#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা পর্ব ১৭
-Farhina Jannat
১৭.
কোন সুইসাইড নোট বা এমন কোন কিছু পাওয়া যায়নি ফারহানের ঘর থেকে, যাতে জানা যায় ওর এমন কাজের কারণ। শুধু ১২ ঘন্টা আগে ফেসবুকে দেয়া একটা স্ট্যাটাস এমন ছিল, “ভালবাসা আর অভিনয়ের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারেনা, এমন বোকা মানুষের কি বেঁচে থাকার অধিকার আছে?” এটা জানার পর দেয়ালে মাথা ঠুকেছে রাইয়্যান, কেন ও এতসময় ধরে ফেসবুকে ঢুকেনি, অন্তত স্ট্যাটাসটা দেখলে কিছু একটা আঁচ করতে পারতো!
কিন্তু এতেই বুঝতে পারে রাইয়্যান, এর পেছনে একটা মেয়ে দায়ী, আর মেয়েটাকে খুঁজে বের করতে হবে। খোঁজার সূত্র হিসেবে প্রথমেই মনে আসে ফেসবুকের কথা।, কিন্তু আইডি ডিএক্টিভেট করে দিয়েছে ফারহান।
তখন ওর এক এক্সপার্ট বন্ধুর সাহায্যে ফারহানের আইডি হ্যাক করে রাইয়্যান। আর্কাইভড মেসেজ এর মধ্যে পায় “শুভ্র অপরাজিতা” নামক একটা আইডির সাথে ফারহানের কনভারসেশন। শেষের কয়েকটা মেসেজ থেকেই বোঝা যায়, এটাই সেই মেয়ে। মেয়েটার লাস্ট মেসেজ ছিল,
“আমাকে তুমি ভুলে যাও, ফারহান। আমি তোমার যোগ্য না। আমি তোমার সাথে কখনওই সিরিয়াস ছিলামনা। ফেসবুকে প্রেম করতে কেমন লাগে, সেটা জানার কিউরিওসিটি থেকে আমি তোমার প্রপোজাল এক্সেপ্ট করে নিয়েছিলাম। কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি, তুমি এতটা সিরিয়াস হয়ে যাবা। আমি তাই সরে যাচ্ছি। প্লিজ আমাকে ভুলে যাও, পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও। আই এম রিয়েলি সরি।“
এরপর আর কোন মেসেজ পাঠায়নি ফারহান, মেয়েটা সম্ভবত ওকে ব্লক করে দিয়েছিল। এখনো নিচে উঠে আছে, “You can’t reply to this conversation”
রাগে মাথা গরম হয়ে যায় রাইয়্যানের। সাথে সাথে নিজের ফেসবুক থেকে মেয়েটাকে সার্চ দেয়, কিন্তু বুঝতে পারেনা কোনটা, কারণ এই নামের অনেক আইডি আছে ফেসবুকে।
তখন ওই মেয়েটার সাথে ফুল কনভারসেশন প্রিন্ট আউট করে রাইয়্যান। এরপর অপরিসীম ধৈর্যের সাথে পুরোটা পড়ে মেয়েটার পরিচয় উদ্ধার করে ও।
মেয়েটার নাম সিদ্রাতুল মুনতাহা, দারুন নাজাত মহিলা মাদ্রাসায় ফাযিল প্রথম বর্ষের ছাত্রী। ফোন নাম্বারও পায়, কিন্তু বন্ধ। ঠিকানা না পেলেও ফোন নাম্বার দিয়ে ঠিকানা খুঁজে বের করতে বেশি সময় লাগেনা ওর। আরো খোঁজখবর নেয় রাইয়্যান, মেয়েটা হাফেযা, আশেপাশের কেউ কোনদিন মুখ তো দূরের কথা হাতটাও দেখেনি ওর। রাগে আগুন হয়ে যায় রাইয়্যান। ছি! মুখ দিয়ে ঘৃণার সাথে বেরিয়ে আসে শব্দটা।
মেয়েটা যদি এখনকার দিনের মডার্ন মেয়েগুলোর মত হত, বেপর্দা হয়ে চলাফেরা করত, রাতদিন ছেলেবন্ধুদের সাথে আড্ডা মারত, কাপড় চেঞ্জ করার মত ছেলে চেঞ্জ করত, তাহলেও হয়ত মেনে নেয়া যেত। ঠিক আছে, মেয়েটা খারাপ, শিক্ষার অভাব আছে বলে ধরে নিতাম, ভাবল রাইয়্যান। কিন্তু যে মেয়ে উপরে খুব ভাল মেয়ে সেজে থাকে সবার সামনে, আর গোপনে গোপনে ফেসবুকে প্রেমের অভিনয় করে, প্রেমিকের সাথে স্টাইলিশ ছবি আদানপ্রদান করে, তার উপর জাস্ট ঘেন্না ধরে গেল রাইয়্যানের। হ্যাঁ, অনেকগুলো ছবি পেয়েছে রাইয়্যান, সেগুলো হাই কোয়ালিটির প্রিন্ট করিয়েছে ও, যাতে চিনতে কোন অসুবিধা না হয়।
