয়েক মিনিটের তাড়াহুড়োর মধ্যেই ও শুধু মেয়েটাকে নাম জিজ্ঞেস করতে পারলো, মেয়েটা তড়িঘড়ি জিনিসপত্র কাঁধে তুলতে তুলতে জবাব দিলো, রিয়া।
নিজেদের সিটে গুছিয়ে বসতে না বসতেই ট্রেন ছেড়ে দিলো, বাপ্পা কে হাত নেড়ে বিদায় দিয়ে অর্ক নিজের সিটে এসে বসতে গিয়ে লক্ষ্য করলো অদিতি গম্ভীর মুখে জানলার বাইরে তাকিয়ে আছে।
কি হলো তোমার?
একটু ভীত গলায় প্রশ্ন করলো অর্ক, দিতি র এই থমথমে মুখ কেই ও খুব ভয় পায়। অদিতি ঘাড় ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকালো, তারপর খুব ঠাণ্ডা গলায় জিজ্ঞেস করলো,
আমার গয়নাগুলো তুমি নিজে পছন্দ করে কিনেছো?
আমি নিজে পছন্দ করেছি বলে তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না! হটাৎ এ প্রশ্ন নতুন করে কেনো?
অবাক গলায় বললো অর্ক,
কারণ স্টেশনে বসে থাকা তোমার ছাত্রীদের মধ্যে একজন আমাকে বললো, সে এগুলো চয়েস করে দিয়েছে! ও কি করে পছন্দ করলো? কোথায় দেখা হলো তোমার সঙ্গে?
এবার অর্কর বিরক্ত লাগলো, একটা সাধারণ বিষয় কে নিয়ে অদিতি এতো প্রশ্ন করছে!
হাটে দেখা হয়েছিলো ওদের সঙ্গে, ওরা এখানে বেড়াতে এসেছিলো বন্ধুরা মিলে। আমি যে দোকান থেকে এগুলো কিনছিলাম, সেখানে ওরাও ছিলো। আমাকে এগুলো কিনতে দেখে তিয়াসা দু একবার মতামত দিয়েছিলো এইটুকুই, এর বেশি কিছু নয়। তার মানে এই নয় যে তিয়াসা এগুলো আমাকে পছন্দ করে দিয়েছিলো!
গলায় একরাশ বিরক্তি নিয়ে বললো অর্ক, অদিতি লজ্জা পেলো একটু। ও বড্ড বেশি ভেবে ফেলে! তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে লজ্জিত গলায় বললো,
সরি! আমি সেইভাবে কিছু বলতে চাই নি! আসলে তুমি বলেছিলে তুমি নিজে পছন্দ করেছো, আর রিয়া আমাকে বললো যে ও নাকি পছন্দ করে দিয়েছে! তাই জানতে চাইছিলাম!
অদিতি কে কথা শেষ না করতে দিয়েই থামিয়ে দিলো অর্ক,
তুমি ভুল করছো, ওর নাম তিয়াসা, রিয়া নয়!
অদিতি একটু অন্য মনস্ক হলো, এতো ভুল শুনলো ও! যদ্দূর মনে পড়ছে মেয়েটা নিজের নাম তো রিয়াই বলেছিলো! একটু চুপ করে থেকে বললো,
তোমার সঙ্গে যে ওদের দেখা হয়েছিলো, তুমি বলো নি তো আগে সেটা!
এটা আবার এমন কি গুরুত্বপূর্ন বিষয় যে মনে রেখে তোমায় বলতে হবে! আর তুমি তো ওদের কাউকেই চেনো না, তাই বলা না বলায় কি বা এসে যায়!
তুমি জানতে ওরা এখানে আসবে?
অর্কর গলার স্বরে বিরক্তি লক্ষ্য করেও অদিতি আবার প্রশ্ন করলো, এবার অর্ক ধৈর্য্য হারালো, একটু রুক্ষ গলায় বললো,
না, জানতাম না! ওরা আমার স্টুডেন্ট, ওদের পড়াশুনার বাইরের খবর আমি রাখি না! কাল হটাৎ করেই হাটে দেখা হয়েছিলো, তখন ওরা বলেছিলো আজ ওরাও ফিরবে! ব্যাস এইটুকুই! আর কিছু জানার আছে তোমার?
