দুজনা পর্ব-৮

0
230

#দুজনা
#রোকসানা_আক্তার
পর্ব-৮

ইদানীং আদিলের ভীষণ অন্যমনস্ক থাকে।অফিস থেকে ফিরলে তেমন কথা বলে না।জিজ্ঞেস করলে অনেকগুলো কথার একটি বা দু’টি উত্তর পায়।আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে সে আমাকে নিয়ে খুব চিন্তিত।কারণ,ডাক্তার বলেছে মায়ের পুষ্টিজনিত অভাবের কারণে বাচ্চা গর্ভপাতে সমস্যা হতে পারে।তাই সিজার করা লাগবে।কিন্তু সিজারের কথা মুখে তুললেই তো হাজার হাজার টাকা।আমাদের মতন নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের পক্ষে ওতগুলো জোগাড় করা খুবই কঠিন ব্যাপার।আর সম্ভবও না।সংসারটাই ঠিক মতন চালাতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে,সেখানে সিজারের কথা ভাবাও স্বপ্নের মতন।আমি রোজ রাতে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ি আর মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করি যেন বাচ্চাটা আমার নর্মালে হয়।

———————————————————
সকাল থেকে শরীরটা ভীষণ খারাপ লাগছে।বিছানায় শুয়ে থাকি,আবার শুয়ে থাকার মাখে কাতরে উঠি।আমার নিজেরই কেমন লাগছে তা আমি নিজেও জানি না।পেঁটের মতন বারবার ঢিপঢিপ ব্যথা করছে।ব্যথাটা তীব্র যেটা আমি সহ্য করতে পারছি না।তাই মাঝে মাঝে একটু কাতরে উঠি।মা পাশের রুম থেকে আমার কাতরানের কিছু ছিঁটেফুঁটে শব্দ হয়তো শুনতে পান।জোর গলায় বলেন,

“কথা বলতেছিস, প্রিয়া?”

চুপ করে থাকি।মা আবারো,
“কথা বলতেছিস না কেনো মা?”

আমার খুব ইচ্ছে হয় আদিলকে একটিবার কল করও।বলি,
“আমার না আর ভালো লাগছে না!”

কিন্তু আদিলতো এখন কাজে।ওকে কল করলে ডিস্টার্ব হবে।কলে বস কথা বলতে দেখলে বেতন কম যদি দেয়?কিন্তু ভাবনাটা বেশিক্ষণ চেপে রাখতে পারলাম না।আসলেই আমার পেঁটে প্রচন্ড ব্যথা করতেছে যা আমি সহ্য করতে পারছি না।আমি পেটে হাত রেখে খুব জোর গলায় কাতরাতে থাকি এবার।মা জবুথবু শরীর নিয়ে খুব কষ্টে হেটে আসেন আমার রুমে।যদিও কিছুটা চোখে আবছা আবছা দেখেন,তবে মেয়ের কষ্টগুলে সহজেই যেন ধরে ফেলেন।মাথাটা উনার কোলে টেনে,

“আদিলকে কল দে!তাড়াতাড়ি কল দে!”

মায়ের যেন কান্না পেয়ে যাওয়া অবস্থা!আমি পাশ থেকে ফোনটা নিই।আদিলকে সত্যি সত্যি এবার কল দিই।বিশ মিনিটের মাথায় আদিল বাসায় এসে হাজির হয়।আমাকে কোলে তুলে নেয়।আর মাকে বলে,

“মা আপনি বাসায় থাকুন!আমি প্রিয়াকে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছি!”

হাসপাতালে আসার তিনঘণ্টা পার হয়ে যায় আমার এখনো সিজার করা হচ্ছে না!আমি কাচের দরজা দিই আদিলকে দেখি সে যেন কাদছে।আর বারবার কারো দিকে হাতজোড়া মিনতি করছে।বুঝতে পেরেছি ডাক্তারকে।হয়তো বলছে,বাকি টাকাগুলো আমি পরে দিয়ে দিব।দয়া করে আমার বউয়ের সিজারটা করে দিন!কিন্তু ডাক্তাররা শুনে না।আমি বুঝতে পারছি আমার হয়তো এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে বেশিদিন বাঁচা যাবে না।আসলে মরে গেলেই শান্তি!বাঁচলে স্বার্থপর,নিষ্ঠুর,খারাপ মানুষগুলোকে প্রতিনিয়ত দেখতে হবে।ওপারে চলে গেলে কাউকে দেখবো না।খুব ভালো থাকবো।খুব।ভাবতে ভাবতে কখন যে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি আর পরে কিছু মনে পরে না।হুঁশ আসতে দেখি আদিলের কোলে ছোট্ট একটা শিশু।সে খুব কাঁদছে।আদিল তার কান্না থামাতে সারা রুমে পায়চারি করছে,
“ওহ বাবু কাঁদে না।শোনা বাবা আমার আম্মু ঘুম থেকে জাগলে খাবার দেবে।একটু শান্ত থাকো,বাবা আমার?উম্মাহ!”

