#Journey episode6
#৬
জাফার বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে থাকে,ওদিকে জেসমিন হাপুসহুপুস করে শ্বাস নিচ্ছে।তার উত্তেজিত হয়ে যাওয়া দেখে জাফার বুঝতে পারছে না কি করবে।ও শুধু অস্থির ভাবে কি যেন খুঁজছে,ওর মনে হচ্ছে অক্সিজেনের অভাবে বুক ফেটে যাবে।হাতড়ে হাতড়ে জেসমিন ইনহেলার বের করে দ্রুত মুখের কাছে আনে,আর বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়।কিছুক্ষণ পর ধীরে ধীরে শান্ত হয় ও,জাফারও স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলে জাফার থমথমে চেহারায় জিজ্ঞাসা করে,
“আপনি কি রুবায়েতকে খুন করেছিলেন?”
জেসমিন এক্টা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে।মুখ বাঁকা করে বলে,
“একটা কথা সবসময় মাথায় রাখবেন,শয়তান কখনো এত সহজে মরে না! রুবায়েতের মত শয়তানও মরেনি।আমি যখন ওর মাথায় আর গলায় মারলাম,তখন ভাগ্যক্রমে সেটা কোন রগে বা শিরায় লাগেনি,মাসেল ছিড়েছে।ওকে মারার পরও ওর জোর কমেনি,তবে হাত আলগা হয়ে গিয়েছিল। আমি ধাক্কা দিয়ে সোফা থেকে ফেলে দিতেই ও আমার পা চেপে ধরে। ওকে লাথি মারতেই আমার জামা ধরে টান দেয়,ওর রক্তের সাথে আমার জামা তাই কিছুটা মাখামাখি হয়ে যায়।তবুও কোনোমতে আমি ওকে ঠেলে ফেলে উঠে দরজার কাছে যাই,সেখানে চাবি নেই।চাবিটা ও পকেটে ঢুকিয়ে রেখেছিল। ওর পকেট থেকে চাবি নিতে গিয়ে দেখি ভালোই রক্ত পড়ছে।একবার ভেবেছিলাম ধরব,পরেই একটা লাথি দিয়ে দৌড়ে পালিয়েছি।
আমাকে রক্ত মাখা কাপড়ে পালাতে দেখে এক ওয়ার্ড বয়ের সন্দেহ হয়।সে রক্তের দাগ খুঁজে খুঁজে আমাদের সেই রুম বের করে,সেটা খোলা পেয়ে রুবায়েতকে দেখে ওকে সবাই মিলে উদ্ধার করে। আমি ততক্ষণে পালিয়ে যাই।পালিয়ে কোনোমতে বাসায় আসি,তখন দুপুর প্রায় শেষের দিকে।ভাগ্য ভাল যে বাসায় কেউ ছিল না,তাই বাসায় নিজের ঘরে ঢুকেই কাপড় বদলে গোসলে ঢুকে যাই। আমি তখনও বুঝতে পারছি না,কি হল আমার সাথে!আমি…আমার সব স্বপ্ন এভাবে ভেঙে যাবে,গুড়িয়ে যাবে,এটা আমার কল্পনাতীত ছিল!শাওয়ার ছেড়ে কাঁদতে কাঁদতে আমি বসে পড়ি।
খুব বাজে অবস্থা ছিল আমার।এত বড় শক তখনও আমি হজম করতে পারছিলাম না,মনে হচ্ছিল কোন দুঃস্বপ্ন থেকে উঠে এসেছি,রুবায়েত এরকম করতেই পারে না!কাঁদতে কাঁদতে এক সময় যখন হুঁশ হল, তখন মনে হয়, ও আবার মরে যায় নি তো? হোটেলের মানুষজন তো আমাকে দেখেছে,সিসিটিভির ফুটেজ থেকে ছবিও বের করতে পারে!হাত পা ঘামছিল খুব,কি করব,কাকে বলব,কার কাছে আশ্রয় চাইব,কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।এভাবেই কয়েক ঘন্টা পার হয়,আর আমিও স্ট্রেস নিতে না পেরে মাথা ব্যথায় অস্থির হয়ে আস্তে করে বিছানার একপাশে ঘুমিয়ে পড়ি।
যখন ঘুম ভাঙে রাতের আট টার দিকে,তখন দেখি আমার মাথার কাছে পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে,হাতে হাত কড়া।চোখ খুলেই পুলিশ দেখে প্রথমে কিছুই বুঝিনি,কিন্তু কয়েক সেকেন্ড পর বুঝলাম যে,আমি ধরা পড়ে গেছি।তারা বেশি কিছু বলেনি,শুধু বলেছে,ওদের সাথে আমাকে নাকি যেতে হবে।আমিও ঠান্ডা মাথায় বলেছিলাম,আমার কাপড় চুল ঠিক করার সময় পাওয়া যাবে কিনা,ওরা সেটাও দেয় নি আমাকে।ঘরের কাপড়েই আমাকে ওরা নিয়ে যায় বাসা থেকে।আমি ঠিক বুঝতে পারিনি,ওরা কিভাবে এত কিছু জানল?মাথায় আমার তখন অনেক প্রশ্ন,আমি শুধুই চুপচাপ ওদের সাথে মাথা নিচু করে সিঁড়ি দিয়ে নামছিলাম আর ভাবছিলাম।
গ্রাউন্ড ফ্লোরে নেমে বেরোনোর সময় শেষ যা দেখেছিলাম,আমি তা কখনো ভাবিনি,এমনকি নিজের চোখকে বিশ্বাসও করতে পারিনি!”