অর্কর কড়া গলা এবার অদিতি কে থামিয়ে দিলো, অদিতির এবার লজ্জা লাগছিলো, অহেতুক সাধারণ ব্যাপার নিয়ে মনোমালিন্য তৈরি হোক সেটা আর চাইছিলো না। অর্ক মনে মনে বিরক্ত হচ্ছিলো, দিতি এতো সব ব্যাপারেই পুলিশি জেরা করতে শুরু করে যে, মাঝে মাঝে ওর অসহ্য লাগে। সামান্য একটা গয়নার কথা থেকে কতো কথায় চলে গেলো। তিল কে তাল করতে ওর জুড়ি মেলা ভার। তাও যে অল্পের ওপর দিয়ে গেলো সেও ভালো, নাহলে এতো সুন্দর বেড়ানোটা একদম নষ্ট হয়ে যেতো। অর্ক কে গম্ভীর মুখে বসে থাকতে দেখে কিছুক্ষন পরে অদিতি নিজেকে সামলে নিয়ে আস্তে করে ওর হাতের ওপর চাপ দিয়ে একটু মজার গলায় বললো,
রেগে গেলে নাকি! আমার ওপর না তিয়াসার ওপর?
তিয়াসার্ ওপর! কেনো?
অর্ক গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলো, অদিতি মুচকি হাসলো,
ওই যে! অর্ক মিত্রর ক্রেডিট টা নিয়ে নিলো যে!
এবার অর্ক হেসে ফেললো,
ফেল করিয়ে দেবো ওকে দেখো!
অনির্বাণ সবে আরাম করে হেলান দিয়ে সিটে বসেছিলো, উল্টোদিকের সিটে বসে থাকা তিয়াসার মুখের দিকে তাকিয়েই অবাক হয়ে গেলো! তিয়াসা ওকে মোবাইলের দিকে দেখতে ইশারা করছে! মোবাইল টা খুলতেই হোয়াটসঅ্যাপে তিয়াসার মেসেজ দেখলো,
একটু বাইরে চল, কথা আছে,
কাঁচের দরজা ঠেলে বেরিয়ে এসে বাথরুমের পাশে হাতে একটা সিগারেট নিয়ে দাঁড়ালো অনির্বাণ, কয়েক মিনিট পরে তিয়াসা কে উঠে দাঁড়াতে দেখে বন্ধুদের মধ্যে একটু মুচকি হাসি ছড়িয়ে পড়লো। তিয়াসা সেটা কে ইগনোর করে বাইরে বেরিয়ে এলো, ওকে দেখেই অনির্বাণ চিন্তিত মুখে তাকালো,
কি হয়েছে? এইভাবে মেসেজ করে বাইরে ডাকলি?
রিয়াটা কি মিথ্যে কথা বলে রে! স্যারের বউ কে বেমালুম মিথ্যে বলে দিলো! ও নাকি হারটা পছন্দ করে দিয়েছে!
রীতিমত উত্তেজিত গলায় বলে উঠলো তিয়াসা, অনির্বাণ একটু থতমত খেলো,
কিসের হার? কি বলছিস কিছুই তো বুঝতে পারছি না!
ধ্যাত! তোকে কিছু বলতে যাওয়াই বৃথা! কাল হাটে যখন স্যারের সঙ্গে দেখা হলো, তখন স্যার গয়নাগুলো কিনছিলেন মনে নেই?
বিরক্ত গলায় বললো তিয়াসা, অনির্বাণ মাথা নাড়লো,
ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে! তুই তো দু একটা সাজেস্টও করেছিলি? তাই না?
এবার খুশি হলো তিয়াসা,
হ্যাঁ, সেটাই তো! অথচ ম্যাম কে কিরকম মিথ্যে বলে দিলো রিয়া! ও নাকি ওগুলো পছন্দ করেছে!
অনির্বাণ হেসে ফেললো,
তাহলে তোর রাগের কারণ কোনটা? রিয়ার মিথ্যে বলা নাকি তোর ক্রেডিট নিয়ে নেওয়া!
তিয়াসা গম্ভীর মুখে চুপ করে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকলো, এবার অনির্বাণ সিরিয়াস হলো,
তুই তো রেগে গেলি! আমি জাস্ট এমনই বলেছিলাম!! আরে, রিয়া যে মিথ্যে বলে এটা কি নতুন কোনো কথা বল? লাস্ট তিন বছরে কতো মিথ্যে বলেছে বলতো! এগুলো নিয়ে এতো ভাবিস না, ও আসলে ম্যাম কে ইমপ্রেস করে স্যারের ক্লোজ হওয়ার চেষ্টা করছে!
তিয়াসা মাথা নাড়লো,
না রে! ম্যাম কিন্তু একটুও খুশি হন নি! কিরকম অবাক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে ছিলেন!