আমার ডেলিভারি হলো।সিজার নাকি নর্মাল?ভাবতেই উঠে বসার চেষ্টা করি প্রস্রাবের জায়গায় প্রচন্ড ব্যথা অনুভূত হয়।বসতে পারি নি।শুয়ে যাই আবার।পেটে হাত বুলাই।নাহ সিজার হয়নি।তাহলে নর্মালে হয়েছে।তবে কিভাবে?আদিল এতক্ষণে আমাকে দেখেছে।হেসে বলে,

“আমাদের ছেলে বাবু হয়েছে, প্রিয়া।কত্ত খুশি আমি।”

বলে হাসে আদিল।খুব হাসে।তারপর বলে,
“আচ্ছা? আগে ওকে দুধ খাওয়াওতো?কিচ্ছু খায়নি ও।ডাক্তার বলেছে খুব অপুষ্ট ও।ওকে প্রচুর শুধু মায়ের দুধ খাওয়াতে হবে।আর তোমাকে পুষ্টিকর খাবার খাওয়াতে হবে।”

বলে চিকন-পাতলা,দেড় কেজিও হবে কিনা জানি না।বাবুকে আমার কোলে তুলে দিয়ে বেরিয়ে যায়।আমি বাবুর দিকে তাকিয়ে থাকি কিছুক্ষণ শান্ত চোখে।ভেতরটা আপনাতেই আনন্দে ভরে যায়।কপালে দুটো আলতো চুমু বসিয়ে দিই।আমার বাচ্চা গর্ভপাতের ব্যাপারটা বলি আদিলের কাছ থেকে শুনলাম।আমি যখন জ্ঞান হারিয়ে ফেলি তখন আমার বাবু মোটামুটি একটা স্টেজে চলে আসে আর বাবুকে বের করা ইজি হয়ে যায় যেখানে সিজারের প্রয়োজন হয়নি।নার্স এটা খেয়াল করেছিল তখন।সেই আমাকে রক্ষা করে।আর সিজারের ওতগুলো টাকা থেকে বাঁচায়।হাসপাতাল থেকে আসার সময় আদিল তাকে কিছু টাকা হাতে দিতে চায়।কিন্তু সে নেয়নি।বলে আপনারা সুস্থ থাকুন।আবার কোনো একদিন দেখা হলে ট্রিট দিয়েন।

—————————————————–
আদিল এখন অফিস থেকে ফিরলেই ভীষণ খুশি খুশি থাকে।এতটা খুশি আমি তাকে আগে কখনো দেখি নি।কারণ জিজ্ঞেস করে ফেলি।সে হাসতে হাসতে বলে,

“জানো?আমাদের কোম্পানিটি দিনেক দিন ভালো একটা জায়গা করে নিচ্ছে।খুব প্রফিট আর্ন হচ্ছে।লাস্ট বার অন্য একটা কোম্পানির সাথে প্রোডাক্ট ম্যানুফ্যাকচারিং এর ডিল হলো না?সেখানে কেম্পানিটি ২ কোটি টাকা আর্ন করেছে।আর যার মধ্যে সবার থেকে সবথেকে বেশি অবদান ছিল আমার।বস তো সেই খুশি।বলেছে আমাকে পরের মাসেই ম্যানেজার বানিয়ে দিবে!”