“সিদ্রাতুল মুনতাহা, ইউ হ্যাভ টু সাফার এন্ড আই উইল মেক শিওর দ্যাট ইউ সাফার টু ডেথ” সবকিছু জানার পর চিবিয়ে চিবিয়ে বলল রাইয়্যান।
তারপর কয়েকদিন ধরে প্ল্যান করেছে, কিভাবে কি করবে ও। তারপর একদিন সকালে ভাইয়ের কবরের কাছে এসে জানিয়েছে নিজের প্রতিজ্ঞার কথা। তার পরদিন সকালেই কিডন্যাপড হয় সিদ্রা।
*****
ফিরে আসছি বর্তমানেঃ
ঝর্ণা পাড়ের ওই ঘটনার পর কেটে গেছে কয়েকটা দিন। সেদিনের পর পুরো নিশ্চুপ হয়ে গেছে সিদ্রা। শুধু একবার খালাকে জিজ্ঞেস করেছিল, “ওইটা সত্যি উনার ভাইয়ের কবর?” মাথা ঝাঁকিয়েছিল খালা। আর ইশারায় বলেছিল, ও আত্মহত্যা করেছে।
আর একটা কথাও বলেনি সিদ্রা, বলে লাভ কি। ভাইয়ের আত্মহত্যার জন্য উনি আমাকে দায়ী করছেন, অথচ আমি ছেলেটার নাম পর্যন্ত জানিনা, ভাবছিল সিদ্রা। কিন্তু আমি এর মধ্যে কিভাবে ফেঁসে গেলাম, সেটা তো কিছুতেই মাথায় ঢুকছেনা। আর মাথায় ঢুকিয়ে কাজ নেই, এই লোক কিছুতেই বুঝবেনা, পালানোই এখন একমাত্র অপশন, ভেবেছে ও। এরপর থেকে সারাদিন সারারাত পালানোর পরিকল্পনা করে চলেছে সিদ্রা।
খালা ওকে কয়েকবার কাজ করার কথা বলেছে, লোকটা নাকি করাতে বলেছে ওকে দিয়ে, কানে তুলেনি সিদ্রা। বুঝে গেছে ও, খালা ওকে জোর করতে পারবেনা, তাই শুধু নিজের প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হত ও।
এত শান্তিতে দিনগুলো কাটানোর পেছনে ছিল লোকটার অনুপস্থিতি। লোকটা মনে হয় দূরে কোথাও থাকে, ভেবেছে সিদ্রা। কয়েকদিনের জন্য এখানে আসে, আবার কয়েকদিনের জন্য যায়।
আর খালাও যে মাঝমাঝে ঘন্টাখানেকের জন্য কোথাও একটা যায়, সেটা সিদ্রা বুঝতে পেরেছে। কারণ সেসময় অনেকবার ডেকেও খালার সাড়া পাওয়া যায়না। কয়েকদিন একই ঘটনা ঘটার পর নিশ্চিত হয়েছে ও। চাল-ডাল, তরিতরকারি আর অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস ওই সময় নিয়ে আসে বলে মনে হয়েছে ওর। তার মানে আশেপাশে নিশ্চয় লোকালয় আছে কিন্তু সেটা কোনদিকে সেটা সিদ্রা বুঝতে পারেনি। সেটা জানলে ওর পালানোর পরিকল্পনাটা একটু সলিড হত। ওই লোকটা এবার ফিরে আসার আগেই পালাব আমি, ঠিক করেছে সিদ্রা।
খালা এখন মাঝে মাঝে এসে ওর কাছে বসে থাকে। সুখের বিষয়, এখন আর আগের মত পাথর মুখ করে না থেকে কথা বলে ওর সাথে, অবশ্যই ইশারায়। আর অবাক ব্যাপার হল, ও এখন খালার কথা অনেকটাই বুঝতে পারে। খালাকে নামাজ পড়া শিখিয়েছে সিদ্রা। শেখানো বলতে কোন ওয়াক্তে কত রাকাত আর কিভাবে নামাজের ভেতর উঠাবসা-অঙ্গভঙ্গি করতে হয় এটুকুই। ওর ক্ষুদ্র জ্ঞানে মনে হয়েছে, যেহেতু খালা বলতে পারেনা, সেহেতু তার নামাজ এগুলো দিয়েই হয়ে যাওয়ার কথা। এখন মাঝে মাঝে আল্লাহ্ বলানোর চেষ্টা করে খালাকে দিয়ে।