তুই কি করে জানলি?
আমি পাশেই দাঁড়িয়েছিলাম তো, ওই টুকু বেঞ্চে অতো লাগেজ নিয়ে তিনজনে বসা যায়! ম্যাম নিজের ফোনের গ্যালারিতে ছবি দেখছিলেন, রিয়া তখন একটা ফটো দেখিয়ে খুব আস্তে করে কথাটা বলছিলো, যাতে আমি শুনতে না পাই!
অনির্বাণ হাসলো,
সেতো আস্তে বলবেই! না হলে তো, তোকে ক্রেডিট দিতে হবে!
ক্রেডিট চাই না! কিন্তু অহেতুক মিথ্যে কথা শুনলে কিরকম মাথা গরম হয়ে যায় যেনো! আমি ওকে ছাড়বো না, সবার সামনে ওকে জিজ্ঞেস করবো!
রাগের গলায় বললো তিয়াসা, অনির্বাণ অবাক দৃষ্টিতে তাকালো,
তোর হলো কি! ছাড় না এসব! ওকে বলে কোনো লাভ আছে! ওটা ওর স্বভাব হয়ে গেছে! এখন কি আর তুই বদলাতে পারবি?
তিয়াসা চুপ করে গেলো, অনির্বাণ ঠিকই বলেছে! সামান্য এইটুকু কথার জন্যে সিন ক্রিয়েট করে লাভ নেই!
শান্তিনিকেতন থেকে ফেরার পরে প্রায় মাস দুয়েক কেটে গেলো, দিতির ডেলিভারির দিন প্রায় এসে গিয়েছিলো, এমন সময় একদিন কলেজে আসার সময় অরিন্দম গাড়ির ধাক্কায় পা ভাঙলো। সামনেই কলেজের এক্সকারসন ছিলো, অরিন্দমের সঙ্গে যাবার কথা ছিলো, এই অবস্থায় সব কিছু অন্য রকম হলো। প্রিন্সিপাল অর্ক কে ডেকে পাঠালেন,
প্লিজ তুমি একটু সঙ্গে যাও! আমার নিজেরই তোমাকে বলতে খারাপ লাগছে, কিন্তু এই মুহূর্তে আমি অন্য কাউকে পাচ্ছি না।
অর্ক চিন্তায় পড়লো, অদিতি কে একা ফেলে এই অবস্থায় যাওয়া ওর পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয় বলে, ও আগে থেকেই প্রিন্সিপালের সঙ্গে কথা বলে রেখেছিলো। তিনিও রাজি হয়েছিলেন তখন, কিন্তু এই পরিস্থিতি যে আসতে পারে সেটা কেউ ভাবতেই পারে নি। বাধ্য হয়েই অর্ক সম্মতি জানালো,
ঠিক আছে স্যার, আমি কিছু ব্যবস্থা করছি!
বাড়ি ফিরতে ফিরতে মেট্রোতে এটাই শুধু মাথায় ঘুরতে লাগলো, এখন ও কি করে! অদিতি যা অভিমানী, এই সময় ওকে একা রেখে চলে যাওয়ার কথা ও কিভাবে নেবে কে জানে! রাতে খেতে বসে এই প্রসঙ্গ তুললো অর্ক,
আজ প্রিন্সিপাল স্যার ডেকেছিলেন আমাকে, অরিন্দমের অবস্থা তো জানো! আমাকেই হয়ত যেতে হবে এক্সকারসনে, জানি তোমার খুব অসুবিধা হবে, কিন্তু কিছু করার নেই দিতি!
দিতি চুপ করে থাকলো, অর্ক মনে মনে চিন্তিত হচ্ছিলো। বিরাট কিছু অশান্তির আশঙ্কা করছিলো। কিন্তু একটু পরে নিজের থেকেই বললো দিতি,
মা, বাবা কে এখানে আসতে বলি তাহলে? আর তো অন্য কিছু মাথায় আসছে না আমার, যেতে যখন হবেই তখন এদিকটা একটু গুছিয়ে নিতে হবে তো?
অর্ক স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো! দিতি যে এতো সহজে এটা মেনে নেবে ও ভাবতেও পারেনি। ও তাড়াতাড়ি মা কে ফোন করলো, রুমা সমরেশ কে নিয়ে যাবার আগের দিনই চলে আসবেন বলে কথা দিলেন। সমস্যার কিছুটা হলেও সমাধান হলো আপাতত।
ক্রমশ