জাফার ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই জিজ্ঞাসা করে,
“কি দেখেছিলেন!”
জেসমিন মাথা নিচু করে হাতের তালুর দিকে তাকিয়ে আছে,ওর মুখের রঙ পুরোপুরি উড়ে গেছে,ফ্যাকাসে একটা ভাব ওর চেহারায়।বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“দেখি আমার মা দাঁড়িয়ে ধুমপান করছে,আর পুলিশ অফিসার মায়ের সাথে হাত মিলিয়ে বলছে,Thanks for your cooperation!”
এ পর্যায়ে জাফার খুব শকড হয়,এটাও সম্ভব,তাও নিজের মায়ের দ্বারা???
“আপনার মা…মানে…উনিই কি পুলিশ ডেকেছেন?!”
“হুম”
“কিন্তু কেন!!মানে উনার কি দরকার!!”
“বলছি।রুবায়েতের পারিবারিক ও আর্থিক ব্যাকগ্রাউন্ড শুনে আপনার কি কিছু মনে হয় নি?”
“কি মনে হবে?আপনারা বড়লোক,ওরাও বড়লোক। বড়লোকদের সাথে তো গরীবদের মিলবে না”
“ভুল বললেন।ওরা আমাদের চাইতেও বেশি বড়লোক,ওদের এত সম্পদ আর ক্ষমতা, তার কাছে আমরা তুচ্ছ।তার উপর বাবার যাও ছিল,মা সব উড়িয়ে উড়িয়ে নষ্ট করেছে।আমার মা খুব লোভী,তাই সত্যিকার অর্থে বলতে গেলে মা আমাকে ওদের কাছে বিক্রি করেছে”
“What!!!”
“হুম।মা ওদের কাছ থেকে চার কোটি টাকা নিয়েছে,বিনিময়ে তার মেয়েকে দিয়ে দিবে এ কথা বলেছে।ঘুরিয়ে পেচিয়ে না বলে এটাকে সরাসরি Business deal বলা যায়,আর আমি ছিলাম প্রোডাক্ট, হা হা হা!!”
জেসমিনের হাসিতে অনেক কিছু মিশে ছিল, রাগ, দুঃখ, অসহায়ত্ব,ঘৃণা, চাপা অভিমান।জাফারের খুব খারাপ লাগে।কি মিষ্টি একটা মেয়ে,অথচ কি নিষ্ঠুর তার পেছনের গল্পটা!কে বলবে এই মেয়ের ভেতরে এতকিছু লুকানো?কে জানে,আরো কত কি হয়েছে ওর সাথে!
জেসমিন আবার বলতে শুরু করে।
“আমার মাথা সেদিন পুরো এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল।একে তো রুবায়েত, আবার মা,দুজনের বেঈমানী হজম করতে গিয়ে আমার স্বাভাবিক চিন্তাভাবনা সব উলটে পালটে গিয়েছিল,আমি বুঝতেই পারছিলাম না আসলে কি হচ্ছে!যখন আমি পুলিশের ভ্যানে বসে আছি,তখনও আমি বুঝতে পারছিলাম না এটা সত্যিকারের পৃথিবী কিনা,নাকি আমি স্বপ্ন দেখছি।পুলিশ আমাকে নিয়ে রমনা থানায় আটকে রাখে।সেখানে আরো কিছু নারী আসামীর সাথে একটা সেলে আটকে ছিলাম।কি অসহ্য বাজে ছিল প্রতিটা মুহূর্ত তা বলে বোঝান যাবে না!আমি নরক দেখেছিলাম ঐ জেলে,পৃথিবীর নরক! ওখানকার মেয়ে সবগুলো জঘন্য রকমের চরিত্রের ছিল।এদের কাছে কেউ নিরাপদ না।আমাকে কতভাবে যে অত্যচার করেছে!উফ!”
“কতদিন ছিলেন জেলে?”