সেদিন একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। ভোররাতে উঠে প্রথমবারের মত দরজা খোলা পেল সিদ্রা। আমি প্রতিদিন ডাকি দেখে মনে হয় আজ খালা ইচ্ছে করে খুলে রেখেছে। পা টিপে টিপে খালার ঘরে উঁকি দিল সিদ্রা। কাঁথামুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে খালা। আস্তে করে দরজাটা টেনে বাইরে থেকে আটকে দিল সিদ্রা। বেশ, আবার যখন সুযোগ পেয়েছি, তখন আজ আর ভুল করবনা। পালাব আমি, একটু শুধু আলো ফুটুক।
খালা অবশ্য ওকে বেশ কয়েকবার বলেছে, এখান থেকে পালানো অসম্ভব। যেদিক দিয়েই পালাতে যাক, স্রেফ মারা পড়বে। মারা যাওয়ার কথাটা গলায় পোঁচ দেয়ার ভঙ্গিতে দেখিয়েছে খালা, যেন কেউ ওকে খুন করবে। কিন্তু তাতে দমেনি সিদ্রা, আমি তো পালাবই, তাতে মারা পড়লে পড়ব।
কোনদিক ধরে পালাবে, সেটা তো ঠিক করাই আছে। ঝর্ণার দিক পাহাড়ে ঘেরা, ওদিকে গিয়ে লাভ নেই, আর লোকালয় যেদিকেই হোক, সেদিন গাছে বাঁধার জন্য যেদিকে নিয়ে গেছিলো, সেদিকে হওয়ার চান্স কম। তাহলে বাকি দুইদিকের যেকোন একদিকে যেতে হবে ওকে। রান্নার জায়গায় পানির বোতল দেখেছিল দুইটা। বোতল দুইটাতে ঝটপট পানি ভরে নিল। তারপর জীবনের সবথেকে তাড়াতাড়ি ফযরের নামাজ আদায় করল সিদ্রা। চারপাশ আবছা হয়ে উঠছে, আল্লাহর নাম নিয়ে রওনা দিল। খালা জেগে উঠার আগে যতদূর যাওয়া যায়, ততই ভাল।
অন্ধকার রাস্তায় বারবার হোঁচট খেতে খেতে এগোচ্ছে সিদ্রা। বোতল দুটোকে ওই ছেঁড়া শাড়িটার মধ্যে পুটলির মত বেঁধে ঝুলিয়ে নিয়েছে, তাতে একটু সুবিধা হচ্ছে। আর বুদ্ধি করে খালার স্পঞ্জের স্যান্ডেলগুলো পরে এসেছে, এতে করে পায়ে কাঁটা বিধে যাবার ভয় নেই। আস্তে আস্তে আলো বাড়ছে, দৃষ্টি পরিস্কার হতেই গতি বাড়াল সিদ্রা। কিন্তু জঙ্গলের মধ্যে অনভ্যস্ত পায়ে আর কত দ্রুত হাঁটা সম্ভব।
কতক্ষণ ধরে হাঁটছে জানেনা সিদ্রা। এর মধ্যে এক বোতল পানি শেষ করে ফেলেছে। প্রচণ্ড ক্ষুধা লেগেছে, পা দুটো আর চলছেনা। উত্তেজনার চোটে খাবারের কথা মনে পড়েনি ওর। আর পড়লেইবা, খাবার দাবার সব খালার ঘরে থাকে, নিতে গেলে স্রেফ ধরা পড়ে যেত। আর পারলনা সিদ্রা, বসে পড়ল একটা গাছের নিচে। আমি নিশ্চয় ভুল পথে এসেছি, ভাবল সিদ্রা। খালার যাওয়া আসা করতে তো এত সময় লাগেনা। কটা বাজে এখন! সূর্যের তাপ আর আলো থেকে মনে হচ্ছে দশটা এগারোটা মত বাজার কথা। এতক্ষণ ধরে হাঁটছি, কোন ফলমূলের গাছও চোখে পড়লনা, এ কেমন বন!
একটু আরাম করে, এক ঢোক পানি খেয়ে আবার হাঁটা শুরু করল সিদ্রা। লোকালয় কখন পাবো, ঠিক নেই, পানিটুকু বাঁচিয়ে রাখতে হবে। কিন্তু ক্ষুধায় আর ক্লান্তিতে ওর হাঁটার গতি যে অনেক কমে গেছে, বুঝতে পারছেনা সিদ্রা। পা টেনে টেনে শরীরটা কোনরকমে এগোচ্ছে ও। অপেক্ষা, কখন পেরোবে বনের সীমানা, কখন দেখবে লোকালয়!
অবশেষে এমন একটা জায়গায় এসে পৌঁছল সিদ্রা, শরীরের সমস্ত শক্তি হারিয়ে ধপ করে পড়ে গেল সিদ্রা। দুচোখ ফেটে পানি বেরিয়ে আসল ওর।