আদিলের কথায় খুশিতে যেন আমার চোখে পানি চলে আসে।

———————————————————সেদিন থেকে আমাদের আর পেছনে তাকাতে হয়নি।আদিল ম্যানেজার!খুব সম্মান অফিসে আজকাল ওর।ওর বস ওকে একটা গাড়ি গ্রিফট করেছে।যেটা দিয়ে ও সহজে যাতায়াত করতে পারে।আমরাও কোথাও ঘুরতে গেলে,বা শপিং করতে গেলে গাড়িটা ব্যবহার করি।আমাদের বাসস্থানেরও পরিবর্তন হয়েছে।আমরা এখন খুব ভালো মানের টাইলসের ফ্ল্যাটে থাকি।বড় বড় তিনটা রুম।একটা ডাইনিং,বাথরুম।আর সবখানে আসবাবে ভরপুর।আমাদের নিজেদেরও ফ্ল্যাট হয়ে যাবে।আদিলের ব্যাংকে অনেক টাকাই জমা হয়েছে।সে ভাবছে আর দুই মাস পরেই একটা ফ্ল্যাট কিনে নিবে।আর তারসাথে আরেকটা খুশির সংবাদ, আমার মাও সুস্থ্য হয়ে গিয়েছেন আগের থেকে।ডাক্তার দেখিয়েছিলাম।ডাক্তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রেসক্রিপশন দিয়েছেন।নিয়মমতো সেভাবেই চলছে মা।এ সবকিছু নিয়ে মহান আল্লাহর কাছে আলহামদুলিল্লাহ!

——————————————————–এভাবে দেখতে দেখতে আরো দুটা বছর কখন যে কেঁটে যায় টেরও পাইনি।সংসার,সন্তান,মা,স্বামী সবকিছুতে মনব্যস্ত হয়ে যাই।সময়ের কথা একদন্ডও মাথায় আসেনি।একদিন দুপুরে আদনানকে(আমার ছেলে)ঘুম পাড়িয়ে নিউজ পেপার পড়তে বসলাম।আর হ্যাঁ,আরেকটা কথা,আমার কিন্তু সংবাদপত্র পড়ার অভ্যেস আছে।আদিলের সাথে বিয়ের আগে,যখন স্কুল-কলেজে পড়তাম তখন প্রচুর সংবাদপত্র কিনে কিনে পড়তাম।দেশের প্রতিদিনকার খবর প্রতিদিন জানতে আমার বেশ আগ্রহ।আর বাসায় তো তখন টিভি ছিলো না।তাই সংবাদপত্রই ছিল নিউজ জানার একমাত্র মাধ্যম।আজ অনেকদিন পর পড়তে বসলাম।কিন্তু সংবাদপত্রের প্রথম পাতা থেকে দ্বিতীয় পাতা উল্টাতেই আমার চোখজোড়া ধাঁধিয়ে উঠে।চরম রকম অবাকও হয়ে যাই।সংবাদপত্রে লিখা ছিল,

“আবদুল হামিদ চামড়া কারখানাটি গত সপ্তাহে পুরোপুরিভাবে দেউলিয়া হয়ে যায় এবং লাখ লাখ টাকার মতন ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন কোম্পানির মালিক,খুলনা!”

“আবদুল হামিদ” আমার শ্বশুরের নাম।শ্বশুরের নামই কারখানাটি ছিল,যেটা এখন আমার ভাসুরের।কিন্তু দেউলিয়া হয়ে গেলো!?তারপর বিস্তারিত পড়ি!বিস্তারিত পড়ে যতটুকু বুঝলাম উনি নকল প্রোডাক্টস উৎপাদন করেছেন,যার কারণে ব্যবসায়টি অনুকূলে চলে আসে!আর এখনো প্রতিকূলে আনারতো উপায়ও নাই।অনেকক্ষণ যাবৎ চুপ করে থাকি আপনাতে।সত্যি কথা বলতে আমি ভাবতেও পারি নি এত নামকরা কোম্পানি ছিল,আর তা এত তাড়াতাড়ি দেউলিয়া হয়ে যাবে!

রাতে আদিল বাসায় ফিরতে আদিলকে বিষয়টি তৎক্ষনাৎ বলি!আদিল গুরুত্ব দিলো না।নিজ মনে গাঁ থেকে শার্ট খুলতেছে।আর শিষ বাজাচ্ছে।

“আহা শুনুন না?ভাসুরের কারখানাটা যে দেউলিয়া হয়ে গেলো!এটা কিভাবে হলো ভাবা যায়!কি অবস্থায় জানি আছেন তারা কে জানে!ইস!!”

সাথে সাথে পেছন ঘুরে আদিল আমাকে বলে উঠে,
“বিজনেস দেউলিয়া হয়েছে ওদের।আমাদের না।অন্যদের নিয়ে এত ভাবতে হবে না তোমাকে।খাবার বাড়তে যাও,আমি ভাত খাবো। প্রচুর খিদে পেয়েছে।”

আমি স্থির চোখে তাকিয়ে থাকলাম আদিলের দিকে।

চলবে…
(গল্পটা শেষের পর্যায়ে।বেশি বড় করবো না।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here