“প্রায় দুই সপ্তাহ”
“কি!এর মাঝে কেউ আসে নি??”
জেসমিন হাত উল্টায়,মুখ ভেংচি দেয়,
“হাহ!আমাকে নিতে আসবে জেল থেকে?কে?মা ছিল,কিন্তু সে নিজেই তো সবচেয়ে খারাপ”
“শিট,এরপর?কিভাবে বেরুলেন?”
“দুসপ্তাহের মত যখন পেরিয়ে গেছে,তখন একদিন এস আই আমাকে ডেকে বললেন,আমার কি কেউ নেই নাকি,সেই যে attempt to murder case দিল,এরপর আর কেউ বিচার চাইতেও আসে না,কেউ আসামীকে ছুটাতেও আসে না।আমি তখন বললাম,আমাকে একটা কল দিতে দিন,আমি শুধু একজনকে কল দিব।”
“কাকে কল দিয়েছিলেন?ভাইয়া?”
“হুম।ভাইয়াকে বলেছিলাম,আমাকে যেন নিয়ে যায়,আমাকে মা জেলে আটকে দিয়েছে।ভাইয়া খুব অবাক হয়নি,ও নাকি জানত মা আমাকে নিয়ে খারাপ কিছু করবে।অভিমান হচ্ছিল,কিন্তু ভাইয়াকে কিছু বলিনি,পুলিশের সামনে অল্প কথা বলা যাবে।ওকে তাই বললাম,আমি ওকে দুলাখ টাকা দিব,ও যেন এসে আমাকে নিয়ে যায়,তবে একটু সময় দিতে হবে এই যা।ভাইয়া খুব অবাক হয়েছিল,তবে রাজী হয়েছে।পরদিন ভাইয়া আমাকে ছুটিয়ে নিয়ে যায়।
আমার অবস্থা খুব খারাপ ছিল।আমাকে দিয়ে কাজ করানো,আমাকে যখন তখন মারধর করা,আমার খাবার নিয়ে যাওয়া,ঘুমাতে না দেয়া,এগুলো ছিল এই দুই সপ্তাহের প্রায় প্রতিদিনের রুটিন।ভাইয়া তাই আমাকে নিজের কাছে নিয়ে রাখে।সেখানে প্রায় এক মাস ছিলাম।এক মাস পর বাসায় যাই।গিয়ে দেখি মা…”
জেসমিন চুপ করে যায়।জাফার জিজ্ঞেস করতে গিয়েও থেমে যায়।জেসমিন নিজেই আবার শুরু করে,
“মূলত মা আমাকে ওদের ছেলের কাছে দিবে,তাই আমাকে একরকম রুবায়েতের দিকে ঠেলতে থাকে।ওর নামে প্রশংসা করা,দেখা করার জন্যে ফোর্স করা,এবং ওর বিরুদ্ধে আমি পদক্ষেপ নেয়ার পর পুলিশকে আমার ব্যাপারে তথ্য দেয়া,সব করে মা।মা আমাকে,বা ভাইয়াকে কখনই ভালোবাসেনি,তাই এসব করেছিল।মায়ের ইয়াবা আর জুয়ার নেশা ছিল,যা আমি আগে জানতাম না।এসবই তাকে ঠেলে দিয়েছিল চূড়ান্ত ধ্বংসের দিকে।
রুবায়েত সেদিন মরেনি,হোটেলের মানুষেরা মিলে ওকে হাসপাতালে নিয়ে যায়।ওর মানিব্যাগের কাগজপত্র দেখে ওর অফিস,বাসায় খবর যায়।ততক্ষণে রুবায়েতের জ্ঞানও ফেরে,সে আমার কথা বলে দেয়।উনারা তখন থানায় আমার বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেন।কিন্তু পরে মনে হয়েছে,আমাকে শায়েস্তা করা শেষ,তাই আর আগায়নি।ওদিক মাকে অনেক প্রেশার দেয় টাকার জন্যে,কারণ আমাকে তো পায়নি!মা টাকা দিতে পারেনি।টাকা নিয়ে নেশা,ক্লাব,বিলাসিতা এসবের পিছনে করতে করতে কখন আমাদের কোম্পানি প্রায় দেউলিয়া হয়ে গেছে,সেটা নিজেও বুঝেনি। আমি যেদিন বাসায় যাই,সেদিন মায়ের হাতের রগ কাটা ছিল,প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছিল,সে লিভিং রুমের একপাশে পড়েছিল।”
“Oh my God”
“আমি অবাক হইনি।কি মনে হয়, এরকম কিছুই কি হওয়ার কথা ছিল না?”
“আপনি তারপর কি করলেন?”
চলবে…
লেখনীতে, #AbiarMaria